ছবি: রাজর্ষি মুখোপাধ্যায়
তখন হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা শেষ হত পুজোর ঠিক আগে। পুজোর পরে বেরোত রেজ়াল্ট। শারদীয়া পূজাবার্ষিকী বেরিয়ে যেত উৎসবের প্রায় মাস দুয়েক বাকি থাকতেই। একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভাল করে মুড়িয়ে করে ড্রয়ারে ভরে রাখতাম সেই অমূল্যরতন। কারণ একটাই। গন্ধটা যেন না চলে যায়। আদ্যন্ত শহুরে বেড়ে-ওঠার প্রাক-পুজো আনন্দে কাশফুলের দোলা ছিল না। পুজোর গন্ধ জমা থাকত ওই ড্রয়ারে, প্লাস্টিকবন্দি হয়ে। শেষ পরীক্ষাটা হয়ে যাওয়ার পরে বাড়ি এসে এক ছুটে শারদোৎসবের আসল বোধন হত ওই প্যাকেটটা খুলে। প্রাণ ভরে গন্ধ নিতাম। ওই গন্ধের সঙ্গেই ঢাকিরা যেন চেয়ার পেতে বসে যেতেন বুকের ঠিক মাঝখানে। ওইখানেই তো থাকে প্রাণভ্রমরা, না কি!
বইয়ের গন্ধকে এক কথায় প্রকাশ করার কোনও উপায় বাংলায় নেই। থাকলেও অন্তত আমার জানা নেই। ইংরেজিতে কিন্তু একটা সুন্দর শব্দ আছে, ‘বিবলিয়োস্মিয়া’ (Bibliosmia)। আমাদের প্রতিটা আঙুলের ছাপের মতো, সইয়ের মতো, জ়েব্রার গায়ের ডোরাকাটা দাগের মতো, এই পৃথিবীর দুটো বইয়ের গন্ধ কোনও দিন এক হতে দেখলাম না। বছর চারেক আগে ‘সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র বলেছিল, আমাদের নাক নাকি এক লক্ষ কোটি গন্ধ আলাদা ভাবে চেনার ক্ষমতা রাখে। এক-এর পরে ক’টা শূন্য যোগ করলে এক লক্ষ কোটি হয়, ভাবতে বসতে তালগোল পাকিয়ে যায় সব। প্রতিটা বইয়ের গন্ধ তাই অন্য রকম লাগবে—এ আর আশ্চর্ষ কি! তা সত্ত্বেও এ এক দারুণ গন্ধ-কাব্য। ইংরেজি বইয়ের গন্ধ এক রকম, বাংলা বইয়ের গন্ধ অন্য। আবার বোর্ড বাঁধাই বইয়ের গন্ধ এক রকম, পেপারব্যাকের আলাদা। পুরনো বইয়ের গন্ধ যে ভাবে কথা বলে, নতুন বই সে ভাবে বলে না।
বইমেলায় গিয়ে বই কেনার থেকেও বইয়ের গন্ধ শুঁকি বেশি। পকেট হয়তো সায় দেয় না সব সময়, নাক দিব্যি সায় দেয় জয়োল্লাসে। কোনও বই খুলে বাঁধাইয়ের কাছে নাকটা নিয়ে গিয়ে সে এক পরম আদর। ঘ্রাণেন্দ্রিয় জানে, মেলায় ছ’শো প্রকাশক থাকলে, প্রতি প্রকাশকের বইয়ের গন্ধ অন্য প্রকাশকের বইয়ের থেকে আলাদা। শুধু তাই নয়, একই প্রকাশকের প্রতিটা বইয়ের গন্ধ এক-এক সুরে কথা বলে। আরও মজার ব্যাপার, একই নামের প্রতিটা বইয়েরও আবার এক এক রকমের গন্ধ-রাগ। কোনও দোকানের এক কোণে ডাঁই করে রাখা অমুক লেখকের তমুক উপন্যাসসমগ্র-র প্রতিটা কপির সূচিপত্র এক, কাহিনিও এক। কিন্তু গন্ধ আলাদা। নাকের ক্ষমতার কথা তো আন্তর্জাতিক জার্নালটা বলেই দিয়েছে। তা সত্ত্বেও তাজ্জব বনতে হয়।
বইয়ের গন্ধের শেকড় কোথায়? শুধু রাসায়নিকে? নাকি তার সঙ্গে লুকিয়ে থাকে অন্য ম্যাজিকও? ‘শার্লক হোমস’-এর গন্ধ তো ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র মতো নয়। ‘টিনটিন’-এর গন্ধ আর ‘চাচা চৌধুরী’র গন্ধের মধ্যেও তো বিস্তর ফারাক। ‘সঞ্চয়িতা’র গন্ধ একেবারেই মেলে না ‘গীতবিতান’-এর সঙ্গে। আরও মজার ব্যাপার, ‘গীতবিতান’-এর পূজা পর্যায় খুলে যখন ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’ গন্ধ নিই, সেই সুঘ্রাণ আবার পাল্টে যায় প্রেম পর্যায় খুললে। তা হলে কি কোনও বইয়ের প্রতিটা পর্যায়ের, প্রতিটা অধ্যায়ের গন্ধ আলাদা? তা যদি সত্যি হয়, প্রতিটা পাতাও কি এক-এক ভাবে ডাক দিয়ে যায় আমাদের? হার্ডবাউন্ড বইয়ের— শুধু হার্ডবাউন্ডই কেন— যে কোনও বইয়েরই প্রথম কভারটা খুলে গন্ধ নিলে যে অনুভূতি, শেষ কভারটা খুলে শুঁকলে তা পাল্টে যায়। বিজ্ঞান বলে, এই সবই রসায়ন আর রাসায়নিকের কেরামতি। বই মানে কি? কয়েক ফর্মা কাগজ, কালি আর আঠা— এই তো। বাঁধানো বই হলে কোনও কোনও প্রকাশকের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যোগ হতে পারে কাপড়ও। সময় যত এগোয়, নানা বিক্রিয়ায় এই সব কিছুর থেকে জন্ম নেয় কিছু উদ্বায়ী যৌগ। পুরনো বই থেকে আমরা যে গন্ধ পাই, তা আসলে এই যৌগেরই গন্ধ। অনেকে বলেন, এই গন্ধের সঙ্গে ভ্যানিলার হাল্কা গন্ধের সাদৃশ্য আছে। হওয়ার কারণও আছে। কাগজ তৈরিতে যে মণ্ড লাগে, তার অন্যতম উপকরণ কাঠ। এই কাঠের মধ্যে থাকে ‘লিগনিন’ নামের এক রাসায়নিক। এই ‘লিগনিন’-এর সঙ্গে ‘ভ্যানিলিন’-এর গন্ধের বেশ মিল আছে। আর ভ্যানিলার গন্ধ আসলে তো ভ্যানিলিনেরই।
বই যত পুরনো হয়, গন্ধও পাল্টে যায়। নস্টালজিয়ার কি কোনও গন্ধ হয়? পুরনো বইয়ের হলুদ পাতাগুলো খুললে যে হাল্কা সুবাস ঘাটের কাছে গল্প করা নদীর জলের মতো মৃদু আসতে থাকে আমাদের নাকে, তার সঙ্গে এক সুতোয় কেন গেঁথে যায় নস্ট্যালজিয়া? বই পুরনো হওয়ার সঙ্গে নস্ট্যালজিক হওয়ার সম্পর্কটাকে বলা চলে সমানুপাতিক। নতুন বইয়ের গন্ধের মধ্যে হয়তো স্মার্টনেস বেশি। এই গন্ধ মূলত কালির, বাঁধাইয়ে লাগানো আঠার। তাতে ষোলো আনা ভাল লাগা থাকলেও নস্ট্যালজিয়া নেই। তবে কি নস্ট্যালজিয়ার গন্ধ সেই উদ্বায়ী যৌগটার মতো? কে জানে!
বই পড়ার জন্য কত কিছু এল। কিন্তু বাজারে শেষ পর্যন্ত টিকল কই? কোনও রকমে টিকে গেলেও দাপট দেখাতে পারল কই? কয়েক বছর আগেও শুনতাম, আগামী দিন নাকি হবে ই-বুকের যুগ। এটা শুনেই দুনিয়াজোড়া বইপ্রেমীরা সমস্বরে বলে উঠেছেন— ছোঃ। কাগজের বইয়ের বিক্রি কমেছে মানুষের ক্রমহ্রাসমান পড়ার অভ্যেসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। কিন্তু ই-বুক রিডারের বিক্রি তো বাড়ল না সে ভাবে। অথচ তাদের প্রস্তুতকারীরা কিন্তু বিপণনের উদ্যমে কোনও ঘাটতি রাখেননি। স্ক্রিনের ম্যাট ফিনিশ লুক দেওয়া হয়েছে বইয়ের মতো। আসল বইয়ের পাতা ওল্টানোর যে শব্দ, তাও পুরে দেওয়া হয়েছে যান্ত্রিক বইয়ে, এসেছে যান্ত্রিক বুকমার্কও। বলা হয়েছে, বিস্কুটের মতো পাতলা যন্ত্রটাই হয়ে উঠবে পাঠকের বিশাল লাইব্রেরি। বিন্দুতে সিন্ধু। পাঠক খোশমেজাজে পড়বেন— বই চুরির ভয় নেই, বিশাল বড় অমনিবাসও এই যন্ত্রের দৌলতে ওজনশূন্য, যন্ত্রের ওজনটুকু বাদ দিলে বইয়ের আলাদা কোনও ওজন নেই। বছরের পর বছর এই যুক্তি উলে বুনেও কেউই যুদ্ধ জয় করতে পারলেন কি?
মার্কিন প্রকাশকদের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকান পাবলিশার্স’-এর ২০১৯ সালের বার্ষিক রিপোর্ট বলছে, গত বছরের মোট ২৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বই বিক্রির মধ্যে ২২.৬ বিলিয়নই এসেছে ছাপা বই থেকে। টিমটিমে বাকিটুকু ই-বুক। মানুষের মনের খবরের কারবারি যাঁরা, তাঁরা বলছেন, আজ আমাদের জীবনের সিংহভাগটাই যেখানে কোনও না কোনও ভাবে স্ক্রিন-নির্ভর, সেখানে একটা বই হাতে তুলে নেওয়া মানে স্ক্রিনের গরাদ থেকে মুক্তিরও এক নিভৃত ইচ্ছে।
মননে আধুনিক হলেও মানুষ তো বারবার সেই আদির কাছেই ফিরে যেতে চায়। তাই তো আকাশছোঁয়া বহুতলের চুয়াল্লিশ তলার সাজানো বিছানাতেও পাতা থাকে অরণ্যছাপ বেডকভার। সম্প্রতি একটা ওয়েবসাইটের কথা জানলাম, যে সংস্থার ওয়েবসাইট, তাদের বিশেষত্ব হল বইয়ের গন্ধ তৈরি করা আর তা ডিওডোরেন্টের মতো ক্যানবন্দি করে বিক্রি করা। নতুন বইয়ের গন্ধ যেমন আছে, তেমন আছে পুরনো বইয়েরও গন্ধ। ওটাই অবশ্য বেশি। তারা লিখছে, এই পুরনো গন্ধ নাকি তৈরি করা হয়েছে কুড়ি হাজার সেকেন্ডহ্যান্ড বইয়ের ‘কনসেনট্রেটেড অ্যারোমা’ থেকে। কোথায় ব্যবহার করা হবে এই গন্ধ? কেন? যাবতীয় ই-বুক রিডারের গায়ে, স্ক্রিনে, সারা শরীরে। এটা নাকি ‘কমপ্যাটিবল’!
রে ব্র্যাডবেরি বলেছিলেন, পুরনো বইয়ের গন্ধ তাঁর কাছে প্রাচীন মিশরের মতো লাগে। এই নামেরও কোনও ‘কমপ্যাটিবল’ গন্ধ হয়তো শিগগিরই বাজারে এল বলে!