wildlife

মাথা ঠুকে মরবে, তবু বশ মানবে না

সারা বিশ্বে হিসপিড খরগোশের সংখ্যা মাত্র তিনশো। বিরল ও লুপ্তপ্রায় প্রজাতির এই প্রাণীটিকে চিড়িয়াখানা বা সংরক্ষণ কেন্দ্রে রেখে বাঁচানো যায় না। অসমের যমদুয়ার বা পশ্চিমবঙ্গের জলদাপাড়ার ঘন ঘাসের জঙ্গল থেকেও কি হারিয়ে যেতে বসেছে ওরা?

Advertisement

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২০ ০০:০৫
Share:

যেখানে ওদের প্রথম দেখা গিয়েছিল, সেই জায়গাটা তন্নতন্ন করে ফের খুঁজেও দেখা মিলল না একটারও। প্রায় এক মানুষ সমান উঁচু, হাতির প্রিয় খাদ্য ‘এলিফ্যান্ট গ্রাস’-এর ঘন জঙ্গলেও আঁতিপাতি করে খুঁজলাম। নেই। কিন্তু ওই ঘাসই তো ওদের খাবার।

Advertisement

‘‘থাকলে এখানেই থাকত,’’ বললেন আমাদের সঙ্গে থাকা সত্তরোর্ধ্ব উপেন নারজারি। নারজারির পূর্বপুরুষেরা ওদের শিকার করতেন। প্রতিটি এলিফ্যান্ট গ্রাসের গোড়া ভাল করে দেখলেন বৃদ্ধ। মাটিতে কিছু খুঁজলেন। তার পর হতাশ হয়ে বললেন, ‘‘এই ঘাসের গোড়া ওরা ধারালো দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। ঘাসের গোড়া দেখলেই তা বোঝা যায়।’’

মাটিতে তা হলে কী খুঁজে দেখছিলেন নারজারি? ‘‘এই ঘাসের জঙ্গলেই ওরা প্রাতঃকৃত্য করে। সেটাই খুঁজে দেখছিলাম। মাটির গন্ধও শুঁকে দেখলাম। বহু দিন এখানে আসেইনি ওরা,’’ নারজারি মাথা ঝাঁকালেন। বললেন, ‘‘ছোটবেলায় দেখতাম, খুব ভোরে কিংবা সন্ধ্যার মুখে ওরা ঘাসের জঙ্গলে লাফিয়ে বেড়াত। কাছে এসে দেখতাম, ঘাসের গোড়া থেকে কাটা। জমিতে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মল। ওরা আসলে নিশাচর।’’

Advertisement

‘হিসপিড হেয়ার’ খুঁজতে আমরা এসেছিলাম অসমের বরোল্যান্ডের যমদুয়ার সংরক্ষিত জঙ্গলে। নাম যমদুয়ার, কিন্তু অসম, পশ্চিমবঙ্গ আর ভুটানের সীমানায় এই ত্রিভুজাকৃতি বনভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কল্পনার স্বর্গকেও বুঝি হার মানাবে। ভুটানের পাহাড় থেকে নেমে এসে এখানেই সঙ্কোশ নদী ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকেছে। এক দিকে খাড়া পাহাড়। দুই দিকে সবুজ বনভূমি। আর মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী সঙ্কোশ। হেলায় ঠেলে নিয়ে চলেছে বিশাল বিশাল পাথর। নদীর বুকে গড়িয়ে আসতে আসতে সে শুধু ভাঙছে। দূর থেকেই শোনা যায় সঙ্কোশের বয়ে চলার শব্দ।

কোকরাঝাড় জেলার (অবিভক্ত গোয়ালপাড়া) গোসাইগাঁও মহকুমার এই বনাঞ্চল জীববিজ্ঞানীদের কাছে অতি পরিচিত নাম। কারণ, দু’টি বিরল স্তন্যপায়ী প্রাণী পাওয়া গিয়েছিল এই অরণ্যভূমিতেই। একটির বাসস্থান সংরক্ষিত থাকায় বিলুপ্ত হতে হতে বেঁচেছে। আর একটির বাসস্থান মানুষ দখল করে নিয়েছে, বন্যা নিয়ন্ত্রণের নানা প্রকল্পের জন্য তাদের উদ্বাস্তু করেছে, আবার সেই সঙ্গে লুকনোর জায়গা না থাকায়, পাল্টা আক্রমণে যাওয়ার ক্ষমতা না থাকায় মানুষ ওদের অবাধে শিকারও করেছে।

প্রথমটি গোল্ডেন লাঙ্গুর বা সোনালি বাঁদর। ভুটান পাহাড়ের পাদদেশের অরণ্যভূমিতেই কেবল তাদের দেখা মেলে। দেশ-বিদেশের পর্যটক, জীববিজ্ঞানীরা এই গোল্ডেন লাঙ্গুরের জন্যই আসেন অসমের মানস অভয়ারণ্যে। যদিও ভারতীয় জীববিজ্ঞান সর্বেক্ষণ বা জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র তথ্য অনুযায়ী, যমদুয়ারের এই জঙ্গলেই প্রথম দেখা মিলেছিল গোল্ডেন লাঙ্গুরের (এপি জি, ১৯৫০)। তার প‍র একের পর এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে ভুটানের ব্ল্যাক মাউন্টেন এবং পশ্চিম অসমের জঙ্গলগুলিতেই কেবলমাত্র দেখা মেলে এই প্রজাতির বাঁদরের।
দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ যে প্রাণীটির জন্য এ বারের খোঁজ, সেটি এক ধরনের খরগোশ। নাম ‘হিসপিড হেয়ার’ বা ‘অসম র‌্যাবিট’। এক সময় এই ছোটখাটো তৃণভোজী প্রাণীটিকে দেখা যেত নেপাল-উত্তরপ্রদেশ সীমান্ত এলাকার ঘাসের জঙ্গল, নেপালের কিছু ঘাসের জঙ্গল, পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্সের জঙ্গল আর ভুটান পাদদেশের পশ্চিম অসমের জঙ্গল। এখন তা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে কেবলমাত্র নেপালের দু’টি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গের জলদাপাড়া অভয়ারণ্য এবং অসমের মানস অভয়ারণ্যে।

যেখানে এই প্রাণীটির অবাধ দেখা মিলত আগে, সেই যমদুয়ারের (অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলাতেই প্রথম দেখা গিয়েছিল) ঘাসের জঙ্গলে ওদের দেখা মেলেনি বহু দিন। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজ়ার্ভেশন অব নেচার-এর (আইইউসিএন) রেড ডেটাবুকে ‘লুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণ’-এর তালিকায় থাকা এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটি যমদুয়ারের জঙ্গল থেকে পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে গেল কি না তা খতিয়ে দেখতে এক দল গবেষক গিয়েছিলেন সেখানে। তাঁদের সঙ্গী হয়েই গিয়েছিলাম যমদুয়ার। অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিলাম। গাছে গাছে সোনালি বাঁদর দেখেছি বেশ কয়েকটা, কিন্তু হিসপিড হেয়ারের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না।

বছর তিরিশেক আগে এক বার কর্মসূত্রে যমদুয়ার এসেছিলাম। তখন অসমে এক দিকে আলফা, অন্য দিকে বড়োদের আন্দোলন চলছে। বড়োরা নিজেদের জন্য আলাদা রাজ্য চেয়ে হিংসাত্মক আন্দোলনে নেমেছে। ট্রেন লাইনে বোমা ফাটছে, বাস জ্বলছে, পুলিশ গুলি চালাচ্ছে, দাউদাউ করে জ্বলছে বনবস্তি, রোজ পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগ আসছে। কখনও টানা ৩৬ ঘণ্টা সব বন্ধ। খবর আসছে প্রাণহানিরও। এই আবহে যমদুয়ারে এসেছিলাম একটি পোড়া বস্তির খবর সংগ্রহ করতে। সেই সময়টা কোকরাঝাড়, গোসাইগাঁও চষে বেড়াচ্ছিলাম খবরের জন্য। পোড়া বস্তিতে কী দেখব সেই উত্তেজনায় জঙ্গলটাকে ভাল করে দেখা হয়নি। কিন্তু যতই ভুটানের দিকে এগোচ্ছিলাম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সারা দিনের ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছিল।

এত সুন্দর জায়গার নাম যমদুয়ার কেন? সামনেই সঙ্কোশ নদী। সেটা পেরোলেই ভুটানের কালো পাহাড়। আমাদের পথপ্রদর্শক বলছিলেন, ‘‘ওই নদী পেরিয়ে ও দিকে গেলে কেউ নাকি আর ফিরে আসত না। তাই নাম যমদুয়ার। এখন অবশ্য মানুষেরা দিব্যি ও দিকে যাচ্ছেন।’’ আমরা পোড়া গ্রামে এসে পৌঁছে দেখলাম, তখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে। জঙ্গলের মধ্য থেকে বেরিয়ে এলেন কয়েকজন প্রবীণ। এক জনের হাতে ঝোলানো তিনটি আধপোড়া খরগোশ। বাড়ির আগুন পুড়িয়ে দিয়েছে ঘাসের জঙ্গল। তাতেই মারা পড়েছে ওই অবলা প্রাণীগুলো। ফটাফট ছবি উঠল।

পরে অসমের এক বনকর্তাকে ওই ছবি দেখাতেই ভদ্রলোক লাফিয়ে উঠেছিলেন, ‘‘আরে, এ তো হিসপিড হেয়ার! ওই ঘাসের জঙ্গলই ওদের প্রিয় বিচরণভূমি। অতি বিরল প্রজাতির প্রাণী ওরা।’’ আমার কাছ থেকে ছবির প্রিন্ট নিয়ে রাখলেন তিনি, বললেন, ‘‘মানস অভয়ারণ্যে গিয়ে ওদের দাঁতে কাটা এলিফ্যান্ট ঘাস দেখেছি। মল পড়ে থাকতে দেখেছি। খুব সকালে আর সন্ধ্যার মুখে ঝুঁকি নিয়ে অপেক্ষা করেছি। দেখা পাইনি।’’

বছর ১৫ আগে এক বার উত্তরপ্রদেশ-নেপাল সীমান্ত লাগোয়া দুধওয়ার জঙ্গলে গিয়েছিলাম। ওদের ওখানে দ্রষ্টব্য প্রাণীগুলির মধ্যে হিসপিড হেয়ারের নাম ছিল। ওই জঙ্গলে এলিফ্যান্ট গ্রাসের প্রচুর ঝোপ। জলার ধারে এমন ঘন ঝোপের মধ্যে বাঘ পর্যন্ত দেখেছি। কিন্তু হিসপিড হেয়ার বা তার মল, কোনওটাই চোখে পড়েনি। এক বনকর্মীর ব্যাখ্যা ছিল, ‘‘এখানে ঘাসের জঙ্গলে গ্রীষ্মকালে মাঝেমধ্যেই আগুন ধরে যায়। আর সেই কারণেই বোধহয় ওরা এই জায়গা ছেড়ে চলে গিয়েছে।’’
কেমন দেখতে এই খ‍রগোশ? জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার দেওয়া তথ্য বলছে, প্রাণীটি লম্বায় পৌনে এক ফুট থেকে দেড় ফুট। লেজটা এক ইঞ্চির মতো লম্বা। গোটা শরীর ঘন লোমে ঢাকা। কালো ও বাদামি লোমের জন্য পিঠের দিকটা ঘন বাদামি দেখায়। বুকের কাছটাও বাদামি, পেটটা সাদা। অন্য খরগোশদের মতো এদের পিছনের পা দু’টি মোটেই সামনের পায়ের চেয়ে বড় নয়। কান দু’টি ছোট, ঘন লোমের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। ওজন দেড় থেকে আড়াই কেজির মতো। গোটা পৃথিবীতে এদের সংখ্যা তিনশোরও কম।

কিন্তু এই প্রাণীটির জীবনধারণের প্রক্রিয়া এখনও জীববিজ্ঞানীদের অজানা। তবে স্থানীয় মানুষ ও বনকর্মীদের থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বছরে দু’বার বাচ্চা দেয় এই খরগোশেরা। তবে ডিসেম্বর থেকে মার্চ সময়কালই ওদের বাচ্চা দেওয়ার প্রধান সময়। এক-এক বারে গড়ে তিনটি সন্তান প্রসব করে মা খরগোশ। মিলনের সময় ছাড়া সাধারণত স্ত্রী ও পুরুষ আলাদা থাকে। সন্তানরা মায়ের সঙ্গে কত দিন পর্যন্ত থাকে তা এখনও অজানা।

বিরলতম প্রাণীদের বংশগতির ধারা টিকিয়ে রাখতে এবং জীবনধারণের গতিপ্রকৃতি জানতে জঙ্গল থেকে ধরে এনে কোনও চিড়িয়াখানায় তাদের বসবাসের আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে সেখানেই তাদের লালনপালন করা হয়। তার পরে বংশ বিস্তার করলে সেই বাচ্চাদের ছেড়ে দেওয়া হয় জঙ্গলে। উত্তরবঙ্গে রেড পান্ডাদের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা সফল হয়েছে। তা হলে হিসপিড হেয়ারদের ক্ষেত্রে তা করা যায়নি কেন?

জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার এক বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘আজ পর্যন্ত কোনও হিসপিড হেয়ারকেই খাঁচাবন্দি করে কোনও চিড়িয়াখানা বা সংরক্ষণ কেন্দ্রে আনা যায়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খাঁচাবন্দি করার পরেই মারা গিয়েছে। কিংবা খাঁচার গায়ে ক্রমাগত মাথা দিয়ে আঘাত করে নিজেই মারা গিয়েছে।’’ বিশ্বের কোনও চিড়িয়াখানা বা সংরক্ষণ কেন্দ্রে তাই এই প্রজাতির প্রাণী একটিও নেই। জঙ্গলে এরা বিলুপ্ত হয়ে গেলে আর কখনওই ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই।

এই জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তথ্যই বলছে, জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের বিস্তৃত তৃণভূমি এক সময় হিসপিড হেয়ারের বাসস্থান ছিল। কিন্তু ১৯৮৮ সালের পর সেখানে আর নজরে আসেনি ওই প্রজাতির খরগোশ। গত বছর জঙ্গলে বসিয়ে রাখা ক্যামেরায় একটি হিসপিড হেয়ারের ছবি ধরা পড়ায় শোরগোল পড়ে যায় বন দফতরে। দফতরের কর্তারা দাবি করেন, প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে আগুন লাগে এখানকার ঘাসের জঙ্গলে। তাতেই অস্ত্বিত্বের সঙ্কটে পড়ে যায় প্রাণীটি। ২০১৮ সালে তোর্সার চরে কোনও অগ্নিকাণ্ড হয়নি। তাই ফের হয়তো অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে এসেছিল সে।

চলতি বছর মার্চের ঠিক গোড়াতেই ফের আগুন লেগেছে তোর্সার চরের ওই তৃণভূমিতে। আগুন নেভানোর পরে তৃণভোজী প্রাণীদের কার কতটা ক্ষতি হয়েছে, তার হিসেব নেওয়ার সময়ে দেখা যায়নি একটিও হিসপিড হেয়ার। জঙ্গলে বসিয়ে রাখা ক্যামেরাতেও তার দেখা মেলেনি।
তা হলে কি জলদাপাড়া থেকে একেবারেই উধাও হয়ে গেল অতি বিরল এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement