আরোহী: সাইকেলে দুই নোবেলজয়ী। আলবার্ট আইনস্টাইন ও অমর্ত্য সেন। ছবি: নোবেল প্রাইজ়-এর ফেসবুক পেজ থেকে
রাঙামাটির পথ ধরে ছুটছে দু’চাকা। সওয়ারিকে চেনে গোটা বিশ্ব। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। লাল মাটির রাস্তায় তাঁর সাইকেল চালানোর ওই ছবিই ৩ জুন নিজেদের ফেসবুক পেজে শেয়ার করেছিল নোবেল পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থা। ওই দিন ছিল বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস। তারা লিখেছিল, এ ভাবে সাইকেলে চড়েই গ্রামে গ্রামে ঘুরে নিজের গবেষণার কাজ করেছিলেন অমর্ত্য সেন। সেই সাইকেলটি সংরক্ষিত রয়েছে সুইডেনের নোবেল পুরস্কারের সংগ্রহশালায়।
বাইসাইকেল দিবসের জন্য একটা তারিখ নির্দিষ্ট করা থাকলেও, বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য মানুষের কাছে প্রতিদিনই বাইসাইকেল দিবস। কারণ তাঁদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে আছে এই দ্বিচক্রযান। তেমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন।
করোনাভাইরাসের অতিমারি ঘরবন্দি করে ফেলেছিল গোটা বিশ্বকে। ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি নিয়ে কাজ চলছে, অবিসংবাদিত সাফল্য আসেনি এখনও। বিশ্ব জুড়ে প্রস্তুতি চলছে, কী ভাবে এই ভাইরাসকে মেনে নিয়েও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেরা যায়। একটা প্রধান উপায় ছোঁয়াচ এড়িয়ে যাতায়াত। সেই কাজে সাইকেল লা-জবাব!
কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় এখন সাইকেল চালানোর পুলিশি অনুমতি। আর সাইকেলের চাকার মতোই যেন সময়ের চাকায় ঘুরে এল ইতিহাসও। ১৯১৮-র কুখ্যাত স্প্যানিশ ফ্লু-র সময়েও জনপ্রিয় হয়েছিল সাইকেল। বিশ্ব জুড়ে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিলেন স্প্যানিশ ফ্লু-তে। এ বার কোভিড-১৯ যেমন ভয়ঙ্কর আঘাত হেনেছে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে, তেমন হয়েছিল সে সময়েও। ওই ১৯১৮-তেই নিউ ইয়র্কের কুইন্স-এ সাইকেলের দোকান খোলেন সিসিলি থেকে আসা শরণার্থী সালভাতোর বেল্যিট, যাঁকে সবাই চিনতেন স্যাম বেল্যিট নামে। সেই দোকানই আমেরিকার সবচেয়ে প্রাচীন সাইকেলের দোকান বলে মনে করা হয়।
এখন সেই দোকান চালান স্যামের নাতি সল বেল্যিট। করোনা-কালেও প্রতিদিন খোলা তাঁর দোকান। সাইকেল ও দেশে আজও অত্যাবশ্যক সামগ্রী। লকডাউন চলাকালীনও বিক্রি হয়েছে প্রচুর সাইকেল। ‘‘ফোন বেজেই যায়, থামে না,’’ বলেছেন সল। তাঁর কথায়, ‘‘ছোট থেকে শুনেছি স্প্যানিশ ফ্লু-র কথা, কী ভাবে ওই সময় দাদু দোকান খুলেছিলেন। এ বার নিজের সেই অভিজ্ঞতা হল।’’
ফিরে এসেছে পুরনো সময়ের আরও অনেক কিছু। তার মধ্যে একটা হল বিজ্ঞাপন। ‘টাইম’ ম্যাগাজিন সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, স্প্যানিশ ফ্লু-র সময়ে কিছু জিনিসের বিজ্ঞাপন বেড়ে গিয়েছিল, তেমন বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে এখনও। তার মধ্যে রয়েছে বার বার হাত ধোওয়ার বার্তা বা হেলথ ড্রিঙ্কের বিজ্ঞাপন, আবার সাইকেলের বিজ্ঞাপনও। সাইকেলে যাতায়াত করলে এই ছোঁয়াচে রোগকে এড়ানো সম্ভব, বলা হয়েছিল বিজ্ঞাপনে।
বিজ্ঞাপন থেকেই শুরু হয়েছিল ব্যোমকেশের বিখ্যাত রহস্যকাহিনি ‘পথের কাঁটা’। গল্পে মূল ভূমিকা বাইসাইকেলের। যার ঘণ্টিই ছিল খুন করার অস্ত্র। ব্যোমকেশের বয়ানে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘‘এমন সহজে অনাড়ম্বরভাবে খুন করবার আর দ্বিতীয় উপায় নেই। বাইসিক্ল-আরোহীকে কেউ সন্দেহ করতে পারে না। কারণ, সে দু’হাতে হ্যান্ডেল ধরে আছে— অস্ত্র ছুঁড়বে কি করে? তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।’’
সাইকেলের সঙ্গে রহস্যের যোগ আমরা পাই শার্লস হোমসের গল্পেও। স্যর আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য সলিটারি সাইক্লিস্ট’-এ মিস ভায়োলেট স্মিথ আসেন হোমসের সাহায্যপ্রার্থী হয়ে। জানান, তিনি যখন সাইকেল চালান, কেউ তাঁকে অনুসরণ করে। এই গল্পের সূত্র ধরেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অভিজিৎ গুপ্ত মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সাইকেল কী ভাবে উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে নারীর ক্ষমতায়নের অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। ওই সময় থেকেই ইউরোপ-আমেরিকায় ব্যাপক ভাবে সাইকেল চালাতে শুরু করেন মেয়েরাও। সাইকেল তাঁদের বাড়ির বাইরে আসা, স্বাধীন চেতনার বিকাশ ঘটানোয় গতি দিয়েছিল। সাইকেল চালানো শুরু করার পর বদল ঘটে মেয়েদের পোশাকেও। যে সব পোশাক পরে সাইকেল চালাতে সুবিধে হয়, তেমন পোশাক পরতে শুরু করেন মেয়েরা।
কেবল বিদেশ কেন, আমাদের বাংলাতেও মেয়েদের সাইকেল চালানোর কথা পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ যাঁকে ‘অগ্নিকন্যা’ বলেছেন সেই কল্পনা দত্ত দেশের স্বাধীনতার বিপ্লবী কার্যকলাপে যোগদানের জন্য সাইকেল চালানো শিখতেন ভোরবেলায়, বেথুন কলেজের ক্যাম্পাসের মধ্যেই। পরে তিনি মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
বিপ্লবীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে যোগাযোগ রাখা, খবর আদানপ্রদান করার ক্ষেত্রে সাইকেল ছিল একটা বড় অস্ত্র। বিখ্যাত অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীতে তার উল্লেখ মেলে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, ‘‘আমার দিদি প্রকৃতি, লীলা রায়ের স্বদেশি দল ‘জয়শ্রী পার্টি’র সদস্য ছিল। ওখানেই আমার দীনেশ (গুপ্ত)দার সঙ্গে চেনাজানা হয়। দিদিকে দেখে আমিও উদ্বুদ্ধ হই। মাঝে মধ্যেই দীনেশদার সঙ্গে সাইকেলে চড়ে বেরিয়ে যেতাম নানান জায়গায়।’’
সাইকেল যে বিপ্লবীদের গতিবিধির একটা বড় অস্ত্র ছিল তার প্রমাণ মেলে ভানুর লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘‘এই দীনেশদার কাছেই অনুশীলন পার্টির ত্রৈলোক্য মহারাজ, রাধাবল্লভ গোপ প্রভৃতির কথা, এর পরে মাস্টারদা, অনন্ত সিং, লোকনাথ বল প্রভৃতির গল্প বলে আমার মনে দেশভক্তির উদ্রেক করেন। ছোটবেলাতেই দীনেশদার কাছে অনেক কিছু শিখেছি। স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ ডা. ভূপেন দত্তের মুখেই গল্পটা শুনেছি— ‘পাঞ্জাবে একটা মিটিং-এ যাওয়ার সময় দীনেশদার সাইকেলের চাকা ফেটে যায়। কিন্তু মিটিং-এ ঠিক সময়ে পৌঁছোবার জন্য দীনেশদা ওই সাইকেল কাঁধে নিয়ে চার মাইল রাস্তা দৌড়ে গন্তব্যস্থলে যান।’’
সেই সময়কার পরিস্থিতিই উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের ‘বদনাম’ গল্পেও। সেই গল্প শুরুই হয় পুলিশ ইনস্পেক্টর বিজয়বাবুর সাইকেলের ‘ক্রিং ক্রিং ক্রিং’ শব্দের উল্লেখে। বিলেত থেকে সাইকেল এ দেশে আসার পর যে তা প্রথমে পুলিশ ও সরকারি কর্মীদের পেশাগত কাজে ব্যবহার হত তার উল্লেখ রয়েছে সে সময়ের অজস্র রচনায়।
পরে অবশ্য সাইকেল ধীরে ধীরে সাধারণের আয়ত্তের মধ্যে আসে। তবে কিছু পেশার সঙ্গে সাইকেলের যোগ ছিল ওতপ্রোত। তেমনই এক পেশা ছিল চিকিৎসা। তার প্রকাশও আমরা দেখতে পাই সাহিত্যে-সিনেমায়। কে ভুলতে পারে ‘সপ্তপদী’ ছবির সেই প্রথম দৃশ্য, যেখানে উত্তমকুমার একটা সাইকেল চালিয়ে রোগী দেখতে যাচ্ছেন! আকাশে দেখা মিলছে যুদ্ধবিমানের ঝাঁকের। পর্দায় ফুটে উঠছে সময়টা, ১৯৪৩। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল ও তার পরবর্তী পরিস্থিতির আবহেই তৈরি আর একটি ছবিও জগদ্বিখ্যাত। ভিত্তোরিয়ো দি সিকা-র ‘দ্য বাইসাইকেল থিভস’। বাইসাইকেল যে প্রাণের কাছাকাছি থাকা একটা অস্তিত্ব, চুরি যাওয়ার পরে ছবির ঘটনাক্রমে তার প্রমাণ মেলে।
সেই সময় কালজয়ী শিল্পেও ব্যবহার হয়েছে সাইকেল। কে ভুলতে পারে সাইকেলের হ্যান্ডেল আর সিট দিয়ে তৈরি, ১৯৪২ সালে গড়া পাবলো পিকাসোর অমর ভাস্কর্য ‘বুল’স হেড’-এর কথা? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও সাইকেলের ব্যবহার দেখা গিয়েছে। মূলত খবর আদানপ্রদান, আহতকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজে ব্যবহার হত সাইকেল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন বাঙালি ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস। পরে তিনি ১৯৩১-এর জুলাইয়ে সিঙ্গাপুর থেকে বাইসাইকেলে বিশ্বভ্রমণে বেরোন। সাইকেলেই চারটি মহাদেশ ঘুরেছিলেন তিনি।
সাইকেল-গতি থেমে নেই। হালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দূরত্ব বজায় রেখে যাতায়াতের জন্য ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ ছবির পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য বেছে নিয়েছেন সাইকেলকেই। যাদবপুরের শিক্ষক অভিজিৎ অবশ্য আগে থেকেই নিয়মিত ব্যবহার করেন সাইকেল।
তবে আলাদা লেন না থাকলে, শহরের ভিড়ে ভরা রাস্তায় যে সাইকেল চালানো খুব ঝুঁকিপূর্ণ, সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ছোটবেলা থেকেই সাইকেলে সওয়ার তিনি, তাঁর ‘পার্থিব’ উপন্যাসে লিখেছিলেন সাইকেলের জন্য আলাদা লেন থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা।
শহুরে চাকুরিজীবী এই বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে সাইকেলের গুরুত্ব অনুভব করলেও গ্রাম-মফস্সলে অবশ্য সাইকেল চালানোর ছবিটা খুব পরিচিত। গ্রাম থেকে শহরের হাটে-বাজারে সাইকেলে চাপিয়ে আনাজ, মাছ, এমনকি চালের বস্তা নিয়ে আসাটা দস্তুর বললে ভুল হবে না। পড়ুয়াদের দল বেঁধে সাইকেলে যাওয়ার ছবিও চেনা। বাংলার ‘সবুজ সাথী’ প্রকল্পে স্কুলপড়ুয়াদের সাইকেল দান স্বীকৃতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্তরে।
সাইকেলের সঙ্গে আর একটা বিষয় এক হয়ে যায়— প্রেম। তার খোঁজ পাই সাহিত্যেও। বিমল করের ‘অসময়’ উপন্যাসে আয়নার সঙ্গে তপুর কথোকথনের মধ্যেই একাধিক বার রয়েছে তপুর সাইকেলের উল্লেখ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মনীষার দুই প্রেমিক’-এ অমলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেমিক বলে, ‘‘অমল বিমান চালায়। অমল মোটরগাড়ি চালাতে জানে কি না— আমি ঠিক জানি না। কিন্তু এ কথা জানি অমল সাইকেল চালাতে পারে না।’’ সাইকেল জায়গা করে নিয়েছে এই প্রজন্মের স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর উপন্যাস ‘পাল্টা হাওয়া’তেও। সাইকেলের গুরুত্ব না থাকলে কি লেখা হত ‘সাইকেলটা আমি ছেড়ে দিতে রাজি আছি, পারব না ছাড়তে এ ঠ্যাং’-এর মতো জনপ্রিয় লাইন?
তাই নতুন সাইকেলের ছবিতে এখন ভরপুর সোশ্যাল মিডিয়া। অনেকে আধুনিক কায়দার সাইকেল কিনছেন, অনেকে আবার ভরসা রাখছেন বাবাকে চালাতে দেখা ‘র্যালে’তে। দু’চাকার সঙ্গে জড়িয়ে কত জীবনের কত আবেগ!
আর জীবনের সঙ্গেই তো সাইকেল চালানোর মিল খুঁজে পেয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন! ১৯৩০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এক চিঠিতে তিনি তাঁর ছেলে এডওয়ার্ডকে লিখেছিলেন, ‘‘জীবন একটা সাইকেল চালানোর মতোই। ব্যালান্স ঠিক রাখতে হলে চলতে হবে।’’
তাই, অতিমারিকে যুঝেই এই সময়ে আপন গতিতে চলতে থাকুক সাইকেল।