প্রেম: (ডান দিকে) ব্যাটিংরত পটৌডী। গ্যালারিতে শর্মিলা ঠাকুর।
সুনা কেয়া? প্রশ্ন বোলারের। যাঁর উদ্দেশে প্রশ্ন, সেই ব্যাটসম্যান এই মাত্র অফস্টাম্পের বাইরে পরাস্ত হয়েছেন। এখনকার দিনে বোলারকে ও ভাবে এগিয়ে যেতে দেখলে মনে হত, এই বুঝি শুরু হল স্লেজিং!
এখানে ব্যাটসম্যানের কাছে গিয়ে কিছু শোনার আর্জি জানাচ্ছেন বোলার। কিন্তু কী? ব্যাটসম্যান আবার মূর্তিমান মনঃসংযোগ— সুনীল গাওস্কর। ব্যাটিং করার সময় তাঁর সামনে এমন অদ্ভুত আর্জি নিয়ে হাজির হতে পারতেন এক জনই। ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচে সে দিন তিনিই ছিলেন বোলার— বি এস চন্দ্রশেখর। বলা উচিত মুকেশ-ভক্ত চন্দ্রশেখর। গাওস্করের কাছে গিয়ে দূর থেকে ভেসে আসা ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায়’-এর গান শোনার অনুরোধ জানাচ্ছেন চন্দ্র!
সুনা কেয়া? এ বার সানিরও কান খাড়া। নিকুচি করেছে মনঃসংযোগের। গুনগুন করে গাইছেন ব্যাটসম্যান-বোলার দু’জনেই। কে বলবে সে দিন তাঁরা যুযুধান প্রতিপক্ষ! তখন ক্রিকেট শুধু খেলা ছিল না, ছিল নানা আবেগের মিলনমঞ্চ! প্রতিদ্বন্দ্বিতার পাশাপাশি ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধা। যেমন ক্রিকেটের চিরকালীন সংগ্রহশালায় ঢুকে রয়েছে আর্থার মেইলির মন্তব্য। মেইলি শুধু বিখ্যাত লেগস্পিন-গুগলি বোলারই ছিলেন না, একই সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে অসাধারণ লিখতেন, দারুণ ‘ক্যারিকেচারিস্ট’ ছিলেন। ভিক্টর ট্রাম্পার ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ক্রিকেটার। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ম্যাচে মেইলি আউট করলেন ট্রাম্পারকে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় ব্যাটসম্যান বলে গেলেন, ‘‘বলটা আমার পক্ষে একটু বেশিই ভাল ছিল।’’ সেই সময় ট্রাম্পারের মুখ থেকে এমন প্রশংসাবাক্য শোনা মানে যে কোনও বোলারের ‘নাইট’ উপাধি পাওয়ার সমান। কিন্তু মেইলি পরে লিখলেন, ‘‘এই উইকেট নেওয়ার মধ্যে কোনও উৎসবের আনন্দ ছিল না। বরং নিজেকে সেই বালকের মতো মনে হচ্ছিল, যে এইমাত্র একটা পাখিকে মেরে ফেলেছে!’’
আরও পড়ুন: তাঁর আমলে চিড়িয়াখানায় ওয়াজিদ আলি শাহ থেকে বিবেকানন্দ
চন্দ্রশেখরের আমলে তারকাদের সঙ্গে আত্মিক যোগ তৈরি করার মাধ্যম হয়ে উঠেছিল ট্রানজিস্টর। প্রিয় ক্রিকেটারের শখ বুঝে গ্যালারি থেকে দর্শকেরা বাজিয়ে দিতেন জনপ্রিয় ফিল্মি গান। চন্দ্র বল করছেন মানে রেডিয়ো স্টেশন ঘুরিয়ে অবধারিত ভাবে মুকেশের গান ধরা হবে। তাঁর অধিনায়ক টাইগার পটৌডী ব্যাট করার সময়ে আবার শোনা যেত শর্মিলা ঠাকুরের ছবির কোনও বিখ্যাত রোম্যান্টিক গান। ‘ওয়াদা করো নহী ছোড়োগি তুম মেরা সাথ/ জাহাঁ তুম হো, ওয়াহাঁ ম্যায় ভি হুঁ...’
চন্দ্রের ‘মুকেশ কালেকশন’-এর সবচেয়ে বড় ভক্ত হয়ে ওঠেন গাওস্কর। মাঝেমধ্যে গুরুদক্ষিণা দিতেও ভুলতেন না সানি। কোনও ম্যাচে হয়তো বিপক্ষ জুটি দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কিছুতেই ভাঙা যাচ্ছে না। গাওস্কর গিয়ে চন্দ্রের পাশে হাঁটতে হাঁটতে গুনগুন করে মুকেশের গান গাইতেন। তাতে অনেক সময়েই বোলার উদ্বুদ্ধ হয়ে উইকেট তুলে নিতেন। পটৌডীর সেই দলে প্রবাদই তৈরি হয়ে গিয়েছিল, যদি চন্দ্রের হাতের জাদুতে উইকেট না-ওঠে, মুকেশের কণ্ঠ আনো। কেল্লা ফতে হবেই!
ট্রানজিস্টরের ভূমিকা যদিও শুধু চন্দ্রকে উদ্বুদ্ধ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত উইকেটকিপার রডনি মার্শ (কট মার্শ বোল্ড লিলি-খ্যাত সেই কিপার) ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলেন বাবার কাছ থেকে বিশেষ উপহার পেয়ে। কী সেই উপহার? বাবা-মায়ের ঘরে ছিল বাড়ির একমাত্র রেডিয়ো। সেখানে অ্যাশেজের একটা দিনের খেলার সরাসরি ধারাবিবরণী শোনার পুরস্কার জুটেছিল মার্শের। সে দিনই তাঁর মনে জন্ম নেয় স্বপ্ন, ‘‘এক দিন আমাকেও অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট খেলতে হবে।’’ রড মার্শের মতো আরও অনেকে আছেন। বিরাট কোহালিদের এখনকার হেড কোচ রবি শাস্ত্রীর মনে ক্রিকেটের রবি-উদয় ঘটে রেডিয়োয় গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের ব্যাটিং শুনতে শুনতে।
আগে মাঠে যেমন খেলোয়াড়-দর্শক আত্মিক বন্ধনের ছবি দেখা যেত, এখন তা অতীত। ড্রয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া টেস্টে দর্শকের মনোরঞ্জন করতেন ক্রিকেটারেরা। কেন ব্যারিংটন যার মাস্টার ছিলেন। এক বার ইডেনে খেলা থামিয়ে দিয়েছিলেন ঘুড়ি ধরার জন্য। এক দর্শকের হাত থেকে অসাবধানে বেরিয়ে যাওয়া ঘুড়ি ধরে তাঁর হাতে ফেরত দিয়ে আবার ফিল্ডিংয়ে মন দেন প্রাক্তন ইংল্যান্ড তারকা। পুণেতে এক দর্শক মাঠে ঢুকে পড়েছিলেন ব্যারিংটনকে সানগ্লাস উপহার দেবেন বলে। ভক্তকে সম্মান দেখাতে সারা দিন সেই সানগ্লাস পরে ফিল্ডিং করেন ব্যারিংটন। শোনা যায়, ইডেনের হাই কোর্ট প্রান্তের গ্যালারির সামনে সার্কাসের ভঙ্গিতে ডিগবাজি দিয়েও দর্শকদের মনে দাগ কেটেছিলেন তিনি।
ইডেনে এক সময়ে শীতকালের ক্রিকেট মানে কমলালেবু, স্যান্ডউইচ, কলা সহযোগে রীতিমতো পিকনিকের মেজাজ দেখা যেত। মেয়েদের দেখা যেত উল-কাঁটা নিয়ে সোয়েটার বুনতে। দর্শকেরা এখন ক্রিকেট ‘দেখেন’, তখন উপভোগ করতেন। তেমনই মাদকতা ছিল তখনকার তারকাদের নিয়ে। এখনও বয়স্করা সম্মোহিত হয়ে আছেন রোহন কানহাইয়ের পড়ন্ত সুইপ শটে। বলা হত, মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ভুল প্রমাণ করে দিত কানহাইয়ের ওই শট।
অথবা ভয়ঙ্কর-সুন্দর গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি। ১৯৬৯-এর ইডেনের শ্বাসপ্রশ্বাস যিনি থামিয়ে দিয়েছিলেন শূন্য রানে দুই উইকেট তুলে নিয়ে। আর তার পরে উদয় বেঁটেখাটো এক কিশোরের। ম্যাকেঞ্জিকে স্কোয়ার কাট মেরে পয়েন্ট বাউন্ডারিতে আছড়ে ফেলে যিনি পাল্টা আক্রমণ শুরু করবেন। স্বাগত গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ! যিনি সে দিন মাত্র ৫৪ রানই করেছিলেন। কিন্তু রোহন ভোলালাল কানহাইয়ের ২৫৬-এর মতোই অমর হয়ে রয়েছে!
আরও কত মণিমুক্তো! বুধি কুন্দরনের ক্যাচ ধরার জন্য তিরিশ গজের বেশি পিছনে ছুটে গ্যারি সোবার্সের অবিশ্বাস্য প্রয়াস! এত বছর পরেও একটা ফেলে দেওয়া ক্যাচে মোহিত হয়ে আছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। সে ছিল অন্য ক্রিকেট, অন্য সময়।
মহম্মদ আজহারউদ্দিনের অভিষেক টেস্টে গাওস্কর এবং তাঁর স্ত্রীর দিকে কলার খোসা উড়ে যাওয়ার পর থেকে ইডেনের পিকনিকে চিরকালের জন্য তালাচাবি পড়ে গেল। এখন ভারতের প্রতিটি মাঠে গ্যালারি এবং মাঠের মাঝখানে অদৃশ্য কাঁটাতার বসে যেন ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ তৈরি হয়ে গিয়েছে। মাঝেমধ্যে কোহালিকে দেখা যায় দর্শকদের দিকে হাত নেড়ে সংযোগ রক্ষার চেষ্টা করছেন। ওই ইশারাতেই যা কথা হয়, হৃদয়ের বন্ধনের খুব অবকাশ নেই। কে বলবে এক সময় ম্যাচ জেতার পুরস্কার হিসেবে হাওড়া স্টেশনে দর্শকদের কাছ থেকে সোনা উপহার পেয়েছেন সেলিম দুরানি, চাঁদু বোরডেরা! নেশাতুরের মতো অটোগ্রাফ সংগ্রহের হিড়িকই বা কোথায়? মোবাইল যন্ত্রের রমরমায় ভক্তের তারকাপুজো এখন শুধু নিজস্বীর ফুলেই সাজানো। আগে যেমন ডাকটিকিট সংগ্রহের নেশার মতো অটোগ্রাফ খাতা নিয়ে ঘুরতে দেখা যেত ভক্তদের, সে-সব এখন ট্রানজিস্টরের মতোই লুপ্তপ্রায়।
সব মাঠে ক্রিকেটার-দর্শকের মধ্যে ব্যবধান না-থাকাটা যে খুব সুখকর অভিজ্ঞতা হত, তা অবশ্য নয়। এক বার গাওস্কর ব্যাট করছেন সাবাইনা পার্কে। আশির দশকে যে কোনও ব্যাটসম্যানের কাছে সাবাইনা পার্ক ছিল মৃত্যুপুরী। হোল্ডিং পর পর চারটে বাউন্সার দিলেন। গাওস্কর বুঝতে পারছেন, হোল্ডিং তাঁকে ব্যাকফুটে নিয়ে যাচ্ছেন। এর পরে প্রলুব্ধ করার জন্য সামনের পায়ে খেলার জন্য ভাসানো বল দেবেন। থতমত খেয়ে ব্যাট বাড়িয়ে দেবেন গাওস্কর আর উইকেটের পিছনে ক্যাচ গিয়ে তাঁর ইনিংস-লীলা সাঙ্গ হবে। পঞ্চম বলটি ঠিক তেমনই দিলেন হোল্ডিং। ধুরন্ধর গাওস্কর পা বাড়িয়ে ছেড়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের মধ্য থেকে এক জন চিৎকার করে উঠলেন, ‘‘ও মাইকি (মাইকেল হোল্ডিংকে ভালবেসে এ নামেই ডাকতেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট দর্শকেরা), ও মাইকি! গিভ হিম আ বাউন্সার মান (ইংরেজিতে ‘ম্যান’-কে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা এ ভাবে ‘মান’ উচ্চারণ করেন)!’’ স্পষ্ট তাঁর কথা শুনতে পেলেন ব্যাটসম্যান। সত্যিকারের ‘মান’ গাওস্করও ছাড়ার পাত্র নন। সেই দর্শকের দিকে ঘুরে পাল্টা বলে উঠলেন, ‘‘ওহে, তোমার মাইকির আগের চারটি বল তা হলে কী ছিল?’’ এখনকার দিনে ম্যাচ চলার মধ্যেই দর্শক-ক্রিকেটারের এ ধরনের সংলাপ কাল্পনিক কাহিনিতেও রাখা সম্ভব হবে না।
সেই সময়: খেলার ফাঁকে সুনীল গাওস্করের কাছে সইশিকারিদের আবদার
এখন ভাবতে গিয়ে কাল্পনিকই মনে হবে যে, ১৯৭১-এ ওভালে টেস্ট জেতার পরে প্রবাসী ভারতীয়রা উৎসব করেছিলেন হাতির প্যারেড করিয়ে। চেসিংটন থেকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আনা হয়েছিল হাতি। আর মুম্বইয়ে মেরিন ড্রাইভে সকলে গাড়ির হর্ন বাজাতে শুরু করে দেন। আরও পিছিয়ে গেলে ভারতীয় ক্রিকেটে হাতির অন্য ভূমিকাও পাওয়া যাবে। যখন রাজা-মহারাজারা খেলতেন। পিচ ‘রোল’ করার জন্য বাইশ গজের উপরে হাতি ছেড়ে দেওয়া হত। আগে টেস্ট ম্যাচে ‘রেস্ট ডে’ থাকত। যা ক্রিকেটারদের সঙ্গে ভক্তের সম্পর্ক আরও নিবিড় করে তুলত। কোর্টনি ওয়ালশ বছর দুই আগে কলকাতায় এসেও বলে গিয়েছেন, তাঁরা খেলতে এলে গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে যে-রকম ভিড় অপেক্ষা করত, তা আর কোথাও দেখেননি। ক্রিকেটাররা ঘরের জানলা খুলে দেখতেন সেই ভিড়। ‘রেস্ট ডে’-তে ভক্তের সংখ্যা আরও বেড়ে যেত, কারণ খেলা থেকে ছুটি মানে সে দিন অটোগ্রাফ পাওয়ার আশা অনেক বেশি।
সব ক্রিকেটারের কাছে অবশ্য ‘রেস্ট ডে’-র অর্থ সমান ছিল না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্পিনার ক্লাইড বাটস ‘রেস্ট ডে’-তে বিয়ে করেছিলেন। এত ঠাসা সূচির মধ্যে নাকি সময়ই করে উঠতে পারছিলেন না! ইংল্যান্ডের প্রাক্তন স্পিনার জন এমবুরি এক বার বলেছিলেন, ‘রেস্ট ডে মানে কারও কারও কাছে একেবারেই রেস্ট নয়।’’ কথাটা অবশ্যই ইয়ান বোথামের কথা মাথায় রেখে বলা। ১৯৮০ সালে ওয়াংখেড়েতে জুবিলি টেস্ট খেলতে আসে ইংল্যান্ড। যা কিনা বোথামের টেস্ট হিসেবে বিখ্যাত। প্রথম ইনিংসে ছয় উইকেট নেন বোথাম। এর পরে ব্যাটিং করতে নেমে ৫৮-৫ হয়ে যায় ইংল্যান্ড। সেখান থেকে একাই ১১৪ রান করে দলকে উদ্ধার করেন। এর পরেই তিনি ঠিক করলেন, সেলিব্রেট করবেন। ডেরেক আন্ডারউডের দুর্ভাগ্য, তিনি সেই সফরে বোথামের রুমমেট ছিলেন। আর ইংল্যান্ডের এক সংবাদপত্রের নামী ক্রিকেট-লেখকের আরও কপাল খারাপ, তিনি আন্ডারউডের আত্মজীবনী লেখার জন্য ওই ঝটিকা ভারত সফরকেই বেছে নিয়েছিলেন। দু’জনকে মুম্বইয়ের তাজ হোটেলের ঘরে টেবিলের উপরে দাঁড় করিয়ে এক হাতে তন্দুরি চিকেন, অন্য হাতে ব্র্যান্ডি ধরিয়ে দিলেন বোথাম। এতে নাকি সিদ্ধিলাভ হবে দু’জনের! সারা রাত ধরে এমনই অভিযান চলল যে, পরের দিন সাংবাদিক মহাশয়ের আর ওয়াংখেড়েতে যাওয়ার অবস্থা নেই। বোথাম? তিনি কোথায়? ম্যাচের কী অবস্থা? বেলার দিকে হুঁশ ফেরা সাংবাদিক জানার চেষ্টা করছেন। টিভি খুলে দেখলেন, গাওস্কর, বিশ্বনাথ, বেঙ্গসরকর, পাটিল, কপিলদের ভারতীয় দল দ্বিতীয় ইনিংসে অল আউট ১৫৯। ইংল্যান্ড জেতার মুখে। কোনও এক ইংরেজ বোলার ২৬ ওভারে ৪৮ রান দিয়ে সাত উইকেট নিয়েছেন। কে তিনি? সাংবাদিক চোখ কচলে দেখলেন। ইয়ান বোথাম! সারা রাত হুল্লোড় চালিয়ে লোকটা ২৬ ওভার বল করল কী করে?
প্রশ্ন জাগে, এখনকার মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিমে পড়ে থাকা বা অত্যাধুনিক ট্রেনিং প্রক্রিয়া না থাকলেও ফিটনেসে কোথায় পিছিয়ে ছিলেন ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিংরা? অথবা বোথাম স্বয়ং? ব্যাটিং, বোলিংয়ে মণিমুক্তো তো ছিলই, সঙ্গে স্লিপে কী অবিশ্বাস্য সব ক্যাচ নিয়েছেন বোথাম! কী ভাবে জিমে সময় না কাটিয়েও হরিণের মতো দৌড়ে আসতেন মাইকেল হোল্ডিং? কী ভাবে অত জোরে বল করতেন? প্রয়াত বব উলমারের বইয়ে হোল্ডিংকে খেলার অসাধারণ বর্ণনা পাওয়া যায়। উলমার লিখছেন, ‘‘প্রথম বলটাই এসে লাগল আমার প্যাডে। তখনকার দিনে আমি সব চেয়ে আধুনিক প্যাড পরতাম। পায়ে কোনও ফাস্ট বোলারের বল লাগার পরে কিছু মালুম হওয়ার কথা নয়। হোল্ডিংয়ের বলটা লাগার পরে বুঝেছিলাম, কতটা ভুল ধারণা ছিল আমার। মনে হল, কেউ যেন পায়ে গুলি করেছে। নড়তে পর্যন্ত পারছি না। আম্পায়ার ছিলেন ডিকি বার্ড। যিনি খুব একটা এলবিডব্লিউ আউট দিতেন না। কিন্তু আমি জানতাম, এ ক্ষেত্রে একটুও না ভেবে আঙুল তুলবেন ডিকি। যদি ওটা এলবিডব্লিউ না হয়, কোনটা হবে!’’
আর ক্রিকেটের গুণগত মান? আশির দশকে সাবাইনা পার্কে রবার্টস, হোল্ডিং, মার্শাল, গার্নারের সামনে খালি মাথায় ব্যাট করতে যাওয়া মানে বাঘের খাঁচায় শুধু লাঠি হাতে ঢুকে পড়ার মতো ব্যাপার ছিল। এখন আর সে সব ঝক্কি কোথায় নিতে হয় এ যুগের ব্যাটসম্যানদের? নিউজ়িল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটার জেরেমি কোনি দারুণ গল্প শুনিয়েছিলেন। সাবাইনা পার্কে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই হাত ভাঙল কোনির। সেটা এমন কোনও বড় ব্যাপার নয়, কারণ তখন সাবাইনা পার্কে খেলা মানে আশেপাশের দু’তিনটি হাসপাতালে রেড অ্যালার্ট জারি হয়েই থাকত। কোনিকেও কাছের এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে তাঁর দেখাশোনার জন্য এল এক কিশোর। ডাক্তার দেখে গিয়েছেন। কিশোর বলল, সেরে উঠলে আপনার অটোগ্রাফ নেব। কোনি রাজি। কিশোর এ বার অটোগ্রাফ খাতা এনে দেখাল। তাতে ইতিমধ্যেই প্রচুর সই। বেশির ভাগই নামী ব্যাটসম্যান। কোনি মুগ্ধ। এতটুকু ছেলে হাসপাতালে সারা দিনরাত কাজ করে আবার মাঠে গিয়ে খেলাও দেখে! অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে! সত্যিই ক্রিকেট নেশাতুর! উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন, এত কাজের মধ্যে তুমি মাঠে যাওয়ার সময় পাও কী ভাবে? কিশোরের নির্লিপ্ত জবাব, ‘‘আমি কোথাও যেতে পারি না স্যর। গত দু’তিন বছরে আসলে এঁরা প্রত্যেকেই আমাদের হাসপাতাল ঘুরে গিয়েছেন। তখনই অটোগ্রাফ নিয়েছি। আপনারটাও নিয়ে রাখব!’’
ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের গতির আগুন তাড়া করেছিল ফিদেল কাস্ত্রোকেও। ১৯৯৮-এ বার্বেডোজ় সফরে গিয়েছেন কাস্ত্রো। তখন বয়স ৭১। ব্রিজটাউন থেকে কিছুটা দূরের পেন্স বে-তে বাইশ বছর আগে এয়ার কিউবানা ফ্লাইটে বোমাবর্ষণে নিহতদের স্মরণে একটি মেমোরিয়াল উদ্বোধন করবেন। যাওয়ার পথে হঠাৎ দেখলেন, ব্যাট-বল নিয়ে কারা সব খেলছে। দ্রুত কনভয় ঘুরিয়ে দিতে হল সে দিকে। কাস্ত্রো খেলতে চান। বার্বেডোজের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন আর্থারকে বললেন, ‘‘বোলিং করো!’’ নিরাপত্তারক্ষীদের তখন নাজেহাল অবস্থা! সেখানেও বার্বেডোজ প্রধানমন্ত্রী অতিথিকে স্বাগত জানালেন পর-পর বাউন্সার দিয়ে। কাস্ত্রোর বেসবল খেলার অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু বাউন্সার-বৃষ্টির সামনে পড়েননি কখনও। বললেন, ‘‘এটা কী হচ্ছে? বুকের উচ্চতায় বল দাও।’’ আর্থার তাঁর অনুরোধ রাখতেই পরের বল তিনি উড়িয়ে দিলেন বাউন্ডারির বাইরে! বরাবরের সেই ফিদেল কাস্ত্রো! খেলবেন, কিন্তু নিজের শর্তে!
টেস্ট ক্রিকেট রক্ষা পাবে কি না, তা নিয়ে তোলপাড় চলছে ক্রিকেট বিশ্বে। নতুন কিছু অবশ্য নয়। ১৯০৬ সালেও এমন ঝড় উঠেছিল। যখন ইংল্যান্ডে অ্যাশেজ দেখতে কোনও মাঠেই লোক হচ্ছিল না। ওভাল খালি। ওল্ড ট্র্যাফোর্ড খালি। ‘অবজ়ার্ভার’ সেই সময়েই বিশেষ সম্পাদকীয় স্তম্ভে লেখে, ক্রিকেটের আমূল সংস্কার প্রয়োজন। এমসিসি জরুরি বৈঠক ডাকে, ওভার-প্রতি বলের সংখ্যা পাল্টে যায়, এমনকি টস তুলে দেওয়ার প্রস্তাবও ওঠে। ডব্লিউ জি গ্রেস ১৯০৬ সালেই বলেছিলেন, কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে দু’টি ডিভিশন করে দেওয়া হোক। এক শতাব্দী কেটে যাওয়ার পরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে এখন দু’ভাগে ভাগ করার কথা উঠছে।
টেস্ট ক্রিকেটকে চার দিনের করে দেওয়ার নতুন প্রস্তাব নিয়েও এক পক্ষ সর্বনাশ হয়ে গেল বলে লাফিয়ে পড়েছে। ঘটনা হচ্ছে, এর আগেও চার দিনের টেস্ট হয়েছে। ক্রিকেটের ইতিহাসে পাঁচ দিনের টেস্ট হয়েছে সব চেয়ে বেশি। দু’হাজারের কাছাকাছি। চার দিনের টেস্ট হয়েছে ১৩৩টি। তিন দিনের টেস্টের সংখ্যাও নেহাত কম নয়— ১২১টি। ছ’দিনের টেস্টও অনেক হয়েছে, যেখানে একটা দিন ‘রেস্ট ডে’ থাকত। একটা সময়ে ‘টাইমলেস’ টেস্ট হত। যত ক্ষণ না ফয়সালা হচ্ছে, খেলে যাও। মোট ১০০টি টেস্টের সন্ধান পাওয়া যায়, যার কোনও সময়সীমা বাঁধা ছিল না। ১৯৩৮-এর ওভালে লেন হাটন-এর স্মরণীয় ৩৬৪ ছিল ‘টাইমলেস’ টেস্টে। কত বল খেলেছিলেন হাটন? ৮৪৭! ডন ব্র্যাডম্যানও অনেক ‘টাইমলেস’ টেস্টে অংশ নিয়েছেন। ডন টেস্ট ক্রিকেটে এক দিনে তিনশো করতে পারতেন, সেটা অন্য ব্যাপার। ১৯৩৯-এ দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট দশ দিনের বেশি চলার পরে বাধ্য হয়ে বন্ধ করতে হয়। কারণ কী? না, ইংল্যান্ড দলকে জাহাজ ধরতে হবে। আর খেললে জাহাজ ছেড়ে চলে যাবে।
জাহাজ থেকে উড়োজাহাজে উত্তরণ ঘটেছে ক্রিকেটের। আগে এক ঘরে দু’জন করে থাকতে হত, এখনকার ক্রিকেটারেরা প্রত্যেকে সিঙ্গল রুম পান। চেন্নাইয়ে মাউন্ট রোডে এ রকমই ডর্মিটরির বেড ভাগাভাগি করে শুতে হত দুই কিশোরকে। এক জন রাতে ভূতের ভয় পেত। অন্য জন মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে উঠে সারা ঘর পায়চারি করত। তাদের বিয়েটা হওয়ারই কথা নয়। অথচ, পনেরো বছর বয়স থেকে শুরু করে মধ্য তিরিশ পর্যন্ত চলল মধুচন্দ্রিমা। ওয়ান ডে ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ওপেনিং জুটি হয়ে থাকল তারা। ভূতের ভয় পাওয়া কিশোর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। মাঝরাতে উঠে হাঁটা ছেলেটি, সচিন তেন্ডুলকর। আর চেন্নাইয়ের মাউন্ট রোডে তারা গিয়ে উঠেছিল কি না ডেনিস লিলির অধীনে ফাস্ট বোলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে!
বিবর্তন হয়েছে ক্রিকেটের। পাশাপাশি ঘটেছে বিপ্লব। সবচেয়ে বড় বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন কেরি প্যাকার। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে টেলিভিশন চুক্তি না-পেয়ে ক্ষুব্ধ প্যাকার বিশ্বের সব দেশের তারকা ক্রিকেটারদের মোটা টাকা দিয়ে সই করিয়ে চালু করেছিলেন ওয়ার্ল্ড সিরিজ় ক্রিকেট। তাঁর হাত ধরেই ক্রিকেটে আসে নৈশালোকের অভিনবত্ব, রঙিন পোশাক এবং হেলমেট। এক ব্যাটসম্যানের হাতে হেলমেট তুলে দিয়ে প্যাকার বলেছিলেন, ‘‘দর্শক মাঠে আসে তোমাদের ব্যাটিং দেখতে, বাউন্সারে আঘাত পেয়ে হাসপাতালে যাওয়া দেখতে নয়। হেলমেট পরো। খেলাটা দর্শকদের জন্য।’’ তখন তাঁর ক্রিকেটের নামকরণ হয় ‘প্যাকার সার্কাস’। পরে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় অভিনবত্ব। প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ় ক্রিকেটের আগে ইংল্যান্ডের মতো দেশের ক্রিকেটারও টেস্ট প্রতি পেতেন ২১০ পাউন্ড। ওয়ার্ল্ড সিরিজ় ক্রিকেট চালু হওয়ার পর রাতারাতি তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০০০ পাউন্ডে।
প্যাকার ভেবেছিলেন কত আগে, সেই ১৯৭৭ সালে! আর তাঁরও আগে আর এক জন ধরতে পেরেছিলেন। ১৯৭১-এ অ্যাশেজে ব্রিসবেন, পার্থে বিরক্তিকর ড্রয়ের পরে তৃতীয় টেস্ট বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল। মেলবোর্নে চতুর্থ টেস্টে প্রথম দু’দিনও নষ্ট হল বৃষ্টিতে। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ডের ২৫,০০০ পাউন্ড লোকসান হয়ে গিয়েছে। তৃতীয় দিনেও যখন একটি বলও হল না, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত এক ভদ্রলোক মেলবোর্নের প্রেস বক্সের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসে সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণা করলেন, ‘‘এই টেস্টও পরিত্যক্ত হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। দর্শকদের কথা ভেবে দু’দলের মধ্যে একটি ওয়ান ডে ম্যাচ করার কথা আমরা ভেবেছি।’’ সরকারি ভাবে সেটাই হয়ে থাকল প্রথম এক দিনের ম্যাচ। তখন কে ভাবতে পেরেছিল, এক দিন সোনার রাজহাঁস হয়ে উঠবে এই ওয়ান ডে ক্রিকেটই!
সেই এক দিনের ম্যাচ দেখতে মেলবোর্নে ৪৬ হাজার লোক এসেছিল। গোটা সিরিজ মিলিয়ে যে জমায়েত দেখা যায়নি। আর মেলবোর্ন মাঠের সিঁড়ি বেয়ে প্রেস বক্সে উঠে আসা সেই ভদ্রলোক? অল্পস্বল্প ক্রিকেট খেলেছেন— স্যর ডন ব্র্যাডম্যান! টেস্ট ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা কিংবদন্তির হাতে আচমকা জন্ম নেওয়া ‘ওয়ান ডে শিশু’ দ্রুত ক্রিকেট সূচির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠল। পরের বছর, ১৯৭১ সালে যখন অস্ট্রেলিয়া দল গেল ইংল্যান্ডে, ষষ্ঠ টেস্ট আর রাখা হল না। তার জায়গায় স্থান পেল তিনটি ওয়ান ডে ম্যাচ। ১৯৭৫-এ হল প্রথম বিশ্বকাপ। মেলবোর্নে হঠাৎ করে আয়োজিত সেই প্রথম স্বীকৃত ওয়ান ডে ম্যাচের অধিনায়ক বিল লরি পরে বলেছিলেন, ‘‘আমার মনে হয়, ব্র্যাডম্যান ওয়ান ডে ম্যাচটা করার কথা ভেবেছিলেন, স্রেফ পয়সা তোলার কথা ভেবে। ওই ব্যাপারটা উনি খুব ভাল বুঝতেন!’’
বুদ্ধিমান প্যাকার ক্রিকেটের ভাষা পাল্টে দিয়ে গিয়েছেন। বিচক্ষণ ডন ব্র্যাডম্যান সময়ের ডাক বুঝতে দেরি করেননি। বিবর্তন হতে থাকবে। এগিয়ে চলবে ক্রিকেট। আইপিএল জমানায় রাজ করবে ডিজে। হোল্ডিং, বোথামদের মতো বিরল প্রতিভা হয়তো কমে এসেছে। সাবাইনা পার্কে আর বাজে না ব্যাটসম্যানের মৃত্যুঘণ্টা। বাণিজ্যের ধাক্কায় বিদ্ধ আজ ক্রিকেট-রোম্যান্স। তবু চলবে ক্রিকেট। শুধু গ্যালারির ট্রানজিস্টর থেকে আর ভেসে আসবে না মুকেশের গান। হারিয়ে যাওয়া গানের কলি, ‘হম উস দেশ কে বাসী হ্যায়, জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায়’!