তিনি যখন যেমন চান, তখন তেমন হন। কখনও লাল, কখনও নীল, কখনও কালো— তিনি বিচিত্র বর্ণময়ী।
Durga Puja 2021

Durga Puja 2021: বহুবর্ণেন সংস্থিতা

দেবী দুর্গা বিশ্বময়ী। তাঁর নির্দিষ্ট রূপ নেই, রং নেই। তাঁর এক-এক রঙের পিছনে আছে আশ্চর্য কাহিনি।

Advertisement

দেবযানী বসু

শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২১ ০৮:৩৭
Share:

বেলেঘাটার কৃষ্ণবর্ণ দুর্গা এবং নবদ্বীপের যোগনাথতলার রক্তবর্ণ দুর্গা। নিজস্ব চিত্র।

অতি প্রাচীন যুগ থেকে ভারতে দেবীশক্তির আরাধনা শুরু। তাই দেবীমূর্তির ইতিহাসও বহু প্রাচীন। আজ যে মহাশক্তির মহিষাসুরমর্দিনী রূপ আমরা দেখি, তার আবির্ভাব অনেক পরে, পৌরাণিক যুগে। তখন দেবী ছিলেন বাসন্তী দুর্গা। পরে শরৎকালে তাঁর অকালবোধন হয়। নানা রূপে তাঁর পুজো হয়। কোথাও তাঁর দশ হাত, কোথাও আঠেরো, কোথাও চার। কোথাও তিনি শিবের কোলে আসীন, দ্বিভুজা, সিংহ বা অসুর নেই। দুর্গার ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী, দেবী তপ্তকাঞ্চনবর্ণা বা অতসীপুষ্পবর্ণা। কিন্তু বহু জায়গায় তাঁর গায়ের রঙেও এসেছে বৈচিত্র।

Advertisement

অর্ধকালী দুর্গা, সুভাষগ্রাম

দেবী দুর্গা ও দেবী কালী, শক্তির দুই রূপ। মায়ের এই দুই রূপই এক বিগ্রহে পূজিতা হয়ে আসছে বাংলার দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষগ্রামের দুর্গাবাড়িতে। শারদলক্ষ্মী এখানে অর্ধকালী-অর্ধদুর্গা। ১৫৮ বছরের প্রাচীন এই পুজোর পিছনে রয়েছে একটি আশ্চর্য ইতিহাস। সময়টা ১৮৬৪ সাল। স্থান, পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার বিক্রমপুর। সেখানকার মেদিনীমণ্ডলের দারোগা হরিকিশোর ঘোষ এক রাতে স্বপ্নাদেশ পেলেন জগজ্জননী মায়ের। পরদিন থেকে শুরু হল পুজোর তোড়জোড়। শুভ তিথিতে সূচনা হল প্রতিমা নির্মাণ। চিন্ময়ী দেবী রূপ পেতে লাগলেন মৃন্ময়ী প্রতিমায়। কিন্তু শেষ পর্যায়ে পটুয়ারা হলুদ রং করতেই মূর্তির ডান দিকের অংশে রং বদলে যায় কালোতে। এই সঙ্কটের মুহূর্তে কুলপুরোহিত উপদেশ দিলেন দেবীকে অর্ধকালী-অর্ধদুর্গা রূপ দিতে। সেই থেকে আজও দেবী এই নতুন রূপে সুভাষগ্রামের ঘোষদের বসতবাটীতে আসেন। দেশভাগের পর ঘোষ বংশের উত্তরপুরুষরা চলে এসেছেন এপার বাংলায়, সঙ্গে এনেছেন পূজার কিছু বাসনপত্র ও বলিদানের খড়্গ। এনেছেন ওপার বাংলার পুজোবেদির এক মুঠো মাটি, যা মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এখনকার পুজোর দালানের মাটিতে। দুর্গাপুজোর ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি কখনও।

Advertisement

একচালার প্রতিমা ঠিক মাঝ বরাবর চুলচেরা ভাগ— এক দিকে অমানিশারূপী দেবী কালিকা এবং অন্য দিকে তপ্তকাঞ্চনবর্ণা দেবী দুর্গা। দশভুজা দেবীর ডান পা সিংহের পিঠে আর বাম পা অসুরের কাঁধে। মহিষাসুর দেবী কালিকার হাতের শূলে বিদ্ধ। ডান দিকে লক্ষ্মী এবং কার্তিক, বাম দিকে সরস্বতী এবং গণেশ, একটু অন্য রকম এঁদের অবস্থিতি। বিশেষ এই রূপের মতো পুজোর আচার-বিধিও একটু আলাদা। বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ মতে পুজো হয়। ভাদ্র মাসের শুক্লা সপ্তমী, অর্থাৎ ললিতাসপ্তমী তিথিতে হয় কাঠামোপুজো। বরাবর ঠাকুরদালানেই প্রতিমা তৈরি হয়। সপ্তমীর সকালে চক্ষুদান ও প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর হয় মহাস্নান। দর্পণে প্রতিফলিত দেবীর প্রতিবিম্বকে স্নান করানোর রীতি এখানে। মহাস্নানের জন্য তিন সমুদ্রের জল, গঙ্গার জল, দুধ, শিশির, মধু ইত্যাদি ১০৮ রকমের জল প্রয়োজন হয়। পুজোর তিন দিনই একটি করে আখ, চালকুমড়ো বলি হয়। নবমীর দিন হয় শত্রুবলি— চালের পিটুলি দিয়ে মানুষের আকৃতি গড়ে কচুপাতায় মুড়ে বলি হয়। এটি ষড়রিপু নাশের প্রতীকী অনুষ্ঠান। অন্নভোগ দেওয়ার রীতি নেই, পরিবর্তে সাড়ে বারো কেজি কাঁচা চালের নৈবেদ্য হয়। দশমীর দিন বিদায়ের আগে মেয়েকে একেবারে গ্রামবাংলার নিজস্ব আহার্য দেওয়া হয়। সেই নৈবেদ্যে থাকে বোরোধানের চাল, কচুর লতি, শালুক, শাপলা, শাক, আমড়া। দশমীর সকালে দর্পণ বিসর্জন হয়।

রক্তবর্ণ দুর্গা, নবদ্বীপ

সাড়ে তিনশো বছরের বেশি পুরনো রক্তবর্ণ দুর্গাপ্রতিমার পুজো হয়ে আসছে নবদ্বীপের যোগনাথতলার ভট্টাচার্য পরিবারে। এঁদের আদি নিবাস পূর্ববঙ্গের ঢাকার মিতরায় গ্রামে। আগে এরা অতসীবর্ণা দুর্গারই আরাধনা করতেন। এক বার বংশের আদিপুরুষ রাঘবরাম ভট্টাচার্য চণ্ডীপাঠ করছিলেন। হঠাৎ বিঘ্ন ঘটে, পুত্র রামেশ্বর পিতার মন্ত্র উচ্চারণের ভুল ধরিয়ে দেন সর্বসমক্ষে। একটি মতানুসারে, এর ফলে দেবী বিশেষ আনন্দিত হন এবং কাঠামো সমেত ঘুরে গিয়ে পশ্চিমমুখী অর্থাৎ রামেশ্বরের মুখোমুখি হন। আনন্দে তাঁর মুখের বর্ণ হয়ে ওঠে লাল। আবার অন্য মতে, পুত্রের আচরণে ক্ষুব্ধ পিতা পুত্রকে মৃত্যুর অভিশাপ দেন। তখনই রাগে ও অপমানে দেবী রক্তবর্ণ ধারণ করেন। পিতার অভিশাপে দশমীর দিনই রামেশ্বরের মৃত্যু হয়। সেই থেকে এই পরিবারে লাল দুর্গারই পুজো হয়। দেবীকে পশ্চিমমুখীই রাখা হয় এবং চণ্ডীপাঠ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। ভট্টাচার্য পরিবার বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছেন একশো বছর আগে। নবমীতে দেবীর ভোগে থোড় ও বোয়াল মাছ দেওয়ার প্রাচীন প্রথা চলে আসছে নিয়মনিষ্ঠা মেনে।

কৃষ্ণবর্ণ দুর্গা, ক্যানিং‌

বাংলাদেশের ঢাকা-বিক্রমপুরের বানিখাড়া গ্রাম। জমিদার রামরাজা ভট্টাচার্যের বাড়িতে মহা সমারোহে দুর্গাপুজো হচ্ছে। মুহূর্তের অসতর্কতায় ঘটে চরম দুর্ঘটনা। প্রদীপ থেকে আগুন ধরে যায় শনের ছাউনি দেওয়া দুর্গামণ্ডপে, ভস্মীভূত হয় গোটা মণ্ডপ। পুড়ে কালো হয়ে যায় প্রতিমা। এ অবস্থায় ভট্টাচার্য পরিবার পুজো নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। তখনই স্বপ্নাদেশ পান, দেবীর বাসন্তী রং নয়, গাত্রবর্ণ তাম্রাভ আর মুখ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ— এমন বিচিত্র রূপেই পুজো করতে হবে দুর্গার। দেশভাগের পর ভট্টাচার্য পরিবার চলে এসেছে পশ্চিম বাংলার ক্যানিং-এ। কিন্তু ৪২৮ বছর ধরে চলা কৃষ্ণবর্ণের দুর্গাপুজোর ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি কখনও। মূর্তি তৈরির পর পোটোদের এই প্রতিমার মুখ দেখা নিষিদ্ধ। এক বার এক জন কুমোর জোর করে দেবীর মুখ দেখায় তাঁর বাক্শক্তি চলে যায়। সেই থেকে কোনও পোটো কখনও পুজোর সময় প্রতিমা দর্শন করেন না। এই দুর্গাপুজো নিয়ে শোনা যায় নানা অলৌকিক ঘটনা।

কৃষ্ণবর্ণ দুর্গা, বেলেঘাটা

শোনা যায়, হিমালয়ের পাদদেশের কোথাও কোথাও নাকি কৃষ্ণবর্ণের অতসীপুষ্পও ফোটে, যা অতি দুষ্প্রাপ্য। দেবীর হয়তো কখনও সাধ জেগেছিল এমন কৃষ্ণবর্ণা রূপে আবির্ভূতা হতে। তাই তিনি কাউকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন, কারও হাত দিয়ে বিশেষ পুঁথি পাঠিয়েছিলেন পূজার মূল উপকরণ হিসেবে।

পূজার ইতিহাস ২৮৯ বছরের পুরনো। ওপার বাংলার হরিদেব ভট্টাচার্য ছিলেন পাবনা জেলার স্থলবসন্তপুরের জমিদার। জমিদারবাড়িতেই কৃষ্ণবর্ণা মা দুর্গার আবির্ভাব ঘটে প্রথম। নাটোরের রানি ভবানী হরিদেব ভট্টাচার্যকে স্থলবসন্তপুরের জমি-জায়গা প্রদান করেন। রানি ভবানীর আমলেই দুর্গাপুজো শুরু হল। কারণ কৃষ্ণবর্ণা মা বার বার স্বপ্নে দেখা দিচ্ছেন হরিদেবকে। কিন্তু মায়ের এই বিচিত্র কৃষ্ণবর্ণ কেন? উত্তর খুঁজতে ভাটপাড়া, কাশীর পণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। কিন্তু কোনও মতই মনঃপূত হল না তাঁর। এক দিন আনমনা হয়ে কাশীর গঙ্গার ঘাটে বসে আছেন, এক সাধু এসে বিষণ্ণতার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। সব শুনে সেই সাধু মাকে ভদ্রকালীরূপে পুজো করতে বললেন। দিলেন তালপত্রে লেখা এক প্রাচীন পুঁথি, যা অনুসরণ করে আজও পুজো হয় দেবীর।

দেশভাগের পর এপার বাংলার বেলেঘাটায় চলে এসে ভট্টাচার্য পরিবার পুজো করে আসছে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে। শাক্তমতে পুজো হয়। আগে বলিদান প্রথা থাকলেও এখন সেই প্রথা বন্ধ। চালকুমড়ো বলি হয় নবমী ও সন্ধিপুজোতে। সকালে নিরামিষ আর রাতে আমিষ ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। সন্ধিপুজোয় থাকে মাছভাজা, দশমীতে পান্তাভাত, দই, কলা।

নীলদুর্গা, কৃষ্ণনগর

আজকের কৃষ্ণনগর নাজিরাপাড়ার চট্টোপাধ্যায় বাড়ির আদি বাসস্থান পূর্ব বাংলা। রথের দিনে কাঠামো পুজো করে প্রতিমা নির্মাণ শুরু হয়। মা দুর্গার গায়ের রং অপরাজিতা ফুলের মতো নীল। অনেক বছর আগে কুপির আলোয় মূর্তি গড়তে গড়তে পটুয়ারা ভুলে দুর্গাকে নীল রং করে ফেলে। কী ভাবে ঠিক হবে রং ভাবতে ভাবতেই দেবীর স্বপ্নাদেশ— নীলমূর্তিই পুজো হবে এ ভিটেতে। সেই থেকে নীলদুর্গা মূর্তিতেই মা পূজিতা হচ্ছেন চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে। বর্তমানে শরিকি ভাগে দু’টি আলাদা পুজো হলেও নিয়ম একই।

১৯৪৯ সাল থেকে কৃষ্ণনগরে পুজো শুরু হলেও এ পুজোর সূচনা বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বামরাইল গ্রাম। ২৫০ বছরের বেশি সময় ধরে পুজো চলে আসছিল, এরই মধ্যে কোনও এক বছর নীলদুর্গার আবির্ভাব। দেশভাগের সময় চট্টোপাধ্যায় পরিবার এপারে এসে বসতি স্থাপন করেন কৃষ্ণনগরে। রথের দিন কাঠামো পুজোর নিয়ম থাকলেও শনি-মঙ্গলবার পড়ে গেলে উল্টোরথের দিন কাঠামো পুজো হয়। একচালার অনিন্দ্যসুন্দর প্রতিমা। নীলমূর্তির গায়ে লাল শাড়ি, জরির সাজ। অনেকের মতো পূর্ববঙ্গীয় রীতি অনুযায়ী এখানেও কার্তিক ডান দিকে এবং গণপতি দেবীর বাম দিকে। পুজো হয় তন্ত্রমতে। অষ্টমীতে কুমারীপুজো হয়। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বামরাইলে এক সময় নরবলি হত। আজও বলির প্রতীক স্বরূপ চালের পিটুলি দিয়ে মানুষ গড়ে বলি হয়। নবমীতে কুমড়ো, শশা বলি হয়। অন্নভোগের সঙ্গে থাকে মাছ। নবমীতে দেওয়া হয় সরলপিঠে, কলার বড়া ইত্যাদি। দশমীর বিদায়বেলায় মাকে দেওয়া হয় পান্তাভাত, কচু শাক, ডালের বড়া, সঙ্গে গন্ধলেবু।

নীলদুর্গা, দক্ষিণ কলকাতা

দক্ষিণ কলকাতার ঘোষরায় পরিবারের নীলদুর্গা-য় অনেকটা যেন শ্যামা মায়ের আদল। ১৮২৭ সালে পূর্ববঙ্গের বরিশাল জেলার নরোত্তমপুরের বাসিন্দা ছিলেন কালীমোহন ঘোষরায়। তাঁর স্ত্রী সারদা দেবী এমনই স্বপ্ন দেখেন। দেবী দুর্গা আর দেবী কালিকা যেন একসঙ্গে আসেন তার স্বপ্নে। তখন আর মাত্র সাত দিন বাকি পুজোর, তড়িঘড়ি আয়োজন করা হয়। দুই দেবীর মেলবন্ধনে তৈরি হয় দেবীপ্রতিমা, যাঁর অবয়ব দুর্গার কিন্তু গাত্রবর্ণ শ্যামাকালীর। এখানেও কার্তিক-গণেশের অবস্থান বিপরীত। অর্ধগোলাকৃতি চালচিত্রে আঁকা থাকে রামায়ণ। পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসার পর ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত টালিগঞ্জে প্রতাপাদিত্য প্লেসে পুজো হয়েছে। ১৯৭৭ সাল থেকে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে মা আসেন প্রতিবছর। দেবীপুরাণ অনুযায়ী শাক্তমতে পুজো হয়। ভোগে দেওয়া হয় কাঁচা মাছ, কাঁচা আনাজ এবং নানা ধরনের মিষ্টান্ন।

নানা কারণে নানা ভাবে তিনি ধারণ করেছেন ইচ্ছেমতো রং। হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন মায়ের কোনও রং হয় না, তাই সব রঙেই তিনি সমান। রং মানুষেরও হয় না। আমরাই অন্ধের মতো বর্ণবিভাজন করে মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব তৈরি করি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement