পরমহংস: বেলুড় মঠে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথিতে তাঁর অর্চনা করছেন সন্ন্যাসীরা ।
আমার মা মূর্তিমতী সরলতাস্বরূপা ছিলেন। সংসারের কোনও বিষয় বুঝতেন না। টাকাপয়সা গুনতে জানতেন না। কারোকে কোনও বিষয় বলতে নেই, তা না জানাতে নিজের পেটের কথা সকলের কাছে বলে ফেলতেন, সেজন্য লোকে তাঁকে ‘হাউড়ো’ বলত এবং তিনি সকলকে খাওয়াতে বড় ভালবাসতেন”— নিজের গর্ভধারিণী মাকে এই ভাবেই ভক্ত-শিষ্যদের কাছে তুলে ধরেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে যখন দক্ষিণেশ্বরে ভক্তদের আগমন ঘটছে, তখন তাঁর জননী আর ইহলোকে ছিলেন না। কিন্তু বহু জনের মঙ্গলের জন্য রেখে গিয়েছিলেন পৃথিবীর এক অসীম আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন দার্শনিক এবং মানবপ্রেমী মহামানবকে।
চলতি বছরে ১৮৬ পূর্ণ করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। পরাধীন বঙ্গদেশের অজ পাড়াগাঁয়ে, এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের ঘরে সেই যে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন, ১৮৬ বছর পেরিয়েও তিনি লক্ষ লক্ষ নরনারীর হৃদয়ে প্রেরণাশক্তি হয়ে আছেন। স্বামীজির কাছে তিনি ‘স্পিরিচুয়াল জায়ান্ট’, রোমাঁ রোলাঁর কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন এক অমৃতভাণ্ড। সেই অমৃতভাণ্ডকে যিনি গর্ভে ধারণ করেছিলেন, তিনিও তাঁর বরেণ্য পুত্রের মতোই পূজনীয়া। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণজননী চন্দ্রমণি দেবী।
চন্দ্রমণি দেবীর জন্ম হুগলির সরাটি-মায়াপুর গ্রামে, ইংরেজি ১৭৯১ সালে। পণ্ডিত নন্দকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং হরবিলাসিনী দেবীর তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম ছিলেন চন্দ্রমণি। ডাকনাম চন্দ্রা। তিনি ছিলেন সুশ্রী, স্বাস্থ্যবতী এবং দীর্ঘাঙ্গী। চন্দ্রমণির পিতৃকুলে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের চর্চা ছিল, যা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন চন্দ্রমণি এবং তাঁর একমাত্র ভাই আয়ুর্বেদ চিকিৎসক কৃষ্ণমোহন। চন্দ্রমণি অনেক রকম কবিরাজি ওষুধ এবং পথ্য জানতেন। তাঁর ভিক্ষাপুত্র কবিয়াল রামনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ম্যালেরিয়া থেকে এবং এক নামজাদা চিকিৎসককে বিস্মিত করে জনৈক জমিদারের নাতিকে টাইফয়েড থেকে বাঁচিয়ে তোলেন চন্দ্রমণি। কামারপুকুরের পাইন বংশ যখন ছোঁয়াচে মারণব্যাধিতে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, ভয়ে গ্রামবাসীরা পাইনবাড়ির ছায়া মাড়াচ্ছে না, তখন চন্দ্রমণি কারও নিষেধ না মেনে পাইনবাড়িতে গিয়ে সেবাশুশ্রূষা করে পরিবারটিকে সুস্থ করে তুলেছিলেন। সরল, মিষ্টভাষী, ভক্তিমতী চন্দ্রমণি ছিলেন সকলের প্রিয়, গৃহকর্মে নিপুণা এবং রান্নায় সিদ্ধহস্ত। সে যুগে কামারপুকুরের পাশ দিয়ে ছিল পুরী যাওয়ার রাস্তা। গ্রামের পান্থশালায় আশ্রয় নেওয়া শ্রীক্ষেত্রযাত্রী সাধু, ভক্তদের রেঁধে খাইয়ে চন্দ্রমণি বড় আনন্দ পেতেন।
সেকালের রীতি অনুযায়ী মাত্র আট বছর বয়সে চন্দ্রাদেবীর বিবাহ হয় দেরেপুর গ্রামের পঁচিশ বছরের যুবক ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ক্ষুদিরামের প্রথমা পত্নী অল্প বয়সে দেহত্যাগ করেন। এটি তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ। ক্ষুদিরাম ছিলেন অত্যন্ত সৎ, সত্যনিষ্ঠ, ধার্মিক ব্রাহ্মণ। গ্রামবাসীরা তাঁকে দেবতার চোখে দেখতেন। পিতামাতার মহৎ গুণাবলি কালক্রমে তাঁদের বরণীয় পুত্রের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। দেরেপুরের দুষ্ট জমিদার রামানন্দ রায়ের পক্ষ নিয়ে মিথ্যা সাক্ষী দিতে রাজি হননি সত্যনিষ্ঠ ক্ষুদিরাম। তাই জমিদারের রোষে পড়ে তাঁকে সপরিবার দেরেপুর ছেড়ে কামারপুকুরে চলে আসতে হয়। চন্দ্রমণির দুই সন্তান রামকুমার ও কাত্যায়নী দেরেগ্রামে ভূমিষ্ঠ হন। কামারপুকুরে জন্মগ্রহণ করেন রামেশ্বর, গদাধর এবং সর্বমঙ্গলা। কথিত আছে, গয়াতীর্থে ক্ষুদিরাম স্বপ্নাদেশ পান স্বয়ং ঈশ্বর পুত্ররূপে তাঁর ঘরে আসছেন। অন্য দিকে কামারপুকুরে যুগীদের শিবমন্দিরের শিবলিঙ্গ থেকে এক আশ্চর্য জ্যোতি প্রকাশিত হয়ে চন্দ্রাদেবীর দেহে প্রবেশ করে। ব্রাহ্মণ দম্পতি নিশ্চিত হন, এ সবই কোনও মহাপুরুষের আগমনবার্তা। শ্রীরামকৃষ্ণ যখন তাঁর গর্ভে, তখন দেব-দেবীদের সাক্ষাৎ দর্শন পেতেন চন্দ্রমণি। জানা যায়, হাঁসের পিঠে চড়া রক্তবর্ণ ব্রহ্মাকে দেখে চিনতে না পেরে চন্দ্রমণি ভাবেন, রোদে পুড়ে দেবতাটি লাল হয়ে গিয়েছে। পান্তাভাত খেয়ে ব্রহ্মাকে জিরিয়ে নিতে অনুরোধ করেছিলেন চন্দ্রমণি। ১৮৩৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, ফাল্গুন মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে বাড়ির ঢেঁকিশালে ভূমিষ্ঠ হন চন্দ্রমণির কনিষ্ঠ পুত্র গদাধর।
শৈশবকাল থেকেই চন্দ্রমণির প্রাণাধিক প্রিয় গদাইয়ের দেবস্বভাবের পরিচয় নানা ভাবে প্রকাশিত হত। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রামাণ্য সব জীবনীগ্রন্থে এমন বহু ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। চন্দ্রমণি তাঁর সরল, ভাবুক, খেয়ালি ছেলেকে নিয়ে সর্বক্ষণ উদ্বিগ্ন থাকতেন। গ্রামের সকলে বালক গদাধরের অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি ও অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে বিস্মিত, উল্লসিত। দেবদেবীর মূর্তি দেখে গদাধরের তন্ময় ভাব, ঈশ্বরের নাম-গুণগান শুনে গদাধরের অচৈতন্য অবস্থা পীড়া দিত চন্দ্রমণিকে। তখন ভুলে যেতেন তাঁর সন্তানের প্রকৃত স্বরূপ। প্রিয় সন্তানকে নিয়ে তাঁর উদ্বেগ ছিল চিরকাল। শ্রীক্ষেত্রগামী সাধুরা এক বার গদাধরকে ভস্ম মাখিয়ে, কৌপীন পরিয়ে সাধু সাজায়। গদাইয়ের সে বেশ দেখে চন্দ্রমণি ভয় পান। গদাইকে হারানোর ভয়ে সর্বদা তটস্থ থাকতেন। পরবর্তী কালে এই ঘটনা স্মরণে রেখে অদ্বৈতসাধনার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ গুরু তোতাপুরীর কাছে গোপনে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। মায়ের কষ্টের কথা ভেবে তিনি মস্তক মুণ্ডন করেননি, গেরুয়া ধারণ করেননি। মায়ের পাশে বসে খেয়েছেন। মাতৃশক্তির উপাসক শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তাঁর জননীই ছিলেন জগজ্জননী।
১৮৪৩ সালে ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাবসান হয়। সতেরো বছর বয়সে গদাধর দাদা রামকুমারের সঙ্গে কলকাতায় আসেন। ১৮৫৫ সালে দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার পর শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনজীবনের সূচনা। জগন্মাতাকে দেখার বাসনায় ব্যাকুল হচ্ছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সকলে ভাবছেন তিনি উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন। কামারপুকুরে এই সংবাদ শুনে চন্দ্রমণি স্থির থাকতে পারলেন না। ভাবলেন, বিয়ে দিলেই গদাই শান্ত হবে, সংসারে মন বসবে। শ্রীরামকৃষ্ণ আপত্তি করলেন না, বরং নিজেই জয়রামবাটীতে সুপাত্রীর খোঁজ দিলেন। পাঁচ বছরের বালিকা সারদামণির সঙ্গে চব্বিশ বছরের গদাধরের বিবাহ হল। চন্দ্রমণি দরিদ্র। প্রতিবেশী লাহাবাবুদের গয়না ধার করে নববধূ সারদাকে সাজানো হয়েছিল। বৌভাতের পরদিন লাহাবাবুদের গয়না ফিরিয়ে দিতে হবে। মা হয়ে মেয়ের গা থেকে গয়না খুলতে হবে ভেবেই কষ্টে চন্দ্রমণির বুক ফেটে গেল। শ্রীরামকৃষ্ণ ঘুমন্ত সারদার গা থেকে নিঃসাড়ে গয়নাগুলো খুলে নিলেন। ঘুম ভাঙলে নিজের গয়নাগুলো না দেখে সারদা কাঁদছেন। চন্দ্রমণি নববধূকে কোলে বসিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “মা, গদাই তোমাকে এর চেয়েও ভাল ভাল গয়না পরে কত দেবে।” শ্রীরামকৃষ্ণ জননীর কথা মিথ্যে হতে দেননি। সাধনার সময় সীতাদেবীর দু’হাতে যেমন সোনার বালা দেখেছিলেন ঠিক তেমন বালা সারদা মা-কে গড়িয়ে দিয়েছিলেন।
পরবর্তী কালে শ্রীরামকৃষ্ণকে চন্দ্রমণি ডাকতেন ‘কেষ্ট’ নামে। বিবাহের পর দক্ষিণেশ্বরে ফিরে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের কালীদর্শনের ব্যাকুলতা আরও বৃদ্ধি পেল। সে খবর শুনে চন্দ্রমণি কেষ্টর মঙ্গল কামনায় শিবমন্দিরে হত্যে দিয়েছেন, গৃহদেবতা রঘুবীর ও শীতলার কাছে মানত করেছেন। অন্য দিকে মায়ের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবনার অন্ত ছিল না। ভক্তদের বলতেন, “মা-বাপ প্রসন্ন না হলে ধর্মটর্ম কিছুই হয় না।” তাই মায়ের কষ্ট লাঘবের জন্য তাঁকে দক্ষিণেশ্বরে নিজের কাছে রাখতে চাইলেন। কামারপুকুর ছেড়ে চিরকালের জন্য দক্ষিণেশ্বরে চলে এলেন চন্দ্রমণি। জীবনের শেষ বারো-তেরো বছর তিনি দক্ষিণেশ্বরেই কাটিয়েছেন। দক্ষিণেশ্বরে এসে চন্দ্রমণি প্রথমে শ্রীরামকৃষ্ণ ও রামকুমারের পুত্র অক্ষয়ের সঙ্গে কুঠিবাড়ির উত্তর-পূর্ব দিকের একটি ঘরে থাকতেন। অল্পবয়সি অক্ষয়ের প্রয়াণের পর চন্দ্রমণি গঙ্গাতীরে নহবতের দোতলার ঘরে বাস করতে থাকেন। ১৮৬৩ সালে রানি রাসমণির সেজো জামাই মথুরানাথের সুব্যবস্থায় শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে চন্দ্রমণি তীর্থদর্শনে যান। বৈদ্যনাথ ও কাশীধাম দর্শন করে শ্রীরামকৃষ্ণ যখন বৃন্দাবনে গেলেন, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা হল বৃদ্ধা সাধিকা গঙ্গামায়ীর। গঙ্গামায়ীর মাতৃসুলভ স্নেহের আকর্ষণে শ্রীরামকৃষ্ণ স্থির করেন বরাবরের জন্য বৃন্দাবনে থেকে যাবেন। গঙ্গামায়ীও তাঁকে কিছুতেই ফিরতে দেবেন না। এমন সময় শ্রীরামকৃষ্ণের “...মাকে মনে পড়ল! মা সেই একলা দক্ষিণেশ্বরের নবতে। আর থাকা হল না। তখন বললাম, আমায় যেতে হবে!”
মথুরানাথের ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি অগাধ ভক্তি ও ভালবাসা। কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণের অভাবের সংসারের কথা জানতে পেরে একখানা তালুক তাঁর নামে লিখে দিতে চেয়েছিলেন মথুর। কামিনীকাঞ্চনত্যাগী শ্রীরামকৃষ্ণ তা শুনে রেগে উঠে বলেছিলেন, “শালা, তুই আমাকে বিষয়ী করতে চাস?” চন্দ্রমণি দেবী তখন দক্ষিণেশ্বরে। মথুর চন্দ্রমণিকে ‘ঠাকুমা’ বলে ডাকতেন। মথুর জানতেন, জননীর প্রতি শ্রীরামকৃষ্ণের অগাধ ভালবাসা। তাই তাঁর সেবাই শ্রীরামকৃষ্ণের সেবা। মথুর বার বার চন্দ্রমণিকে অনুরোধ জানালেন যাতে তিনি মথুরের কাছ থেকে যা ইচ্ছে তাই চেয়ে নেন। বিপুল ধনৈশ্বর্যের মালিক মথুরানাথের অনুরোধে চন্দ্রমণি অনেক ভেবেচিন্তে বললেন, “যদি নেহাত কিছু দিতে চাও, তা হলে আমার মুখে দেওয়ার গুলের অভাব, এক আনার দোক্তা তামাক কিনে দাও।” চন্দ্রমণির কথায় মথুরের চোখে জল এসে গিয়েছিল। এমন নির্লোভ মা না হলে কি ছেলে অমন সর্বত্যাগী হয়!
১৮৭১ সালে মথুরের দেহত্যাগের পরের বছর দক্ষিণেশ্বরে এলেন মা সারদা। শ্রীরামকৃষ্ণ নহবতের একতলার ছোট ঘরটিতে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশিত পথে ধ্যান, জপ, ভজনের সঙ্গে সঙ্গে সারদা দেবী বৃদ্ধা শাশুড়ি ও শ্রীরামকৃষ্ণের সেবাভার গ্রহণ করলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ দেখতেন, যে মা মন্দিরের গর্ভগৃহে আছেন, তিনিই যেন জননী ও সারদা রূপে নহবতে বাস করছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা, “যতক্ষণ মা আছে, মাকে দেখতে হবে। আমি মাকে ফুল চন্দন দিয়ে পূজা করতাম। সেই জগতের মা-ই মা হয়ে এসেছেন। যতক্ষণ নিজের শরীরের খবর আছে, মার খবর নিতে হবে।” প্রতিদিন নহবতে গিয়ে চন্দ্রমণির খোঁজখবর নিতেন তিনি। পেটরোগা ঠাকুর কালীবাড়ির ঘি-মশলাপূর্ণ ভোগ খেয়ে প্রায়ই আমাশয়ে ভুগতেন। তাই মাঝে মাঝে জননীকে বলতেন, “তুমি মা, সেই দেশের মতন করে, বেশ ফোড়ন-টোড়ন দিয়ে দুটো একটা তরকারি করো না। খেতে বড় মন যায়। আর এদের তরকারি রুচেনি।” রান্নায় পাঁচফোড়নের প্রতি ঠাকুরের এক বালকসুলভ প্রীতি ছিল। ঠাকুরের পেট খারাপ হলে চন্দ্রমণি খোঁজ নিতেন এবং কালীঘরের ভোগ খেতে বারণ করে শ্রীমাকে ঠাকুরের জন্য মাছের ঝোল আর কাঠের জ্বালে ভাত রেঁধে দিতে বলতেন।
১৮৭৩ সালে যখন শ্রীরামকৃষ্ণের মেজদাদা রামেশ্বর মারা যান, সে দুঃসংবাদ শুনে চন্দ্রমণি দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন, “সংসার যে অনিত্য, সকলেরই মৃত্যু নিশ্চিত। অতএব শোক করা বৃথা।” শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝেছিলেন তানপুরার কান টিপে সুর চড়ানোর মতো মা জগদম্বা তাঁর জননীর মনকে এমন উঁচুতে তুলে রেখেছেন যে মরজগতের শোক-দুঃখ তাঁকে স্পর্শ করতে পারছে না। ১৮৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। শ্রীরামকৃষ্ণ ক’দিন ধরে ঘন ঘন জননীর কাছে আসছেন। সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি মায়ের সঙ্গে নিজের ছেলেবেলার গল্প করে চন্দ্রমণির মন খুশিতে ভরিয়ে রাখছেন। সে দিন সকাল আটটা বাজলেও চন্দ্রমণি দরজা খুললেন না। পরিচারিকার মুখে জানতে পেরে ঠাকুরের ভাগ্নে হৃদয়রাম কৌশলে দরজা খুলে দেখলেন, চন্দ্রমণি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে রয়েছেন। কবিরাজি ওষুধ এনে তাঁর মুখে দিয়ে মধ্যে মধ্যে দুধ আর গঙ্গাজল বিন্দু বিন্দু করে খাওয়ানো হল। তিন দিন পর চন্দ্রমণির অন্তিমকাল উপস্থিত হলে তাঁকে কালীবাড়ির বকুলতলা ঘাটে অন্তর্জলি করা হল। শ্রীরামকৃষ্ণ জননীর মুখে গঙ্গাজল দিয়ে কানে নাম শোনালেন। পা ধুইয়ে সাদা চন্দন মাখিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিলেন। তার পর জননীর চরণে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “মা, তুমি কে গো, আমায় গর্ভে ধারণ করেছিলে! তুমি তো সাধারণ মা নও! মা, যেমন আমায় আগে দেখাশোনা করতে, এখনও আমায় দেখো।” পরদিন সূর্যোদয়ের আগে, ব্রাহ্মমুহূর্তে স্নেহের পুত্রকে পাশে রেখে চন্দ্রমণি অমৃতলোকে চলে গেলেন। দেহত্যাগের মুহূর্তে শ্রীরামকৃষ্ণ “মা! মা!” বলে কেঁদে উঠলে হৃদয় তিরস্কার করে বললেন, “মামা, তুমি না সাধু হয়েছ?” শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর দিলেন, “ওরে শালা, সাধু হয়েছি বলে আমি কি জানোয়ার হয়েছি?” ঘটনাচক্রে সেই দিনটিও ছিল ফাল্গুন মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া, শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি! সেই উষাকাল!
সন্ন্যাসী শ্রীরামকৃষ্ণ জননীর সৎকার করতে পারেননি। করেছিলেন রামেশ্বরের পুত্র রামলাল। কিন্তু গর্ভধারিণী মাকে কোনও দিন ভুলতে পারেননি শ্রীরামকৃষ্ণ। চন্দ্রমণির দেহরক্ষার বহু দিন পরে এক দিন মায়ের মন্দিরে প্রসাদ পেতে যাওয়ার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ হঠাৎ পিছন ফিরে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। বিস্মিত হয়ে সঙ্গীরা তাঁকে ডাকল, “এখন কোথায় চললে?”
পঞ্চবটীর দিকে যেতে যেতে সজল নয়নে শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর দিলেন, “দাঁড়াও, আগে মার জন্য একটু কেঁদে আসি!”
তথ্যঋণ: শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ (১) – স্বামী সারদানন্দ, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত (অখণ্ড) – মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শ্রীরামকৃষ্ণজননী চন্দ্রমণি দেবী – প্রব্রাজিকা প্রবুদ্ধপ্রাণা