সাহিত্যস্রষ্টা: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ডান দিকে, সিগনেট প্রেস থেকে ছাপা ‘চাঁদের পাহাড়’ বইয়ে সত্যজিৎ রায়ের আঁকা প্রচ্ছদ
চারধারে ঘন বাঁশের জঙ্গল। বুনো হাতীর দল মড়্ মড়্ করে বাঁশ ভাঙচে।... সেই ঘন বাঁশ বন, সেই পরগাছা ঝোলানো বড় বড় গাছ, নীচে পচাপাতার রাশ, মাঝে মাঝে পাহাড়ের খালি গা— আর দূরে গাছপালার ফাঁকে জ্যোৎস্নায় ধোয়া সাদা ধব্ধবে চিরতুষারে ঢাকা পর্ব্বত শিখরটী— এক এক বার দেখা যাচ্ছে, এক এক বার বনের আড়ালে চাপা পড়চে।...”— তখন ক্লাস সিক্স কি সেভেন। সদ্য হাতে পেয়েছি সিগনেট প্রেসে ছাপা বইটা। চিরকালের পড়াশুনোয় অমনোযোগী আমি তখন পাটিগণিতের বইতেও রিখটার্সভেল্ডের চুড়োগুলো দেখতে পাই। অস্তগামী সূর্যের লালচে আলোমাখা এক ফালি আফ্রিকা, পায়ের নীচে শুকনো পাতার গালচে, মাথার উপর নাম না জানা বেগনে ফুলের লতা আর বাওবাব গাছের সারি, অজস্র পাখপাখালি আর বেবুনের চিৎকার। রাত্রি নামছে বনে, আর অনাদি অতীতের চাপা পড়া সব রহস্য নিয়ে ক্রমশ বাঙ্ময় হচ্ছে আফ্রিকা। রাতের অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় তার আলো-আঁধারি রূপ ঝকঝক করছে চাঁদের মতো। যেন স্বপ্নের দেশ— সত্যি থেকে অনেক দূরে সে দেশের সীমানা— আমাদের মতো দশটা-পাঁচটার একঘেয়ে জীবন, হোমওয়ার্কের ভিড়ে সে নিজেকে মিশিয়ে দেবে না কিছুতেই।
বিভূতিভূষণ ‘মৌচাক’ পত্রিকার জন্য ‘চাঁদের পাহাড়’ লিখতে শুরু করেন ত্রিশের দশকের শেষের দিকে। তত দিনে কিশোর সাহিত্যে অ্যাডভেঞ্চারের ঘরানা যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। হেমেন রায়ের কলমে বিমল-কুমারের গল্প বাঙালির কাছে পৌরুষ যাপনের জীবন্ত প্রক্রিয়া। পুরুষ হয়ে উঠতে গেলে ঠিক কতখানি পথ পাড়ি দিতে হবে, তার একটা মানচিত্রও তৈরি খাতায়-কলমে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই ম্যাপ তথাকথিত ভিতু, ঘরকুনো বাঙালিকে পৌঁছে দিচ্ছে আফ্রিকার ‘অন্ধকার’ অন্তরে। বাঙালির ছেলেকে গেরাহ্যি না করে আর উপায় নেই। তারা এখন দু’টি বেলা ডাম্বেল ভাঁজে, কুস্তি শেখে, আর একটু ডাকাবুকো হলে ফেন্সিং কি রাইফেল শুটিংও বাদ দেয় না। হাওয়ায় কান পাতলেই শোনা যায়, এ পোড়া দেশে নতুন যুগ আসবে এই তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে সম্বল করেই। ম্যালেরিয়ায় ভোগা পিলেসর্বস্ব বাঙালি তখন অ্যাডভেঞ্চারে বিভোর। আর সেই অ্যাডভেঞ্চারে প্রতিপক্ষ কখনও ‘থ্যাবড়া নাকের হলদে চামড়ার চিনেম্যান’ (রক্তমুখী ড্রাগন), কোথাও ‘গোল চোখ, কোঁকড়ানো চুল আর বড়বড় দাঁতের’ বোর্নিয়োর জনজাতীয় যোদ্ধা (রত্নদ্বীপের বিভীষিকা), আবার কোথাও বা ‘কালোজামের মতন গায়ের রঙওয়ালা নিগ্রো’ (আফ্রিকার জঙ্গলে)। রিসলে সাহেবের শেখানো পশ্চিমি জাতিকল্পের ধারণায় বিশ্বাসী বাঙালি বীরেরা অবশ্য এদের মানুষ বলেই ধরে না। তাদের চোখে এরা ‘অন্ধকার’ আর ‘আদিম’-এর প্রতিরূপ। মানুষের মতো দেখতে বটে কিন্তু আদতে হিংস্র পশুর সঙ্গে তফাত নেই। ক্রূর জান্তব তাড়নায় এরা ধনরত্নের গুহা পাহারা দেয় যুগ যুগ ধরে, আর সভ্য মানুষকে আশপাশে ঘেঁষতে দেখলেই তাদের রক্তপিপাসা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সে এক রীতিমতো রোমহর্ষক কাণ্ড! তবে বাঙালি কি না তখন আলোকপ্রাপ্ত, তাই উপনিবেশি তত্ত্বাবধানে শরীর আর মন দুটোকেই শানিয়ে নিয়ে সে সব ভয়ের মাঝমধ্যিখানে ঢুকে পড়ে, রহস্যের জট ছাড়াতে আর ভীষণ সব বিপদের মোকাবিলা করতে তার এখন জুড়ি মেলা ভার। ঘরে ঘরে ছোট ছেলেদের চোখে গল্প-উপন্যাসের এই সব ডাকাবুকো যুবকের দল স্বপ্ন-পৌরুষের মাপকাঠি। শহরতলির অনামী বছর দশেকের কিশোরও হয়তো পড়ন্ত দুপুরে আয়নার ও পিঠে দাঁড়িয়ে আমাজনের জঙ্গলে লুকিয়ে রাখা সূর্যনগরীর গুপ্তধন খুঁজে পাচ্ছে। ইনকা রাজার সভায় দাঁড়িয়ে গল্পের বিমলের মতো হাসিমুখে বলছে, “আমি মরতে ভয় পাই না, আমি অজানার আনন্দে রোজ রোজ ঝাঁপ দিতে চাই… আমরা যে চাই বৃহৎ মরণ, তা ছাড়া আর নেইকো চারা। ডাকছে মরণ, ডাকছে কামান, ডাকছে সাগর পাগলপারা।”
এমনই এক ঝোড়ো সময়ে ‘মৌচাক’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতে শুরু করল ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসটি। বাংলার অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে শঙ্কর চাকরিসূত্রে পাড়ি দিল আফ্রিকা। মোম্বাসা থেকে সাড়ে তিনশো মাইল দূরে উগান্ডা রেলওয়ের কেরানি আর স্টোরকিপার হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হল। তার পর দিন গড়ায়… কিসুমুর স্টেশন মাস্টারের রোজকার দিনের চড়াই-উতরাই, আফ্রিকার সিংহ আর ব্ল্যাক মাম্বার সঙ্গে ইতিউতি সাক্ষাতের জেরে যখন তার প্রত্যেকটা দিনই কমবেশি অ্যাডভেঞ্চার, তখনই এক দিন বনের মধ্যে মাছ ধরতে গিয়ে শঙ্কর দেখল, ইউকা গাছের তলায় বসে আছে কে যেন এক জন বুড়োমতো লোক। দীর্ঘ দিনের না-কাটা চুলদাড়ি, রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রং, বলিষ্ঠ অথচ অনাহারক্লিষ্ট বৃদ্ধ প্রস্পেক্টর আলভারেজের সঙ্গে শঙ্করের সেই প্রথম পরিচয়। জ্বর গায়ে আলভারেজ সে দিন তাকে এক অদ্ভুত হলদে হিরের খনির গল্প শুনিয়েছিল। কাফেরদের গ্রাম আর জঙ্গল ছাড়িয়ে সেই যে অনেক দূরের ধোঁয়া-ধোঁয়া পাহাড়, সেখানেই আছে সেই নাম না জানা হিরের খনি। কাফেররা বলে চাঁদের পাহাড়। পাহাড়ি উপদেবতা বুনিপের বাস সেখানে। কেউ তাকে দেখেনি বটে, কিন্তু সে হল সাক্ষাৎ মৃত্যু। এক বার যে সেই পাহাড়ে যায়, আর কোনও দিন ফিরে আসে না। গল্পে হারিয়ে যেতে যেতে শঙ্কর সে দিন দেখেছিল আলভারেজের জ্বরতপ্ত, ঘোলাটে চোখ অন্ধকার স্টেশনঘরের নিবে আসা আলোতেও জ্বলজ্বল করছে! বুয়র যুদ্ধের পোড়-খাওয়া সৈনিক, অশক্ত, বুড়ো আলভারেজ আজও হিরের খনির স্বপ্ন দেখা ছাড়েনি। আর তার পর?
গল্পের ঠাসবুনটের মুনশিয়ানা আর গায়ে কাঁটা দেওয়া উত্তেজনায় শুরুর ভূমিকা অনেক সময় চোখ এড়িয়ে যায়। লেখক এক মোক্ষম তুলনা টেনে এনেছিলেন, যা অ্যাডভেঞ্চার গল্পের সমাজবীক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই প্রাসঙ্গিক। “চাঁদের পাহাড় কোনও ইংরিজি উপন্যাসের অনুবাদ নয়... বা ছায়াবলম্বনে লিখিত নয়।” এই স্বাতন্ত্র্যের ধারণা আরও স্পষ্ট হয় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় লেখা একটি সমালোচনাপত্রে। হেমেন রায়ের ‘আবার যখের ধন’ কাহিনির সমালোচনায় বিভূতিভূষণ লেখেন, “গল্পটি ভাল লাগিয়াছে এমন কথা বলিতে পারি না। বাঙালির ছেলেকে পাকেচক্রে আফ্রিকায় লইয়া গিয়া ফেলিলেই ‘অ্যাডভেঞ্চার’-এর গল্প হয় না, নিতান্ত খেলো ধরনের ইংরিজি গল্পের অনুকরণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে।”
কিন্তু নিজের চাঁদের পাহাড়েই তো অ্যাডভেঞ্চারের প্রেক্ষাপট আফ্রিকায় ছকেছেন লেখক! আর গতটিও তো আলাদা কিছু নয়। অর্থাৎ হেমেন রায়ের গল্পের মতো এই উপন্যাসও তো ডাকাবুকো বাঙালি ছেলের আফ্রিকার প্রান্তরে অবিমিশ্র পৌরুষ-যাপনের কল্পকাহিনি। আর শঙ্করের বকলমে আফ্রিকার যে বর্ণনা দিয়েছেন লেখক, তাও তো যথেষ্টই বিভীষিকাময়। তিরুমল আপ্পার গল্পটিই ধরা যাক না কেন! তরুণ মাদ্রাজি যুবক তিরুমল বাড়ি থেকে পালিয়ে আফ্রিকায় এসেছিল অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। ঠিক ছিল পরের ছুটিতে বাড়ি যাবে। কিন্তু কোথায় কী! হাজার হাজার মাইল দূরে আফ্রিকার শরবনে পড়ে রইল সিংহে খাওয়া তার দেহাংশ, তার ছেলেমানুষি স্বপ্নের মূল্য দিতে। আফ্রিকা সুন্দরী হতে পারে, কিন্তু সে ভয়ঙ্কর! তার যেখানে সেখানে মৃত্যুর ফাঁদ পাতা। আফ্রিকা স্বপ্নের ঠিকানা হতে পারে, কিন্তু তার আদিম, অনাঘ্রাত রহস্যের অনেকটাই পাশবিক, যা সভ্য সমাজের আধুনিক ভাবনাচিন্তার বাইরে। আর উপন্যাসের শুরুতে শঙ্করের চোখে আফ্রিকার উপস্থাপনাটিও তো একেবারে পশ্চিমি, পুঁজিবাদী ছাঁচে ঢালা। আফ্রিকা মানেই তো শুধু সোনার দেশ, হিরের খনির দেশ। অগুনতি রহস্য আর অজানা অন্ধকার সরিয়ে সে সাত রাজার ধন সভ্যসমাজের পরিধিতে টেনে হিঁচড়ে বার আনতে পারলে তবেই না আধুনিকতার আলেখ্যটি দানা বাঁধবে! সেই গতে-বাঁধা নিয়মের গল্পই তো শুনিয়েছেন লেখক। তা হলে চাঁদের পাহাড় আর ব্যতিক্রমী হল কিসে?
মজার কথা হল, বিভূতিভূষণ এই নিয়মের আড়ালেই বেনিয়মের পথে হেঁটেছেন, আর সেই নিয়ম ভাঙার রেশ রেখে গেছেন বেশ স্পষ্ট ভাবেই। গল্পের গোড়াটুকু পশ্চিমি অ্যাডভেঞ্চারের ছাঁচে সাজালেও মাঝখান থেকেই ধাপে ধাপে তার নিয়মচ্যুতির সূত্রপাত চোখে পড়ে। উপন্যাসটিতে ডানপিটে বাঙালি তরুণ শঙ্করের অ্যাডভেঞ্চারের তিনটি পর্যায় দেখিয়েছেন লেখক। শুরুর দিকে শঙ্করের সাহসী মন তৈরি করার উপকরণগুলি কিন্তু নেহাতই পশ্চিমি। গ্রামের ঘরে, ঝুপঝুপে বৃষ্টির মধ্যে প্রদীপের আলোয় ওয়েস্টমার্কের বড় ভূগোলের বইটিই তো তার স্বপ্নের চুন-সুরকি জোগায়। কত বার যে সে বইখানা পড়েছে আর ভেবেছে হের হাউপ্টম্যানের মত সেও এক দিন যাবে ‘মাউন্টেন অব দ্য মুন’ জয় করতে! তার পরে তার আফ্রিকা-অভিযানের প্রাক্পর্বটিও তো দিব্যি উপনিবেশিক ইতিহাস-নির্মিতির ধারণার অনুসারী। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে-পিছে বহু বাঙালি তরুণই কাজকর্মের খোঁজে আফ্রিকায় পাড়ি দিয়েছিল। আফ্রিকা হল ইংরেজদের জংলি কলোনি, তাই সেখানে সভ্য শহর গড়তে, রেল-রাস্তা বানাতে কম পয়সায় ভারতীয় শ্রমিক নিয়োগ করলে কাজও সারা হত সহজে, আর আয়েও কুলোত দিব্যি। আর সেখানে তখন প্রস্পেক্টরদেরও ছড়াছড়ি। তাদেরও কম পয়সার কুলির দরকার পড়ে যখন তখন। আলভারেজের বকলমেই তো লেখক শুনিয়েছেন সে সব গল্প। ১৮৮৮-৮৯ সালের দিকে কেপ কলোনির উত্তরের পাহাড়ে তার সোনার খনি খুঁজে বেড়ানোর গল্প, জিম কার্টারের গল্প, যে নদীর পাড়ে পাড়ে রুপো খুঁজে বেড়াত। খেপাটে, ভবঘুরে কার্টার ভাবত জায়গাটা খুঁজে পেলে সে এক দিন নিশ্চয়ই লক্ষপতি হয়ে যাবে। অর্থাৎ আফ্রিকার গহন বনে তাদের অ্যাডভেঞ্চারের উদ্দেশ্যটি ছিল একেবারেই বস্তুবাদী, ধনতান্ত্রিক যুক্তিবোধে জারিত। এমনকি অসুস্থ আলভারেজ শঙ্করের হাতে যখন সেই গুপ্তধনের ম্যাপখানা তুলে দিচ্ছে, তখনও তার মুখে বড়মানুষ হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কথা নেই। আর মুমূর্ষু আলভারেজের কথার ধারে, তার পাকা ভুরুর নীচেকার কঠিন নীল চোখদুটোর প্রতিজ্ঞায় সে দিন শঙ্কর নিজের মূল্যবোধকে মিশিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। পরম শ্রদ্ধায় আর ভালবাসায় স্বীকার করেছিল, ‘আলভারেজ সত্যিকার মানুষ বটে একজন’। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় আলভারেজের ‘কুলী’ হতেও তার তাই বিশেষ বাধেনি। কিন্তু আলভারেজ যতই তাকে নিজের ছেলে বলুক, সে তো জানে সে নেহাতই এক জন ‘কালা আদমি’ আর আলভারেজ হল অ্যাডভেঞ্চারের দলপতি।
তাই যতই কষ্ট হোক, মরে গেলেও সে তার কষ্টের কথা আলভারেজকে জানাতে পারবে না। আলভারেজ হয়তো ভাববে, ইস্ট-ইন্ডিজ়ের লোকগুলো অপদার্থ! কিন্তু সকালের পর সকাল, মাইলের পর মাইল বুনো আদার ঝোপ আর বুনো বাঁশের বন পেরিয়ে তারা কেবল উঠছে তো উঠছেই। অসহ্য কষ্ট! পায়ের তলায় মাটি নেই, পাথর নেই, শুধুই শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে জড়ো হওয়া পচা পাতার রাশ আর শুকনো গুঁড়ির স্তূপ শঙ্করকে টলিয়ে দিচ্ছে মাঝেমধ্যে। সে তো আর আলভারেজের মতো কঠিনপ্রাণ স্বর্ণান্বেষী প্রস্পেক্টর নয়। সোনার খোঁজে, হিরের খোঁজে এ কোথায় চলেছে সে? তার ছোট্ট গ্রাম, পিদিমজ্বালা তুলসীতলা, গ্রামের আকাশে কৃষ্ণপক্ষের এক কোয়া চাঁদ— সব পরিচিত ছবি ছেড়ে এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে আর কত দূরে যেতে হবে তাকে?
শঙ্করের মনে এই সংশয় যত দিনে জাগছে, আমাদের গল্প তত দিনে মাঝপথ পেরিয়েছে। আর প্রস্পেক্টরদের মতো হাজার কষ্ট সহ্য করে সোনা খোঁজার পাশাপাশি শঙ্কর তার সৌন্দর্য-পিয়াসী মনটিকেও আলাদা করে চিনতে শিখেছে। সে বুঝতে শিখেছে প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে নিত্যদিন হাজার রূপকথা তৈরি করে। আলভারেজের কঠিন চোখে বন্য প্রকৃতির সেই রূপকথা ধরা পড়ে না। কিন্তু এই ঘাসের বন, ইউফোর্বিয়া গাছ, আকাশে সূর্যাস্তের হাজার একটা রং, জ্যোৎস্নারাত্রির মায়া যে তার চোখে ঘোর লাগিয়ে দেয়! অনেক রাতে আলভারেজ ঘুমোলে নিষেধাজ্ঞা ভুলে শঙ্কর তাঁবুর বাইরে আসে, নির্ঘুম কাটিয়ে দেয় বাকি রাত। ঝিঁঝি ডাকে, জঙ্গলের দিক থেকে দমকা হাওয়ায় কত বন্য জন্তুর ডাক ভেসে আসে, মাথার ওপর জ্বলজ্বল করে লুব্ধক। এত অসহ্য সুন্দরও হয় রূপকথা? এই রূপকথার নেশা তো হিরের নেশার চেয়েও তীব্র, শিরায় শিরায় জ্বালা ধরিয়ে দেয়, তিষ্ঠোতে দেয় না এক মুহূর্তও।
আর তখনই কেমন যেন শঙ্করের অ্যাডভেঞ্চারের চেনা পরিচিত ছকগুলো নিয়ম ভাঙতে শুরু করে। আলভারেজের রোডেশিয়ান ভেল্ডের গল্প সে মন দিয়ে শোনে না, কিম্বারলি খনির গল্প আর তাকে উত্তেজিত করে না, পাঁচ হাজার ফুট উপরে ইপোমিয়া ফুলের জঙ্গলে সে খুঁজে পায় বাংলার বনকলমির আটপৌরে আতিথ্য। পাহাড়চুড়োর মেঘগুলো নেমে আসে মাথার ওপর, এক রাশ আদরে ভিজিয়ে দেয় তাকে, রঙিন ভেরোনিকা ফুল বন আলো করে ফুটে থাকে এখানে-ওখানে। প্রকৃতির এই অপরূপ রাজ্যে সোনা, হিরের খোঁজ বড্ড ছোট মনে হয় তার। মনে হয়, এই দুর্ধর্ষ পর্তুগিজ লোকটার সঙ্গে হিরের সন্ধানে এসে সে কি ঝকমারিই না করেছে!
আর তার অনিচ্ছুক মনটাকে মদত দিতেই যেন পাহাড়ে বর্ষা নামে সে যাত্রা। রিখটার্সভেল্ডের ভয়ঙ্কর দুর্গম স্যাডেল পেরোতে গিয়ে বুনিপের হাতে প্রাণ হারায় আলভারেজ। সেই কাফেরদের গল্পের রহস্যময় মৃত্যুদূত বুনিপ, যাকে কেউ চোখে দেখেনি কখনও, কিন্তু ভয় পেয়ে এসেছে চিরকাল। যে ভয় মানুষের অপ্রতিরোধ্য গতিকেও প্রতিহত করেছে, তাকে বার বার বুঝিয়েছে যে, সব সাহসিকতার পুরস্কার জয়ের অভিষেকে হয় না। বুঝিয়েছে যে, প্রকৃতি তার চিরন্তন রহস্যে, তার সুন্দরে, তার ভয়ঙ্করে চিরদিনই অসীম, অপ্রতিরোধ্য। এখানে লেখক সত্যি আর কল্পনার মধ্যে খানিক রফা করার চেষ্টা করেছেন বুনিপের এক জীবতাত্ত্বিক প্রজাতি নির্ণয় করে। লোকচক্ষুতে সে ধরা দেয় না বটে, তবে কাফেরদের গল্পকথায় মনে হয় বুনিপ মধ্য আফ্রিকার ডিঙ্গোনেক বা রোডেশিয়ান দৈত্যের মতোই সুপ্রাচীন কোনও ‘এপ’, যে সেই হলদে হিরের গুহা পাহারা দেয় যুগ যুগ ধরে। সভ্য মানুষ, সে তার যত ক্ষমতাই থাকুক না কেন, সেই দুরূহ বাধা পেরোনোর শক্তি আজও বাগে আনতে পারেনি। +আর তাই হয়তো বুনিপের সত্যিকারের চেহারাটাও আজ অবধি কেউ দেখতে পায়নি ঠিকমতো, সভ্য মানুষের যুক্তিবোধের বাইরে বুনো, আদিম অপ্রতিরোধ্যতার ছায়াছবি হয়েই বুনিপ থেকে গেছে সারাটা জীবন।
সম্ভবত আলভারেজের মৃত্যুই এই উপন্যাসে নিয়ম ভাঙার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্রটি পাঠককে ধরিয়ে দেয়। সাহস আর শক্তির যে পুরুষোচিত আদর্শের ছায়ায় এত দিন শঙ্করের অ্যাডভেঞ্চারের মাত্রাগুলো দানা বাঁধছিল গল্পে, হঠাৎ ধাক্কায় সেই চেনা ছক ভেঙে যায় বেমালুম। রিখটার্সভেল্ডের অজানা, অচেনা রাত্রি, তুমুল বৃষ্টি আর আলভারেজ ছাড়া শঙ্করের একলা আগামী অভিযান— এ সবই তখন পাঠকের কাছে এক দিগ্ভ্রান্ত, বেনিয়ম অ্যাডভেঞ্চারের সূত্র হয়ে দাঁড়ায়। যে অ্যাডভেঞ্চারের উদ্দেশ্য আর প্রস্পেকটরের রত্ন-অনুসন্ধান নয়, অনেকখানি সংশয় আর মৃত্যুপথ পেরিয়ে রণক্লান্ত যোদ্ধার আত্ম-অনুসন্ধান। সেই অ্যাডভেঞ্চারে আর কারও নির্দেশ মানার তাগিদ নেই, ভুল করার নিশ্চিন্তি নেই, সংশয়ের দোটানাও নেই— সেই অ্যাডভেঞ্চারের নিশানা পথিককে নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়, আর তাই সেই পথের চড়াই-উতরাই আরও তীব্র। শঙ্কর ভয় পায়। কষ্টে-তেষ্টায় তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, তবু সে পথ ফুরোয় না। মাথার উপরে আগুনের মতো সূর্য, পায়ের নীচে জ্বলন্ত কালাহারি মরুভূমি। রোজ সূর্য ওঠে, অস্ত যায়, আর সুদূর নীহারিকা আর নক্ষত্ররাজির তলা দিয়ে শঙ্কর পেরোয় একের পর এক মরীচিকা।
কেউ পারেনি। কেউ নয়। আফ্রিকার রূপসী গহীনে একে একে হারিয়ে গেছে জিম কার্টার, আত্তিলিয়ো গাত্তি, আলভারেজের মতো আরও অনেকে। কিন্তু শঙ্কর তো হারিয়ে যাবে না কিছুতেই। হতে পারে, হলদে হিরের খনি তার কাছে ধরা দিয়েও হারিয়ে যাবে, সে আর কোনও দিনও খুঁজে পাবে না সেই ঝরনা-গুহা, কিন্তু তাও চিমানিমানি পর্বতের হাড়-কাঁপানো ঠান্ডায়, নেকড়ে আর কোয়োটের দলের সঙ্গে যুঝতে গিয়ে আহত, বুভুক্ষু শঙ্কর অবাক হয়ে দেখবে বিশাল পর্বত আর মরুভূমির এই অনিন্দ্য-গম্ভীর রূপখানি। নিঃসঙ্গ তারাজ্বলা আফ্রিকার আকাশের তলায় ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে ভাববে, সে তো পেরেছে! একলা এই পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে, মরুভূমির তীব্র উষ্ণতাতেও তো সে তার ভিতরের স্বপ্নগুলোকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। সেই স্বপ্নই তাকে ঠিক এক দিন আবার ফিরিয়ে আনবে আফ্রিকায়। রিখটার্সভেল্ডের রত্নখনি যে বড় কঠিন যত্নে তাকে নিজেকে চিনতে শিখিয়েছে। ফিরতে যে তাকে হবেই!
একটু বড় হয়ে কেমন যেন মনে হত, চাঁদের পাহাড় একা শঙ্করের অ্যাডভেঞ্চার নয়— গোটা একটা বাঙালি সমাজ উনিশ শতকের সবটা জুড়ে নিজেকে ভাঙছে, গড়ছে, স্বপ্ন দেখছে, মরীচিকায় পথ ভুল করছে, আবার শুধরে নিচ্ছে, তীব্র যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ছে, কিন্তু থেমে যাচ্ছে না— এ তারই গল্প। সেই সমাজ, যে উপনিবেশের শেখানো বুলি আওড়ায় বটে, কিন্তু নিজেকে হারিয়ে ফেলে না, ভিতরে ভিতরে এখনও নিজের দেশ তৈরি করার স্বপ্ন দেখে। অনেকটা বাধা পেরিয়ে, অনেকখানি কষ্টের পরে, বড় মমতায়, বড় যত্নে তৈরি করা তার নিজের দেশ— যেখানে পেলবতা আছে, চোখের জল আছে, ভয় আছে, হতাশা আছে, কিন্তু সে সব পেরিয়ে গিয়েও আছে নিজেকে স্বেচ্ছায় বাড়তে দেওয়ার স্বাধীনতা।
আচ্ছা, এই সত্যিকারের ‘দেশ’টা তৈরি হয় কোথায়? সত্যিই কি তার ধরাবাঁধা রাজনৈতিক সীমানা আছে? সেই ভূগোল কি বলে যে, এই ছকে দেওয়া ‘রাষ্ট্রের’ চৌহদ্দিতেই শুধু দেশ জন্মায়? তা-ই যদি হবে, তা হলে শঙ্কর কাফেরদের সেই ‘অসভ্য’ দেশে, রোদ-জ্বলা আকাশে প্রতি মুহূর্তে এত মমতা খুঁজে পায় কেমন করে? পাঁচ হাজার ফুট পাহাড়ের ওপরে জঙ্গুলে আফ্রিকাকে কেন তার বড় কাছের মনে হয়? ঠিক যেন তার নিজের দেশটির মতো? বিভূতিভূষণ তাঁর কোনও লেখাতেই দেশ বা রাজনীতির কথা প্রকাশ্যে আনেননি। সমালোচকেরা তা নিয়ে একটু নিন্দে-মন্দও করতেন বই কী! আর সেই প্রসঙ্গেই গোপাল হালদারের ‘শনিবারের চিঠি’-র একটি কথা মনে পড়ে যায়। তিরিশের দশক। লোকের মুখে মুখে ফিরছে গান্ধীর ডান্ডি অভিযানের খুঁটিনাটি। কিন্তু বিভূতিবাবু একেবারেই চুপ। শেষে অনেক করে প্রশ্ন করলে তিনি একটা ভারী অদ্ভুত কথা বলেন। সে দিন বিভূতিভূষণ বলেছিলেন, দেশ কি আর সবার কাছে একই রকম? আমরা লেখকরা দেশটা খুঁজি অন্য ভাবে, আমরা জীবনের অনেক গভীরতর দেশকে দেখি— রাজনীতি তো শুধু তার ওপরের ভাসাভাসা পরত মাত্র, আর কিচ্ছু নয়।... হয়তো এ কারণেই শঙ্করের খোঁজ কখনও শেষ হয় না। চাঁদের পাহাড় কি সত্যিই পৃথিবীতে নামে কোনও দিন? ভবঘুরে অপু কি কখনও খুঁজে পায় তার পোর্তো-প্লাতা? মহালিখারূপের জঙ্গলে বৃদ্ধ সাঁওতাল রাজা কি জানতে পারেন সত্যিকারের ভারতবর্ষের মানে? হয়তো পারেন, কিংবা পারেন না। পথের দেবতা স্মিতমুখে বলেন, “সামনে, শুধুই সামনে… দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডি এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশ্যে… বিচিত্র আনন্দ-যাত্রার অদৃশ্য তিলক তোমার ললাটে পরিয়েই তো তোমাকে ঘরছাড়া করে এনেছি!”
পথ যে এখনও অনেক বাকি।