Swami Vivekananda

স্বামীজির স্মৃতিমন্দির যেন পুণ্যভূমি ভারতেরই রূপ

মন্দিরের দ্বিতলের ওঙ্কার হল সর্বধর্মসমন্বয়, অর্থাৎ ভারতের প্রাণ। নীচে সমাধিমন্দিরে বিরাজিত ভারতাত্মা বিবেকানন্দের বিগ্রহ। বারংবার অর্থাভাবে ব্যাহত হয়েছে বেলুড়ে বিবেকানন্দের স্মৃতিমন্দির নির্মাণের কাজ। এই মন্দিরের অনতিদূরেই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম অধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দের স্মৃতিমন্দির। একই বছরে প্রতিষ্ঠিত। জানুয়ারিতে পূর্ণ হয়েছে দু’টি মন্দিরেরই শতবর্ষ। অরুণাভ দত্ত

Advertisement

অরুণাভ দত্ত

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৪ ০৮:৫৭
Share:

স্মৃতিসাক্ষ্য: মন্দিরের নীচের তলায় মার্বেল-নির্মিত স্বামীজির বাস-রিলিফ মূর্তি। ছবি সৌজন্য: বেলুড় মঠ

এক অপরাহ্নে, স্বামী বিবেকানন্দ স্বামী প্রেমানন্দের সঙ্গে বেলুড় মঠপ্রাঙ্গণে বেড়াচ্ছিলেন। বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎই মঠভূমির দক্ষিণ দিকে একটি নির্দিষ্ট স্থান আঙুল তুলে দেখিয়ে গুরুভাইকে স্বামীজি নির্দেশ দিয়েছিলেন, “আমার দেহ গেলে ওইখানে সৎকার করবি।”

Advertisement

ঘটনাটি ঘটেছিল তাঁর মহাসমাধির ঠিক তিন দিন আগে।

মঠভূমির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি বিল্ববৃক্ষের নিকটবর্তী ওই স্থান স্বামীজির বিশেষ প্রিয় ছিল। ওই স্থানের বিপরীতে, গঙ্গার অপর পারে কাশীপুর মহাশ্মশান। এক বার স্বামীজি স্বামী সারদানন্দকে শ্মশান এবং নিজের ভাবী দাহস্থল দেখিয়ে বলেছিলেন, “ওই দেখ শরৎ, সামনেই ঠাকুরের চিতাস্মৃতি, আমার মনে হয় সমস্ত মঠভূমির মধ্যে এই স্থানটিই সর্বোৎকৃষ্ট।”

Advertisement

এমনকি স্বামীজি তাঁর গুরুভাই, তৎকালীন সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দকে অনুরোধ করেছিলেন, “রাজা, আমায় এখানে একটু জায়গা দিতে পারিস?”

স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলেছিলেন, “ভাই, তোমারই তো সব। তোমায় আবার জায়গা দেব কি?”

স্বামীজির গুরুভাইরা তাঁর কোনও ইচ্ছেই অপূর্ণ রাখেননি। ১৯০২ সালের ৪ জুলাই, রাত্রি ৯.১০ মিনিটে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে স্বামীজি বেলুড়ে মহাসমাধি লাভ করলেন। পরদিন দুপুরে সুসজ্জিত পালঙ্কে শায়িত স্বামীজির মরদেহ দাহকার্যের জন্য স্বামীজির চিহ্নিত করা স্থানে নিয়ে যাওয়া হল। সেই সময় ভক্ত-অনুরাগীদের “জয় শ্রীগুরুমহারাজজি কী জয়”, “জয় স্বামীজি মহারাজজি কী জয়” ধ্বনিতে মঠপ্রাঙ্গণ মুখরিত। বিকেল চারটের সময় চিতায় অগ্নিসংযোগ করা হল। সন্ধে ছ’টা নাগাদ চিতা নির্বাপিত হলে স্বামীজির পবিত্র ভস্মাস্থি সংগ্রহ করে তা রাখা হল বেলুড় মঠের পুরনো শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরে। পরে যখন স্বামীজির দাহস্থানে তাঁর স্মৃতিমন্দির গড়ে উঠল, তখন স্বামীজির পূতাস্থি সেই পুণ্যভূমিতে সমাহিত করা হল।

বেলুড় মঠে গঙ্গাতীরস্থ স্বামীজির স্মৃতিমন্দিরটি বর্তমান বছরে শতবর্ষ পূর্ণ করেছে। ১৯২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা। ওই বছরই অল্প সময়ের ব্যবধানে (৭ ফেব্রুয়ারি) প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীরামকৃষ্ণের মানসপুত্র, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম অধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দের স্মৃতিমন্দির। সেই মন্দিরও এই বছর শতবর্ষ পূর্ণ করল।

স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিমন্দির। ছবি সৌজন্য: বেলুড় মঠ

জানা যায়, স্বামীজির দেহত্যাগের অব্যবহিত পর থেকেই ওই পবিত্র স্থানটি বিশেষ ভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ করা হয়েছিল। কাশীর ‘বীরেশ্বর’ শিবের প্রসাদে নরেন্দ্রনাথের জন্ম। তাঁর অপর নামও ‘বীরেশ্বর’। স্বামীজির শিবস্বরূপের কথা স্মরণে রেখে প্রথমে বেলুড় মঠের অছি পরিষদে প্রস্তাব গৃহীত হয়, স্বামীজির দাহস্থানে ২৫০০ টাকা ব্যয়ে নাটমন্দির-সহ একটি শিবমন্দির নির্মাণ করা হবে। পরে শিবমন্দিরের পরিবর্তে শুধুমাত্র স্বামীজির মন্দিরের নীচের তলার ক্ষুদ্রায়তন গর্ভমন্দিরটি নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছিল। স্বামীজির স্মৃতিমন্দির নির্মাণের কাজে প্রধান সমস্যা ছিল অর্থাভাব। জানা যায়, বেলুড় মঠ কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে স্বামীজির একতলা সমাধিমন্দিরটির সঙ্গে শিবমন্দির, কখনও মঠে আগত সাধুদের জন্য বিশ্রামাগার, কখনও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ধর্ম-দর্শন সংক্রান্ত বিশাল লাইব্রেরি, আলোচনার জন্য একটি সমাবেশকক্ষ, সেই সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক ধর্মবক্তৃতার স্থান, আবার কখনও একটি বেদ-বিদ্যালয় গড়ে তোলার ভাবনাচিন্তা করেছিলেন। কিন্তু অর্থের অভাবে কোনও পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হয়নি।

স্বামীজির আকস্মিক প্রয়াণে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনকে ভিতরে ও বাইরে অনেক রকমের জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাই সেই সব সমস্যার কিছুটা সুরাহা এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হতে প্রায় সাড়ে চার বছর সময় লেগে যায়। স্বামীজির মাদ্রাজনিবাসী ভক্তরা স্বামীজির স্মৃতিমন্দির নির্মাণকল্পে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে কিছু অর্থ সংগ্রহ করেন। ‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’ প্রণেতা শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর বইয়ের সর্বস্বত্ব বেলুড় মঠকে দান করেন। স্বামীজির গুরুভাই ত্রিগুণাতীতানন্দ এবং হিমালয়ের কোলে মায়াবতীতে অবস্থিত ‘অদ্বৈত আশ্রম’ স্বামী বিবেকানন্দ-স্মৃতিমন্দির নির্মাণ তহবিলে কিছু অর্থ দান করেন। স্বামীজির আবির্ভাবের ৫০তম বর্ষে স্বামী ব্রহ্মানন্দ ‘প্রবুদ্ধ ভারত’, ‘মরাঠা’ প্রভৃতি পত্রিকার মাধ্যমে পাঠক ও স্বামীজির ভক্ত-অনুরাগীদের কাছে এই কাজের জন্য অর্থসাহায্যের আবেদন করেন। কিন্তু এই আবেদন প্রকাশের প্রায় এক বছর পর যে অর্থ সংগৃহীত হয়েছিল, তা আশানুরূপ ছিল না।

স্বামী ব্রহ্মানন্দ চেয়েছিলেন, “…গঙ্গার পবিত্র তীরে স্মারক মন্দিরখানির শিখর ভারতবর্ষের দেশপ্রেম তথা ধর্মচেতনার প্রতীকরূপে মস্তক উন্নীত করিয়া গগন স্পর্শ করিবে।” তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে সুদীর্ঘ সতেরো বছর (১৯০৭-১৯২৪) লেগেছিল। দু’টি পর্যায়ে স্বামীজির স্মৃতিমন্দিরটি গড়ে ওঠে। ১৯০৭ সালের ১০ মার্চ স্বামীজির মন্দিরের ভিত্তিপত্তন হয় এবং ১৯০৯ সালে বেদি-সহ একতলা গর্ভমন্দিরটি নির্মিত হয়। স্বামী জ্ঞানাত্মানন্দের স্মৃতিকথা অনুযায়ী, সেই সময় স্বামীজির মন্দিরের কাছাকাছি “…অন্য কোনও মন্দিরাদি ছিল না। মঠ বাড়ির অংশ ছাড়া তাহার দক্ষিণ দিকে, স্বামীজির মন্দিরের দিকেও, কোনও পোস্তা বাঁধানো হয় নাই। জোয়ারে গঙ্গার জল প্রায় স্বামীজির মন্দিরের কাছাকাছি আসিয়া পড়িত। …অতি অল্প লোকই তখন সেদিকে আসিতেন।”

মন্দিরটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় বহুকাল থাকার পর, ১৯২০ সালে পুনরায় মন্দিরের নির্মাণকাজ আরম্ভ হয়। এই মন্দির নির্মাণের কাজ অত্যন্ত ধীর গতিতে এগিয়েছে। বার বার পরিকল্পনা বদলেছে। জিনিসপত্রের অত্যধিক দামের কারণে একাধিক বার মন্দির-নির্মাণের কাজ স্থগিত রাখতে হয়েছে। শেষে ঋণ করে মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ করতে হয়েছে। স্বামীজির স্মৃতিমন্দিরের রূপকার ছিলেন স্বামীজির ইঞ্জিনিয়ার গুরুভাই, স্বামী বিজ্ঞানানন্দ। বেলুড় মঠের শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরের রূপকারও তিনিই। বিজ্ঞানানন্দজি শ্রীরামকৃষ্ণ-মন্দিরের নকশার মূল তত্ত্বগুলি নিয়েই স্বামীজির সমাধিমন্দিরের পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছিলেন। স্বামীজির প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল স্বামী বিজ্ঞানানন্দ মন্দির-নির্মাণকার্যের তদারকির সময় মিস্ত্রি-মজুরদের বলতেন, “দেখো বাবারা, ঠিক ঠিক ভাবে কাজ করো। এ শিবের মন্দির তৈরি করছ; খুব সাবধান, খুব সাবধান।”

নীচে, স্বামী ব্রহ্মানন্দের স্মৃতিমন্দির। ছবি সৌজন্য: বেলুড় মঠ

স্বামীজি তৎকালীন মাদ্রাজে একটি বক্তৃতা দেওয়ার সময় একটি অসাম্প্রদায়িক মন্দির নির্মাণের কথা বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, সেই মন্দিরের উপাস্য হবেন শুধুমাত্র ‘ওঁ’ অর্থাৎ ওঙ্কার। স্বামীজির কাছে ওঙ্কার ছিল সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রতীক। তাই ১৯২৩ সালে মঠ-কর্তৃপক্ষ স্থির করেন যে, স্বামীজির স্মৃতিমন্দিরের দোতলায় সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রতীকরূপে ওঙ্কারের প্রতীকযুক্ত একটি বেদি নির্মাণ আবশ্যক। অবশেষে ১৯২৩ সালের শেষের দিকে স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিমন্দির নির্মাণ সম্পন্ন হয় এবং তা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি। সে দিন ছিল স্বামীজির ৬২তম জন্মতিথি। সেই উপলক্ষে প্রায় ৫০০০ দরিদ্র ও ভক্তনারায়ণ প্রসাদ পেয়েছিলেন। এই মন্দির নির্মাণে প্রায় ৪০,০০০ টাকা খরচ হয়েছিল। এর মধ্যে ১০,০০০ টাকা দেনা করে কাজ শেষ করতে হয়।

গঙ্গাতীরে পশ্চিমমুখী স্বামীজির স্মৃতিমন্দিরটি ভূমিতল থেকে সাড়ে ৭৮ ফুট উঁচু। মন্দিরের শীর্ষে স্থাপিত ত্রিশূলটি প্রায় ৪ ফুট লম্বা। মন্দিরের নীচের তলায় বর্গাকৃতি মূল গর্ভমন্দিরে মার্বেলের তৈরি স্বামীজির বাস-রিলিফ মূর্তি। এই ধরনের মূর্তির কারুকার্যগুলি খোদিত পৃষ্ঠতল থেকে সামান্য উঁচু হয়ে থাকে। মূর্তিটি সরু কাঠের ফ্রেম দিয়ে বাঁধানো। ফ্রেম-সহ মূর্তিটির উচ্চতা ৫ ফুট ও চওড়ায় ৩ ফুট ৬ ইঞ্চি। স্বামীজির আমেরিকান শিষ্যা মিসেস
বেটি লেগেটের অর্থে এবং ভগিনী নিবেদিতার উৎসাহে জয়পুরের জনৈক ভাস্কর স্বামীজির ধ্যানমগ্ন মূর্তিটি নির্মাণ করেন। সহসা মূর্তিটি দেখলে মনে হবে যেন জীবন্ত। যেন সমাধিমন্দিরে বসে স্বামীজি সত্যিই ধ্যান করছেন এবং সন্ধান করছেন ভারতের মোহনিদ্রা থেকে জাগরণের পথ। মূর্তির নীচে শ্বেতপাথরে মোড়া বেদিটিই হল স্বামীজির পাঞ্চভৌতিক
দেহের দাহস্থান।

মন্দিরের দোতলায় একটি দুই ফুট উচ্চতার কালো পাথরের বেদির উপর একটি শ্বেতপাথরের পাদপীঠ। তার উপর প্রায় ১৫ ইঞ্চি উঁচু এক শ্বেতপাথরের কলসে প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর অ্যালাব্যাস্টার বা স্বচ্ছ তেলপাথরের তৈরি ওঙ্কার। এটির নির্মাতা খিদিরপুরের ‘কুতরা স্টোন ওয়ার্কস’। প্রথম দিকে স্বামীজির মন্দিরের দু’পাশ দিয়ে খাড়া ও সঙ্কীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঙ্কার মন্দিরে উঠতে হত। পরে স্বামীজির অনুরাগী মিস ম্যাকলাউডের বান্ধবী মিসেস ব্রিউস্টারের তৈরি করা নকশা অনুযায়ী পুরনো সিঁড়ির স্থানে নতুন অর্ধচন্দ্রাকৃতি সিঁড়ি তৈরি করা হয়।

স্বামীজির এই মন্দিরটি যেন পুণ্যভূমি ভারতের ঘনীভূত রূপ। মন্দিরের দ্বিতলের ওঙ্কার হল ধর্ম অর্থাৎ ভারতের প্রাণ, এবং নীচে সমাধিমন্দিরে বিরাজ করছেন ভারতের আত্মা। স্বামীজির স্মৃতিমন্দিরের অদূরে অবস্থিত স্বামী ব্রহ্মানন্দের স্মৃতিমন্দির নির্মাণের ব্যয়ভার বহন করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত নবগোপাল ঘোষের তৃতীয় পুত্র শ্যামসুন্দর ঘোষ। মন্দিরের একতলায় গর্ভমন্দিরে বিরাজিত স্বামী ব্রহ্মানন্দের শ্বেতপাথরের অপূর্ব মূর্তিটি বেলুড় মঠে প্রতিষ্ঠিত প্রথম পূর্ণাবয়ব মূর্তি। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামী ব্রহ্মানন্দকে ‘গোপাল’ জ্ঞান করতেন। তাই এখানে মহারাজের মূর্তির সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বালগোপাল মূর্তিও পূজিত হন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement