‘কৈশোরে হারিয়েছিলাম অতি প্রিয় একটা
চন্দনকাঠের বোতাম
এখনও নাকে আসে তার মৃদু সুগন্ধ
শুধু সেই বোতামটা হারানোর দুঃখে
আমার ঠোঁটে কাতর ক্ষীণ হাসি লেগে থাকে’
—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (চন্দনকাঠের বোতাম)
আমাদের কৈশোরে, না কৈশোর বলাটা বাড়াবাড়ি হবে, সেই বালক বয়সে কোনও খসে পড়া চন্দনকাঠের বোতাম ছিল না। তবে রঙিন ম্যাগাজ়িন খুললেই পাতাজোড়া ব্লোআপ ছিল। হয়তো সামান্য একটা গ্রুপ ফোটো। সেন্টারস্প্রেডে আপাত-সাদামাটা কয়েকটি মূর্তির গায়ে নীল-সাদা জার্সি। ফ্রেমের বাঁ ধারে দাঁড়ানো বেঁটেখাটো মস্তান গোছের লোকটাকে দেখেও বোঝা যাচ্ছিল না, পায়ে সাদা-কালো চর্মগোলকটি পেলে কী অপূর্ব ছন্দের কবিতা সে লিখতে পারে। তার সেই শিল্প আমরা অনেকেই তখনও দেখার সুযোগ পাইনি! মুগ্ধতার তাতে ঘাটতি ছিল না। ওই ছেলেগুলো অনায়াসে হয়ে ওঠে আমাদের শৈশবের লোকগাথার শরিক। সে সব সাড়ে তিন দশক আগের কথা। কলকাতা থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরের এক মফস্সলি ইস্কুলের হস্টেল-কাহিনি। আমাদের হামলে-পড়া হাতে হাতে ঘুরত পত্রিকার পাতার ছবিওয়ালা টানাহ্যাঁচড়ার খাতাগুলো। সেই সব ছবি অন্তর্ধান-রহস্য ঘিরেই সে বছর আমরা যেন এক টান-টান গোয়েন্দাকাহিনির চরিত্র হয়ে উঠি।
পৃথিবীর বয়স তখন ঢের কম ছিল অবশ্যই। আর দিনগুলো বড় সহজেই রঙিন হত। কিন্তু বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের পরই গ্রীষ্মের ছুটি ফুরিয়ে গেল আমাদের। স্কুল খুললে হাফ ইয়ার্লি। আমাদের ফিরে যেতে হবে বাড়ি থেকে এক রাত্রির ট্রেন সফরের ও পারে সেই বাঘের খাঁচার হস্টেলে। সবই পূর্ব ঘোষণামাফিক। তবু মনে হচ্ছিল, এ তো মৃত্যু পরোয়ানা! মারাদোনাদের সেমিফাইনাল, ফাইনাল খেলার থেকে কী সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসের মরসুমি পরীক্ষা! জীবনের সব যন্ত্রণা, বিয়োগব্যথার তাপ থেকে সন্তানকে আগলে রাখা সুরক্ষিত পরিবারের দুর্গে সেই প্রথম আমার শোকের অনুভব! যেন বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল নয়, আসলে আমরাই ছিটকে গেছি টাইব্রেকারে। মনখারাপের সেই ভুবনে নানা নিষেধাজ্ঞার চেকপোস্ট পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক জেলার ঊষর জমির ক্যাম্পাসে পৌঁছল দু’-এক খণ্ড রঙিন পত্রিকা। আর আমাদের পলকা বুকের ফুসফুস নিমেষে সাত সাগরের বাতাস ভরে নিল। এর হপ্তাতিনেক আগেই সম্ভবত মেক্সিকোয় বিশ্বকাপ ফুটবলের নিষ্পত্তি ঘটে গেছে। না, পুরুলিয়ার হস্টেলের বাঘের খাঁচায় সে যুগেও টিভির গর্জন ঢুকে পড়ার ছিদ্র ছিল না। বিশ্বকাপের ফলাফল আমরা হয়তো বা শুনেছিলুম, ক্লাসের ফাঁকে কোনও মাস্টারমশাইয়ের উৎসাহী কিন্তু অগোছালো তর্জমায়। যদিও যদ্দূর মনে পড়ে, সেই স্কুল ক্যাম্পাসের লৌহকপাট ভেদ করে তখনও গুরুপল্লির গৃহস্থ শিক্ষকদের সংসারেও টিভি সেট বসানোর অনুমতি ছিল না। শুনেছি কলকাতার অনেক সরকারি স্কুলে বিশ্বকাপের ধ্রুপদী সব ম্যাচের রেকর্ডিং পড়ুয়াদের দেখাবেন বলে ক্যাসেট নিয়ে তখন ঘুরছেন অমল দত্ত। ক্যাম্পাসে অজস্র খেলার মাঠ আমাদের। কিন্তু খেলা দেখার জো নেই। শুধুমাত্র মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের দ্বৈরথে স্কুল একটু আগে ছুটি হত। ছেলেদের সদনে সদনে স্পিকারে বাজানো হত রেডিয়োর রিলে। কিন্তু গভীর রাতের বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে পড়ুয়াদের ছকে-বাঁধা রুটিন ভাঙার দায় সে যুগে স্কুল কর্তৃপক্ষ আদৌ জরুরি মনে করেননি।
তবু মনা, সুব্রত, সুদীপ, কৃশানু, প্রশান্ত, বিদেশ, চিমা, মানি, জামশিদদের বৃত্ত থেকে আমাদের জগতে একটা অমোঘ পরিবর্তনের ঢেউ আসাটা তখনই অনিবার্য হয়ে ওঠে। তখন পুরুলিয়ায় সকালের কাগজ দুপুর বা বিকেলে এসে পৌঁছত। এক দিনের বাসি কাগজ আর রেডিয়োর খবর থেকে বাছাই করে ইংরেজির মাস্টারমশাই শক্তিদার তত্ত্বাবধানে স্কুল অ্যাসেম্বলিতে দিনের খবর পড়ে শোনাত ক্লাস নাইনের কোনও ছাত্র। একটু উঁচু ক্লাসে উঠলে রাতে হস্টেল সদনের রিডার্স রুমে সকালের কাগজ দেখতে আমাদের ভিড় জমত। কিংবা তার আগেই রাতের আহার সেরে ডাইনিং হলের ম্যানেজার সন্ন্যাসী মহারাজের অফিসের পাশে আমরা জড়ো হতুম। সকালের কাগজের পাতাগুলো ছুঁতে চলত কাড়াকাড়ি। বিশ্বকাপ ম্যাচের স্কোরটুকু এক বার ছাপার অক্ষরে দেখতে আমাদের সে কী কাঙালপনা! নইলে স্কুলের সাপ্তাহিক লাইব্রেরি ক্লাসের অপেক্ষায় থাকত ফোর, ফাইভ, সিক্সের খুদেরা। মারণ রোগে ঘর-বন্দি খেলাপাগল কিশোর আনন্দর গল্প শুনিয়েছিলেন মতি নন্দী। টিভি-যুগ শুরুর আগে ম্যাচের ছিটেফোঁটা না দেখেও যে গড়গড়িয়ে বলতে পারে উইম্বলডন ফাইনালে কোনর্স বনাম রোজ়ওয়ালের মহাকাব্যিক টক্করের প্রতিটি সার্ভিস বা রিটার্নের খুঁটিনাটি। মফস্সলি শৈশবে বাসি কাগজে আমরাও শুষে নিতুম গোলের কিছু মুভ, চমকপ্রদ সেভ, বিজয়ী বা বিজিত তারকার শরীরী বিভঙ্গ। ‘আর্জেন্টিনাই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ বা ‘পেনাল্টি মিস সক্রেতিস, জ়িকো, প্লাতিনির’ মার্কা শিরোনামগুলো বর্শার ফলার মতো আমাদের হৃদয়ে গেঁথে থাকত। গেঁথে আছেও অনেক দিন, অনেক বছর, অনেক দশকের পার।
হয়তো কিছুটা বোঝাতে পারছি, সেই কাঙালপনার বুভুক্ষু শৈশবে বিশ্বকাপ কিংবা খেলার পত্রিকার একটা ছবির কী মূল্য ছিল। ’৮৬-র বিশ্বকাপ ফাইনাল ছিল ২৯ জুন। আগের দিন পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তবে কড়া অনুশাসনের হস্টেলে রাতের শেষ ঘণ্টা, থার্ড বেলের পর মশারির বাইরে থাকার অনুমতি ছিল না। মেক্সিকো সিটির আজ়টেকা স্টেডিয়ামে মারাদোনা, রুমেনিগেদের মাঠে নামতে নিশ্চয়ই তখনও কিছুটা দেরি ছিল। এর কিছু দিন পরই আমাদের হাতে আসে মহার্ঘ পত্রিকাগুলি। এই ২০২২-এও বিশ্বকাপের খেলা দেখার সঙ্গী হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দিনভর সহচর, কুলদীপ দত্ত সেই স্কুলবেলার বন্ধু। ওর কাছে এখনও আছে, ১৯৮৬-র জুলাইয়ের দু’-তিন সপ্তাহে পর পর প্রকাশিত সেই ইংরেজি খেলার পত্রিকা। একটি কভারে ঝকমক করছেন ফাইনালে জয়ের গোল স্কোরার বুরুচাগা। অন্য দু’টিই মারাদোনাময়। সহখেলোয়াড় অস্কার রুগেরির কোলে শিশুর মতো আদররত, বা পরম কাঙ্ক্ষিত কাপটি আঁকড়ে আহ্লাদে ভরপুর বিশ্বকাপ নায়ক। এই সংখ্যাগুলির কোনও একটিতেই সম্ভবত মধ্যিখানের দু’পাতা জুড়ে ছিল ব্লোআপে টিম আর্জেন্টিনার ছবিটা। যা হস্টেলে কী ভাবে উধাও হয়ে যায়। সে রহস্যও বিশ্বকাপের মতোই সাড়া ফেলেছিল আমাদের অল্পে খুশির কিশোরবেলায়। তখন আমাদের অঙ্ক, ভূগোলের পুরনো খাতাতেই মুখ গুঁজে থাকেন দুনিয়ার ক্রীড়াতারকারা। হস্টেলের ঘরের দেওয়ালে ফ্যানবয়গিরির অনুমতি না থাকলেও অনেকেরই নিজস্ব দেওয়াল-আলমারির ভিতরের পাল্লায় শোভা হয়ে আছেন মারাদোনা, প্লাতিনি বা কপিল, ইমরান। কিন্তু টিম আর্জেন্টিনার ছবি কে হাপিশ করল? মাস্টারমশাইদের বিস্তর তদন্ত তল্লাশির পরেও ফয়সালা হয়নি। সকাল-সন্ধেয় ক্লাসঘরে রোজকার পড়াশোনার সময়টাতেই দু’-এক জন দুষ্টু ছেলে কদাচিৎ তক্কে তক্কে থাকত অমুকের বাড়ি থেকে পাঠানো ক্রিম বিস্কুট বা ছবিওয়ালা ম্যাগাজ়িনের লোভে। হস্টেল তখন ফাঁকা! প্রাকৃতিক প্রয়োজনে হস্টেলে যাওয়ার কথা বলে ঘরে ঢুকেই সম্ভবত কেউ ঘটায় সেই ‘অপারেশন আর্জেন্টিনা’। স্কুলের তখনকার গেমস টিচার, মায় ক্লাস ফাইভের ওয়ার্ডেন অশোক ঘোষাল হাসতে হাসতে বললেন, “বিশ্বকাপ নিয়ে যা পাগলামি ছিল তোদের, ফেলুদা বা শার্লক হোমসকেই বোধহয় সেই আর্জেন্টিনা অন্তর্ধান রহস্যভেদের চ্যালেঞ্জ নিতে হত।”
বিশ্বকাপ এলে কিছু সোনালি দুঃখ এবং সে দিনের ইস্কুলের কথাই সবার আগে মনে পড়ে। বিশ্বকাপ এবং সেই ইস্কুলই সে বছর আমাদের শিখিয়েছিল, কাকে বলে ট্র্যাজেডির নিষ্ঠুর অভিঘাত। গ্রিক ট্র্যাজেডির কঠোর দেবতারা অনায়াসে সুখী, তৃপ্ত, পরিপূর্ণ জীবনের ছক হঠাৎ উল্টে দিতে পারেন। যেমন পাহাড়ি পথের মুগ্ধ আবেশ ভেঙে বাঁকের মোচড়ে খাঁ খাঁ করে খাদের অতল হাঁ। বল, বুটের ঠোক্করে অবিশ্বাস্য বাঁক নেওয়া ফ্রি-কিকও দুর্দম নিয়তির মতোই রক্ষণব্যূহ ভেঙে বয়ে আনে ঘোর বিপর্যয়। কিন্তু সেই হার, জিত, আনন্দ, বেদনায় মিশে থাকে উত্তরণেরও মন্ত্র। ফুটবল জীবনেরই রূপক। ১৯৮৬-র সেই গ্রীষ্মে নানা আজব ঘটনায় আসলে আমাদের গভীর জীবনতত্ত্ব শেখার ক্লাসই শুরু হয়েছিল।
শুনেছি, কলকাতায় টিভি-যুগ শুরুর পরে ১৯৭৮-এর বিশ্বকাপ ফাইনালের রেকর্ডিং দেখানো হয়। আর ’৮২তে সেমিফাইনাল থেকে লাইভ টেলিকাস্ট হয়েছিল বিশ্বকাপের খেলা। কিন্তু ১৯৮৬ দৃশ্যতই আলাদা। মেক্সিকোয় বিশ্বকাপের মহাভোজে এক মাস ধরে নেমন্তন্নের আসরে কেন ব্রাত্য থাকব আমরা? কেন গ্রুপ লিগ থেকে সব খেলা দেখানো হবে না— এই মর্মে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর কাছে বাংলা, গোয়া, কেরল, পঞ্জাবের মতো অনেক রাজ্য থেকেই জোরালো আর্জি জমা পড়ে। ছাদের অ্যান্টেনায় বুস্টার নামক যন্ত্র বসিয়ে বহু কসরতে বাংলাদেশ টিভি ধরে বিশ্বকাপের সব ম্যাচ দেখার মরিয়া চেষ্টাও শুরু হল কলকাতায়। তাতে দিনভর ধকলটাই সার হত। অনেক সাধ্যসাধনার পরে টিভির মাথায় বাবা-বাছা বলে চড়চাপড় মেরে খেলার মাঝপথে আবছা ছবি এলে ঘরভরা বিশ্বকাপ পাগলের দল হাততালিতে ফেটে পড়ত। রাজীব গান্ধী অবশেষে ফুটবলপ্রেমী জনতার দাবি মেনে নেন। গ্রুপ পর্ব চলতে চলতেই অতএব দূরদর্শনেও বিশ্বকাপের সম্প্রচার শুরু। তাতেই স্পষ্ট সঙ্কেত ছিল, তখনও অজানা শব্দ ‘বিশ্বায়ন’-এর ছোঁয়ায় দুনিয়ার আগামী চেহারাটায় ঠিক কী কী হতে চলেছে। বাড়ির সাদাকালো টিভির ঝিরঝিরে ছবিতে সেই প্রথম স্প্যানিশ শব্দের ছোঁয়ায় ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানির ইংল্যাটেরা, পোলোনিয়া, অ্যালেমেনিয়া অবতারে আত্মপ্রকাশ। আমাদের নিষ্পাপ শৈশবে গ্যালারির সাম্বা-সুন্দরীদের আবেদনের আঁচও প্রথম ফুলকি ছড়িয়ে গেল। রবিবাসরীয় সকালে (এখন বিস্মৃত) ক্রাউনিং গ্লোরি সাবানের বিজ্ঞাপনে ডিম্পল কাপাডিয়ার আগুনে উপস্থিতি তখনও টিভি সেটগুলো জ্বালিয়ে দিতে শুরু করেনি।
রামায়ণ, মহাভারতের সিরিয়ালে পৌরাণিক নারীদের চাক্ষুষ করারও ঢের দেরি। তার আগে মারাদোনা, বুরুচাগা, জ়িকো, কারেকা, রুমেনিগে, শুমাখার, তিগানাদের সঙ্গে সঙ্গে চোখ টানল ফুটবল গ্যালারিwর রূপসী প্রমীলা ব্রিগেড। আমাদের ময়দানের সবুজ গ্যালারি, র্যাম্পার্টের পাশে সেও যেন ভিনগ্রহের আমেজ। বাঙালির ঘরকুনো মধ্যবিত্ত পরিসরে এক অন্য পৃথিবীর উত্তাপে ছোট, বড় সবাইকেই এক রকম সাবালকত্বের পথে এগিয়ে দিল মেক্সিকান ঢেউয়ের ক্যালেইডোস্কোপ।যা বলেছি, জীবনের প্রথম শোককেও আমাদের অনেকেরই সেই প্রথম চিনতে শেখা। ১৯৮৩, ’৮৫-তে লর্ডস, মেলবোর্নে ইন্ডিয়ার এক দিনের ক্রিকেটে বিশ্বজয় তত দিনে দেখা হয়ে গিয়েছে। শুধু অপ্রত্যাশিত নয়, আশাতীতের মাত্রাও বেশ কয়েক ডিগ্রি ছাড়িয়ে আন্ডারডগ বা বিশ্ব-হেরোর সে ইচ্ছাপূরণ। এর আগে ভয়ঙ্কর বেদনায় কুপোকাত হওয়া বলতে আমাদের মোহনবাগান-বাড়িতে ইস্টবেঙ্গলের কাছে পাঁচ গোলে ভরাডুবির গল্প শুনেছি। আমার দুই কাকা মুখ চুন করে সে হারা ম্যাচ দেখে বাড়ি ফিরেছিল। বেচারিদের নতুন চাকরি— শরীর, মন বিগড়ে সম্ভবত আপিস কামাইও ঘটে। কিন্তু সে তো সবটাই শোনা গল্প। নিজে সরাসরি অনুভব করা নয়। ১৯৮৬-র বিশ্বকাপ শুধু আমাদের মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলময় ময়দানি জগতে অলৌকিক ফুটবলের দরজা খোলেনি, ছুরিতে ফালা-ফালা করা একটা যন্ত্রণার মাধুর্যও বুকের মধ্যে ছড়িয়ে দিল।সেই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের বছরেই সম্ভবত আনন্দবাজার বা দেশ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় ‘ব্রাজিল’ গল্পটি লেখেন দিব্যেন্দু পালিত। তখন কলকাতাতেও সবার বাড়িতে টিভি থাকত না। সম্পন্ন পড়শির বাড়ি টিভিতে ব্রাজিলের জোসিমারের গোল দেখে কাচের টেবিলে লাথি মেরে বসা এক মধ্য পঞ্চাশের বালকের গল্প। টিভির দোকানদারকে পটিয়ে টানাটানির সংসারে বিলাসিতার ইলিশ খাইয়ে ব্রাজিলের টানে কালার টিভি ভাড়া করলেন কিঙ্কর দত্ত। ব্রাজিলের জন্য ভালবাসা তাঁর ছেলে সমুকে ভালবাসারই সমান। ব্রাজিল এ ম্যাচটা জিতছেই! কিঙ্করবাবুর অপেক্ষা, তার পর রাত পোহালেই ফ্রান্স কিংবা আর্জেন্টিনা সমর্থক অফিসের নচ্ছার বসের চোখে চোখ রেখে এক বারটি ঘাড় সোজা করে তাকাবেন। গল্পের শেষে তাঁর জন্য শুধুই শূন্যতার আঁধার। হলুদ, সবুজ জার্সির দেশের টানে কোথাকার কলকাতার পাগলামির অনুপুঙ্খ দলিল সে আখ্যানের ছত্রে ছত্রে।আমরা সবে কাগজ পড়তে শেখা ছোটরা অনেকেই তখন বাড়ির বড়দের ব্রাজিল-ভক্তির জবাবে পাওলো রোসির ইটালি বা প্লাতিনির ফ্রান্সের নামে জবাব দিতে শিখেছি। যদিও মোহনবাগান-মেম্বার ‘ব্যাঙ্ক কাকা’ (ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন বলে) তত দিনে দেরাজ খুলে সব থেকে মহার্ঘ পারিবারিক সম্পদটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। টাকাপয়সা, সোনাদানা নয়, স্রেফ একটি স্মারক-পুস্তিকা! ১৯৭৭-এ ইডেনের কাদা মাঠে পেলের কসমসের সঙ্গে ফুটবল ম্যাচ উপলক্ষে মোহনবাগানের সুভেনির। সবুজ মাঠে সাদা কালো ফুটকির ফুটবলের সঙ্গে সম্ভবত পেলেরও ছবি ছিল কভারে। ভিতরে দু’দলের খেলোয়াড়দের সচিত্র খুঁটিনাটি। কাকা বোঝায়, ফুটবল সম্রাটের ছোঁয়াচটুকুর সুবাদে ভারতের সঙ্গে ব্রাজিল-সেতুর নাম নাকি আমাদের মোহনবাগান। ফুটবল-আভিজাত্যের এত বড় গয়না এ দেশে আর কার আছে! তৎকালীন টাইগার হলে ‘৮২-র বিশ্বকাপ নিয়ে সিনেমা ‘গোল’ দেখে এসেও চোখে লেগে থাকে ‘জোগো বোনিতা’! গোলসন্ধানী পাওলো রোসির কাছে হেরেও অবিস্মরণীয় ব্রাজিলের ফুটবল-সৌন্দর্য। মহাভারতের অর্জুনের থেকেও কর্ণকে বেশি ভালবেসে ফেলি আমরা। তখন রাতে হার্ডকভারে ফুটবলের ‘বুক অব এক্সেলেন্স’ কিংবা গুচ্ছের বাংলা খেলার পত্রিকা জড়িয়ে ঘুমোতে যায় আমাদের প্রজন্মের কেউ কেউ। ভাই-বোনের অনন্ত ফুটবল-জিজ্ঞাসার মোকাবিলায় মুশকিলে পড়ে বেচারি মা-বাবারা! ছেলের কাছে অপ্রস্তুত হওয়া ঠেকাতে রাতে সে ঘুমোনোর পরে মাকেও খেলার পত্রিকাগুলো তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে হোমওয়র্ক সেরে রাখতে হয়। তবে পেলে, ভাভা, ডিডি, গ্যারিঞ্চা থেকে টোস্টাও, জেয়ারজ়িনহোর অলৌকিক জয়গাথা ছাপিয়ে আমায় বিদ্ধ করে পর্তুগালের ইউসেবিয়ো, হল্যান্ডের ক্রুয়েফ বা হাঙ্গেরির পুসকাস, হিদেকুটি, ককসিসের বীরগাথাও। নিয়তির বিধানে সেরার শিরোপা থেকে যারা বঞ্চিত, কিন্তু লড়াইয়ের শৌর্যে এক ফোঁটাও কম নয়! আবার মেক্সিকোয় জোয়েল বাত্সের কাছে ঠকে যাওয়া জ়িকোর পেনাল্টি বা কারেকা, জুনিয়রদের পর পর গোল মিসে ব্রাজিলের বিদায় এক ধরনের না-পাওয়ার রং লেপে দেয় সেই ছেলেবয়সের ক্যানভাসে। কে সি নাগের অঙ্কের চেয়ে ঢের সহজে তখন আমাদেরও মাথায় বসে যায় ১৯৩০ থেকে শুরু হওয়া বিশ্বকাপের ইতিহাস! কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালের পরে খেলা দেখার পাট চুকিয়ে ফিরতেই হয় ইস্কুলে পরীক্ষার টানে।এর চার বছর বাদেও বিশ্বকাপে ভাগ্যদেবীর বিচিত্র খেলা। তখন ক্লাস নাইন! স্কুল ক্যাম্পাসের ডাইনিং হল কর্মীদের ধর্মঘটে শেষ মুহূর্তেই পিছিয়ে দেওয়া হল ইস্কুল খোলার তারিখ। আর আমরা বাড়িতে বসে বিশ্বকাপের শেষ বিন্দু পর্যন্ত চেখে দেখবার অপ্রত্যাশিত সুযোগ পেয়ে যাই। তত দিনে বাঙালির ব্রাজিল-প্রেমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর্জেন্টিনা-আবেগও রীতিমতো জোরদার, যার কেন্দ্রে একমেবাদ্বিতীয়ম মারাদোনা। মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ডিফেন্স ফালা-ফালা করে মারাদোনার শতাব্দীর সেরা গোলের পরে অন্নদাশঙ্কর রায় পর্যন্ত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের নৈতিকতা নিয়ে মাথা ঘামাননি। তাঁর ছড়া বলেছে, ‘মেকসিকোতে যাচ্ছে শোনা/ মারাদোনা! মারাদোনা! /…ফকল্যান্ডের যুদ্ধে হেরে/ ইংল্যান্ডকে দিল মেরে/ শোধবোধ অস্ত্র বিনা/ আর্জেন্টিনা আর্জেন্টিনা’! আর ১৯৯০-এর ফাইনালে হারের পরে অন্নদাশঙ্কর যেন শোকে বিমূঢ়! ‘ঘাটে এসে ডুবল তরী/ এ কী বিষম দুর্ঘটনা!/ জার্মানরা পেনাল্টিতে করল যেন তুলোধোনা!/ কী বেদনা! কী বেদনা!/ মারাদোনা! মারাদোনা!’আনন্দবাজার পত্রিকাতেও পরের দিন সুভাষ ভৌমিকের ম্যাচ রিপোর্ট শুরুই হয়, পরাজিত মারাদোনার কান্নায় ভেঙে পড়া দিয়ে। রোম থেকে রূপক সাহার রিপোর্টেও এক রকম সস্নেহ প্রশ্রয়, খ্যাতি অর্থ পেয়েও ‘মাটির মানুষ’ মারাদোনার ছেলেমানুষির প্রতি। যিনি সেই ম্যাচ হেরেও প্রতিপক্ষের অধিনায়ক পশ্চিম জার্মানির লোথার ম্যাথাউসের সঙ্গে হাত মেলাতে চাননি। মারাদোনার কান্নার ছবি দেখতে দেখতেই সেই নব্বইয়ের দশকে কিছুটা ডাঁটো হয়ে আমরা সুনীল, শক্তিকে পড়ছি। ‘রমণী দমন করে বিশাল পুরুষ তবু কবিতার কাছে অসহায় থুতু ও পেচ্ছাব সেরে নর্দমার পাশে বসে কাঁদে!’ (‘পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর কিছুই থাকে না’/ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) কিংবা হয়তো ভাবছি, ‘কখনো ফিরে পাবো না সেইসব দিন যা ঝড়-বৃষ্টি-রৌদ্রে হেমন্তে ভরা/ সেইসব বাল্যকালের নগ্নতার কান্নার পয়সা-পাবার-দিন/ ফিরে পাবো না আর...’ (‘আমরা সকলেই’/ শক্তি চট্টোপাধ্যায়) চার বছর অন্তর এক-একটা বিশ্বকাপে সকল প্রতাপ অবসিত পুরুষের এই চিত্রকল্প কিন্তু ঘুরেফিরে আমাদের ধাক্কা দেয়। মুখগুলো হয়তো পাল্টে পাল্টে যাবে। কিন্তু সক্রেতিস, জ়িকো, প্লাতিনির পরে ১৯৯০ বলতে ইটালির মালদিনি, দোনাদোনি, বেলজিয়ামের এনজো শিফো, হল্যান্ডের রাইকার্ড, খুলিট, বাস্তেনদের কথা মনে পড়বে। ১৯৯৪-এ মারাদোনা, ১৯৯৮-এর রোনাল্ডো, ২০০২-এর অলিভার কান বা ২০০৬ এর জ়িনেদিন জ়িদানই ট্র্যাজিক শিরোমণি। কে বলে বিশ্বকাপ ফুটবল শুধুই অমিত শক্তিধর পৌরুষের উদযাপন! মোক্ষম সময়ে কে ম্যানমার্কিংয়ের চক্রব্যূহে বন্দি হবে বা কে ভুলে যাবে অস্ত্রদীক্ষার মন্ত্র, কিংবা হঠাৎ আঘাতের তীব্রতায় ডুবে যাবে কার রথের চাকা? গত কালের চ্যাম্পিয়নের মুকুট ধ্বস্ত মলিন হয়ে আজ ধুলোয় গড়াবে! দামালপনার মোড়ক ছিঁড়ে এমন অবশ্যম্ভাবী ভাবেই ফুটে ওঠে বীরযোদ্ধার অসহায় ব্যর্থতা, রিক্ততা, ভঙ্গুরতার স্মারক। সুনীলের কবিতায় পাপ ও দুঃখের কথার মতো আমিও আসলে মনে রেখে দিই চার বছরের ব্যর্থতার জমা হিসেব। এ বার লিস্টে যোগ হয় প্রতাপশালী জার্মানির বিদায়গাথাও। সাফল্যের খতিয়ানের পাশাপাশি বিশ্বকাপ অনবরত লিখতে থাকে, মুহূর্তের ভুল বা এক চুলের ব্যর্থতায় শৃঙ্গ থেকে পা হড়কে ইন্দ্রপতনেরও ইতিহাস।কৈশোর শেষের ফচকেমিতে মালদিনি, দোনাদোনি, জিয়ানিনিদের অনুপ্রেরণায় প্রৌঢ় অবনীবাবু, ভবানীবাবু, নলিনীবাবুদের একদা আমরা অবনিনি, ভবানিনি, নলিনিনি নামে ডাকতে শুরু করেছিলুম। ১৯৯০-এর বিশ্বকাপে ছ’গোল করে স্কিলাচির সোনার বুট লাভের পরে পাড়ায় ছয় সন্তানের জনক এক গুরুজনকে আড়ালে স্কিলাচি বলে মস্করা। আর ছিল বাজ্জো, দোনাদোনি, ফিগো, মোরিয়েন্তেস, কাকা, ভিয়া থেকে কোচ স্কোলারি, জোয়াকিম লো-দের ঘিরেও যুগে যুগে কত শত রক্তাক্ত হৃদয়ের প্রেমকাহিনি। এখনও রাতদিন চলে পছন্দের দল বা তারকার প্রতি আনুগত্যে পারস্পরিক পা টানাটানি। তবু জীবনে বলে পা না ছোঁয়ালেও বিশ্বকাপ আসলে অত্যন্ত সিরিয়াস একটা ব্যাপার।ছেলেবেলায় ফুটবল খুনসুটির সঙ্গী বন্ধুরা কেউ কেউ এখন মাঠেও বিশ্বকাপ দেখতে যায়। তারা গ্যালারিতে থাকাকালীন প্রিয় দল কুপোকাত হলে হোয়াটসঅ্যাপের খেউড়ে ‘তুইই কুড়ুম’ বলে সক্কলের টার্গেট। রসিকতার মোড়কেই মিশে থাকে প্রিয় দলের জন্য উৎকণ্ঠা। ক্রমশ ছোট হয়ে আসা বিশ্বে মেসিরা নামার আগে আর্জেন্টাইন বন্ধু রোক্সানা নীল-সাদা গ্যালারির সাম্প্রতিক গান স্প্যানিশ থেকে ইংরিজিতে অনুবাদ করে আমায় পাঠায়। আমি তা বাংলায় আওড়াই, ‘আমি দিয়েগো আর লিয়োনেলের দেশে জন্মেছি/ জিতব তিন বারের বিশ্ব খেতাব / আকাশে দিয়েগো আছে আমাদের/ সেও মাঠে লিয়োনেলের দিকে চেয়ে!’ অতিমানব এক প্রাচীর হয়ে ওঠা সৌদির গোলপ্রহরীর সামনে সে দিন আর্জেন্টিনা থমকে গেলে আমার কবীর সুমনের গান মনে পড়ছিল, ‘ভালবাসা শত যুদ্ধেও জেতা যায় না’! ১৯৮৬-র মারাদোনার টিমের রঙিন ব্লোআপ, একদা দেরাজে সুরক্ষিত মোহনবাগানের পেলে ম্যাচের সুভেনির হারিয়ে ফেলেছি কবেই। বিশ্বকাপে টাটকা পরাজয়ের জ্বালায় পুরনো ক্ষতস্থানে নতুন করে রক্তধারা বয়। তবু আমি, আমরা জানি, বিশ্বকাপ এলে আমাদের মুক্তি নেই। আবার খেলব, চাইবই প্রতিশোধ!