রাজনীতিতে মানুষই সব। তাই ‘মানুষই শেষ কথা বলে’, ‘মানুষই ইতিহাস গড়ে’, ‘আমাদের সঙ্গে মানুষ আছে’, ‘মানুষের জন্য কিছু করতে চাই’ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ রাজনীতিতে ঘুরেফিরে আসে। যার পক্ষে যত মানুষ, সে তত শক্তিশালী। রাজনৈতিক এজেন্ডা যে ভাবেই হোক আমমানুষের কাছে পৌঁছতে হবে এবং তাদের স্বপক্ষে আনতে হবে। অতীতে পথসভা, মাঠসভা, প্রচারপুস্তিকা, মিছিল, মুদ্রণ-মাধ্যমে লোকের কাছে পৌঁছনো যেত। পরে এল বৈদ্যুতিন মাধ্যম। এখন সামাজিক মাধ্যমে মানুষকে সরাসরি ছোঁয়া যায়।
রাজনীতিতে জনচেতনায় কড়া নাড়ার বিভিন্ন পন্থা। বক্তৃতা, দেওয়ালচিত্র, গণসঙ্গীতের মতো স্লোগানও একটি শক্তিশালী পন্থা। এই মুহূর্তে কোনও সমীক্ষা রিপোর্ট ছাড়াই হয়তো বলা যায়, এ বছর এ রাজ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী শব্দগুচ্ছ ‘খেলা হবে’। ছোট বেলা থেকে ‘খেলা জমে যাবে’ ‘খেল খতম’ ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত। ও পার বাংলার সাংসদ শামিম ওসমান, বছরপাঁচেক আগে তাঁর বিরোধীদের কটাক্ষ করে বলেছিলেন ‘খেলা হবে’ কথাটি। তাঁর ব্যবহৃত এই স্লোগান এ রাজ্যের শাসক দলের এক নেতার মুখ হয়ে এসে বর্তমানে রাজনীতির ট্যাগলাইন হয়ে দাঁড়াল। অধিকাংশ দলই স্লোগানটি ব্যবহার করছে, এমনকি দেশের হেভিওয়েট রাষ্ট্রনেতারাও এ রাজ্যে এসে স্লোগানটিকে ব্যবহার করে উল্লসিত জনোচ্ছ্বাস উপভোগ করছেন। বলা ভাল, এই প্রথম একটি শব্দবন্ধ এমন একটি স্লোগান তৈরি করল, যা নিয়ে নিল প্রায় সব দল। এও বিবিধের মাঝে ঐক্য বইকি।
আসলে স্লোগান কতকগুলো আকর্ষণীয় শব্দগুচ্ছ, পুনরাবৃত্তিমূলক অভিব্যক্তি। ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। রাজনীতিকরাও রাজনৈতিক তাগিদ থেকে তাঁদের বক্তব্য নানা ভাবে মানুষের কাছে নিয়ে যেতে চান। কখনও সুদূরপ্রসারী বা তাৎক্ষণিক দাবি আদায়ের জন্য, কখনও নির্বাচন পর্বে।
এ দেশের একটি সার্থক ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক স্লোগান হল ‘বন্দে মাতরম’। ১৮৮২-তে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ব্যবহৃত গানটি ১৮৯৬-এ কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশনে গাওয়া হয়। পরবর্তী কালে গানের প্রথম দুই শব্দ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বীজমন্ত্র হয়ে ওঠে। আজও একে রাজনৈতিক দলগুলি তাদের স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করে। আর একটি জনপ্রিয় স্লোগান হল ‘জয় হিন্দ’। গ্বালিয়র শহরের অধিবাসী রামচন্দ্র করকরে পরবর্তী কালে মধ্যপ্রদেশ প্রদেশ-কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন। তাঁরই লেখা একটি নাটক ‘জয় হিন্দ’। পরে আজাদ হিন্দ বাহিনীর মেজর আবিদ হাসান সাফরানি ‘জয় হিন্দুস্থান কি’ স্লোগানটি ছোট করে ‘জয় হিন্দ’ চালু করেন। এই রকমই এক বিখ্যাত উর্দু কবি হাসরত মোহানি ১৯২১ সালে একটি সাড়া জাগানো স্লোগান লিখেছিলেন, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। বিপ্লবী ভগৎ সিংহ দীপ্ত কণ্ঠে এই স্লোগানটি ব্যবহার করেন এবং এটি পরবর্তী কালে এ দেশের কমিউনিস্ট তথা বাম দলগুলোর রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হয়। এ ছাড়া পরাধীন ভারতে ‘স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার’, ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’, ‘সাইমন গো ব্যাক’ ইত্যাদি স্লোগান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
ভোটের স্লোগানের কথা যাঁকে দিয়ে শুরু করা যেতে পারে, তিনি দাদাঠাকুর, ওরফে শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। তাঁর আমলে প্রচারকৌশলের রমরমা ছিল না, ভোটের ছড়া ও গান লিখে প্রচার চলত। দাদাঠাকুর এই কাজে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। এক বার জঙ্গিপুর মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনে তাঁরই এক স্নেহধন্য ছোলাভাজাওয়ালা কার্তিক সাহাকে দাঁড় করান। প্রচারে লিখলেন সেই বিখ্যাত ছড়া, ‘ভোট দিয়ে যা/ আয় ভোটার আয়/ মাছ কুটলে মুড়ো দিব/ গাই বিয়োলে দুধ দিব/ দুধ খেতে বাটি দিব/ সুদ দিলে টাকা দিব/ ফি দিলে উকিল দিব… আমার যাদুর কপালে ভোট দিয়ে যা।’ এ ছাড়া কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে ‘কর-পরশনে বিপরীত রীত’ নামে একটি ভোটের ছড়া লিখেছিলেন— ‘যিনি তস্কর দলপতি দৈত্যগুরু/ যিনি বাক্যদানে আজি কল্পতরু/ ঠেলি নর্দমা কর্দমে অর্ধরাতে/ কত মর্দজনে ফিরে ফর্দ হাতে...’ বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার উপনির্বাচনেও দাদাঠাকুর ‘দক্ষিণ দুয়ারি উপনির্বাচন’ নামে একটি ছড়া লেখেন। এ ছাড়াও ‘ভোটামৃত’-এর একটি গানে দাদাঠাকুর লিখেছেন ‘এবার হুইপ বেড়ে করবে হুইপ/ গ্যালপে চলেছি ভাই, করিব উইন রে/ দোহাই ভোটার যেন কোরো না রুইন রে।’ তাঁর সমস্ত স্লোগানই ছিল নিজস্বতায় উজ্জ্বল, সে কারণেই কালজয়ী।
চল্লিশের দশকের শুরু থেকে সত্তরের দশকের শেষ ভাগ স্লোগানের রমরমা। এই চল্লিশের দশক নানা দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। এক দিকে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক প্রভৃতি রাজনৈতিক দল তাদের অবস্থান, বিতর্ক, অন্য দিকে বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪১-এ অনাক্রমণ চুক্তি ভেঙে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করলে কমিউনিস্ট পার্টি ‘জনযুদ্ধ’ নীতি ঘোষণা করে। অর্থাৎ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন করেনি, এই যুদ্ধকে ‘জনগণের যুদ্ধ’ আখ্যা দিয়েছিল। তাতে ভারতের পরাধীন জনগণের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছয়। কংগ্রেস এই সময় ইংরেজের কাছে দাবি করে, যুদ্ধে তারা সমর্থন দিতে পারে, যদি যুদ্ধের পর ভারতকে স্বাধীনতা দিয়ে দিল্লিতে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি তারা মেনে নেয়। ব্রিটেন চার্চিলের পরামর্শ মোতাবেক জানিয়ে দেয়, এ দাবি মানা সম্ভব নয়। কংগ্রেস এই সময় সত্যাগ্রহে বসে, সেখান থেকে তারা একটা সাড়াজাগানো স্লোগান দেয়, এই যুদ্ধে ‘না এক ভাই, না এক পাই’। স্লোগানটি সেই সময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৪২-এর ৮ অগস্ট কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি গাঁধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রস্তাবকে গ্রহণ করে। এই প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার পর গাঁধীজি জোর গলায় ঘোষণা করেন ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’— হয় স্বাধীনতা নয় মৃত্যু। এই স্লোগানটি মানুষের স্মৃতিতে আজও অমলিন। এই সময় সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন ‘ভারতের মুক্তিসুর্য’। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। এই স্লোগান জানে না, এমন বাঙালি খুব কমই আছেন। তরুণ জনতা আলোড়িত হয়েছিল এই স্লোগানে। ১৯৪৫-এ আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি সৈনিকদের মুক্তির দাবিতে হরতাল পালিত হয়। ছাত্ররা সেখানে স্লোগান তোলে ‘লাল কিল্লা কো তোড় দো/ আজাদ হিন্দ ফৌজ কো ছোড় দো’। দিল্লিতে জাতীয় সরকার গড়ার ভাবনা নেতাজিরও ছিল, তাই তাঁর ‘দিল্লি চলো’ স্লোগান। এই দশকেই বাংলার তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়। সেখানে কৃষকরা ‘আধি নয় তেভাগা চাই’, ‘বিনা রসিদে ভাগ নাই’, ‘পাঁচ সেরের বেশি সুদ নাই’ ইত্যাদি স্লোগানের ভিত্তিতে সংগঠিত হয়েছিল। আবার স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সময় বামপন্থীরা স্লোগান দিয়েছিল ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়/ভুল মৎ ভুল মৎ’। পরে বহু প্রথম সারির বামপন্থী দল এই স্বাধীনতা সদর্থক বলে মেনে নিলেও মানুষ সেই স্লোগান ভোলেনি।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির এক দশকের মাথায় রাজ্যে খাদ্যসঙ্কট তীব্র হয়। মজুতদার আর কালোবাজারিদের দাপট, সঙ্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই সঙ্কটের কারণ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৯-এর ৩১ অগস্ট খাদ্য আন্দোলন। আন্দোলনকারী জনতার উপর পুলিশ গুলি চালালে প্রায় ৮০ জন মারা যান। এই সময়কার দু’টি জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘পুলিশ তুমি যতই মারো/ মাইনে তোমার একশো বারো।’ আর একটি হল ‘কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না’। ষাটের দশকের মাঝামাঝি আবারও এই স্লোগান দু’টি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
ষাটের দশক স্লোগানের ক্ষেত্রে বৈচিত্রের দশক। চিন-ভারত যুদ্ধের আগে চু এন লাই ভারতে এলে সেই সময় দেশে স্লোগান ওঠে ‘হিন্দি চিনি ভাই ভাই’। তার পর চিন-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে রাজনীতি ক্ষেত্রেও ভাঙচুর শুরু হয়। হিমালয়ের এক বিস্তীর্ণ মানবশূন্য উচ্চভূমি কার দখলে থাকবে, তা ছাড়াও নাসের, বন্দরনায়েক, সোয়েকার্নো, চু এন লাই, নেহরু এঁদের জোটনিরপেক্ষ অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে রাজনীতিক্ষেত্র উত্তাল। কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে তীব্র বিতর্ক এবং তার জেরে কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিখণ্ডিত হয়। তখন জ্যোতি বসুদের চিনের দালাল বলে ‘দূর হঠো’ স্লোগান দেওয়া হত।
এই সময় কলকাতার পথে পথে জ্যোতি বসু ও চু এন লাই-এর কুশপুতুল পোড়ানো হত। কালীঘাটে কুশপুতুলের একটা দোকানই খুলে যায়। চিন দেশে ওঠা কিছু স্লোগান তখন আমাদের দেশের শিক্ষিত যুবকদের আলোড়িত করেছিল, মাও জে দঙ-এর ‘সদর দপ্তরে কামান দাগো’, ‘যুবকেরা ভোর আটটার সূর্য’ অথবা লিন পিয়াও-এর ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা’ ইত্যাদি। নকশালরাও স্বপ্ন দেখেছিল চিনই পারবে ভারতের জনতাকে সব বন্ধন থেকে মুক্ত করতে। আবার সিপিআই(এম)-এর অভ্যন্তরে বিতর্ক এবং ১৯৬৯-এ আবার ভাগ। সিপিআই(এম) ছেড়ে গিয়ে তারা স্লোগান তোলে ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’, ‘বন্দুকের নলই শক্তির উৎস’। সেই সময় সিপিআই(এম) দুই দেশের সংহতিতে স্লোগান তুলেছিল, ‘গঙ্গা যদিও মেকং নয়/ মেকং তোমায় লাল সেলাম/ গঙ্গা মেকং এক করি/ দুই জনতার মৈত্রী গড়ি’। এই দশকেই ভিয়েতনাম যুদ্ধ। কমিউনিস্টরা শ্লোগান তুলত ‘তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’।
কমিউনিস্ট-বিরোধীরা কটাক্ষ করত ‘বলতে বলতে ভিয়েতনাম/ ভুলে গেছে বাপের নাম’।
১৯৬৫-৬৬ সালেও খাদ্যসঙ্কট তীব্র আকার নেয়। খাবার আর কেরোসিনের দাবির মিছিলে গিয়ে নুরুল ইসলাম আর আনন্দ হাইত নামে অল্পবয়সি দুই ছাত্র মারা যান। তার পর শুরু হল বিমান বসু, দীনেশ মজুমদার, সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের নেতৃত্বে উত্তাল ছাত্র আন্দোলন। সলিল চৌধুরীর লেখা কবিতার দুই ছত্র উঠে এল স্লোগান হয়ে, ‘গ্রাম নগর মাঠ পাথার বন্দরে তৈরি হও/ কার ঘরে জ্বলেনি দীপ চির আঁধার তৈরি হও/ কার বাছার জোটেনি দুধ শুকনো মুখ তৈরি হও’। এই সময় আমাদের দেশের সঙ্গে আমেরিকার চুক্তি অনুযায়ী, আমেরিকা থেকে গম আমদানি করা হত, যা পি এল ৪৮০ নামে খ্যাত। তৎকালীন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন বলেছিলেন ‘হয় কম খাও নয় গম খাও’। তিনি গমের সঙ্গে আলু, কাঁচাকলা, বেগুন ইত্যাদি আনাজ খাওয়ার নিদান দিয়েছিলেন। আর এর জন্য অ-কংগ্রেসিদের তীব্র কটাক্ষের শিকার হয়েছিলেন। এই সময় একটা স্লোগান কিছুটা শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করেছিল, সেটা হল ‘বাজার থেকে বেগুন কিনে/ মনটা হল প্রফুল্ল/ ঘরে এসে দেখি/ এ তো কানা অতুল্য’। অর্থাৎ ব্যক্তি আক্রমণ আজ নতুন নয়, সেই চল্লিশের দশক থেকেই তা শুরু হয়েছে। যত দিন গেছে ততই তা বেড়েছে। ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ১৯৬৫-তে ইন্দো-পাক যুদ্ধের সময় একটা স্লোগান তুলে ধরেন— ‘জয় জওয়ান জয় কিষাণ’। এক দিকে যুদ্ধজয়, অন্য দিকে তীব্র খাদ্যসঙ্কট মোকাবিলা, এই দুই উদ্দেশ্যেই এই স্লোগান। এই সময় কংগ্রেসিরা কমিউনিস্টদের কটাক্ষ করে স্লোগান দিত, ‘চিনের কাস্তে হাতুড়ি/ পাকিস্তানের তারা/ এর পরেও কি বলতে হবে/ দেশের শত্রু কারা?’ আবার বামপন্থী ছাত্ররা দেওয়ালে লিখত, ‘যখনই জনতা চায় চাকরি ও খাদ্য/ সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য।’ এই ষাটের দশকের শেষ ভাগে ইন্দিরা গাঁধী স্লোগান দেন ‘গরিবি হঠাও’। এই স্লোগান তখনকার রাজনৈতিক জটিলতা থেকে তাঁকে কিছুটা রেহাই দিয়েছিল, কিন্তু স্লোগানটি বিরোধীরা করে দিয়েছিলেন ‘গরিব হঠাও’। এতে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে। এর সূচনা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে। সেই সময় বাংলাদেশের সব ক্যাম্পাসে তরুণরা স্লোগান তুলত ‘বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই/ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা চাই’। তারই চূড়ান্ত পরিণতিতে বাংলা ভাষার রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল, যেখানে ইন্দিরা গাঁধীর অবদান অপরিসীম। আর এখান থেকেই স্লোগান এল ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরা গান্ধী যুগ যুগ জিও’। এই স্লোগান তৎকালীন কংগ্রেসকর্মীদের উৎসাহিত করত। এর পরই ১৯৭২-এর নির্বাচন। সিপিআই-এর সঙ্গে ইন্দিরা-কংগ্রেসের জোট হল। সিপিআই বাদে কয়েকটি বাম দল স্লোগান দিল, ‘দিল্লি থেকে এল গাই/ সঙ্গে বাছুর সিপিআই’। নকশালপন্থী ছাত্রদের স্লোগান ছিল, ‘ভোট ভোট করে কারা/ সাম্রাজ্যবাদের দালাল যারা’। বর্তমানে বাম-কংগ্রেস জোট নিয়েও অ-বাম, অ-কংগ্রেসিরাও সাঁইবাড়ি, মরিচঝাঁপির প্রসঙ্গ নিয়ে এসে দেওয়াল ছাপিয়ে দেয় নানা স্লোগানে। কিছু কিছু বাম-মহল থেকেও ১৯৭২ সাল, জরুরি অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে কটাক্ষ করে স্লোগানও দেওয়া হয়।
বর্তমানে স্লোগান পাল্টেছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে, তা মূল ধারার রাজনীতিতে চলে আসছে। দাবি আদায়ের লড়াইকে বর্তমানে নাগরিক সমাজ অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের হাতে ছাড়ছে না। বরং নাগরিক সমাজের নানাবিধ আন্দোলনে বা ছাত্র বা পেশাগত কোনও সংগঠনের স্বতন্ত্র আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলো প্রবেশ করছে। সে ক্ষেত্রে স্লোগানও রাজনীতি-নিরপেক্ষ থাকছে না। যেমন ২০১৪-র ১৩ সেপ্টেম্বর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানি কেন্দ্র করে তীব্র ছাত্র আন্দোলন আমরা দেখলাম। শুরু হল ‘হোক কলরব’। হাততালি দিয়ে দিয়ে স্লোগানটি বেশ নজর কেড়েছিল। বাংলাদেশের শায়ান চৌধুরী অর্ণব-এর একটি গানের অ্যালবামের একটি গানের প্রথম দু’টি শব্দ নিয়ে গড়া এই স্লোগানটি মানুষের সমর্থনও আদায় করেছিল কিছুটা। এই সময়ের পর পরই আর একটি ঘটনা। কেরলের কোঝিকোড়ে প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেমে গেরুয়া হানা। তার প্রতিবাদে যাদবপুর থানার সামনে ‘হোক চুম্বন’। স্লোগান উঠল ‘আমার শরীর আমার মন/ দূর হোক রাজশাসন’। পথচলতি মানুষ ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’তে খানিকটা বিমূঢ়ই হয়েছিল, তাই পথেই ভুলে এসেছিল এই স্লোগান। সম্প্রতি এক বাম ছাত্র সংগঠনের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে একটি শহরে শোভাযাত্রায় চোখে পড়ল একটি স্লোগান ‘জুনিয়ার মজদুর এক হও’। স্লোগানটি মার্কস-এঞ্জেলস-এর কমিউনিস্ট ইস্তেহারের শেষ লাইন ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’-এর ধ্বনিসাম্যে গৃহীত, কিন্তু ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা পেলাম না, ছাত্ররা কবে মজদুর হল? ছাত্রদের কারা শোষণ করে, তার ধরনটাই বা কেমন, এর যথাযথ ব্যাখ্যা না দিয়ে এই সব খুদে বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধিত্বকারী ছাত্র সংগঠন কোথাও অজান্তে মজদুরদের খাটো করে ফেলছেন না তো?
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের একটা গানে ছিল, ‘হাট মিটিঙে চোঙা ফুঁকেছি, গেট মিটিঙে গলা ভেঙেছি চিনছি শহর গ্রাম/ স্লোগান দিতে গিয়ে আমি সবার সাথে আমার দাবি প্রকাশ্যে তুললাম।’ স্লোগানে জড়িয়ে থাকে বৃহত্তর জনগণের ভাবাবেগ। দেখা গেছে কালোত্তীর্ণ হয়েছে সেই সব স্লোগান, যেখানে মানুষ নিংড়ে দিয়েছে তার আবেগকে। নির্বাচন-পর্বের স্লোগান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্বাচনের পরই হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময়ে গ্রামগঞ্জে ‘পদধ্বনি’, ‘মা মাটি মানুষ’ ইত্যাদি যাত্রাপালা বামেদের জমি আন্দোলনে সাহায্য করেছিল এবং বামেদের এক সময়ের স্লোগান ‘লাঙল যার জমি তার’ বা ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই/ লড়াই করে বাঁচতে চাই’ ইত্যাদিকে জনমানসে আকর্ষণীয় করে তুলতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু পরে সেই জমি আন্দোলনে সরাসরি পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের ওই যাত্রাপালার নামটি তৃণমূল কংগ্রেস তাদের মাস্টারপিস স্লোগান করে নিলেন, ‘মা মাটি মানুষ’। এর সঙ্গে ‘বদলা নয় বদল চাই’ স্লোগানটিও জনপ্রিয় হয়ে রাজ্যে পটপরিবর্তনে সহায়ক হয়েছিল।
হালফিলে হিন্দি অনুকরণে বিভিন্ন স্লোগান সমর্থক মহলে আলোড়ন তুললেও জনমনে প্রভাব ফেলছে না। ‘গোলি মারো...’ স্লোগান রীতিমতো আতঙ্কজনক। বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
এ বছর করোনা-জনিত কারণে হুগলির তারকেশ্বরে ভক্তবৃন্দের সমাগম হয়নি। তার আগের বছর শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবার শেওড়াফুলি থেকে তারকেশ্বর যাওয়ার ১২ নং রোডে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পুণ্যার্থীরা যাবেন বাবার মাথায় জল ঢালতে। ‘ব্যোম ব্যোম ভোলে ব্যোম’, ‘ভোলে বাবা পার করেগা’ এই সব ধর্মীয় স্লোগান দিতে দিতেই এত দিন যেতেন ভক্তবৃন্দ। সে বছর সংযোজন ‘জয় শ্রীরাম’। হাতে জাতীয় পতাকা। ধর্মীয় ক্ষেত্রে আপত্তির কিছু তো থাকে না। কোনও রাজনৈতিক দল যদি এই ধ্বনিকে তার রাজনীতির স্লোগান করে তাতেও কারও আপত্তির কিছু নেই, আপত্তি তখনই থাকবে সরল ভক্তিবিধি যদি রাষ্ট্রবিধিতে পরিণত হয়, এক অংশের বিশ্বাস প্রকাশের ধ্বনিসমষ্টি যদি মুক্তকণ্ঠকে কোথাও কোনও ভাবে আঘাত করে। আর একটু অন্য ভাবে বিষয়টিকে যদি আমরা দেখি, তা হলে দেখব, এই ধর্মীয় স্লোগানটিকে স্থান-কাল-পাত্র না ভেবে আকছার ব্যবহার করা হচ্ছে। গত ২৩ জানুয়ারি নেতাজির ১২৫তম জন্মদিবস উপলক্ষে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের একটি অনুষ্ঠানে খোদ প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ভাষণ দিতে যাবেন, দর্শকাসন থেকে ভেসে এল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। মুখ্যমন্ত্রী অসম্মানিত বোধ করলেন। ক্ষোভ প্রকাশও করলেন। এ ঘটনা আগেও ওঁর সঙ্গে ঘটেছে। সুদূর ভবিষ্যতে এই স্লোগানটির ধর্মীয় বা রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকুক বা না থাকুক, জনচেতনায় এটা একটা অতিকথন বা অতিসত্যের নির্মাণ করতে পারে। ভবিষ্যতের মানুষ তো কার্য-কারণ সম্বন্ধ বুঝবে না। তারা জানবেও না যে, রামের নামে জয়ধ্বনি ছিল আসলে বিরোধী স্লোগান। তারা ভাববে ‘জয় শ্রীরাম’ এমন একটি স্লোগান, যা শুনলে আমাদের রাজ্যের এক মুখ্যমন্ত্রী রেগে যেতেন। মানুষ আর বিচার করতে যাবে না, কোন পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী রেগে গেছিলেন। যেমন রাজনীতিক অতুল্য ঘোষ ‘কানা অতুল্য’ পরিচিতি পেলেন। আমরা তাঁর দৃষ্টিহীনতা নিয়ে স্লোগান তুললাম অথচ আমরা জানলাম না এর পিছনের মর্মস্পর্শী ইতিহাসকে। ১৯৪২-এর অগস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়ে অন্যান্য সহকর্মীর মতো তাঁকেও জেলে যেতে হয়। মেদিনীপুর জেলের মধ্যে অনশন বিক্ষোভে বাকিদের সঙ্গে তিনিও শামিল হন। ইংরেজ কারা-আধিকারিকের বেয়নেটের খোঁচায় তিনি একটি চোখ হারান। অনেক চিকিৎসাতেও তাঁর চোখ তিনি ফিরে পাননি। আসলে নানাবিধ কুৎসা ছড়িয়ে ব্যক্তিমানুষকে আমমানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে জনমানসে কোনও কোনও তকমা স্লোগানের আকারেও গেঁথে দেওয়া যায়। যেমন আরএসপি নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী অতুল্য ঘোষের বাঁকুড়ার দেওলাগড়ের এক ছোট বাড়িকে কল্পনার রং মিশিয়ে তাকে রাজপ্রাসাদ, পাশে প্রমোদ উদ্যান, সেখানে অবস্থিত সুইমিং পুলে বঙ্গেশ্বর ফুর্তি করেন ইত্যাদি প্রচার করেছিলেন। পরবর্তী কালে এই ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হলে প্রকাশ্যে শ্রীচক্রবর্তী দুঃখপ্রকাশ করেন, কিন্তু তত দিনে কিছু মানুষের চেতনায় এই ভুল স্থায়ী আসন লাভ করে ফেলেছে, সঙ্গে যোগ হয়ে গেছে সহযোদ্ধা প্রফুল্ল সেনকে যুক্ত করে আর একটি আপত্তিকর স্লোগান ‘আরামবাগের হারামশালায় কানা ব্যাটা অতুল্য/ অজয় নদীর (অজয় মুখার্জি) ভীষণ স্রোতে ভেসে গেল প্রফুল্ল’। একই ভাবে এ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে প্রকাশ্যে একটা অভিযোগ করা হয়, তিনি নাকি নন্দন চত্বরে সান্ধ্যকালীন আড্ডায় মহিলা-পরিবৃত হয়ে নিয়মিত মদ্যপান করেন, এই অভিযোগের পরে অনেক দিন কেটে গেছে। সময় জানে, কালি ছেটানো সহজ কিন্তু সে দাগ তোলা কষ্টকর। সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য শাসক দলের এক সাংসদ এই অবমাননাকর অভিযোগের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তখনই মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নামে স্লোগান তোলা হয়েছিল ‘রক্তখেকো হায়না’, নেপথ্যে আছে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের আন্দোলন। সেই সময়কার বামেদের স্লোগান ছিল ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। স্লোগানটিকে মানুষ সদর্থক কী নঞর্থক দৃষ্টিতে দেখেছে, তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু এর সঙ্গেও যুক্ত হয়েছে অতিরঞ্জিত সত্য। যেমন, কোনও কোনও অংশ থেকে প্রচার করা হয়, শিল্পের নামে প্রমোটিং হবে, বেছে বেছে বিশেষ একটা সম্প্রদায়ের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বা হাইটেনশন তার বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে বা বসবাসযোগ্য অঞ্চলের পাশে গ্রিড স্টেশন হলে মানুষ নানা রকম রোগের শিকার হবে ইত্যাদি। একটা স্লোগান প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ল কি না সেটা বড় কথা নয়, রাজ্যের শিল্পসম্ভাবনা প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, এ কথা দ্বিধাহীন সত্যি। এমন উদাহরণ অজস্র। বোফর্স মামলার সময় একটা স্লোগান দেশ মাতিয়েছিল ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়/ রাজীব গাঁধী চোর হ্যায়’। অর্থাৎ স্লোগান যেমন এক দিকে জনমত সংগঠনে সহায়ক হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তেমনই ভিত্তিহীন অতিকথন জনচেতনায় ভুলের পলি সঞ্চয় করেছে, এ কথাও অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।