সেখানে উঁকি দিলে দেখা যাবে, সবটা ছেলে-ভোলানো রঙিন কল্পনার ফানুস নয়। দক্ষিণারঞ্জনের গ্রামীণ লোককথা সংগ্রহে আছে স্বদেশি আন্দোলন, উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনি, লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের পটভূমিতে শক্তিমানের বিরুদ্ধে দুর্বলের প্রতিবাদ। তেমনই ক্ষীরের পুতুল, কিরণমালা, রাক্ষসীর রূপকেও আছে নানা প্রথা আর প্রতীক।
Bengali Story

রূপকথার অন্দরমহল

তখন বিশ শতকের শুরু। দেশ ব্যাপারটা তখনও একটা তুলতুলে জায়মান ধারণা, তার সত্যিকারের রাজনৈতিক ছিরিছাঁদ নেই।

Advertisement

প্রমিতি চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২২ ০৫:২৩
Share:

এক ভাদ্র মাসের সকাল, সালটা ১৯০৭। সাতটা বাজতে না বাজতেই চাঁদিফাটা রোদ্দুর। কলকাতা শহরের আবহাওয়া তার চেয়েও বেশি গরম স্বদেশিয়ানার উত্তাপে। কার্জন সাহেবের দাবি মানা হয়নি বটে, কিন্তু রাজনীতির শক্ত মামলা-মোকদ্দমা কি আর মুখের কথায় মেটে? তাই পেটা ঘড়িতে ন’টার ঘণ্টা পড়তে না পড়তেই রাস্তায় ছাত্রদের দু’-দশখানা মিছিল দিব্যি বেরিয়ে পড়ে। ইস্কুল-কলেজের ক্লাস অনেক দিন ধরেই বন্ধ। অফিসকাছারি যাওয়ার পথে খদ্দরের জামা পরা বাবুরা দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে তাদের বক্তৃতা শোনে, রাস্তায় পড়ে থাকা দিশি টনিকের প্যামফ্লেটটা সযত্নে কুড়িয়ে বুকপকেটে তুলে রাখে ছেলেপুলেরা, গেরস্তবাড়ির বৌ-মেয়েরা কর্তাদের অফিসের ভাত বাড়বার ফাঁকে ঝটিতি খড়খড়ি তুলে পথচলতি মিছিল উঁকি দিয়ে দেখতে ভোলে না। গোলদিঘির মোড়ে মিষ্টির দোকানটার সামনে কাদের বাড়ির ঝি উঁচু গলায় গল্প জোড়ে ছোকরা ময়রাটার সঙ্গে— “আজকালকার ছেলেমেয়েগুলোর ছিষ্টির বায়না বাপু! বোসদের ছোটখুকির কাল রাত থেকে ধুম জ্বর, এ দিকে সে ওষুধ-পথ্যি করবে না। কী না কী বাবা, বিলিতি ওষুধ খেতে মানা। যাই, মোড়ের কবরেজ মশায়কে ধরি গিয়ে!”

Advertisement

ধন্দে পড়েছেন দক্ষিণারঞ্জনও। গত দু’-দু’টি বছর ধরে পূর্ব বাংলার গণ্ডগ্রামে ঘুরে ঘুরে, মা-ঠাকুমার মুখের পুরনো দিনের সব গল্পকথা ফোনোগ্রাফে রেকর্ড করে কত যত্নে বইখানা ছাপিয়েছিলেন, ঝক্কি তো আর কম পোহাতে হয়নি সে বেলায়! চলতি প্রকাশকরা কেউ বইখানা ছাপবে না কিছুতেই, বলে এ সব ছেলে-ভোলানো রাজা-রানির গল্প বাজারে বিকোবে না। দীনেশ সেন মশায় ছিলেন বলেই বোধহয় এ যাত্রায় উতরোনো গিয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির স্বর্ণদেবী আর দীনেশবাবু মিলে কী উৎসাহেই না বইখানা ছাপালেন! পাঁজি-পত্রিকায় শুভদিন দেখে ‘ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন্স’ থেকে বইখানা দিব্যি বেরোল। কিন্তু সে দিনই ‘সাধারণী’ পত্রিকার অক্ষয়বাবু পত্র দিয়েছেন। এ সব পুরনো দিনের গ্রাম্য বাংলা শব্দ নাকি শহুরে ইশকুলে পড়া ছেলেপুলেরা বুঝবে না। বেজায় চটেছেন দীনেশ সেন, ক্রমশই মুষড়ে পড়ছেন দক্ষিণারঞ্জন। সব দিক ভেবেচিন্তে শ’খানেক কপি মাত্র ছাপা হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে টাকাটুকুও বুঝি বাঁচানো গেল না। অথচ ভাষার এতখানি বদল ঘটালে বইয়ের মান বাঁচানোই শক্ত হবে। বাংলা ভাষা, বাংলার মা-ঠাকুমার আদরে মোড়া আদ্যিকালের সব গল্প— শহুরে ভাষার পালিশে তার মিষ্টি মাটির টানটুকুই যদি হারিয়ে যায়? ছেলেমেয়েরা যদি গল্পের কথনে ভাষার আদরটুকুই না খুঁজে পায়, তা হলে আর এ বইয়ের সার্থকতা কী! বিলিতি ইশকুলে পড়া ছেলেগুলোকে বাংলায় স্বপ্ন দেখানো যে বড় প্রয়োজন। না হলে ক্লাসের ঘণ্টা, পরীক্ষার মনখারাপ, বাবা-কাকাদের স্বদেশি রাজনীতি আর মিছিল-মিটিংয়ের রোজকার একঘেয়ে বকবক পেরিয়ে সে কেমন করে পৌঁছবে রাজকন্যে কলাবতীর প্রাসাদে? কে তাকে চিনিয়ে দেবে শীত-দুপুরের মায়াজড়ানো তেপান্তরের রাস্তা?

শুরুর দিকের হাজার আর্থিক টানাপড়েন আর ভাষাবিভ্রাট কাটিয়ে সেই বছরেই যখন বইয়ের দ্বিতীয় দফার প্রকাশনা শুরু হল, দক্ষিণারঞ্জন তার ‘মাতৃগ্রন্থাবলী’ নাম বদলে রাখলেন, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। আগাগোড়া গ্রামবাংলার সোনালি রোদ আর নবান্নের নতুন ধানের গন্ধমাখা পনেরোখানা গল্পের ভূমিকা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ভাগ্য করে বাংলার ছেলেমেয়েরা ঠাকুরমার ঝুলি পড়তে পেল। নইলে দশটা-পাঁচটার দম-দেওয়া রোজকার জীবনে তারা যা শেখে, সে সব তো “কেবলি বইয়ের কথা! স্নেহময়ীদের মুখের কথা কোথায় গেল? দেশলক্ষ্মীর বুকের কথা কোথায়?” ঔপনিবেশিক শিক্ষার জাঁতাকলে যেখানে ছেলেছোকরার পকেট নাড়া দিলে শুধু মার্টিনের এথিক্স আর বার্কের ফরাসি বিপ্লবের নোটবইয়ের শুকনো পাতা খচমচ করে ওঠে, যেখানে দেশ আর মাটির আত্মাটাই বিদেশি শিক্ষাদফতরে বন্ধক রেখে সভ্য হতে শিখতে হয়; ছোট ছেলেরা রাত্তিরবেলায় মায়ের কাছে শুয়ে সাত সমুদ্র-তেরো নদী পারের রাজার বাড়ির গল্প না শুনে প্যারী সরকারের ইংরেজি ওয়ার্ডবুক মুখস্থ করে, সেখানে দক্ষিণারঞ্জন ‘ঠাকুরমার মুখের কথাকে ছাপার অক্ষরে পুঁতিয়াছেন’। মাটির সোঁদা গন্ধটুকু তাই এখনও অমলিন। এর চেয়ে বেশি স্বদেশি জিনিস আর কী-ই বা হতে পারে?

Advertisement

তখন বিশ শতকের শুরু। দেশ ব্যাপারটা তখনও একটা তুলতুলে জায়মান ধারণা, তার সত্যিকারের রাজনৈতিক ছিরিছাঁদ নেই, তার চর্চা আর গঠন দুটোই একান্ত ভাবে মানুষের মনের ভিতরে, তাদের আশায় আর কল্পনায়। সেই দেশের মেঘবৃষ্টির হিসেব সাহেবসুবোর সর্বনেশে আইনকানুনের তোয়াক্কা করে না। সেখানে ছেলেদের ইশকুল নেই, ইশকুলে গোমড়ামুখো মাস্টার নেই, পান থেকে চুন খসলে শাস্তির ভয় নেই— সে এক স্বপ্নের রাজ্য। সে দেশে দিঘির কালো জলে রুইকাতলা খেলা করে, চাষির ঘরে সুগন্ধি ধানের গোলা, তার জন্য ১৮৮৫-এর কৃষি আইনের ঝক্কি পোহানোর ভয় নেই। সেখানে ভদ্রলোকেরা গ্রামোদ্ধার করতে এসে ‘ছোটলোক’ বলে দূরে ঠেলে দেয় না। ইংরেজি পড়া শহরের ছেলে চাষির ছেলের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজে, ভিজে জামাতেই ঘোড়া হাঁকিয়ে কমলাপুলির দেশে যায়— ‘সে এক নতুন দেশ’— যার নাম নাকি বাংলা! তার মেঠো বাঁশির সুরে ধনী-গরিব, শহর-গ্রাম সবটুকু একাকার হয়ে গিয়ে মস্ত একটি জাতি তৈরি হয়। সে জাতি সবুজ ধানখেতে ঢেউতোলা বাদলা হাওয়ায় প্রাণ পায়, সে জাতি ভূগোল বইয়ের শেখানো সীমা-পরিসীমা ছাপিয়ে যায়, রাজনীতির সত্যিকারের দেশটা যখন অবিরাম যুদ্ধে টালমাটাল, তখন সে জাতি সাহস দেখায় তার বাঙালিয়ানার নির্যাসে।

বাঙালি নির্যাসটুকুর ছিটেফোঁটা কুড়িয়ে নিয়ে মজাদার সেই দেশটার গল্প দানা বাঁধতে শুরু করে উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে। কলকাতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, রাজশাহীর বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতিসহ আরও কয়েকটি গোষ্ঠীর উৎসাহে বাংলার লোককথা চর্চার পরিসরটিও দিব্যি জমে উঠেছিল। পুরনো দিনের বাংলার মানুষ, তাদের রোজকার জীবনের খুঁটিনাটি, পালাপার্বণের রীতিনীতি, অর্থাৎ পশ্চিমিয়ানার দাপটে ক্ষতবিক্ষত হতে হতেও বাঙালির জাতিসত্তার যতটুকু সে দিন বেঁচেছিল, সেটুকুকে নতুন করে ফিরে দেখার ইচ্ছেটাই ক্রমশ রূপ নিচ্ছিল শিক্ষিত বাঙালির সংস্কৃতিবোধে। শুরুর দিকের কোম্পানির সাহেবদের উদ্যোগে লেখা রূপকথার থেকে শতক-শেষের সেই জাতিচেতনার স্বপ্নে মশগুল রূপকথার তফাত অনেকটাই। এমনকি ১৮৭০ বা ’৮০-তেও লালবিহারী দে যখন বেঙ্গলি ম্যাগাজ়িনে নিয়মিত শম্ভুর মা-র রূপকথার গল্প শোনাচ্ছেন বা রামগরীব চৌবে উত্তর ভারতের পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা পরিদের গল্প লিখছেন, তখনও কিন্তু গল্পের ভূমিকায় পশ্চিমি উপকথার প্রভাব বেশ জোরদার, পাশাপাশি পশ্চিমি সভ্যতাগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টাও প্রবল। বরং ১৮৯৪-৯৫ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন দুই খণ্ডে বাংলার ‘ছেলেভুলোনো ছড়া’ সংগ্রহ করছেন, যোগীন্দ্রনাথ সরকার ‘খুকুমণির ছড়া’ লিখছেন, আর সর্বোপরি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু ক্লাসের পাঠ্য, বাঙালি জাতির ইতিহাসের রসদ খুঁজতে গিয়ে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর দীনেশ সেন মিলে গ্রামবাংলার সেই কবেকার হারিয়ে যাওয়া রূপকথার গল্প, মুখে মুখে শেখানো ছড়া, লুপ্তপ্রায় মেয়েলি ভাষা নতুন করে শিখছেন— তখন তাতে শিকড় খোঁজার টানটাই প্রবল। আর সেই শিকড়ের টানেই গল্পে উঠে আসে বাংলার পুরনো জনজাতির লোককথা— সাঁওতাল, চাকমা, পাহাড়িয়াদের জীবন। ছোট ছেলেমেয়েরা তখন বৃষ্টির দিনে বর্ণপরিচয় ভুলে অবন ঠাকুরের ছবি পড়ে, দেখতে দেখতে বেলা পড়ে আসে, ছেলেপুলের দল তখন সাদা ধুতি-চাপকান চাপিয়ে বাঁদরের সঙ্গে ষষ্ঠীতলায় ‘ক্ষীরের পুতুল’-ছেলের বিয়ে দিতে যায়। সেখানে থাকে বনগাঁবাসী মাসিপিসি— তারা খইয়ের মোয়া গড়ে। এ বড় ভাল দেশ— পড়া নেই, শোনা নেই...মিটিং-মিছিল-স্বদেশি স্লোগানের চেঁচামিচি নেই, আছে শুধু ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াপাখি!

সত্যিকারের দেশটা যখন বিলিতি শাসন আর স্বদেশি বিপ্লবীদের লড়াইয়ে লড়াইয়ে ভয়ে আর ব্যথায় সিঁটিয়ে এক্কেবারে নীল হয়ে যায়, তখন মনসাবুড়োর আদ্যিকালের গল্প শুনতে শুনতে, খোঁড়া হাসের পিঠে চেপে, ‘ভূত-পতরীর দেশে’-র পান্নারঙের আকাশে মেঘের ছানাদের পাশ কাটিয়ে হুস করে উড়ে যাওয়ার ছবি দেখতে দেখতেই ছোট ছেলেপুলের দল বোধহয় প্রথম বুঝতে শেখে ‘স্বাধীনতা’ ব্যাপারটা ঠিক কতখানি মিষ্টি! আর সবচেয়ে ভাল কথা হল, স্বাধীন হলে সময়ের হিসেব বিলিতি ঘড়িপেটার তালে হয় না। তাই তো সে দেশে চোখের নিমেষে ভোর হয়, পলক পড়তে না পড়তেই সন্ধে নামে। সূর্য-ডোবার কমলা আলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে আকাশে, আর তার ছায়া পড়ে গায়েবের সপ্তাশ্বরথের চুড়ো ঝলমল করে! ছেলের দল মনে মনে তারই সঙ্গে রাজ্যের পর রাজ্য জয় করে শেষমেশ বলভীপুরে পৌঁছয়। সেখানকার অত্যাচারী রাজাকে যুদ্ধে হারিয়ে ‘শিলাদিত্য’ নাম নিয়ে দেশের রাজা হয়ে বসে। তার পর তো আর কোনও চিন্তাই নেই। রাজার পাঠশালার বন্ধুরাই কেউ হয় মন্ত্রী, কেউ বা সেনাপতি— দেশ ব্যাপারটা এত দিনে ঠিকমতো বুঝতে শিখেছে তারা। দেশ হল তাদের এক্কেবারে নিজেদের জায়গা, সেখানে বাইরের লোকের জোরজুলুম চলে না, আর তাই দেশের জন্য, তাকে রক্ষা করতে রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতিদের যুদ্ধ করতে হয়!

কিন্তু সেই যুদ্ধটাও বেশ অন্য রকম! তার খানিকটা দিব্যি চোখে দেখা যায়। যেমন খবরের কাগজে রোজই বিপ্লবীদের উপরে পুলিশের হাঙ্গামার খবর বেরোয়; ল্যাম্পপোস্টের দেওয়ালে সাঁটা থাকে কত দিশি সাবান, ফিনাইল আর আয়ুর্বেদ পঞ্চামৃতের বিজ্ঞাপন! ফিরিঙ্গি পল্টনের দল টহল দিতে বেরোলে এক বার করে পোস্টার ছেঁড়ে, আবার পরের ঘণ্টাতেই দিস্তাখানেক নতুন পোস্টার সাঁটা হয়ে যায়— এ সব লড়াই তো হামেশাই চোখে পড়ে। কিন্তু দেশ আর জাতির লড়াইয়ের বাদবাকিটা নাকি মনে মনেই করতে হয়! কল্পনায় গড়েপিটে নিতে হয় স্বপ্নদেশের নিয়মকানুন, সকাল আর সন্ধেয় তার আকাশের রং, মেঘলা দিনে সে দেশের বৃষ্টিছাঁটের গন্ধ, সেখানকার মানুষগুলোর টুকরো টুকরো গল্পকথা! কল্পনার সেই দেশে স্থানকালের বাঁধা ভূগোল নেই, আর সেখানকার বিশাল রাজ-রাজত্বের বয়সেরও সীমা-পরিসীমা নেই। কবেকার অচিন-অভিন রাজপুরী, অজানা রাজ্যের অচেনা রাজপুত্ররা, দুধসাগরের তীরে কলাবতীর দেশ, দেড় আঙুলের সমান কাঠুরে রাজা পিপ্পলীকুমারের রাজ্য— সে সব যত দূরেই হোক না কেন, তারা তো এখন সকলেই স্বপ্নদেশের আপনজন। আর সেই স্বপ্নদেশের চেয়ে সুন্দর আর সত্যিও তো আর কিছু নেই— সেখানে আজও নিঝুম রাতে জ্যোৎস্নার বান ডাকে, বর্ষার ভিজে হাওয়ায় হাসনুহানার গন্ধ ভাসে, সবুজ মাঠে কাশের ঢেউ জাগিয়ে শরৎ আসে, ঘরে ঘরে লক্ষ্মীমণির পিদিম জ্বলে— সে দেশ দেখলেই মন জুড়োয় আর মনের যুদ্ধও শেষ হয়! কিন্তু তবু কি তা এক্কেবারে মনের মতো হয়?

সে দেশে বুদ্ধু আর ভুতুম পাঁচ রাজপুত্রের হাজার নিন্দেমন্দ শুনেও শেষমেশ রাজা হয় বটে, দেড় আঙুলে রাজা হয়েও দুপুরবেলায় কাঠ কাটে, রাখালছেলের বাঁশিতে বিভোর রাজপুত্র তারই গলা জড়িয়ে জ্যোৎস্না দেখে, অথচ এত সব ওলটপালট সত্ত্বেও রাজদণ্ডের অতুল ঐশ্বর্যদীপ্তি এতটুকু টসকায় না। বরং কালো কুচকুচে রাতে, গহিন বনে বুড়ো বটগাছের কোটরে হাজার বছর বাদেও রাজাদের গল্প বাঁচিয়ে রাখে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী। অপেক্ষা করে, কখন রাক্ষসীর মায়ায় অন্ধ, অসহায়, স্মৃতিভ্রষ্ট রাজপুত্র সেখানে এসে পড়বে, আর সে চুপিচুপি তাকে বলে দেবে রাজবাড়ির ঠিকানা। বেশি দেরি হলে রাজপুত্রকে পিঠে নিয়ে পৌঁছেও দেবে সেখানে। কারণ বাঙালি সমাজ আর তার উপরতলার মানুষগুলোর মতো ব্যাঙ্গমাও ভয়ে ভয়ে থাকে, বেশি দেরি করলে যদি রূপকথা বদলে যায়? স্মৃতিভ্রষ্ট রাজপুত্র রাজবাড়ি চিনতে না পেরে যদি মুকুট, তরোয়াল ফেলে বেমালুম সাধারণ হয়ে যায়! সে তো কল্পনাতেও মানা যায় না। অর্থাৎ, ছোটখাটো মানুষগুলো স্বপ্নদেশ আর জাতিগঠনের প্রক্রিয়ার অংশীদার হতেই পারে— তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু তা বলে সমাজচলতি বড়-ছোটর দ্বন্দ্বসীমা তো আর বাতিল করে দিতে পারে না! রাজপুত্রেরা সাধারণ হতেই পারে না। তারা রাজবাড়িতেই পৌঁছয়, তা সে পথ রাক্ষসীর মায়ায় যতই অন্ধকার হোক না কেন!

আর একেবারে সেই কারণেই পুষ্পমালা কোটালপুত্রের সঙ্গে এক আসনে বসতে পারে না। একই পাঠশালা, একই গুরুমশায় দু’জনকে পাঠ দেন, অথচ রাজার মেয়ে পুষ্পমালা বসে হাতির দাঁতের সাদা ধবধবে জাফরিকাটা সিংহাসনে, নীচেই পায়ের কাছে বসে হাঁটু মুড়ে বসে থাকে চন্দন— সে কোটালের ছেলে, সিংহাসনে ওঠার বা সে দিকে তাকানোর সাধ্যও তার নেই। পুষ্পমালার সমস্যা অবশ্য আরও একটু বেশি। মনে মনে সে কোটালপুত্রকে ভালবাসে, অথচ বিয়ের আগে ভালবাসাবাসির স্পর্ধা লেখক বেচারিকে দেননি। একে তো সমাজের ভয়, তায় আবার সে হল গিয়ে রাজার মেয়ে! সে হবে শুদ্ধচিত্ত, পবিত্র, তার কোনও দেহবোধ থাকবে না, সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব তার থাকবে, কিন্তু মুখে টুঁ-শব্দটি থাকবে না— এই হল গিয়ে কল্পনার স্বপ্নরাজ্যে পুষ্পমালাদের আদর্শ নারী হওয়ার ঘরোয়া, ছিমছাম প্রণালী। তাই ১৯০৮ সালে, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র পরে পরেই দক্ষিণারঞ্জন যখন আধুনিক বাংলাদেশের গীতকথাগুলো সঙ্কলন করে ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’ প্রকাশ করলেন, তখন তাতে বেশ কিছু অদলবদল ঘটাতেই হল। না ঘটিয়ে উপায়ই বা কী? পুষ্পমালার সত্যিকারের গল্পটি হুবহু ছোটদের জন্য প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ভাষার মিষ্টতা যতই থাকুক, সাক্ষীসোনার গল্পে রাজকন্যে যে বড়ই চঞ্চলা! সে কোটালের ছেলের সঙ্গে বিয়ের আগেই ভাব করে, লুকিয়ে লুকিয়ে রাজপ্রাসাদের অন্ধকার ঘরে দেখাটেখাও করে। কিন্তু স্বদেশিকালের হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ কি আর সে সব মানবে? একে তো রিভাইভালিজ়ম-এর নামে হিন্দু মেয়েদের মোটামুটি দেবী বানিয়েই ফেলা হয়েছে— তাদের মনের অসামান্য শক্তিতে ঠেকনা দিয়েই কোনও মতে জাতি উদ্ধারের চরমপর্বটি অনুষ্ঠিত হবে বলেও শোনা যাচ্ছে। তায় আবার ভূদেব মুখুজ্জেমশায় প্রাক্‌বিবাহ প্রণয়কে নেহাত পশ্চিমি, অতএব আপৎকালে পরিত্যাজ্য ইত্যাদি লিখেটিখে আরও গোল বাধিয়েছেন। সুতরাং, সাহসিনী সাক্ষীসোনার আনতনয়না পুষ্পমালা হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ই থাকে না! আবার বেচারি মধুমালা সারা দিন ধরে রান্না করে রাজপুত্রকে খাওয়ায়। তার পরেও তার মনে বেজায় ভয়। রাজপুত্রের আরও পাঁচ-পাঁচখানা সুন্দরী বৌ; কী জানি, তার আদরে যদি কম পড়ে! শেষে আর চেপে রাখতে না পেরে পায়েসের পাতে রাজকন্যে প্রশ্নটা করেই ফেলে, “বল স্বামী, তুমি আমায় পুষিবে?” ও দিকে ভর সন্ধ্যেয় স্বামীর মৃতদেহ বুকে চেপে শ্মশানে ঠায় বসে থাকে মালঞ্চমালা। সরু-সরু পিশাচগুলো এসে কত অনুনয়বিনয় করে, “মালঞ্চ লো! পতি দিয়া কি করিবি? পতিটা দে না!” কিন্তু সে কি হয়? পতি বলে কথা! সমাজ বলে দিয়েছে তাকে বাঁচিয়েই বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। অতএব মালঞ্চমালা বসেই থাকে, মাথার ওপর ঝড়জল, হ্যাংলা ভূতের চোখরাঙানি— কিছুই তার পতিপ্রেমের আদর্শ রূপকথাকে টলাতে পারে না। স্বামী, সংসার, ভাইয়েরা— এরাই মেয়েদের আপনজন। তাদের জন্য দরকার হলে কিরণমালা পুরুষবেশ পরবে, মেঘবরণ চুল পাগড়িতে ঢেকে তরোয়াল হাতে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে হিরের গাছের সোনার ফল ছিঁড়ে আনবে। ডাইনির মায়া থেকে ভাইয়েরা মুক্তি পাবে, সুস্থদেহে ঘরে ফিরবে। তখনই আবার পুরুষবেশ ছেড়ে কিরণমালা আলপনা আঁকবে, দুয়োরে জলছড়া দিয়ে পিঠে করতে যাবে। নিপুণ হাতে চন্দ্রপুলি, মোহনবাঁশি, ক্ষীরমুরলী, চন্দনপাতা— এ সব তৈরি করবে। নতুন চালের পিঠের গন্ধে, কপিলা গাইয়ের দুধের সোনালি ঘিয়ের সুবাসে গোটা পাড়া ম-ম করবে, তবে না সবাই ধন্য ধন্য করবে! প্রণাম করে বলবে, “সাত যুগের শ্রেষ্ঠ বীর!”

ও দিকে আবার বেশি বেশি করে নিজের ইচ্ছের কথা জানালে, খিদে পেলে রাতের অন্ধকারে উঠে একটু এ দিক-সে দিক বেশি খেলে পাঁচ জনে পাঁচ কথা বলবে। গোড়ায় যতই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলুন না কেন, রানিমার একটুখানি বেচাল দেখলেই লেখক বড় নিন্দেমন্দ করবেন। বলবেন কি না, “রাক্ষসী রানির জিভে লাল, ঘোমটার আড়ালে জিব লকলক, আনাচে কানাচে উঁকি...” তার পর বলবেন, রাক্ষসী রানির রাজ্যে হুলুস্থুলু ব্যাপার! “রাজপুরীর চূড়া ভাঙিয়া পড়িল, রাজার বুক কাঁপিয়া উঠিল... ঘরে ঘরে মানুষের হাড়, পথে পথে হাড়ের জঙ্গল!” অর্থাৎ কিনা সমাজের যে সুন্দর স্বপ্নে ছোটরা অভ্যস্ত হবে, রাক্ষসীরা সেখানে চির-অসুন্দর, অপাঙ্‌ক্তেয় উপস্থিতি। তাদের বড় বড় নখ, ভাঁটার মতো চোখ, শণের মতো চুল— দেখলেই বেজায় ভয় লাগে, কিন্তু রাক্ষসীদের শরীরে মায়াদয়া আছে। রূপকথার নিয়মে রাক্ষসীরা সবাই যখন মেয়ে, তাদের মনেও একটু-আধটু বাৎসল্য আছে! তাও সে যত স্নেহশীল দিদিমা আর ছোট্ট রাজকন্যেকে বড় করা আয়িবুড়িই হোক না কেন, তাদের না মারা অবধি রাজপুত্রদের শান্তি নেই। রাজা হতে গেলে, রাজকন্যাকে বীরত্বের বহর বোঝাতে গেলে রাক্ষসীকে মারা খুবই দরকার। রাক্ষসীর স্নেহটুকুও সমাজের স্বপ্ন-পথে বিবর্জনীয়।

তাই গল্পের জাতিটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বেশ বড় হয় ঠিকই, কিন্তু তাও কৈশোরের দুঃখের মতো একটু-আধটু খোঁচা কোথাও যেন থেকেই যায়। সেখানকার ছোট-বড় সকলেই তুলো খুঁজতে খুঁজতে, ছুটতে-ছুটতে তেপান্তরের মাঠ, আরও কত দেশ পেরিয়ে চাঁদের মা বুড়ির কাছে পৌঁছয়। কী ভাল সে বুড়ি, পেটটি ভরে ভালমন্দ খাওয়ায়, রংচঙে বাক্সে কত রকম উপহার দেয়। কিন্তু সবার উপহার কি আর সমান হয়? হিরে-মানিকের বন্যা, সোনার পাখি, রাজপুত্র বর, অর্থাৎ সোজা চোখে যা যা ভাল, সে-সবই পায় রাজপুত্র আর রাজকন্যের দল। আর যারা সে সব পায় না? সেই দলছুট প্রান্তিকদেরও কি মনখারাপ করে? তারাও কি প্রাপ্যটুকু দাবি করতে শেখে? কেউ কেউ হয়তো শেখে। যেমন ছোট্ট টুনটুনিটা শিখেছিল। বেপাড়ার ধাড়ি বেড়ালটা রোজ তার ছানাদের দিকে লোভ দিত। টুনটুনির খুব রাগ হত। কিন্তু যে হেতু তার ছানাগুলো উড়ে পালাতে শেখেনি তখনও, অসহায় টুনটুনি রোজ গালফোলা বেড়ালটাকে সেলাম ঠুকত আর অপেক্ষা করত। শেষমেশ সাহস করে একরত্তি ছোট্ট পাখিটা বেড়ালটাকে অপমান করতে পারল তো! রাজার ঘরের শুকোতে দেওয়া টাকা নিজের ঘরে রাখার অপরাধে রাজা যখন তাকে ছোট বলে হাসাহাসি করলেন, সে রাজাকে শাস্তি দিতে পারল তো! কল্পনার দেশটা যদি সত্যিই এত সুন্দর হয়, তাহলে সেখানে ছোট্ট টুনটুনিও রাজার ঐশ্বর্য রাখার ক্ষমতা ধরে! আর তার সেই ক্ষমতাকে প্রতি দিন বাড়তে দেওয়ার সাহস রাখে যে দেশ, সেই-ই তো আসল স্বপ্নের দেশ— যার কোনও ভূগোল নেই, যার কোনও শ্রেণিবিভাজনের বাধাবন্ধ নেই, যে ভীষণ অন্য রকম আর ভীষণ আদরের!

আর সেই স্বপ্নদেশের দারুণ রঙিন সব ছবি যখন উপেন্দ্রকিশোর তুলে আনছেন ছেলেমেয়েদের জন্য, তখন ময়মনসিংহে জোরদার লড়াই চলছে। আঁচ পড়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম আরও আশপাশের সব অঞ্চলে। ময়মনসিংহের সাধারণ মানুষেরা মিলে কার্জনের বাংলাভাগের বিরুদ্ধে সত্তর হাজারেরও বেশি সই সংগ্রহ করছেন। বড়লাট কার্জন অবাক হয়েছেন, সরকারি দফতরে চিঠি লিখে জানিয়েছেন ছোট ছোট শহরের মানুষজনের অপ্রত্যাশিত স্পর্ধার কথা। কোথায় পেল তারা এত সাহস? সত্যিই তো, ১৯১০ সালে প্রথম যখন এতখানি রাগ আর স্পর্ধা সঙ্গে করে ‘টুনটুনির বই’ প্রকাশ পেল, তখনও হয়তো পাঠকেরা এই কথাটাই ভেবেছিলেন। রাজার বাগানের এক কোণে পড়ে থাকা টুনটুনি, পথ হারানো ছোট্ট ছাগলছানা নরহরি দাস, বোকা গরীব জোলা— এরাও স্বপ্ন দেখার আকাশ খোঁজে? রোজকার জীবনে খুচরো অসম্মান পেতে অভ্যস্ত এরাও এক দিন মাথা তুলে বলে, স্বপ্নদেশটা আসলে সবার? লেখাপড়া শেখেনি, ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে পরা হাবাগোবা নাপিত আর জোলাও জানে, রূপকথায় বিভেদ হয় না!

আসলে রূপকথারও একটা রাজনীতি আছে। সে শিশুপাঠ্য হতে পারে, কিন্তু শিশুর মতোনিষ্পাপ নয়! তার ভালমন্দের দ্বন্দ্বসীমা বড় তীক্ষ্ণ। রূপকথার দেশে স্থান-কালের হিসেবে নড়চড় থাকলেও, রূপকথা লেখার উদ্দেশ্য বরাবরই দেশ ও জাতিনির্ভর; সেখানে মায়ার অলীক অলিন্দেও হাজারটা সমাজযুক্তির অঙ্ক! তাই স্বদেশি যুগে যে রূপকথা পাঠককে ভীষণ প্রিয় স্বপ্নরাজ্য চিনতে শেখায়, তার ভালমন্দ, ছোট বড় আর শক্তিসাম্যের শক্ত সমীকরণ গল্পচ্ছলে বুঝিয়ে দেয়, সেই রূপকথাই চল্লিশের দশকে এসে মরা চাঁদের আলোয় থমকে দাঁড়ায়। সমাজ বদলেছে, বদলে গিয়েছে তার চাওয়া-পাওয়ার হিসেবগুলোও। সেই টিয়াপাখির দল কবেই মরে গিয়েছে,বনগাঁবাসী মাসিপিসির ঘর ফাঁকা, রাজপুত্র রাজ্যশাসন করতে গিয়ে অচিরেই বুড়িয়ে গেছে, রাজকন্যের ভাঁড়ারে চাল বাড়ন্ত— যুদ্ধের বাজারে খাবার নেই, স্বপ্ন নেই, মেঠো বাঁশির মনকেমন করা সুরটিও আজ স্তব্ধ। কিন্তু সেখানেই তো শেষ নয়! রূপকথা জানে, বৃষ্টি আবার এল বলে! আবার কোনও দিন বালি চিকচিক করবে, নদীর পাড়ে ভিড়বে শিবঠাকুরের নৌকো। নতুন বৌয়ের গোঁসা ভাঙিয়ে আবার সে নৌকো রওনা দেবে ‘হলদে পাখির’ দেশে। না, তার বেশি দেরি নেই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement