ছবি: তারকনাথ মুখোপাধ্যায়।
রাগে চোখ-মুখ কুঁচকে গেল বিপ্রনাথবাবুর। ম্যাসিয়োর ছেলেটির এ রকম সময়জ্ঞান তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়েছে। এমনিতেই তাঁর রগচটা স্বভাবের কথা এ পাড়ার আর কারও জানতে বাকি নেই। পান থেকে চুন খসল কি খসল না, অমনি বিপ্রনাথের মাথায় রাগের পারদ চড়তে থাকে। তার উপরে সময়ের ব্যাপারে তিনি পাক্কা সাহেব, এক পলও বৃথা ব্যয়ে নারাজ। সেখানে এই ম্যাসিয়োর ছেলেটি কি না পাক্কা দু’ঘণ্টা লেট! এর পর আর মাসাজ নেওয়ার মুড থাকে? আজ সপ্তাহ তিনেক আসছে ছেলেটি, বয়স বেশি নয়, ত্রিশের কোঠায়। প্রথম দিন নাম জিজ্ঞেস করায় জানিয়েছিল, ধ্রুব মণ্ডল। শুধু তার মুখের কথায় অবশ্য বিশ্বাস করেননি বিপ্রনাথ। পরিচয়পত্রও চেক করে নিয়েছিলেন। যে সংস্থার হয়ে ছেলেটি মাসাজ দিতে এসেছে, তাদের বলেই নিয়েছিলেন, “আমি পরিচয়পত্র আগে ভেরিফাই করে নেব। তার পর অন্য কথা!”
ফোনের ও পারে থাকা ‘ইজ়ি লাইফ’-এর তরফ থেকে কথা বলছিল যে মেয়েটি, নাম বলেছিল রণিতা, সে রিনরিনে গলায় বলল, “নিশ্চয়ই স্যর। আমাদের সংস্থার সব অ্যাটেনডেন্ট কিংবা ম্যাসিয়োরের সঙ্গে তার আধার কার্ড ক্যারি করা বাধ্যতামূলক। আপনি দেখে তার পর মাসাজ নেবেন। শুধু মাসাজের আগে টাকাটা পে করে দেবেন। এটা আমাদের সংস্থার ঠিক করা নিয়ম। যদিও আপনাদের জন্য এ নিয়ম নয়, আপনারা ভদ্রলোক, মাসাজ শেষ হওয়ার পর চার্জের সামান্য টাকাটা দিতে অস্বীকার করবেন না। কিন্তু কী জানেন, বেশ কয়েক বার আমাদের ম্যাসিয়োরদের কাজ শেষ হলে ক্লায়েন্ট ফিজ় দিতে অস্বীকার করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, আমরা গলাকাটা ফিজ় নিচ্ছি! কিন্তু আমরা আগেই ওঁদের চার্জ জানিয়ে দিয়েছিলাম। তাঁরা এগ্রি-ও করেছিলেন। বেশ কয়েক বার বিভিন্ন জনের সঙ্গে এই রকম হওয়ার পর কোম্পানি এই নিয়ম চালু করতে বাধ্য হয়েছে স্যর। প্লিজ় ডোন্ট মাইন্ড!”
মেয়েটিকে আশ্বস্ত করেছিলেন বিপ্রনাথ। ওই তো সামান্য হাজার টাকা। সারা জীবন দু’হাতে রোজগার করেছেন তিনি। ছিলেন আয়কর বিভাগের বড় কর্তা। কত সাদা হাতি যে তাঁর কাছে বাঁধা ছিল তার ইয়ত্তা নেই। বছরের নির্দিষ্ট সময় এলেই মাসোহারা ঠিক পৌঁছে যেত। কালো টাকা সাদা করার কত যে ফিকির তিনি তাঁদের দিয়েছেন! আর এ সমস্ত ব্যাপারে ডিপার্টমেন্টে তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল। মধুরিমা চলে যাওয়ার পর একা হাতে মেয়েকে মানুষ করেছেন, মেয়ে এখন ইঞ্জিনিয়ার, থাকে কানাডায়। জামাইও একই কোম্পানিতে চাকরি করে। তিন-চার বছর অন্তর আসে। এখন ঝাড়া হাত-পা তিনি। সংসারে থাকার মধ্যে আছে শুধু সর্বক্ষণের কাজের লোক গোবিন্দ।
আজকাল কী ভাবে সঞ্চিত টাকা খরচ করবেন, তা নিয়েই বিপ্রনাথের মাথাব্যথা। কোমরের এই ব্যথাটা চাগাড় না দিলে হয়তো ম্যাসিয়োর রাখার কথা ভাবতেন না তিনি। কিন্তু ডাক্তার বললেন, “আপনার যা অবস্থা, তাতে ওষুধের চেয়ে হালকা এক্সারসাইজ় এবং মাসাজ থেরাপি নিলে ভাল ফল দেবে। আমার চেনাজানা সংস্থা আছে। খুব বিশ্বস্ত, আপনি হয়তো শুনে থাকবেন, ‘ইজ়ি লাইফ’ নামের এই সংস্থাটি আজকাল খুব নাম করেছে। এখন আপনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন…”
সিদ্ধান্ত আর কী নেবেন? ডাক্তারের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে নিয়েছিলেন তিনি। ‘ইজ়ি লাইফ’-এর নাম না শুনলেও, এত কালের চেনা এবং কলকাতার এক জন নামকরা অর্থোপেডিক সার্জেন যখন বলছেন, তখন সে-কথা অন্ধের মতো বিশ্বাস করা ছাড়া আর উপায় কী? সেই শুরু। আজ মাস তিনেক হল ওই সংস্থা থেকে সার্ভিস নিচ্ছেন তিনি। ঘণ্টা দেড়েকের সেশন। সপ্তাহে দু’-বার। নো মেডিসিন। শুধু প্রথম তিন দিন রাতের দিকে পেনকিলার খেয়েছিলেন। তার পর আর কোনও ওষুধ খাননি তিনি। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে চা-বিস্কুট খেয়ে বিপ্রনাথ আধ ঘণ্টা এক্সারসাইজ় করেন, আর সপ্তাহে দু’দিন সন্ধ্যার দিকে মাসাজ নেন। গালভরা নাম ‘ফিজ়িয়োথেরাপি’ শুনলেই হাসি পায় তাঁর। গেঞ্জির আবার বুকপকেট!
এই যে ছেলেটি কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে যদি আজ মাসাজ না নিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেন, তা হলে তাঁর নিজের ক্ষতি কিছুই হবে না, কিন্তু ম্যাসিয়োর ছেলেটির হবে। গরিব ঘরের মানুষজন সব। আর কোনও চাকরি-বাকরি না পেয়ে এই কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। প্রপার ট্রেনিং কতটা আছে, সে বিষয়েও তিনি সন্দিহান। এখন যদিও পরে আছে কোম্পানির লোগো দেওয়া শার্ট-ট্রাউজ়ার্স। কিন্তু এরাই ঘরে ফিরে ফুটি-ফাটা গেঞ্জি বা বহু ব্যবহারে জীর্ণ টি-শার্ট গায়ে দিয়ে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখবে। টিপিক্যাল ছোটলোক বলতে যা বোঝায়, ধ্রুব মণ্ডলের মতো লোকজনই তারআদর্শ উদাহরণ।
“স্যর, মাসাজ ক্লথটা পেতে ফেলি?” ধ্রুব মণ্ডল ভয়ার্ত মিনমিনে স্বরে জিজ্ঞেস করল।
“কেন? বললাম যে, আজ থাক, মাসাজ করতে হবে না!” থমথমে গলায় বললেন বিপ্রনাথ।
“প্লিজ় স্যর। ব্যক্তিগত কারণে একটু দেরি হয়ে গেল। আর এ রকম হবে না। প্লিজ় আজ মাসাজ নিয়ে নিন। আমি কথা দিচ্ছি…”
এত ক্ষণ নিজেকে কন্ট্রোল করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন বিপ্রনাথ, কিন্তু ধ্রুব মণ্ডলের “আমি কথা দিচ্ছি” শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, “তোমার মতো ছোটলোক ম্যাসিয়োরদের আবার কথার দাম! আজকে যা করলে, এর পরেও তুমি সেই কথাই বলবে? লজ্জা করে না তোমার? আবার বড় মুখ করে আমার সামনে দাঁড়াতে এসেছ?”
“স্যর, বিশ্বাস করুন। আমি কিছুতেই ম্যানেজ করতে পারিনি। আমার ব্যক্তিগত কারণের জন্য আপনার যে অসুবিধে হয়েছে, তাতে আমি যারপরনাই দুঃখিত। কিন্তু স্যর, আপনি মাসাজটা নিন। এতে গ্যাপ দেবেন না। তা হলে নিজের শরীরেরই ক্ষতি হতে পারে। ছ’মাস টানা নিয়ম করে নিলে দেখবেন, আপনার কোমরের ব্যথাটা অনেকটাই কমে গেছে স্যর…”
বিপ্রনাথবাবুর গোঁফের কোণে একটা ফিচেল হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। হুম, পথে এসো বাছাধন! মাসাজ না করে ফিরে যাওয়া মানেই কোম্পানির লস। আর কোম্পানি খেপে গেলে তোমার বিপদ। এই রিসেশনের বাজারে এক-নিমেষে চাকরি ‘নট’ হয়ে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে বৌ-বাচ্চা, সংসার নিয়ে পথে দাঁড়ানো। সেই জন্যই ধ্রুব মণ্ডলের প্রাণে ভয় ধরেছে, বুকের মধ্যে গুড়গুড় করছে। তেমন ঘোড়েল লোক হলে লেজে খেলাত। কিন্তু বিপ্রনাথ সে-সবের ধারেকাছে গেলেন না। তিনি ঠিক করে নিয়েছেন, আজ যদি ধ্রুব মণ্ডলের হাতে মাসাজ নেনও, তা হলেও তিনি এর বিরুদ্ধে কোম্পানিকে অভিযোগ জানাবেন। অনুরোধ করবেন, কাজের ক্ষেত্রে সৎ, প্রকৃত ওয়েল-ম্যানারড কোনও ম্যাসিয়োর পাঠাতে। অন্তত ধ্রুব মণ্ডল নয়। যত্ত সব ছোটলোকের দল এসে তাঁরই কপালে জোটে, ডিসগাস্টিং!
প্রতিবার মাসাজ নেওয়ার আগে টাকাটা একটা খামে করে টেবিলের উপর রেখে দেন তিনি। ভিতরে টিপ্স হিসেবে একশো টাকাও থাকে। আজও রেখেছিলেন। কিন্তু এত বিরক্ত লাগছিল আজ তাঁর, খাম থেকে ধ্রুব মণ্ডলকে দেখিয়েই একশো টাকার নোটটা বার করে নিলেন বিপ্রনাথ। টিপস দেওয়া তো বাধ্যতামূলক নয়। আজ ধ্রুব মণ্ডল তাঁর মেজাজ এমন ভাবে খিঁচড়ে দিয়েছে যে, তাকে টিপস দেওয়ার অর্থ সততা ও নিয়মানুবর্তিতার গালে থাপ্পড় মারা। অতএব আজ ধ্রুব মণ্ডলকে কোনও টিপস দেবেন না তিনি।
মাসাজের সময়েও মেজাজ এত তিক্ত ছিল যে, বার বার বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছিল বিপ্রনাথের কথায়-আচরণে। ধ্রুব প্রথম দিন জিজ্ঞেস করে নিয়েছিল, প্রেশার মিডিয়াম দেবে না লো। তাতে লো প্রেশারটাই প্রেফার করেছিলেন তিনি। গত সেশনেও ধ্রুবর হাতের মাসাজ নিয়ে কোন আপত্তি ছিল না তাঁর, কিংবা মাসাজের সময় ডিসকমফর্ট ফিল করছেন— এমন কথাও বলেননি। কিন্তু আজ বললেন। কখনও তাঁর কশেরুকার উপর প্রেশার বেশি দিচ্ছিল ধ্রুব, কখনও ওর কর্কশ-রুক্ষ হাতে তাঁর পিঠের নুনছাল উঠে যাচ্ছিল বলে মনে হচ্ছিল, কখনও কোমরের উপর চাপ বেশি হওয়ায় তিনি চেঁচিয়ে উঠছিলেন ব্যথায়। আর মনে মনে ভাবছিলেন, কখন ধ্রুব মণ্ডল বিদায় হবে আজ। বেশ কড়া করে একটা ফোন কল করে ছেলেটির কাজের বারোটা না-বাজিয়ে তিনি ক্ষান্ত হবেন না।
ধ্রুব মণ্ডল অনেক ক্ষণ হল চলে গেছে। রোজকার মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বিপ্রনাথ। ভেবেছিলেন, আজ মেজাজ এত তিক্ত আছে যে ঘুম আসবে না। কিন্তু না, কখন যে ঘুম নেমে এসেছিল চোখে, বুঝতে পারেননি। উঠে রোজ যেমন কুসুম কুসুম গরম জলে শাওয়ার নেন, আজও নিলেন। ডিনারের দেরি আছে। গোবিন্দকে ডেকে ব্ল্যাক কফি দিতে বললেন তিনি। কফি এলে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে ফোন করলেন, ‘ইজ়ি লাইফ’-এর কাস্টমার কেয়ারে।
রণিতাই ফোন ধরল। পরিচয় দিতে একগাল হেসে বলল, “কেমন আছেন স্যর? আমাদের সার্ভিস ভাল লাগছে তো?”
বিপ্রনাথ ভেবেছিলেন স্বাভাবিক গলাতেই কথা বলবেন, কিন্তু তাতে ভুল বার্তা যেতে পারে। অভিযোগের গুরুত্বও কমে যেতে পারে। অতএব কড়া গলাতেই বললেন, “আর ভাল থাকব কী করে বলুন। ইজ়ি লাইফকে ডিফিকাল্ট করে দিচ্ছেন, ভাল আর কী করে থাকা যাবে?”
রণিতা থমকে গেল। সতর্ক গলায় বলল, “কেন স্যর, কিছু হয়েছে কী?”
“কী আর হবে? আপনারা লাস্ট কয়েকটা উইক যে লোকটিকে পাঠাচ্ছেন, সে অত্যন্ত কেয়ারলেস এবং হোপলেস এক জন ম্যাসিয়োর। তা-ও মানিয়ে নিচ্ছিলাম, ভেবেছিলাম কিছু দিন দেখি, তার পর না হয় অন্য ম্যাসিয়োরের জন্য রিকোয়েস্ট করব আপনাদের। কিন্তু লোকটির টাইমের কোনও ঠিক নেই। আজকে সেশন শুরু করেছে পাক্কা দু’ঘণ্টা লেটে। দেখুন হয়তো কোথাও বসে আড্ডা দিচ্ছিল কিংবা পাতা খাচ্ছিল। চোখ দুটো তো করমচার মতো লাল দেখলাম। আমার বিনীত অনুরোধ যে, এই ধরনের লোককে আপনারা আর সার্ভিস দিতে পাঠাবেন না। অন্য কোনও ম্যাসিয়োর না দিতে পারলে বলে দিন। ‘ইজ়ি লাইফ’-এর সঙ্গে আমার কানেকশনেরও তা হলে এখানেই ইতি!”
রণিতা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “না না স্যর। রাগ করবেন না প্লিজ়। আমি চেক করে দেখলাম, আপনার কাছে শেষ তিন সপ্তাহ ধরে ধ্রুব মণ্ডল যাচ্ছে সার্ভিস দিতে। কিন্তু আপনি যখন তার সার্ভিসে স্যাটিসফায়েড নন, তা হলে আমরা নিশ্চয়ই তার জায়গায় অন্য কাউকে পাঠাব। এমনিতেও ধ্রুব মণ্ডল কিছু দিন যেতে পারত না। তার বাড়িতে একটা মিসহ্যাপ হয়ে গিয়েছে আজ সকালে। ওর একমাত্র সন্তান, ছোট্ট ছেলে, হেপাটাইটিস বি হয়েছিল। আজ সকালে মারা গেছে। ওর মা-বাবা দু’জনেই অসুস্থ, স্ত্রী আগেই মারা গিয়েছেন, ছেলেটিই ছিল ওর সব। তাকে দাহ করে শ্মশান থেকে ফিরে ওর যেতে আজ একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমরা অন্য কাউকে পাঠাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে-ই বলল যে, আপনি বয়স্ক মানুষ। ঠিকঠাক প্রেশার না দিয়ে মাসাজ করলে আপনার অসুবিধে হবে। বলল, পরে একটু সময় নিয়ে যেন আপনার জন্য ভাল কাউকে পাঠানো হয়। কারণ আপনার আজকের কাজটা করে ও হপ্তাখানেক ছুটি নিয়েছে। গয়া যাবে সম্ভবত। ধ্রুবর মানসিক অবস্থা ভাল ছিল না, কাজের মধ্যে থাকলে যদি ভুলে থাকে কিছুটা, সেই জন্যই আমরা অ্যালাও করেছিলাম। ওকে এই অবস্থায় পাঠানোর জন্য আমরা ক্ষমা চাইছি। নিশ্চিন্ত থাকুন, ধ্রুব মণ্ডলকে আপনার কাছে আর কোনও দিন পাঠাব না আমরা। ভাল থাকবেন স্যর। সার্ভিস নিয়ে পছন্দ-অপছন্দ এই ভাবেই যে কোনও সময় নির্দ্বিধায় নাবেন। ‘ইজ়ি লাইফ’ ইজ় অলওয়েজ় অ্যাট ইয়োর সার্ভিস...”