ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।
দোতলার ঘরে অভ্র চুপচাপ শুয়ে থাকল। আজ একটি রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। কয়েকটি শালিক ছাদে আলো খুঁটে বেড়াচ্ছে। নীল অপরাজিতার মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে আকাশ।
রুমকি নামটা ছারপোকা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে। রুমকির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে হা-হুতাশ কিছু দিন ছিল, তার পর আর্থিক অনটন শোক কমিয়ে দিল। সমস্ত শোকের উপরই সময়ের পলি জমে। সে-ও রুমকি অধ্যায় বন্ধ করে দিতে পেরেছিল। গত ন’বছর দু’তরফেই কেউ যোগাযোগ রাখেনি। ছারপোকার কামড় কমাতেই রুমকির ফেসবুক প্রোফাইলে উঁকি দিল অভ্র। আশ্চর্য ব্যাপার, গত মাস থেকে নিজের ওয়ালে একটিও স্টেটাস দেয়নি রুমকি। তার আগে পর্যন্ত প্রতি মাসে দশ-বারোটি করে পোস্ট করে যাচ্ছিল।
প্রাক্তনকে কি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো যায়? আজকাল তো জগতে অনেক ন্যাকামোই চলে। ডিভোর্সের পরে নাকি প্রাক্তন স্বামী-স্ত্রী বন্ধুর মতো হয়ে যায়। যত্তসব বকওয়াস, বন্ধুত্বের এত আঠা থাকলে দেবা-দেবীর ডিভোর্স হল কেন?
রুমকি বন্ধুনি হতে চাইবে আদৌ? মনের দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিল অভ্র ।
মল্লার বলল, “পেট্রলের দাম বেড়েছে।”
কমল বললেন, “জানি। পেট্রল-ডিজ়েলের দাম চিরকালই বাড়ে। ওটা পলিটিকাল ইস্যু। যে আজ বিরোধিতা করছে, কাল ক্ষমতায় এলে একই পথে হাঁটবে। তা আমাকে কী করতে হবে?”
“যখন পেট্রল খরচ বাবদ আমাকে মাসে সাতশো টাকা দেওয়া শুরু করেছিলে তখন লিটার ছিল সাতাশি টাকা, এখন তা একশো পনেরো ছুঁতে চলেছে। তাই বরাদ্দ বাড়াতে হবে।”
কমল মৃদু হাসলেন, “যদি না বাড়াই? তোর বাইকের জ্বালানি আমি কেন দিতে যাব?”
“প্রতিদিন সিন্থেসাইজ়ারের টিউশন করার জন্য প্রচুর পেট্রল পোড়ে। ওতে খরচা বাড়ছে। সবই বোঝো, তবু কথার কারুকাজ করছ কেন?” মল্লার ঈষৎ রাগের ভঙ্গিতে বলল।
“আমাকে কত দিতে হবে?”
“এক হাজার। শুনে আবার ভিরমি খেয়ো না। ভাই মাঝেমধ্যে যে টাকাটা পাঠায় সেটাও ব্যাঙ্কে দিয়ে আসো। ভেবে পাই না যে টাকার জন্য জীবন না জীবনের জন্য টাকা। হেভি কনফিউজ়িং।”
কমল বললেন, “থাক। অত কনফিউজ়ড হতে হবে না। দিয়ে দিচ্ছি। তবে আমাকে কথায় কথায় কৃপণ বলে খোঁটা দেওয়ার বদভ্যেসটা ছাড়।”
টাকাটা প্যান্টের পকেটে পুরে মল্লার বলল, “না বললে যে তোমার হাত থেকে টাকা খসে না।”
“কোন গানটা বাজাচ্ছিলি রে? আকাশে আজ রঙের খেলা?”
মল্লার অবাক চোখে তাকাল, “তুমি গানটা ধরতে পেরেছ?”
“কেন, তোর বাবা কি এতই কাঠখোট্টা? ও
সব আমাদের যৌবনের গান। আমার বাবা ক্লাসিকাল গান শিখতেন, আমি জীবিকা আর সংসারের চাপে কিছুই শিখতে পারলাম না। তুই সেই ধারাটা পেয়েছিস। সুন্দর বাজাচ্ছিলি, বড় ভাল লাগছিল শুনতে।”
মল্লার মাথা দুলিয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, ড্যাড। জীবনে প্রথম তুমি আমার প্রশংসা করলে। মন গার্ডেন-গার্ডেন হয়ে গেল। আমি এ বার বেরোই। আজ তিনটে বাড়িতে শেখানো আছে।”
পেট্রল পাম্প থেকে হাজার টাকার তেল ট্যাঙ্কে পুরে নিয়ে মল্লার এগোল। আজ গুমোট গরম, আকাশের মুখ ভার, হয়তো বৃষ্টি আসবে। রুক্ষ দাবদাহ থেকে একমাত্র বৃষ্টিই মুক্তি দিতে পারে।
মল্লার চমকে গেল। বাঁ দিক দিয়ে একটা বাইক স্পিড তুলে তাকে ওভারটেক করে গেল। সে বাঁ দিকে সামান্য ঘুরলেই অ্যাক্সিডেন্ট হত। সে চেঁচিয়ে বলল, “ইডিয়ট! এটা কি ন্যাশনাল হাইওয়ে? ইচ্ছেমতো ডান-বাঁ না মেনে ওভারটেক করছিস?”
রাগে গজগজ করে মল্লার। আইন ভাঙাটাই এ দেশের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম টিউশন সেরে সে সন্ধে সাতটা নাগাদ চিরশ্রীদের বাড়ির দরজায় নক করল।
চিরশ্রী দরজা খুলে বলল, “আসুন।”
ড্রয়িংরুমে বেতের চেয়ারে বসল মল্লার।
সামনের রুমেই চিরশ্রী শেখে। মিনিট কয়েক বাদে চিরশ্রী এসে বিছানায় বসল। একটু হতাশ হল মল্লার। গত বারে উপরের ঘরে এসি-র হাওয়ায় শিখিয়েছিল, তুলনায় নীচটায় বেশ গরম ভাব।
মল্লার বলল, “নিন, শুরু করুন।”
চিরশ্রী বাজানো শুরু করতেই চোখ বুজে ফেলল মল্লার। এটা তার মুদ্রাদোষ বলা যায়। চোখ বন্ধ রেখে একমনে সে শোনে, ভুল হলে ঠিক ধরে ফেলে। উহুঁ, চিরশ্রী অন্তরায় এসে গন্ডগোল করছে। এমন তো কখনও হয় না।
মল্লার চোখ খুলে বলল, “অন্তরাটা আর এক বার বাজান। কানে লাগছিল। সুরটা কেমন যেন কেটে যাচ্ছে।”
তবু চিরশ্রী আবার একই ভুল করল।
মল্লার মাথা নেড়ে বলল, “না, হচ্ছে না। কী হল আপনার? এ রকম তো কখনও হয় না! ঠিক আছে। আমি এক বার বাজিয়ে শোনাচ্ছি। বি অ্যাটেনটিভ।”
চিরশ্রী থুতনিতে আঙুল রেখে শুনছে। শুনছে না একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে? দ্বিধায় পড়ে গেল মল্লার। কমবয়সি শিক্ষার্থী হলে সে মৃদু ধমক দিত। চিরশ্রীর বেলায় তা সে করতে পারবে না।
“শুনলেন?”
“হ্যাঁ,” চিরশ্রী যেন কোনও এক জগতে আচ্ছন্ন ছিল, বাস্তবে ফিরে এসে নড়েচড়ে বসল।
“তা হলে বাজান। আর যেন ভুল না হয়।”
“ছোট ছোট ভুল নিয়েই তো জীবন,” চিরশ্রীর চিবুক জুড়ে হাসির ঢেউ, “কিছু ভুল হয়তো নিজের অজান্তেই হয়ে যায়।”
মরেছে, এ যে দার্শনিকের মতো কথা বলছে।
মল্লার কঠিন গলায় বলল, “সুরের জগতে ছোট ভুলই মারাত্মক, সবটাকেই এক লহমায় বেসুরো করে দিতে পারে। আপনি বাজিয়ে যান, এ বার আরও মন দিয়ে শুনব, কানে বেসুর ধাক্কা মারলেই ধমক খাবেন কিন্তু।”
“আপনি ধমকাবেন?”
“হ্যাঁ। হোয়াই নট? শিষ্যা ভুল করলে গুরুর ধমক খেতে হবেই।”
চিরশ্রী কপট অভিমানে ঠোঁট বেঁকিয়ে
বলল, “শিষ্যা যদি ইচ্ছে করেই ভুল করে, তা
হলেও বকবেন?”
মল্লার বিস্মিত হয়, “ইচ্ছে করে ভুল!”
“হ্যাঁ, তা হলে গুরুর সান্নিধ্য বেশি ক্ষণ পাওয়া যাবে। কোনও মতে শিখিয়ে পালাবেন না। তাঁকে আটকে রেখেই সুখ,” চিরশ্রীর চোখের কোণে হাসি।
“কলিযুগের গুরু। খেটে খেতে হয়। এক জায়গায় বেশি ক্ষণ সময় দিলে অন্যের বেলায় টাইম কমে যাবে। কথা না বাড়িয়ে এ বার বাজান,” মল্লার হালকা গলায় বলল। বাজিয়ে মল্লারকে পছন্দ করছে চিরশ্রী, পুরুষ মল্লারের কোনও ঠাঁই নেই সেখানে। কী ভাবে এ রকম ভেবে নিচ্ছে সে? মাঝারি উচ্চতার সাদামাটা চেহারার মল্লার ঘোষকে আজ অবধি কারও মনে ধরেনি। তার মালঞ্চে বসন্ত কখনও ভুল করেও উঁকি মারেনি।
চিরশ্রী অপূর্ব বাজাচ্ছে এখন, সারা ঘরটায় মধুর ছন্দোময় সুর ভেসে বেড়াচ্ছে। এত সুন্দর বাজাচ্ছে যে মল্লার আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে।
গান শেষ হলে সে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “ওয়ান্ডারফুল। দারুণ বাজালেন।”
চিরশ্রী মৃদু হেসে তাকাল, “বলছেন?”
“মিথ্যে স্তুতি আমি করি না।”
“শুনে ভাল লাগল। আপনার প্রশংসা সহজে পাওয়া যায় না। উঠি একটু?”
“হ্যাঁ।”
মিনিট পাঁচ পরে চিরশ্রী ট্রে হাতে ফিরে এল। চা এবং চানাচুর এগিয়ে দিল।
মল্লার বলল, “এ সব করতে গেলেন কেন?”
“করতে ইচ্ছে করল।”
“মাত্র এক ঘণ্টার জন্য আসি। তার মধ্যেই রোজ কিছু না কিছু খাওয়াচ্ছেন। বেশি ফর্ম্যালিটি হয়ে যাচ্ছে না?”
চিরশ্রী ঘাড় দুলিয়ে হাসল, বলল, “আপনি ফর্ম্যালিটি করার লোক, তাই করছি। চা ঠান্ডা হওয়ার আগে চুমুক দিন।”
মুখে এক মুঠো চানাচুর পুরে মল্লার বলল, “প্রমিতদা কোথায়? আজকেও ভিজ়িটে গেছে?”
“বিকেলেই ফিরেছে। উপরের ঘরে রেস্ট নিচ্ছে,” চিরশ্রী আঁচল দিয়ে গলার ঘাম মুছে বলল, “প্রমিতদার খোঁজ নিচ্ছেন যে!”
“এমনিই।”
চিরশ্রী বলল, “খুব একঘেয়ে জীবন আমাদের। ওর কাজের কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। সারা দিন ঘরে একা, টিভি দেখা, মোবাইল ঘাঁটা, খাওয়া আর ঘুম। তার মধ্যে এই সিন্থেসাইজ়ার নিয়ে কিছুটা সময় খুব ভাল কেটে যায়। তবু নিজেকে লোনলি লাগে।”
মল্লারের মুখে চলে এসেছিল যে, ‘একটা ইস্যু নিলেই তো পারেন। ব্যস্ততায় সারা দিন কেটে যাবে।’ বলতে পারল না, জিভে জড়তা চলে এল। এই যুগলের প্রাইভেট ব্যাপারে সে কোন আক্কেলে কথা বলতে যাচ্ছিল!
চায়ে চুমুক দিয়ে মল্লার বলল, “এই পৃথিবীতে সবাই লোনলি। আমার কথাই ধরুন। অভ্র নামের এক বন্ধু আছে। আর কেউ নেই। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শেখাই বলে চার দিন সন্ধেটা অনায়াসে কেটে যায়।”
“ছেলেদের তবু বাইরের জগৎ থাকে। মেয়েরা চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি। একটা প্রাইভেট স্কুলে কিছু দিন পড়িয়েছিলাম। মাইনে কম, খাটুনি বেশি। আপনার দাদাও আপত্তি করছিল। ছেড়ে দিলাম।”
“প্রমিতদা আপত্তি করেছিল কেন?”
“জানি না। তবে পছন্দ করত না।”
চা শেষ করে মল্লার জানতে চাইল, “এ বারে কোন গান?”
“হঠাৎ ভীষণ ভাল লাগছে। ওই গানটা।”
“আপনি দেখছি লতা মঙ্গেশকর ছেড়ে বেরোতেই চান না! ওই গানটার নোটেশন কঠিন, আমাকে একটু দেখে রাখতে হবে। তত দিন আগের গানটারই প্র্যাকটিস চলুক।”
“ঠিক আছে। ও কী! উঠে পড়লেন যে!” চিরশ্রী আবদারের সুরে বলল, “প্লিজ় একটু বসুন। এই তো এলেন। বেশি ক্ষণ আপনাকে বসিয়ে রাখব না।”
মল্লার আবার চেয়ারে বসে পড়ল।
“এ বার আপনার পছন্দের একটা গান
বাজিয়ে শোনান।”
“আমার পছন্দের?”
“হ্যাঁ।”
কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে মল্লার রিডে আঙুল চালাল, “আজ মনে হয় এই নিরালায় একা একা ছন্দের গান শুনি।”
চিরশ্রী একমনে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে লাবণ্য উপচে পড়ছে, মায়ামেদুর তার দু’টি চোখ, গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট। এমন নারীর দিকে কি না তাকিয়ে থাকা যায়? মল্লার এক বার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল, তালে ভুল হয়ে গেল তার।
“থামালেন যে!”
“ভুল বাজানো হয়ে গেল। আবার প্রথম
থেকে ধরছি।”
“আপনারও তা হলে ভুল হয়।”
মল্লার বলল, “সারা জীবনটাই তো ভুলে ভরা। সে জন্যই এই চৌত্রিশেও বেকার।”
“কে বলল আপনি বেকার? চাকরি না করলেও নিজস্ব রোজগার তো আছে। ও রকম ভাবেন
কেন? হয়তো ঈশ্বর এই পথেই আপনার উন্নতি লিখে রেখেছেন।”
মল্লার বলল, “ঈশ্বর আগে হয়তো ও সব পারতেন। এখন পপুলেশন বেড়ে গেছে, এত কোটি মানুষের দায়দায়িত্ব রাখার সময় পাচ্ছেন না। এনার্জি কমে গেছে, নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তাই মনের দুঃখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন থেকেই দুনিয়াটা হাড়বজ্জাতদের দখলে চলে গেছে।”
চিরশ্রীর গালে আলতো হাসি, বলল, “বেশ তো কথা বলেন। এত কাল গম্ভীর হয়ে থাকতেন, দেখে বিরক্ত লাগত।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ, সুরের গুরু রোবট হলে ভাল লাগে না।”
গানটা মন দিয়ে বাজিয়ে মল্লার জিজ্ঞেস করল, “ভাল লাগল?”
“আপনার বাজানো কখনও খারাপ হতে পারে? এক দিন দেখবেন, শেখার জন্য আপনার বাড়ির দরজায় লাইন পড়ে যাবে।”
“আপনার মুখে মোগলাই-বিরিয়ানি পড়ুক,” মল্লার হালকা চালে বলল, “গানটা কার জানেন? শুনেছেন আগে?”
“পুরনো দিনের গান, স্বর্ণযুগের গান প্রায় সবই আমার শোনা। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গান। আমাকে আন্ডারএস্টিমেট করবেন না।”
“তা কেন করব?” লজ্জিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় মল্লার, “এখন তা হলে আসি?”
“হ্যাঁ, আসুন। আটকে রাখার ক্ষমতা তো আমার নেই,” চিরশ্রী উদাস ভঙ্গিতে বলল, “আচ্ছা, জীবনে ওই গানটার মতো মধুর মুহূর্ত কেন আসে না?”
মল্লার চটি পরে নিয়ে বলল, “প্রমিতদাকে জিজ্ঞেস করুন।”
“করে দেখব। আপনার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর আর কনট্যাক্ট নম্বর কি এক?”
“হ্যাঁ। কেন বলুন তো?”
“এমনিই,” চিরশ্রী হাসিমুখে বলল।
ক্রমশ