ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৯
Bengali Story

দৈবাদিষ্ট

সিংহ যখন ক্রুদ্ধ হয়, তখন ত্রিভুবনে কারও আর্তিতে সে কর্ণপাত করে না। রুক্মীর বিনাশ নিশ্চিত ছিল। কিন্তু রুক্মিণী অঝোর ধারায় ক্রন্দন করছিলেন, সঙ্গে আকুল মিনতি।

Advertisement

সৌরভ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:২৬
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

পূর্বানুবৃত্তি: কুরুকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ। তাই দ্রোণাচার্যও চাইলেন তাঁর ঈপ্সিত গুরুদক্ষিণা— বন্দি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ। এর পিছনে আছে বাল্যবন্ধুর কাছে অপমানিত হওয়ার ইতিহাস। বাল্যকালে দ্রুপদ দ্রোণের বন্ধু ছিলেন। তাঁকে অর্ধেক রাজ্যদানের কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু পূর্ণবয়স্ক দরিদ্র দ্রোণ যখন রাজা দ্রুপদের কাছে গিয়ে বন্ধুত্বের দাবি করেন, দ্রুপদ সভাস্থলে দ্রোণকে তীব্র কটুকাটব্য করেন। তার পর থেকেই নীরবে প্রতিশোধের অপেক্ষায় দিন গুনেছেন দ্রোণ।

Advertisement

অনেক ক্ষণ নীরবে কৃষ্ণের সারথ্য পর্যবেক্ষণ করলেন রুক্মিণী। বলশালী বাহু দুটির পেশি স্ফীত, দৃঢ় মুষ্টিতে অশ্বের বল্গা ও চাবুক। শ্যাম দেহটি ঘর্মাক্ত, আনন ধূলিধূসরিত। কেশদাম বিস্রস্ত। স্থানে স্থানে বর্ম ছিন্ন, সামান্য কয়েকটি ক্ষতচিহ্ন থেকে রুধির নির্গত হচ্ছে।

রুক্মিণী ক্ষত্রিয়দুহিতা, রক্ত দেখে ভীত হন না। বিশেষত, কৃষ্ণের রথে আরোহণ করার সময়েই জানতেন, রক্তনদী অতিক্রম করেই তাঁকে শ্বশুরালয়ে পৌঁছতে হবে, অবাধে ও বিনা-সংঘর্ষে বিদর্ভ থেকে দ্বারকা পর্যন্ত চলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যুদ্ধ অবধারিত ছিল, একাধিক বার, একাধিক শত্রুর সঙ্গে— হয়েছেও। বরং, অদ্ভুতকর্মা কৃষ্ণ আঘাত পেয়েছেন সে তুলনায় অতি অল্পই।অন্য যে কোনও যোদ্ধা— রথে অবস্থিতা প্রণয়িনীকে সামলে, নিজেকে আঘাত থেকে বাঁচিয়ে, একক প্রত্যাক্রমণের মাধ্যমে দুর্ধর্ষ অরাতিদের পর্যুদস্ত করতে পারতেন না। আজ রুক্মিণী চমৎকৃত হয়েছেন বারংবার।

Advertisement

বস্তুত, বিদর্ভ-কন্যার রীতিমতো আশঙ্কা ছিল— তাঁদের এই দুঃসাহসিক পরিকল্পনা আদৌ সফল হবে কি না! এক দিকে কৃষ্ণ একা, অন্য দিকে রুক্মিণীর পিতৃকুল এবং পিতৃবন্ধুদের প্রবল সমাবেশ! শত্রুপুরীতে সেই সমবেত শক্তি ঘিরে রেখেছে দয়িতাকে, এমতাবস্থায় অকুস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে স্বগৃহে নিয়ে গিয়ে তুলবেন— এমন অঘটন-ঘটন-পারঙ্গম প্রেমিক কি হতে পারবেন বাসুদেব? বিশেষত সেই শত্রুশক্তির এক-একটি নাম শুনলেই আর্যাবর্তের যে কোনও প্রতিস্পর্ধীর হৃৎকম্প হওয়ার কথা!

বিদর্ভরাজ মহাবলী ভীষ্মকের পুত্র বীরচূড়ামণি রুক্মী, মুখ্য পাণিপ্রার্থী চেদিরাজ শিশুপাল, মায়াযুদ্ধনিপুণ সৌভ-নরেশ শাল্ব, প্রতাপশালী পৌণ্ড্রক-নৃপতি...! এবং সর্বোপরি, অশেষপরাক্রান্ত মগধ-সম্রাট জরাসন্ধ! এঁদের শ্রেষ্ঠ সৈন্যদল এঁরা রাজধানীতে সুবিন্যস্ত রেখেছিলেন যাদব-বাহিনী তথা কৃষ্ণকে বাধা দেওয়ার জন্য। বিনা নিমন্ত্রণেই যে কৃষ্ণ কুণ্ডিনানগরীতে আসছেন— এবং তাঁর অভিপ্রায় যে রুক্মিণীকে সভা থেকে বলপূর্বক হরণ— সেই তথ্য চরমুখে পূর্বাহ্ণেই জেনে গিয়েছিলেন স্বয়ংবরে আগত মিত্ররাজারা। যাদব বাসুদেব তাঁদের সকলেরই সাধারণ বৈরী; তাঁরা রীতিমতো রক্তপিপাসু শ্বাপদের মতো উদ্যতকৃপাণ হয়ে অপেক্ষা করছিলেন, সভাতেই হরণোদ্যত কৃষ্ণকে সমবেত আক্রমণে বিনাশ করবেন বলে।

রুক্মিণীর নিজস্ব দাসীরা গুপ্তচরের চেয়েও তথ্য-আহরণ-নিপুণা। বিশেষত, শিশুপালের চেয়ে কৃষ্ণকেই তারা অধিক পছন্দ করেছিল রাজকন্যার ভাবী পতি হিসেবে। সহোদরার স্বামী-নির্বাচন বিষয়ে রাজকুমার রুক্মীর স্বৈরাচারী মনোভাব তারা সমর্থন করতে পারেনি। সহানুভূতিশীল ছিল তারা রুক্মিণীর প্রতি, তাদের মুখ থেকে গূঢ় সংবাদ মিলছিল। কৃষ্ণের আগমন-সংবাদ ও তৎপরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলি। পিতা ভীষ্মকের দ্বিধা-সঙ্কট, ভ্রাতা রুক্মীর গর্জন, লুব্ধ শিশুপালের আস্ফালন! সবচেয়ে উদ্বেগজনক ছিল এই গোষ্ঠীর নেতা সম্রাট জরাসন্ধের ক্রিয়াকলাপ। তিনি অপেক্ষাকৃত নীরবেই পূর্বশত্রু কৃষ্ণকে বিপন্ন করার বহুতর কৌশল অবলম্বন করে চলেছিলেন। ধুরন্ধর যোদ্ধা ও সেনানায়ক মগধপতি, একমাত্র তিনিই অনুমান করেছিলেন— যুদ্ধ এড়িয়ে ছলে বা কৌশলে কৃষ্ণ রুক্মিণীকে নিয়ে পলায়ন করতেও পারেন। সেই মতো সভাগৃহের অন্দরে-বাহিরে তাঁর দক্ষতম যোদ্ধাদের সন্নিবিষ্ট রাখার আয়োজন ছিল জরাসন্ধের; তা ছাড়াও, নিজের বিশাল সেনাবাহিনী থেকে সুনির্বাচিত কয়েকটি ক্ষুদ্র দলকে তিনি কৃষ্ণের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনপথের কয়েকটি বিন্দুতে স্থাপন করে রেখেছিলেন সন্তর্পণে। কিন্তু রুক্মিণীর দাসীরা পরামর্শসভার গোপন আলোচনার নির্যাস সংগ্রহ করে নিত ঠিক। পৌঁছে দিত রাজকন্যার কানে।

সমবেত রাজন্যবর্গের সব অভিসন্ধি-ষড়যন্ত্র বিপর্যস্ত করে দিয়ে ক্ষুরবুদ্ধি কৃষ্ণ তাঁর কৌশল বিস্তার করেন অতঃপর। ইচ্ছা করেই তিনি আগে থেকে অন্য রকম রটনা করিয়েছিলেন, শত্রু-চরদের বিভ্রান্ত করতে। কিন্তু না, দ্বিপ্রাহরিক স্বয়ংবরসভায় নয়, তিনি রুক্মিণীকে রথে তুলে নিলেন প্রত্যুষে— গূঢ় পূর্বপরিকল্পনা মতো, যখন সদ্যস্নাতা রাজকন্যা সখি-সমভিব্যাহারে দেবীমন্দিরে পূজা দিয়ে বেরোচ্ছেন। আমন্ত্রিত রাজারা অধিকাংশই তখন নিদ্রাগত, বাহিনী অসংগঠিত, রাজপুরী অপ্রস্তুত! হতচকিত সদ্যোত্থিত নগরবাসীর চোখের সামনে দিয়েই রাজকন্যা হৃতা হলেন, স্বেচ্ছা-হৃতাই বলা চলে— ফলে বাধা দেওয়ার সুযোগ মিলল না।

কিন্তু ধূর্ত জরাসন্ধের দ্বিতীয় কৌশল এ বার কাজে লাগতে শুরু করল। পথের বিভিন্ন বাঁকে মগধের সৈন্য পলায়নপর রথটির গতিরোধ করছিল বার বার। তাদের বিমুখ করা এমন কিছু কঠিন নয় বাসুদেবের কাছে, কিন্তু সময় নষ্ট হচ্ছিল। বিদর্ভ থেকে বৃহত্তর চমূ নিয়ে রথী-মহারথীরা পশ্চাদ্ধাবন করে আসছেন, এ বিষয়ে সন্দেহ ছিল না। সুতরাং পথে প্রান্তরে গিরিসঙ্কটে জরাসন্ধের সৈন্যদের সঙ্গে ছোট ছোট যুদ্ধগুলি কৃষ্ণের পক্ষে যথেষ্ট হানিকর হয়ে উঠছিল।

অবশ্য কৃষ্ণও সৈন্যাপত্যের কূটকৌশলে অদ্বিতীয়। প্রতিপক্ষের ভাবনাকে মায়াবীর মতো অনুধাবন করে নেন, এবং তার এক স্তর উপর দিয়ে নিজের পরিকল্পনা স্থাপন করে রাখেন— এ তাঁর চিরকালের বৈশিষ্ট্য। জরাসন্ধের সম্ভাব্য কৌশলের উপযুক্ত প্রতিষেধক-ব্যবস্থা না করে তিনি এই দুঃসাহসিক কর্মে নামেননি। তিনিও নির্বাচিত কিছু যাদবসেনাকে পথের বিভিন্ন উপযোগী ক্ষেত্রে সংস্থাপিত রেখেছেন, নিজের রক্ষার্থে নয়— তাঁর পিছনে ধেয়ে-আসা শত্রুদের পথরোধের দায়িত্ব দিয়ে। বিদর্ভের মূল নিষ্ক্রমণপথে শত্রুদের বাধা দেবেন স্বয়ং বলরাম। তাঁর প্রবল বিক্রম এড়িয়ে যদি কোনও রথী রাজকন্যা-অপহারকের পশ্চাদ্ধাবন করেও— পথের বিভিন্ন সঙ্কট-স্থানে সংস্থাপিত যাদব যোদ্ধাদের মুখোমুখি তাকে হতেই হবে।কোন পক্ষের রোধ-প্রয়াস কতটা কার্যকর হয়, তার উপর অভিযানের সাফল্য-ব্যর্থতা অনেকটা নির্ভর করে ছিল।

কিন্তু কৃষ্ণ এও জানতেন, দু’-পক্ষের এই রোধ-প্রতিরোধের অক্ষক্রীড়ায় আনুপাতিক ভাবে তাঁর পরিস্থিতিই অধিকতর দুর্বল। বিদর্ভ থেকে যে সমবেত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ মহাশক্তি ধূলা উড়িয়ে ছুটে আসছে, তাদের সবাইকেই বেশি ক্ষণ আটকে রাখা মুষ্টিমেয় যাদব-দলগুলির পক্ষে সম্ভব হবে না। অপর পক্ষে জরাসন্ধের সেনাদের বারবার বিদ্রাবিত করতে একাকী কৃষ্ণের সময় লাগছে অনেক বেশি। সুতরাং, পথের কোনও এক জায়গায় তাঁর নাগাল ওরা পেয়ে যাবেই— এ এক প্রকার নিশ্চিত।

মূল আশঙ্কা ছিল একজনকে নিয়েই। রাজকুমার রুক্মী। একই সঙ্গে মহাবীর ও মহাকৌশলী। তাঁকে অধিক ক্ষণ রুখতে পারবে না হয়তো যাদব-গোষ্ঠীর প্রতিযোদ্ধারা!

বাসুদেবের আশঙ্কা ফলবতী হল অচিরেই। শিশুপাল শাল্ব পৌণ্ড্রক প্রমুখ পরাক্রমী রাজাদের রোধ করতে পেরেছিল যাদবরা, কিন্তু রুক্মী— কখনও রণদক্ষতায় কখনও কূটকৌশলে— ঠিক পিচ্ছিল মৎস্যের মতো সেই বাধা উল্লঙ্ঘন করে বেরিয়ে এসেছিলেন।

দ্রুতগামী একদল সেনা-সহ বায়ুগতি রথে রুক্মী অচিরেই ধরে ফেলেছিলেন কৃষ্ণের রথ। একেবারে মধ্যপথেই। তার পর শুরু হয় যুদ্ধ।

ভ্রাতা বনাম দয়িত— এই মর্মান্তিক সংগ্রাম, রথে আসীন অবস্থায় প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল রুক্মিণীকে। তেমন সংগ্রাম কোথাও কখনও হয়েছে কি? রুক্মিণী এই প্রথম ভীতা হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রাতার দুর্জয় শৌর্যের কথা জানতেন। কখনও কোনও যুদ্ধে পরাজিত হননি সর্বশস্ত্রবিদ মহারথ রুক্মী, আজও ভগ্নী-হরণকারী তস্করকে বিনষ্ট না-করে স্বরাজ্যে ফিরবেন না প্রতিজ্ঞা করেছেন। উপরন্তু, তিনি সসৈন্য। এ দিকে কৃষ্ণ একা। পথিমধ্যে বারংবার খণ্ডযুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়েছেন। তিনি কি হননেচ্ছু বিদর্ভ-কুমারের রোষাঘাত সহ্য করতে পারবেন? বিশেষত, রুক্মিণী শুনে এসেছেন বরাবর, এই যাদব-নায়ক বীরত্বের চেয়ে কূটবুদ্ধিতে অধিক পটু, যুদ্ধের চেয়ে যুদ্ধত্যাগে!

এবং... রুক্মিণী আজ স্বচক্ষে দেখলেন ‘রণছোড়’ বাসুদেবের রণমূর্তি!

রুদ্ধশ্বাস, নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন রুক্মিণী, তাঁর রথের সহ-আরোহীটির যুদ্ধকৌশল দেখে। শান্ত মৃদুভাষ সুহাস শ্যামবর্ণ এই তরুণ যে এত বিরল-কোটির ধনুর্ধর, এমন বিপুল তাঁর অস্ত্রনৈপুণ্য ও সমর-জ্ঞান— চোখের সামনে না দেখলে বিশ্বাস হত না। বিচিত্র আয়ুধসজ্জিত বিদর্ভ-সেনা তাঁর খরশরজালে কয়েক দণ্ডের মধ্যে বিপর্যস্ত হল, তার পর ঝঞ্ঝাতাড়িত শুষ্ক তৃণের মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তাদের সমাবেশ। অতঃপর শুরু হল রুক্মীর সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ দ্বৈরথ। প্রবল হুঙ্কার ও কটূক্তি-সহ ধাবিত হয়ে এলেন বলশালী রুক্মী, গর্বিত উদ্ধত রক্তপ শার্দূলের মতো। তাঁর সে সব কটুকাটব্য রুক্মিণীর অন্তরাত্মা পর্যন্ত দগ্ধ করছিল। কিন্তু তিনি দেখলেন, কৃষ্ণ একটি বাক্যব্যয় করলেন না। শুধু তাঁর আনন ক্রমশ প্রস্তরকঠিন হয়ে উঠতে লাগল, পেশিগুলি দৃঢ়তর। রুক্মীর মারাত্মক অস্ত্রগুলি নিবারণ করলেন, তাঁর সারথি রথাশ্ব নষ্ট করলেন, তার পর সবেগে নিজ রথ থেকে অবতরণ করে, মুক্ত কৃপাণ হাতে রুক্মীর একেবারে মুখোমুখি! পলকে দেখা গেল, কেবল একটি শরীরের মোচড়— তার পরেই অজেয় মহারথী রুক্মী ধরাশায়ী! তাঁর বুকের উপর জানু স্থাপিত করেছেন রণোন্মত্ত বৃষ্ণিসিংহ, বাম মুঠিতে ধৃত পদানত রুক্মীর কেশগুচ্ছ! এবং, দক্ষিণ হস্তের কৃপাণ ঝলসে উঠেছে রৌদ্রে!

সেই প্রথম রুক্মিণী দেখলেন বাসুদেবের চোখে সর্বগ্রাসী রোষবহ্নি! তাঁর চাপা গর্জন শোনাচ্ছিল অবিকল সিংহেরই মতো, আঘাতে উদ্যত তাঁর হাতটিকে মনে হচ্ছিল লৌহনির্মিত, রক্তলিপ্ত ধুলিধূসর দেহখানি ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। মহানাগের মতো তীব্রশ্বসমান, বিস্ফারিত নাসাপুট, দন্তঘর্ষে কঠিন চিবুক— তাঁর ক্রোধদীপ্ত আননটি অচেনা মনে হচ্ছিল রুক্মিণীর।

রুক্মিণী মুহূর্ত বিলম্ব না করে রথ থেকে নেমে দৌড়ে গিয়েছিলেন। হননোদ্যত বাসুদেবের পা ধরে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন সহোদরের। কৃষ্ণ রক্তচক্ষুতে ফিরে তাকিয়ে সরোষে বলেছিলেন, “না!”

সিংহ যখন ক্রুদ্ধ হয়, তখন ত্রিভুবনে কারও আর্তিতে সে কর্ণপাত করে না। রুক্মীর বিনাশ নিশ্চিত ছিল। কিন্তু রুক্মিণী অঝোর ধারায় ক্রন্দন করছিলেন, সঙ্গে আকুল মিনতি। পতিগৃহে যাচ্ছেন তিনি, এই আনন্দলগ্নে দয়িতের হাতে ভ্রাতার নিধন— এত বড় অশুভ তিনি সহ্য করতে পারবেন না।

রুক্মিণী একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন কৃষ্ণের মুখটির দিকে, তাই সে মুখের তীব্র-কঠিন-শাণিত রেখাগুলি যখন ধীরে ধীরে সহজ হতে লাগল— সেটিও তিনি দেখলেন। প্রবল চেষ্টায় নিজেকে সংবরণ করলেন কৃষ্ণ। নিজের ইন্দ্রিয়গুলির উপর অসামান্য নিয়ন্ত্রণ তাঁর। উদ্যত অস্ত্র নামিয়ে নিলেন। তার পর গম্ভীর স্বরে বললেন, “প্রাণভিক্ষা দিলাম। কিন্তু প্রাণটুকুই; মান নয়। যে অপরাধ এ ব্যক্তি করেছে, তাঁর শাস্তিবিধান অবশ্যকর্তব্য! এ অস্ত্রের অভিমুখ কণ্ঠের দিকে ছিল, তাকে সামান্য পরিবর্তন করে দিই...!” এই বলে, পদানত রুক্মীর কেশ-কর্তন করে দিলেন ওই অস্ত্র দিয়েই!

কেশ-কর্তন ক্ষত্রিয়ের পক্ষে চূড়ান্ত অপমান। “এর চেয়ে নিধন ভাল ছিল!” বলে লজ্জিত হতমান রুক্মী সৈন্যদল নিয়ে ফিরে গেলেন।

কৃষ্ণ আবার রথ ছুটিয়েছিলেন দ্বারকার দিকে।

পথে আর কোনও বিঘ্ন ঘটেনি তার পর। সমুদ্রতীরবর্তী রৈবতকের পার্বত্য প্রদেশে প্রবেশ করেছে রথ। এখন অপরাহ্ণ অবসিতপ্রায়, দ্বারকার গিরিদুর্গের কৃষ্ণচ্ছায়া দেখা যাচ্ছে দূরে, রক্তসূর্যের প্রেক্ষাপটে।

রুক্মিণী মৃদুস্বরে বললেন, “আর সম্ভবত কোনও বিপদ নেই, তাই না আর্য?”

“নিশ্চিত করে বলা যায় না, সুপ্রিয়া,” কৃষ্ণ চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টিপাত করতে করতে অনুচ্চকণ্ঠেই বললেন, “জরাসন্ধ অতি ধূর্ত। হয়তো ইচ্ছাকৃত ভাবেই সে তার শেষতম দু’টি সৈন্যদল-স্থাপনের ব্যবধান অনেকটা বেশি রেখেছে। যাতে আমরা নিজেদের বিপন্মুক্ত মনে করি। শত্রুকে নিশ্চিন্ত হওয়ার অবকাশ দেওয়া একটা ইচ্ছাকৃত কৌশল, রুক্মিণী— অতি প্রাচীন রণনীতি। বিশেষত, যখন আমরা দ্বারাবতী-দুর্গের খুব কাছে এসে পড়ব, তখন স্বাভাবিক ভাবেই গৃহসন্নিকটে উপনীত হওয়ার আনন্দ ও নিশ্চিন্ত ভাব যুগপৎ আমাদের স্নায়ুগুলিকে শিথিল করে দেবে, অসতর্কতা গ্রাস করবে আমাদের। তদুপরি সূর্যালোকও অনেকটা ক্ষীণ, এই পার্বত্য প্রদেশে অতর্কিত আক্রমণের পক্ষে এটিই প্রশস্ততম সময়— এ সব কি জরাসন্ধের মতো চতুর রণপণ্ডিত না ভেবে রেখেছে?”

কাকতালীয়? কৃষ্ণের বাক্য শেষ হতে না হতেই নিকটবর্তী এক পাথুরে টিলার পিছন থেকে অতর্কিতে রে-রে শব্দে লম্ফ দিয়ে পড়ল এক দল সশস্ত্র আততায়ী!

৩২

দেখে সুশিক্ষিত সেনা মনে হয় না। সম্ভবত অসভ্য আরণ্য জাতির লোক, হাতে তির ধনুক কুঠার মুষল লগুড় ভল্ল, নেতৃত্বে এক ধনুর্ধারী।

কিন্তু কৃষ্ণ জানেন, এরা মগধরাজেরই প্রেরিত বাহিনী। জরাসন্ধের সৈন্যদলে বনচর সম্প্রদায়ের যোদ্ধারাও অনেক থাকে, আগেও দেখা গিয়েছে। রাজ-অনুগত উপজাতি, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হলেও জিঘাংসু; যুদ্ধকালে বাহিনীর দলবৃদ্ধি করে মূলত, আর কোলাহল-বিশৃঙ্খলা-রক্তপাত বাড়িয়ে শত্রুকে বিভ্রান্ত করে।

সম্ভবত এই শেষ দলটিকে একেবারে গিরিনগর দ্বারকার দ্বারপ্রান্তসন্নিকটেই অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া ছিল। অন্তিম দংশন! কৃষ্ণ ঠিক যেমন অনুমান করছিলেন, হুবহু তেমনই পরিকল্পনা রেখেছিলেন মগধরাজ! আধো-অন্ধকারের মধ্যে রৈবতকের গিরি-অন্তরাল থেকে চকিতে আত্মপ্রকাশ করবে সশস্ত্র শত্রুদল। অসতর্ক, পথক্লান্ত এবং বিমূঢ় লক্ষ্যবস্তুকে সহজেই নিপাতিত করতে পারবে। তা-ই ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা।

কিন্তু প্রতিপক্ষের মস্তিষ্ক সম্পর্কে তাদের অবধান ছিল না, প্রতিপক্ষের সামর্থ্য সম্পর্কেও। কৃষ্ণ একেবারেই অসতর্ক ছিলেন না। পূর্ণ প্রস্তুতি ছিল তাঁর মননে। ফলে, স্বল্পসংখ্যক উপজাতীয় শস্ত্রধারীকে হত, আহত বা বিতাড়িত করতে তিনি খুবই কম সময় নিলেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement