ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৭
Bengali Story

দৈবাদিষ্ট

খুব ধীরে ধীরে দু’দিকে মাথা নাড়ে নিষাদ। এখন হতাশায় মলিন তার বদন। বস্তুত, জোর করেই সে মুখে কৃত্রিম হাসি ধরে রেখে রাজ-সকাশে এসেছিল আজ। অনেক আগেই সে জেনে ফেলেছে তার ভাগ্য, এই সুদীর্ঘ কাল অরণ্যাভ্যন্তরে অস্ত্র-অনুশীলন করতে করতেই!

Advertisement

সৌরভ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:৫১
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

পূর্বানুবৃত্তি: অস্ত্রবিদ্যার প্রদর্শনীতে অর্জুনের সমকক্ষ যে ধনুর্ধরের অমিত তেজ দেখে সকলে বিস্মিত হয়, তিনি অধিরথপুত্র বসুষেণ। তখনই রাজমাতা কুন্তী অসুস্থ হয়ে পড়েন। মহামন্ত্রী বিদুরের মনে পড়ে যায় প্রায় আড়াই দশক আগের ঘটনা। তখন দৈবকৃপার ছলের আড়ালে বিদুরের সাহায্যে নিয়োগপ্রথায় যুধিষ্ঠিরের জন্ম দেন কুন্তী। এবং আরও অন্য অন্য পুরুষদের সহায়তায় পরবর্তী সন্তানদের। সে তথ্যের অনুসরণেই বসুষেণের জন্মরহস্য অনুমান করেন বিদুর। তাঁর স্পষ্ট ইঙ্গিতে বিবর্ণ হয়ে যান কুন্তী।

Advertisement

বিদুর আবার ঈষৎ তিক্ত-শীতল স্বরে বললেন, “আপনি বার বার বলেন, আর্যা— ধর্ম আপনার প্রথম সন্তানের পিতা! অথচ আপনি নিজে জানেন, সে কথা সত্য নয়! তবু কেন বলেন?”

Advertisement

“সত্য নয়...!” যেন শরীর-মনের সব শক্তি সংহত করে এনে কোনও ক্রমে দু’টিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেন পৃথা।

“না! সত্য নয়!” এই প্রথম বিদুরের কণ্ঠ উত্তেজনায় ক্ষোভে কেঁপে উঠল সামান্য, “সত্য-যে নয়, সে আমি ত্রয়োবিংশতি বর্ষ আগেই জেনেছিলাম— শতশৃঙ্গের সেই প্রথম রজনীতেই! স্পষ্ট ছিল লক্ষণসমূহ! যৌনক্ষীণতার রোগী পাণ্ডু না-বুঝতে পারুক— সক্ষম পুরুষমাত্রেই অনুধাবন করতে পারবে, যে নারীতে সে এখন গমন করছে সে ইতিপূর্বে গর্ভে সন্তান ধরেছে কি না! সে অঙ্গচিহ্ন অমোঘ, তাকে গোপন করে এমন সাধ্য মরজগতে কোনও নারীর নেই!”

পৃথা দুই তালু দিয়ে মুখ ঢাকলেন। বিদুর অপাঙ্গে এক বার তাঁর দিকে দৃষ্টিপাত করে অনুচ্চকণ্ঠে বললেন, “পৃথা! সূর্য-কুণ্ডল-ধারী বসুষেণ... সে কি আসলে মহাতেজা ঋষি দুর্বাসারই আশীর্বাদ? কুমারী-বয়সে নির্জন গৃহে দীর্ঘকাল আপনি সেই মহর্ষির সেবা করেছিলেন বলে আমি অনুসন্ধানে জেনেছি! ‘সূর্যপুত্র’— এই রটনার গভীরে কোন সত্য লুক্কায়িত, কিছু জানেন আপনি? মহাত্মা ব্যাস এ বিষয়ে কী বলবেন, তাঁর ভারত-ইতিবৃত্তে?”

অনেক দিন পর বিদুর তাঁর প্রিয় নারীকে নাম ধরে ডাকলেন। কিন্তু হায়, এই কি সঠিক প্রসঙ্গ? এই কি সে উপযুক্ত ক্ষণ?

২৮

“পূর্বের মতো ক্ষিপ্রতা এসেছে অঙ্গুলিতে? উত্তর দিচ্ছ না যে! প্রতিপক্ষের পলক পড়ার আগে যে ভাবে দশ বাণ জ্যামুক্ত করতে পারতে...” জরাসন্ধ সাগ্রহে জানতে চান।

ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে ফেলে একলব্য। সে নিরুত্তর এখনও।

ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললেন জরাসন্ধ। গম্ভীর শুষ্ককণ্ঠে বলেন, “হয়নি? অনুশীলন করেও... তত দূর সিদ্ধ হয়নি অভিপ্রায়?”

খুব ধীরে ধীরে দু’দিকে মাথা নাড়ে নিষাদ। এখন হতাশায় মলিন তার বদন। বস্তুত, জোর করেই সে মুখে কৃত্রিম হাসি ধরে রেখে রাজ-সকাশে এসেছিল আজ। অনেক আগেই সে জেনে ফেলেছে তার ভাগ্য, এই সুদীর্ঘ কাল অরণ্যাভ্যন্তরে অস্ত্র-অনুশীলন করতে করতেই!

অঙ্গ-প্রতিস্থাপনের কর্মটি বিস্ময়কর ভাবে সফল করে তুলেছেন বৈদ্যরা, নিঃসন্দেহে। শিরা-স্নায়ু-অস্থিসন্ধি জুড়েছেন নিপুণ ভাবে। ক্ষত নিরাময় হয়েছে, অঙ্গুলি-সঞ্চালনেও সমস্যা নেই, দেখতেও একেবারে স্বাভাবিকেরই মতো। কিন্তু হায়! এ অঙ্গুলি তো তার সেই নিজেরটি নয়— অন্যের! ঋণ-নেওয়া ধন! সংযুক্ত অঙ্গে সেই ইন্দ্রজাল কোথায় পাবে একলব্য— যা জন্মগত ভাবে তার নিজের আঙুলে ছিল? সেই সহজাত বিরল সামর্থ্যই ছিল তার উপর প্রকৃতির আশীর্বাদ, যা তাকে অনন্য করেছিল, সেই সবল ক্ষিপ্র বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ! অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে নিষ্ঠুর অভিসন্ধিপরায়ণ ছলনাময় ব্রাহ্মণের পায়ে সে সমর্পণ করে এসেছে সেই অতুল ঐশ্বর্য— এখন বুঝতে পারছে, সেই ক্ষতি অপূরণীয়, আত্মহননেরই সমতুল্য!

“মহারাজ, আগের সেই ক্ষমতা আর ফিরে পাওয়া যাবে না, এ আমি বুঝতে পেরেছি। যতই অভ্যাস হোক। এই নতুন আঙুলে আগের জাদু ফিরবে না। হ্যাঁ, কাটা আঙুল বলে চেনা যাবে না, সাধারণ কাজকর্ম চালিয়ে নেওয়া যথেষ্ট ভাল ভাবেই, সাধারণ তির ছোড়ার কাজও। কিন্তু রাজন্‌, সেই বিদ্যুতের মতো লঘু-হাতের তিরন্দাজ একলব্য— যাকে নিয়ে আপনার অনেক আশা ছিল—তার মরণই ঘটেছে।”

“তা হলে... এত পরিশ্রম বৃথা?”

“শুধু ‘আঙুল-কাটা একলব্য’ বলে তাকে আর কেউ উপহাস করতে পারবে না, মহারাজ, এইটুকু লাভ,” যেন অসহ বেদনা অতিক্রম করে করুণ হাসল নিষাদ, “তির সে এখনও লক্ষ্যে লাগাতে পারে, তার মস্তিষ্ক তো মরেনি, তার দৃষ্টি তো ক্ষয়ে যায়নি। এখনও যে কোনও সাধারণ যোদ্ধাকে সে সামনাসামনি হারাতে পারে। কিন্তু সেও নিজেই এখন... প্রায় ওই সাধারণের দলেই। আর কোনও বিস্ময় নেই তাকে ঘিরে। আগে সে ব্যতিক্রম ছিল; এখন, স্বাভাবিক মাত্র।”

জরাসন্ধের মুখ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠল। স্বরেও জলদগাম্ভীর্য। ক্রুদ্ধ ভাবে পদচারণা করলেন কক্ষের মধ্যে কয়েক পাক। তার পর একলব্যের একেবারে সামনে এসে, দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করে বললেন, “ও দিকে হস্তিনায় অর্জুনের শিক্ষা সমাপ্ত, তাকে ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর ঘোষিত করা হয়ে গিয়েছে প্রকাশ্যে! আর তুমি... ধিক! নিজের নির্বুদ্ধিতার ফল ভোগ করছ, অর্বাচীন। প্রতিশোধ নিতেও ইচ্ছা করে না তোমার? যে তোমাকে এই ভাবে...”

একলব্য স্থির চোখে তাকাল। দৃষ্টি বদলে গিয়েছে তার। যেন বাক্‌ভঙ্গিও, শব্দচয়নও!

ধীরে ধীরে সে বলল, “গুরুদক্ষিণা মেটানো হয়ে গিয়েছে। এখন আর কোনও ঋণ নেই। এখন গণিত সমান-সমান। এখন শুধু প্রতিশোধের জন্যই জীবন ধরে আছি, রাজন্‌!”

“কী ভাবে নেবে হে, প্রতিশোধ? তোমার ধনুর্বিদ্যাটি তো শেষ করে দিয়েছে কপট ব্রাহ্মণ! মুখোমুখি হলে তুমি তো দাঁড়াতেই পারবে না!”

“জানি মহারাজ। তাই আমি অন্য অস্ত্র নিয়ে অভ্যেস শুরু করে দিয়েছি!”

কটি থেকে শাণিত আয়ুধটি খুলে হাতে নেয় একলব্য। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়েছে তার। হিমশীতল কণ্ঠে বলে, “এই আমার নতুন সাধনা! এতে বুড়ো-আঙুল আর কোনও সমস্যা তৈরি করবে না... সূক্ষ্ম শিল্প আর প্রয়োজন নেই, শুধু হাতের জোর, কাঁধের জোর... আর অস্ত্র ঘোরানোর কৌশল!”

“খড়্গ!”

“হ্যাঁ, রাজন্‌! আচার্য দ্রোণই তাঁর শিষ্যদের বলতেন, আমি দূর থেকে শুনেছি— তির-ধনুকের পরেই যে শস্ত্র শ্রেষ্ঠ, তা হল এই খড়্গ বা অসি! আরও শুনেছি, জগৎস্রষ্টা ব্রহ্মা নাকি নিজে দুষ্টের শাস্তি দেওয়ার জন্য যজ্ঞ করেছিলেন, সেই আগুন থেকে ধারালো-দাঁত সরু-পেট-বিশিষ্ট খুব লম্বা আর কালো এক পুরুষ উঠে আসেন— ব্রহ্মা তাঁকেই ‘অসি’ নাম দিয়ে অস্ত্রের রূপ দিয়ে দেন! এ হল সেই বস্তু! আমি একে আয়ত্ত করেছি নিজের চেষ্টায় আর সাধনায়!”

জরাসন্ধ চুপ করে থাকেন কিছু ক্ষণ। একটি শ্বাস চাপেন। তার পর বলেন, “আমি জানি, এই নতুন আয়ুধেও তুমি অজেয় হবে। অসীম প্রতিভা তোমার। কিন্তু... এই খড়্গের সম্মুখে দ্রোণকে পেতে হলে তো সম্মুখযুদ্ধের প্রয়োজন! তুমি নিশ্চয় তস্করের মতো গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা করছ না!”

“না! একলব্য চোর নয়! যুদ্ধ করলে যোদ্ধার মতোই করবে সে!”

“কিন্তু তেমন যুদ্ধের সুযোগ পাবে কোথায় তুমি? হস্তিনার আশ্রিত দ্রোণ, তার প্রতিপক্ষ হওয়ার সুযোগ মেলাও তো কঠিন বড়!”

চিবুক কঠিন হয় নিষাদের। চক্ষু অতর্কিতে জ্বলে ওঠে বাততাড়িত রক্ত-অঙ্গারের মতো।

“এখন থেকে এই বিশ্বের যে প্রান্তেই আচার্য দ্রোণ যে কোনও পক্ষের হয়েই যুদ্ধে জড়িত থাকুন না কেন— একলব্য খুঁজে খুঁজে তাঁর শত্রুশিবিরে যোগ দেবে ঠিক। দরকার হলে সাধারণ সৈনিক হয়েই তাঁর বিপক্ষে নামবে।”

“অবতীর্ণ না-হয় হলে! তার পর? সর্বাস্ত্রবিদ দ্রোণ প্রায় অপরাজেয়, শোনা যায়!”

“তার পর, এই অসি— এ কথা বলবে! আপনার সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রতিজ্ঞা করলাম মহারাজ, দ্রোণের মাথা ধড় থেকে ছিন্ন না করে আমি মরব না! আজ থেকে আমার জীবনধারণের এই একমাত্র সাধনা হয়ে রইল।”

জরাসন্ধ স্থিরদৃষ্টিতে দেখছিলেন। যে তীব্র আবেগ তরুণ ধানুকীকে নির্দ্বিধায় নিজ অঙ্গুলি গুরু-পদে দান করতে তাড়িত করেছিল— সেই আবেগেরই এক বিপ্রতীপ রূপ, আজ জ্বলন্ত প্রতিবিধিৎসা হয়ে নিরন্তর দগ্ধ করছে তাকে! শ্রদ্ধা-প্রেম-উৎসর্গের চেতনা যখন নিষ্ঠুর প্রতারণার শিকার হয়, তখন সেই চিতাবহ্নি থেকেই জেগে ওঠে প্রেত— যার নাম ঘৃণা! তার মুষ্টিতে জিঘাংসা-খড়্গ, তার স্কন্ধের তূণীরে শপথ-বাণ, তার আকণ্ঠ প্রতিশোধ-পিপাসা! সেই তৃষ্ণা-নিবৃত্তির জন্য সে করতে পারে না এমন কর্ম বিশ্বে নেই।

এগিয়ে এসে একলব্যের স্কন্ধে হাত রাখলেন মগধেশ। বললেন, “তোমার সাধনা চরিতার্থ হোক! আপাতত তোমার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযান আমি নির্ধারিত করেছি। শীঘ্রই বিদর্ভ রাজ্যের দিকে যাত্রা করবে আমার নির্বাচিত সেনানীর কয়েকটি সংগঠন। কুণ্ডিনা-নগরে স্বয়ংবর-সভাকে কেন্দ্র করে সেখানে ছোটখাটো কিছু যুদ্ধবিগ্রহের সম্ভাবনা আছে। তুমি তোমার নিজস্ব অনুচরদের নিয়ে সেই বাহিনীতে যোগ দাও, একটি ক্ষুদ্র দলের নায়ক হিসেবে তোমাকে উপযুক্ত কার্যে নিযুক্ত করব।”

“আপনি আমায় নবজীবন দিয়েছেন, আপনার আদেশ শিরোধার্য! কিন্তু...” একলব্য দ্বিধাগ্রস্ত হয়। বিনীত ভাবেই বলে, “সেখানে তো আচার্য দ্রোণের থাকার কোনও সম্ভাবনা নেই, মহারাজ! দ্রোণকে খড়্গের সমীপে পাওয়াই আমার জীবনের লক্ষ্য, যুদ্ধ করতে হলে আমি শুধু তাঁর বিপক্ষ-শিবিরেই... আপনি কুরুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন না, মহারাজ?”

জরাসন্ধ বাতায়ন দিয়ে এক বার ঘনায়মান সান্ধ্য অন্ধকারের দিকে তাকালেন। তার পর বললেন, “না। পরামর্শ শোনো। দ্রোণের সঙ্গে সংঘর্ষ কোনও বালক-ক্রীড়া নয় হে, শশক-শিকার কিংবা বরাহ-সন্ধানও নয়। অস্ত্রবিদ্যা তোমার বিপুল, কিন্তু যুদ্ধবিদ্যা অন্য বস্তু, তাতে প্রভূত অভিজ্ঞতা আবশ্যক। তোমার এখন কিছু প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অভ্যাস প্রয়োজন। আর, হ্যাঁ, আগামী সময়ে কোনও এক দিন হস্তিনার বিরুদ্ধে মগধ যুদ্ধঘোষণা করবেই নিশ্চিত, তখন সেই রণভূমিতে তোমার সুযোগ আসবে...”

“আমি সেই লগ্নটির জন্যই উন্মুখ হয়ে আছি মহারাজ!”

“কিন্তু তৎপূর্বে তুমি কিঞ্চিৎ আহব-স্বাদ নিতে থাকো, হে নবীন নিষাদ। আমার সেনার সঙ্গে তুমি বিভিন্ন অভিযানে অংশ নাও, অভ্যস্ত হতে থাকো, উপকৃত হবে। এই কুণ্ডিনা-যুদ্ধেই তুমি নিজেকে অভিজ্ঞ করে তোলার যথেষ্ট সুযোগ পাবে, একলব্য। এক পরাক্রান্ত বৈরীর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ! যদি তার উপরেই তোমার শাণিত খড়্গটির প্রয়োগ করতে পারো...”

“কোন লোকের কথা বলছেন, প্রভু?”

জরাসন্ধ অন্য দিকে তাকিয়ে ঈষৎ মুখ বিকৃত করে জবাব দিলেন, “এমন লোক, যাকে অন্য লোকেরা ঈশ্বর বলে!”

২৯

প্রথমে দু’টি মুখ, তাদের পশ্চাতে সারিবদ্ধ বাকিরা। দাঁড়িয়েছেও দু’টি ভাগে। যুধিষ্ঠিরের পিছনে চার জন, দুর্যোধনের পিছনে নিরানব্বই। এক দিকে পাঁচ, অন্য দিকে একশত।

নিকট জ্ঞাতি, এক পিতামহের উত্তরপুরুষ, তবু... সকলে একত্র সমাবদ্ধ হতে দাঁড়াতেই অনিচ্ছুক, এখনও। এত দীর্ঘ কাল সতীর্থ হয়ে এক গুরুকুলে শিক্ষাগ্রহণ করেও, অন্তিমে সেই বিভাজনটিরয়েই গেল! শুধু রয়ে গেল না, সম্ভবত তীব্রতর হয়েছে। সে দিনের রঙ্গভূমিতে শেষলগ্নের কুনাট্য সেই বৈরকে আরও তিক্তরসে ভরেছে, দ্রোণ অনুভব করেছেন। পুরাতন দ্বন্দ্বের পাশা-ছকে উপস্থিত হয়েছে নতুন এক অক্ষ— রাধেয় বসুষেণ! এ শত্রুতার অঙ্কুর আপাতত বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই, নিয়ত জলসেচনের মাধ্যমে মহীরুহের রূপ নেওয়াই এর ভবিতব্য।

তবে আজ দ্রোণ নিজের দিক থেকে সামান্যতম বিভাজন রাখতে চান না। আজ তাঁর গুরুদক্ষিণা নেওয়ার লগ্ন। কুরুকুমাররা সকলে প্রস্তুত, তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হয়ে সকলকেই সমান সুযোগ ও অবকাশ দেবেন দক্ষিণাপ্রদানের। আগেই আবেদন করেছেন তিনি, সকলে যেন এই যৌথ প্রয়াসের সমান অংশভাক্‌ হয়। এও বলেছেন, তিনি

কোনও ভোগ্যসম্পদের অর্থী নন। তাঁকে এনে দিতে হবে এক অন্য প্রার্থিত বস্তু, তার জন্য দুরূহ কোনও এক কর্ম সম্পাদন আবশ্যক হতে পারে। এতে রাজপুত্ররা বেশ উত্তেজিতও হয়েছে, উৎসুকও। মনে হয় না অন্তত এই কাজটিতে কোনও ক্লৈব্য বা ভেদ থাকবে শিষ্যদের।

যুধিষ্ঠিরের মুখের দিকে এক বার তাকালেন দ্রোণ, এক বার দুর্যোধনের দিকে। তার পর সমগ্র সমাবেশের উপর দ্রুত দৃষ্টি বুলিয়ে আনলেন। ভীমসেন আর অর্জুনের সঙ্গেও এক ঝলক চক্ষুমিলন হল। অতঃপর আচার্য বললেন, “তোমরা, সমস্ত ভ্রাতাই প্রস্তুত আছ? তা হলে গুরুদক্ষিণার কথা ঘোষণা করি?”

“করুন, গুরুদেব...”, “আজ্ঞা করুন আচার্য...,” সমবেত-স্বর রণিত হল। গর্জনই বলা চলে। এখন আর কিশোর নেই কেউ, প্রত্যেকেই ক্ষাত্রতেজোদৃপ্ত সশস্ত্র যোদ্ধা, যে কোনও অসাধ্য-সাধনেই অ-পরাঙ্মুখ।

দ্রোণ একটি শ্বাস নিলেন, এক বার চোয়াল কঠিন করলেন, চোখের পলক স্থির করলেন কয়েক লহমার জন্য। তার পর নিষ্কম্প শুষ্ক কণ্ঠে বললেন, “যাও, পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে বন্দি করে আমার সামনে আনো! মনে রাখবে, জীবিত ও বন্দি দ্রুপদ! এই আমার দক্ষিণা।”

‘বন্দি দ্রুপদ’! আহ্‌! শব্দবন্ধটি নিজের ওষ্ঠ থেকে কর্ণ পর্যন্ত পৌঁছতেই দ্রোণের সর্বাঙ্গে যেন এক শিহরন খেলে গেল।

বন্দি দ্রুপদ। দ্রুপদ... বন্দি! এই কথাটি মানসচক্ষে যে ছবি ফুটিয়ে তোলে, সেটি বাস্তবায়িত হতে দেখবেন বলে আজ কত বৎসর বিনিদ্র রাত যাপন করছেন দরিদ্র ব্রাহ্মণ দ্রোণ! প্রবল প্রতাপী পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ, শৃঙ্খলাবদ্ধ, নতজানু— দ্রোণের সামনে...

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement