ছবি: রৌদ্র মিত্র।
পূর্বানুবৃত্তি: বাসুদেব কৃষ্ণের প্রেরিত গূঢ়পুরুষ জম্বুক একলব্যের বর্তমান অবস্থিতির সন্ধান না পেলেও, তার জন্মপরিচয় সম্বন্ধে কিছু সূত্র সংগ্রহ করে আনে। সে সব নির্দিষ্টক্রমে সাজালে ইঙ্গিত মেলে যে, নিষাদ হিরণ্যধনুর পালিত পুত্র একলব্য খুব সম্ভবত কৃষ্ণেরই খুল্লতাত দেবশ্রবার পুত্র। এই সংবাদে কৃষ্ণ বিস্মিত হন। অন্য দিকে হস্তিনা নগরীর কেন্দ্রস্থলে আয়োজিত রাজকুমারদের অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শনী উৎসবে হঠাৎ সংজ্ঞা হারান কুন্তী। অর্জুনের ধনুর্বিদ্যার কৌশল প্রদর্শনের পরই এ ঘটনা ঘটে।
কে এই অমিততেজা শালপ্রাংশু ধনুর্ধর? যে অবলীলায় সাধিত করে সর্বসমক্ষে দেখাল অর্জুনেরই সমতুল অজস্র কলাকৌশল? তার পর তৃতীয় পাণ্ডবের শ্রেষ্ঠত্বকে সরাসরি পরীক্ষায় আহ্বান করল, প্রস্তাব দিল দ্বন্দ্বযুদ্ধের?
রাধেয়! অধিরথপুত্র বসুষেণ! যে তরুণ এই দ্রোণের গুরুকুল ত্যাগ করে গিয়েছিল, পরশুরামের আশ্রমে বিদ্যালাভ করে ফিরেছে!
মহানাটকের ঘ্রাণ পেয়ে জনতা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। সূতপুত্রের বংশমর্যাদা নিয়ে কুটিল প্রশ্ন উঠতে, ত্বরিতবুদ্ধি দুর্যোধন তৎক্ষণাৎ তাকে অঙ্গপ্রদেশের রাজপদে অভিষিক্ত করে দেয়। নিমেষে তপ্ত হয়ে ওঠে রঙ্গস্থল। রাধেয় আর কৌন্তেয়র সম্মুখ-সংগ্রাম এখন অনিবার্য...
অকস্মাৎ দর্শকাসনে কোলাহল ওঠে, “রাজমাতা কুন্তী অসুস্থ! চেতনা হারিয়েছেন!”
সমাসন্ন দ্বৈরথ থেমে যায়। কুন্তীর পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে সকলে— তত ক্ষণে দিবাকর অস্তোন্মুখ, অতএব রঙ্গ-প্রদর্শনীর অন্ত ঘোষণা করেন গঙ্গাপুত্র।
বসুষেণ আর অর্জুনের যুদ্ধে রঙ্গভূমি রক্তস্নাত হতই, নিশ্চিত। বলা চলে, কুন্তীর সংজ্ঞালোপ সেই দুর্বিপাক রোধ করল।
কিন্তু আসন্ন দ্বন্দ্ব-যুদ্ধের ঠিক প্রাক্-মুহূর্তে রাজমাতার অতর্কিত অসুস্থতা— সত্যই কি সারা দিনের রৌদ্রদহনের পরিণাম? বৈদ্য যেমন বলছেন?
অথবা— পৃথা স্বয়ং যা বলছেন— ‘কালের গ্রাস... বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে...’?
বিদুর দেখেই চলেছেন ভ্রাতৃবধূকে। প্রায় অপলক। কী যেন ভাবছেন। যা ভাবছেন, তা কি বলা সমীচীন হবে এখন?
অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করছে তাঁর। কুন্তী যখন বয়স-বৃদ্ধির কথা বললেন, তার উত্তরে বিদুরের খুব বলতে সাধ হয়েছিল যে, কালগ্রাসের সাধ্য নেই কুন্তীকে স্পর্শ করে... অন্তত তাঁর চোখে কুন্তী চিরযৌবনা... এই প্রৌঢ় বয়সেও হস্তিনার প্রধান-অমাত্য ক্ষত্তা বিদুর— বিবাহিত, সংসারী, সন্তানের পিতা বিদুর, প্রাজ্ঞ ও যশস্বী বিদুর— এই তথাকথিত ‘মধ্যবয়সিনী’ পৃথার চেয়ে আকর্ষণীয়া কোনও রমণী খুঁজে পান না এ জগৎমণ্ডলে! আজ থেকে নয়, বহু কাল বহু বর্ষ ধরে তিনি এই কথা ব্যক্ত করতে চেয়েছেন পৃথার সামনে, সেই যৌবনের মধ্যযাম থেকে।
কিন্তু হায়, বিদুর কখনও, কখনওই স্পষ্ট উচ্চারণে নির্দিষ্ট শব্দগুলি ব্যক্ত করতে পারেননি তাঁর প্রিয় নারীর সমক্ষে। রাজসভার লোকে বলে, ক্ষত্তার রসনায় সরস্বতীর নিবাস। এত নিপুণ তাঁর যুক্তিজাল, বাক্যবিন্যাস, শব্দপ্রয়োগ! প্রতিযুক্তি স্তিমিত হয়ে যায় তাঁর বক্তৃতার ঔজ্জ্বল্যে। কিন্তু বাক্পটু মন্ত্রী বিদুরকে পরিহাস করে রাজবধূর সামনে একাকী দণ্ডায়মান দেবর বিদুর। কখনও নিরঙ্কুশ সপ্রতিভতায় বলতেই পারলেন না, বহু যুগ ধরে যা অন্তরের মধ্যে সঞ্চিত রেখেছেন।
আশ্চর্য, না?
যে নারীকে তিনি অঙ্কে পেয়েছেন একদা, যে নারী তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতম ঘনিষ্ঠতায় এসেছে, এমনকি যার দেহে তিনি বপন করেছেন নিজের বীজ— সেই নারীকে আর নতুন করে জ্ঞাপনেরই বা কী অবশিষ্ট থাকতে পারে?
পারে, পারে! বিদুর জানেন, শরীর লাভ করলেই হৃদয়দ্বারে পৌঁছনো অনিবার্য নয়! এবং শরীর-ভোগেই নেই চূড়ান্ত তৃপ্তি, যদি অন্তর আরও কিছু চায়!
এই পৃথা... সুন্দরী কুরুরাজ্ঞী, মহারাজ পাণ্ডুর পত্নী। বিদুরের জ্যেষ্ঠ-ভ্রাতৃবধূ। সম্পর্ক-বিচারে প্রণম্যা। বিদুর ক্ষত্তা ও কনিষ্ঠ, পাণ্ডুর জীবিতকালে কুন্তীকে স্পর্শ করাই তাঁর স্বপ্নাতীত ছিল।
কিন্তু নিয়তিনির্বন্ধে সেই অভাবিত, অকল্পিত ঘটনা এক রকম স্বয়মাগত হয়ে ধরা দিয়েছিল বিদুরের করতলে...
২৭
প্রায় দুই দশক আগের কথা। কিন্তু আজও মনে পড়ে, মহারাজ পাণ্ডুর বনগমনের ঠিক পূর্বরাত্রির সেই প্রথম যাম। নির্জন দেবমন্দিরে পূজার ডালি নিয়ে উপস্থিত রানি কুন্তী, তাঁরই এক বিশ্বস্ত দাসী অতি গোপনে সংবাদ দিয়ে আহ্বান করে এনেছে মন্ত্রী বিদুরকে। কিঞ্চিৎ বিস্মিত, কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন দেবর বিদুর উপস্থিত হয়েছেন, আর নতনেত্রে আর্যা পৃথা তাঁকে বলছেন... স্বকর্ণকে বিশ্বাস করতে পারেননি বিদুর। এ কী শুনছেন? এ কি স্বপ্ন?
“না, স্বপ্ন নয়, ভদ্র! এ এক নারীর অসহায়তার করুণ রক্তাক্ত বাস্তব। আপনি সেই তিক্ত বাস্তবের বন্ধন থেকে তাকে মুক্তি দেবেন, এই তার প্রার্থনা!”
প্রথমে বিস্ময়-পুলকে রুদ্ধবাক বিদুর, ক্রমে রোমাঞ্চ-উত্তেজনায় তপ্ত-জাগ্রত হতে-থাকা বিদুর কোনওক্রমে বলেছিলেন, “কবে... কোথায়... কী ভাবে... আজ্ঞা করুন! আমি আপনার দাস...”
কুন্তী কিন্তু অপ্রতিভ ছিলেন না এতটুকু। অনুচ্চস্বরে বলেছিলেন, “আপনি আমার বার্তার জন্য অপেক্ষা করবেন। সুশিক্ষিত দু’টি পারাবত আমি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি বনবাসে। তাদের একটি প্রাসাদে ফিরবে যথাকালে। সেটিই হবে আহ্বান-বার্তা। তখনই আপনাকে যেতে হবে হিমালয়-লগ্ন অরণ্যে। তার পূর্বে অবশ্য আমাকে সেখানে একটি কঠিন কার্য সমাধা করে রাখতে হবে...”
“কী?”
“রাজাকে সম্মত করতে হবে, দৈব-আশীর্বাদে পুত্রলাভে যেন তিনি অনুমতি দেন। সেই সম্মতি পেলেই আমি আপনাকে আহ্বান করব আর্য!”
“কিন্তু... দৈব আশীর্বাদে পুত্রলাভ...! বিষয়টি তো বুঝলাম না!”
পৃথা হেসেছিলেন, দেউলের ক্ষীণ প্রদীপালোকেও বিদুরের মনে হয়েছিল সে হাসি মলিন, বিষণ্ণ। “আমি গুপ্ত মন্ত্র জানি, দেবতাদের আহ্বান করে তাঁদের কাছ থেকে পুত্রলাভের মন্ত্র— এই কল্পকথাটি তো বিশ্বাস করাতে হবে রাজাকে। পুরুষের অহং... যিনি নিজে পুত্রোৎপাদনে অপারগ, তিনি কি আর এতই সহজে অপর কোনও সাধারণ পুরুষের কাছ থেকে পত্নীর পুত্রলাভে আপত্তিহীন থাকবেন? হ্যাঁ, একমাত্র দেবতারা এসে যদি পুত্রদান করেন, তবে হয়তো...”
বিদুর এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে, বলেছিলেন, “অর্থাৎ... মিথ্যাচার?”
“প্রাণ ও বংশরক্ষায় সত্যলঙ্ঘন অবিধেয় নয়, সে আর আমি আপনাকে নতুন করে কী শেখাব ভদ্র! আপনি স্বয়ং অবিকল্প ধর্মজ্ঞ। তবে, তার চেয়েও একটি বড় কথা বলি? মিথ্যা নেই এতে, আদৌ। যিনি আমাকে সন্তানহীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দেবেন, আমার অপুত্রক পতিকে পুন্নাম-নরক থেকে উদ্ধার করবেন, কুরুসাম্রাজ্যকে দান করবেন বংশপ্রদীপ— সেই মহাত্মা আমার কাছে বাস্তবিকই দেবতার চেয়ে কোনও অংশে ন্যূন হবেন না, এ আমি নিশ্চিত বললাম! সুতরাং, দেব-সংসর্গের মাধ্যমে পুত্রলাভ, যা আমার স্বামী জানবেন, তা ধর্মত অসত্যও হবে না; শুধু পুত্রদাতা দেবতার নামটি আমি তাঁকে আমার নিজের ব্যাখ্যানুসারে জানাব। সেটিও বস্তুত অনৃত-পর্যায়ভুক্ত থাকবে না, জানবেন। এবং, হ্যাঁ, হিমালয়বাসী পুণ্যবান ঋষি-ব্রাহ্মণরা সেই দৈব-লীলার বিষয়টি সত্য বলে ঘোষণা করবেন, তথ্যপ্রতিষ্ঠার জন্য তাঁদের সাক্ষ্য আমার অতি প্রয়োজন! আমি তাঁদের তত দূর সম্মত করাব নিশ্চিত— সেবায় ও আনুগত্যের মন্ত্রে!”
রানির তীক্ষ্ণ শীতল মস্তিষ্ক ও অবিচল প্রত্যয় দেখে বিদুর বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কিন্তু... কোন দেবতার কথা বলবেন, আর্যা?”
“ধর্ম! আমার গর্ভের প্রথম সন্তানটি হবে ধর্মপুত্র!” মৃদু কিন্তু দৃঢ়স্বরে বলেছিলেন পাণ্ডুপত্নী।
আজ এত বর্ষ পরেও প্রৌঢ় বিদুরের মনে সে দিনের চিত্রটি ভাসিত হলে— অনিবার্য ভাবে একটি দীর্ঘশ্বাস তাঁকে গোপন করতেই হয়। রসনাগ্রে কিছু খেদবাক্য চলে আসে, দমন করেন বহু চেষ্টায়।
পৃথার সংসর্গে এসেছিলেন তিনি, পৃথাকে অঙ্কে লাভ করেছিলেন— এ তাঁর অপার সৌভাগ্য। কিন্তু এও তিনি জানেন, সেই ক্ষণিকের সম্পর্কটুকু পৃথার কাছে কেবলই প্রয়োজন-নিরসনের উপকরণ-রূপে ব্যবহৃত হয়েছিল। তাঁর আশু প্রয়োজনটি সিদ্ধ করেছিলেন বিদুর, সে জন্য পৃথা অশেষ কৃতজ্ঞও। তাঁকে দেবতার আসন দেবেন বলেছিলেন, তা দিয়েছেন, সত্য! তাঁর আচরণে এখনও অপার নম্রতা ক্ষরিত হয়।
কিন্তু, কেবল শ্রদ্ধা-কৃতজ্ঞতা তো বিদুরের ঈপ্সিত ছিল না। সে তো উপশমিত রোগীও প্রাণদাতা ভিষকের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে, অভুক্ত কাঙাল বিনম্র থাকে তণ্ডুল-বিতরক শ্রেষ্ঠীর কাছে! বিদুর ‘দেবতা’ হতে চাননি, পৃথার কাছে যা চেয়েছিলেন তা আরও বেশি কিছু। তিনি ভেবেছিলেন, স্বেচ্ছায় যে নারী নিজের দেহ তুলে দিচ্ছেন, তাঁর মনও...
বিদুর নিজে তো সর্বস্ব হারিয়ে বসে আছেন সেই বিংশতিবর্ষ আগে, শতশৃঙ্গ পর্বতের চূড়ায় আরণ্য অন্ধকারময় সেই নির্জন সন্ধ্যায়— যে দিন প্রথম সেই রমণীরত্নের চারু অঙ্গ তিনি স্পর্শ করেছিলেন! বিবাহিত অভিজ্ঞ পুরুষই তো ছিলেন বিদুর, কিন্তু সেই নগশীর্ষে বনাভ্যন্তরের শষ্প-পত্র-শয্যায় যেন প্রথম কৌমার্যহরণ হল তাঁর— সেই প্রথম অধরচুম্বন বুঝি, প্রথম অসহ কোমলতার পরিচয়, প্রথম মথনসুখ, ভেদন-রোমাঞ্চ! তেমন তুমুল অলৌকিক প্লাবন-অভিজ্ঞতা... না, তাঁকে নিজ পত্নী কখনও দিতে পারেননি। সেই শরীরী স্রোতে চিরকালের মতো তাঁর অন্তরটিও কখন যে ভেসে গেল অনিবার! বুঝি সেই প্রথম বার তিনি প্রকৃত অর্থে অনুপ্রবিষ্ট হলেন নারীতে, তাঁর সমগ্র জগৎ সেই নারীর বিম্বে পূর্ণ হল! সে বার হিমালয় থেকে প্রত্যাগমনের পরেই স্থিতপ্রজ্ঞ বিদগ্ধবুদ্ধি ক্ষত্তা অনুভব করেছিলেন, জীবনে এই প্রথম বার— সম্ভবত শেষ বারও— তাঁর সত্তার একটি শ্রেষ্ঠ অংশ তিনি গচ্ছিত রেখে এসেছেন কোনও মানবীর কাছে, এবং সেটি আর ইহজীবনে ফিরে পাবেন না!
কিন্তু, সেই নারীও কি একই ভাবে ভেসেছিলেন? সন্তানদাতা বিদুরের জন্য তাঁর অন্তরেও কি—
ওই শ্রদ্ধা-ভক্তি-কৃতজ্ঞতা ভিন্ন অন্য কোনও আবেগ জন্মেছিল কখনও? এমনকি, ঘনিষ্ঠতম সংসর্গের পরেও? আজ পর্যন্ত কখনও কুন্তী বিদুরের প্রতি একটিও এমন শব্দ উচ্চারণ করেননি, যাকে প্রণয়-সম্ভাষণ বলা চলে। বেশ মনে আছে বিদুরের, শতশৃঙ্গের সেই বনান্ধকারে নিবিড় আশ্লেষ-মুহূর্তগুলিতেও না! তুঙ্গলগ্নে কেবল জৈবিক সুখানুভবের শব্দরাজিই ছিল পাণ্ডুজায়ার ওষ্ঠে, যেমন থাকার কথা; কিন্তু সংলগ্নাবস্থায়পরম আবেগতাড়িত বিদুর তাঁকে যত বার প্রিয়াসম্ভাষণে ডেকেছেন, একটি বারও তেমন প্রতিসম্ভাষণ শুনতে পাননি!
রাজমন্ত্রী বিদুর, পাণ্ডবদের হিতচিন্তক বিদুর, অভিভাবক বিদুর, জ্ঞানী বিদুর, ধর্মাত্মা বিদুর— নানা ভূমিকায় বিদুরকে মান্য করেন পৃথা, আন্তরিক অভিভাষণ করে থাকেন। পরম নির্ভর করেন বিদুরের উপর, বিদুরের বাসগৃহে এসে আতিথ্য পর্যন্ত নেন। কিন্তু হায়! এক পলের জন্যেও এই নারীর অক্ষিতারায় কপোলে ওষ্ঠপ্রান্তে সেই অবর্ণনীয় বর্ণোদ্ভাস খুঁজে পাননি বিদুর— যার জন্য তাঁর যুবক চক্ষু দু’টি তৃষার্ত হয়ে বৃদ্ধ হতে বসল!
এখন, এই দীর্ঘ ও ব্যর্থ যাত্রার পর বিদুর উপলব্ধি করেছেন, তীক্ষ্ণধী পৃথা নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য পুরুষদের নির্বাচন ও ব্যবহার করেছেন মাত্র। মরালীগাত্রে শীকরকণার মতো, কোনও সংসর্গই তাঁর অন্তর স্পর্শ করেনি, স্থায়ী চিহ্ন রাখা দূরস্থান! বিদুরের সঙ্গে যতটুকু প্রয়োজন ছিল— রাজচক্রবর্তীলক্ষণযুক্ত পুত্র লাভ— সেই অভীষ্ট সিদ্ধ হওয়ার পর তিনি অক্লেশে আবার নতুন পুরুষদের আহ্বান করেছেন। শুধু একটি সুশাসক ধর্মশীল পুত্র যথেষ্ট নয়। তাঁর প্রয়োজন ছিল প্রবল শক্তিধর পুত্রের, দিগ্বিজয়ের সামর্থ্যবান বীরপুত্রেরও। মনস্বিনী কুন্তী বংশগতির প্রভাব সম্পর্কে অবহিতা। তাই একাধিক পার্বত্য-আরণ্য গোষ্ঠীর নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ গুণাধার পুরুষের বীজ নির্দ্বিধায় গর্ভে নিয়েছেন। যেমন শুদ্ধসত্ত্ব বিদুর পালন করেছেন ‘ধর্মদেবতা’র ভূমিকা, তেমনই পর পর পাণ্ডুপত্নীর গর্ভে ঔরসদানে আহূত হয়ে এসেছেন মল্লপারদর্শী বিপুলবলশালী জনজাতি থেকে ‘পবনদেবতা’, তিরন্দাজ উপজাতির সর্বোত্তম প্রতিনিধি ‘ইন্দ্রদেবতা’র নাম নিয়ে...
সন্তানদের এবংবিধ দৈবী পরিচয়গুলি ঘোষিত ও প্রতিষ্ঠিত হত সর্বমান্য বিপ্র-তপস্বী-ঋষিদের দ্বারা, যার উপরে আর কথা চলে না।
সেই সব সংবাদ হস্তিনায় বসেই পেতেন বিদুর। আবার মা হচ্ছেন কুন্তী। আবার...! একাধিক অপর-পুরুষের ঔরস নিতে অকুণ্ঠিতা শৌরসেনী...
কী অজ্ঞাত এক ভার যে অহর্নিশ চেপে থাকত হৃদয়যন্ত্রের উপর!
...আজ অপলকে কুন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিদুরের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে কী যেন আলোড়িত হয়ে ওঠে। সে কি স্মৃতি? সে কি অভিমান? সে কি বঞ্চনাবোধ? কয়েক মুহূর্তের জন্য তাঁর আত্মবিস্মরণ ঘটে বুঝি! বহু দিন ধরে যে বাক্যটি দমন করে রেখেছেন, যে প্রসঙ্গকে জিহ্বা থেকে বার বার নির্বাসন দিয়ে রেখেছেন সচেতন প্রয়াসে— অতর্কিতে তা অর্গলহীন হয়ে বেরিয়ে আসে! আর রোধ করা যায় না।
“আমি কিন্তু আপনার আজকের আকস্মিক অসুস্থতার একটি অন্যতর গূঢ় কারণ অনুমান করি, আর্যা কুন্তী! ভয় নেই, আমি এ প্রসঙ্গে একটি বর্ণও কাউকে বলব না। কিন্তু আমার অনুমানটি সত্য কি না, আপনাকে বলতে হবে!”
কুন্তী পলকের মধ্যে বিবর্ণ হয়ে গেলেন। বললেন, “কী অনুমান?”
এক পল চুপ করে রইলেন বিদুর। তার পর পেশ করলেন বক্তব্য, একটু কি নিষ্ঠুর শোনাল তাঁর কণ্ঠ?— “সূতপুত্র বসুষেণ যে অধিরথের নিজের সন্তান নয়, সে কথা অনেকেই জানে। সদ্যোজাত এক শিশুকে নদীতে ভাসমান এক পেটিকা থেকে রাধা ও অধিরথ উদ্ধার করেছিল। তার কর্ণের কুণ্ডল ও অঙ্গের কবচে সূর্যচিহ্ন অঙ্কিত ছিল। সে স্বয়ং সূর্যের সন্তান, লোকমুখে এমনই প্রচার। অধিরথ তাকে পালিত পুত্র রূপে লালন করে বটে, কিন্তু ত্যক্ত শিশুর সেই ক্ষুদ্র কবচ-কুণ্ডলের অবিকল অনুরূপ চিহ্ন-সম্বলিত আনুপাতিক বৃহদাকারের কবচ-কুণ্ডলে সর্বদা তাকে সজ্জিত রাখে। হয়তো এই ভেবে, যে, যারা শিশুকে নির্বাসন দিয়েছিল, তারা কখনও চিনতে পারবে ওই অভিজ্ঞান দেখে...”
শুষ্ক পত্রের মতো কাঁপছেন রাজমাতা কুন্তী। ওষ্ঠও কম্পমান, কিন্তু শব্দ নেই!