ছবি: পিয়ালী বালা।
পূর্বানুবৃত্তি: সে দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ শুটিং ছিল মিশুকের। গ্রামের মেলায় ঝড়ের দৃশ্যে সারথির সঙ্গে রিখি সেনের প্রথম দেখা হওয়ার সিন। সারথির রোল করার কথা ছিল বাদশা বোসের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই ভূমিকায় নির্বাচিত হয় এক জন নবাগত। অর্ক ঘোষাল। কার্যকালে দেখা যায়, নতুন হলেও সে খুবই দক্ষ অভিনেতা। যথেষ্ট সাবলীল ভাবে সে অভিনয় করে সবাইকে অবাক করে দেয়। এরই মধ্যে মিশুকের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে সব্য। মিশুক দেখে, তাকে মেসেঞ্জারে তার বয়স জিজ্ঞেস করেছে কস্তুরী। অবাক হয় মিশুক।
আজ কী মনে হল, মিশুক যা করে না, সেটাই করল। মেসেজ করল কস্তুরী রায়কে, ‘একদিন চলে আসুন নিউ টেকনিশিয়ানে।’ সেন্ড বাটন টিপে দিতেই ফের দরজায় মলয়। নাঃ। এই বার দেবদা বকবে। কে জানে হয়তো তার পেয়ারের অর্ক ঘোষাল আগেই রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মোবাইল সাইলেন্ট করে ফ্লোরের দিকে দৌড়ল এ বার সে।
ফ্লোর বলাটা অভ্যেস মাত্র। আসলে একটা ফাঁকা জায়গায় সেট ফেলা হয়েছে। একটা গ্রামের পরিবেশ। হাট বসেছে যেন। হাটে প্রচুর লোকজন ঘোরাফেরা করছে। সবাই এক্সট্রা। তাদের মধ্যে কেউ ফেরিওয়ালা সেজেছে। কয়েকটি মনিহারি, পাঁপড়-বিস্কুটের দোকান দেখা যাচ্ছে। একটা টি-স্টল আছে। গায়ে লেখা ‘হারানের চা’। এই টি-স্টলটা আগেও দু’-একটা সিরিয়ালে ব্যবহার করা হয়, পরেও হবে, তবে নাম পাল্টে পাল্টে। মাটির দেওয়ালের গায়ে একটা একটা গরুর গাড়ির চাকা দাঁড় করানো আছে। চার দিকে চারটে চিমায়া বসানো হয়েছে। ট্রলিতে বসানো ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে বসে দেবদা। দেখে নিচ্ছেন। চারটে এইচএমআই লাইট জ্বলে উঠেছে। মানবেন্দ্র, পুরুষোত্তম, যোগিনী আর বাউলের চরিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রেডি। আর হ্যাঁ। সামান্য চোখ ঘুরিয়েই দেখতে পেল সারথিকে। তার সিন পরে আসবে। তবুও সে সম্পূর্ণ ধড়াচুড়োয় বসে আছে একটা দেওয়ালের গায়ে, অবশ্যই ক্যামেরার প্যানের বাইরে, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেটের দিকে। ছেলেটা সত্যি সিরিয়াস। অন্য কোনও ছেলে হলে এত ক্ষণ মেকআপ রুমে বসে গুলতানি মারত, সিগারেট ফুঁকত।
একটা কথা তাকে বলেছিল অনিরুদ্ধ পাল, সারা জীবন মনে থাকবে মিশুকের। অনিরুদ্ধদার জন্য কষ্ট হয়। এমনিতে মন্দ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ছিল না, তবুও কেন যেন টিআরপি তুলতে পারছিল না। অনিরুদ্ধদা এক বার বলেছিল, “অভিনয়ের একেবারে মূলে ঢুকে যেতে হলে সেটে দাঁড়িয়ে দেখবি। তোর সিন হয়তো এক ঘণ্টা পরে। তবুও সেট ছেড়ে যাবি না। চেয়ার পেতে বসে দেখবি। তোর টার্ন এলে দেখবি তোকে আলাদা করে ইমোশন ক্রিয়েট করতে হচ্ছে না। এমনিতেই এসে যাচ্ছে।”
বেচারা অনিরুদ্ধদা। সবাইকেই ডেকে ডেকে ভাল ভাল উপদেশ দিত। হাতে গোনা আর্টিস্ট ছাড়া আর কেউ শোনেনি। ওয়ান্ডার মোমেন্টস ছাড়ার পর ফিউচার প্রোডাকশনে জয়েন করেছে। ওদের ডেলি সোপ স্টারে চলছে। ভালই। তবে ‘রাঙামাটির মেয়ে’কে বিট করতে দেরি আছে।
আজ রবিবার। আজ কার মুখ দেখে উঠেছে কস্তুরী, বাপ-মেয়ে এক টেবিলে বসেছে পরোটা, মাংসের কিমা খেতে। আকিঞ্চনের মধ্যেও ইদানীং একটা পরিবর্তন লক্ষ করেছে কস্তুরী। আজকাল মেয়ের সঙ্গে সেই আগের মতো দিলখোলা গল্পগুজব করে না। কস্তুরী মনে মনে হাসে। আকিঞ্চন বুঝবে এক দিন। স্ত্রীকে। মেয়েও বুঝবে মাকে। তবে সে দিন হয়তো আর কস্তুরী থাকবে না।
কস্তুরী নিজের প্লেটটা নিয়ে পা গুটিয়ে বসল সোফায়। সোফার হাতলে খাবারের প্লেট। স্ক্রিন অন করে দেখল একটা মেসেজ জমা হয়েছে মেসেঞ্জারে। কে? এক সেকেন্ড, দু’সেকেন্ড... পরক্ষণেই হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠেছে কস্তুরীর। সঙ্গে সঙ্গে প্লেটটা উল্টে মেঝেয়। প্লাস্টিকের ছিল বলে ভাঙেনি, খাবারগুলো নষ্ট হল। চমকে গেছে আকিঞ্চন আর মেহুলিও। দু’জনেই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আকিঞ্চন বলল, “হোয়াট হ্যাপেনড? কিছু কামড়াল না কি?”
মেহুলিও এত দিনের অভিমান-টভিমান ভুলে দৌড়ে কাছে এসে দারুণ উদ্বেগের স্বরে বলল, “কী হয়েছে মা?”
মেয়ে কত দিন বাদে তার সঙ্গে কথা বলল! আচমকাই কী কারণে চোখে জল এসে গেল কস্তুরীর। আসল কারণ এদের বলে লাভ নেই। বুঝবে না। বরং এই মুহূর্তটাকে উপভোগ করা যাক। কস্তুরী বলল, “আরে কিছু না রে, অনেক দিন কাঁচালঙ্কা খাওয়ার অভ্যেস চলে গেছে। আজ ভাবলাম পরোটার সঙ্গে তরকারি না খেয়ে আচার দিয়ে খাই। লঙ্কার আচার। উরে বাপ রে! কী ঝাল! মাথা ঘুরে গেল। হাত-ফাত কেঁপে...”
আকিঞ্চন উঠে এল তোয়ালেয় হাত মুছতে মুছতে, “এই সব ছেলেমানুষি তোমার কবে যাবে? সেই গত মাসে বললে সবাই ছুরি দিয়ে তরকারি কাটে। তুমিও কাটবে। তখন কত করে বারণ করলাম। তার পর রক্ত-ফক্ত বেরিয়ে, যাচ্ছেতাই। চিনি এনে দেব?”
মেহুলি ‘ডিসগাস্টিং’ বলে ফিরে গেল নিজের ঘরে। যেটুকু মন ভাল হয়েছিল ফের আগের অবস্থায় ফিরে গেল কস্তুরীর। তবু ভুল করে হলেও, মেয়েটা এসেছিল তো তার কাছে। কত দিন পর! আকিঞ্চনের সহানুভূতিকে পাত্তা না দিয়ে ফের মেসেঞ্জারে চোখ রাখল সে। একেবারে দেখা করবার ডাক! ভাবা যায়! মিশুক মুখার্জি তাকে ডেকেছে! যাবে সে? কবে যাবে? নিউ টেকনিশিয়ানটা আবার কোথায়?
“কেসটা কী?”
চমকে তাকিয়ে দেখে, আকিঞ্চন একটা মোড়া টেনে সামনে বসেছে। তবে কী ধরে ফেলেছে?
“কিসের কেস?”
“উঁহু। আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল।”
“আমি বলেছি তোমায়।”
“উঁহু। এগজ়্যাক্ট তিন সেকেন্ড আগে আমি দেখেছি তুমি মোবাইলের দিকে তাকিয়েছিলে অ্যান্ড তোমার প্লেটে আচার ছিল না।”
কী আর করা। বাধ্য হয়ে মোবাইলটা এগিয়ে দেয়। আকিঞ্চন ভুরু-টুরু কুঁচকে কিছু ক্ষণ পরে বলল, “কে এই মিশুক মুখার্জি? নিউ টেকনিশিয়ানটা আবার কোথায়?”
“নো আইডিয়া।”
“বোঝো! একে তুমি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলে কেন? চেনো?”
“এই মেয়েটার অ্যাক্টিং আমার দারুণ লাগে। ”
“ওফ! সেই ট্র্যাশ বেঙ্গলি সিরিয়াল!”
“ট্র্যাশ তোমার কাছে। আমার কাছে এন্টারটেনমেন্ট। ওর মধ্যে একটা...”
“থামো! এই সব সিরিয়াল দেখে সব মিডল-ক্লাস মেন্টালিটির লোকেরা।”
“অশান্তি কোরো না। আমি কি তোমায় বলেছি আমার জীবনে উঁকি মারতে? তুমি তোমার কাজে যাও না।”
“এই সব লাইনের মেয়েরা অতি বাজে হয়। কোনও কাজে আসবে না তোমার।”
নাঃ, আকিঞ্চন বাড়াবাড়ি করছে। ওকে থামানো দরকার। কস্তুরী গলা তুলল, “আকিঞ্চন, মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ। লাইনের মেয়ে মানে কী?”
হয়তো একটু বেশিই চেঁচিয়ে উঠেছিল কস্তুরী, আকিঞ্চন থমকে গেল। তার পর মোড়াটাকে উল্টে দিয়ে দুমদাম করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। চোখে জল এসে গেল কস্তুরীর। দিনে দিনে আকিঞ্চন কী নোংরা হয়ে যাচ্ছে! লাইনের মেয়ে! কী অশ্লীল শব্দ!
কিন্তু এখন এ সবে কান দিলে তার চলবে না। তাকে ডেকেছে মিশুক, তাকে ডেকেছে! সে যাবে, এক বার অন্তত যাবে। কিন্তু কবে? যে দিন ইচ্ছে? দূর! রোজ ওর শুটিং থাকে না কি! এই রে, তারিখ, সময় এ সব তো বলেনি। তা ছাড়া আর একটা সমস্যাও আছে। সে সারা জীবনে শুধুমাত্র ইন্দ্রপুরীর নাম শুনেছে। টালিগঞ্জে। নিউ টেকনিশিয়ান স্টুডিয়ো তা হলে কোথায়? এক বার গুগল ম্যাপ করে দেখবে? না হলে মিশুকের কাছে সে যাবেটা কী করে?
সব্যর মেসেজের কথা ভুলেই গিয়েছিল মিশুক। আজকের শুটিং শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে গেল। এর মধ্যে মাকে একটা ফোন করা ছাড়া আর কারও ফোন ধরেনি সে। না কোনও মেসেজ। আজ সারা দিন অনিরুদ্ধদার কথামতো সে ফ্লোরে ছিল। অর্ক ছেলেটার অ্যাক্টিং খুব মন দিয়ে দেখছিল আর অবাক হচ্ছিল। এ তো পুরো প্রফেশনাল! বাদশা বোসকে টক্কর দিয়ে দেবে। স্পেশ্যালি চোখে চোখ রেখে ঠিক তিরিশ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকার সিনটায় এতটুকু পাতা কাঁপেনি, উল্টে লুক যা দিয়েছে মাঝেমধ্যে ঘাবড়ে যেতে হচ্ছিল মিশুককে। ডায়লগ থ্রো করার সময়েও ফিলিংস দিচ্ছিল একেবারে নতুন প্রেমে-পড়া প্রেমিকের মতো। যেন কত দিনের চেনা। মনে মনে তারিফ করেছিল সে। তাই তার শট শেষ হয়ে গেলেও সেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। চেয়ার থাকা সত্ত্বেও বসেনি। পা টনটন করছিল, তবে দিনের শেষে এই স্যাক্রিফাইসটা কাজে এসেছে। সিন-এইটে এসে অর্ককে ডজ করে বেরিয়ে গেছে মিশুক। শট শেষ হলে অর্ক ছেলেটা এগিয়ে এসে সামান্য হেসে বলেছিল, “আপনি দারুণ অভিনয় করেন ম্যাম। ফার্স্ট ডে থেকে আমার মনে হয়েছে কার সঙ্গে আপনার অভিনয় ক্ষমতার মিল পাচ্ছি, আজ মনে পড়ল। নিকোল কিডম্যান। আমি নিকোলের ব্লাইন্ড ফ্যান। আপনি?”
“শ্রীদেবী।”
বলে হতভম্ব অর্কর সামনে দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে এসেছিল মিশুক। স্ক্রিন শেয়ার করতেই পারে, তবে হাজার হোক জুনিয়র আর্টিস্ট। এই ট্যানট্রামটা তো মেনটেন করতেই হয়। এক বার টয়লেট ঘুরে মেকআপ রুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে একটা অ্যাপ-ক্যাব বুক করে গেটের সামনে বিশাল পার্কিং প্লটটায় আসতেই চমক! সব্যসাচী! হ্যাঁ। সব্যসাচীই তো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সোনেলার সঙ্গে কথা বলেছে। সোনেলা সরকারকে চেনে মিশুক। ওদেরই পাশের ফ্লোরে চলছে রেড ইউন্ডোজ-এর লেটেস্ট ডেলি সোপ ‘সমসাময়িক’। প্রধানত সাহিত্য সিরিজ় নিয়ে ডেলি সোপ বানায় রেড ইউন্ডোজ়। তারই একটা সিরিজ়ে এখন সোনেলা কাজ করছে। কিন্তু সোনেলাকে সব্যসাচী চিনল কী করে? ও তো সিরিয়াল দেখে না। বলে, “রসিয়ে প্রেম করবার সময় পাচ্ছি না তো সিরিয়াল!”
মিশুককে দেখে সোনেলা ইশারা করে। সোনেলাকে ফলো করে সব্য ঘুরে দাঁড়িয়ে একগাল হাসে। মিশুক বলে, “বাবা! আজ যে একদম ভেতরে চলে এলি?”
“আর বলিস না। বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ে দেখছিলাম। এমন সময় রিপিটেড হর্ন। কে রে বাওয়া? তাকিয়ে দেখি একটা টুকটুকে লাল গাড়ি আর ভেতরে আমাদের সেই জ়াভেরিয়ান সোনামণি।”
“সোনামণি!”
“জ়েভিয়ার্সে ওকে আমরা সোনামণি বলে খেপাতাম। কেমন সোনামণি-সোনামণি মুখ করে থাকত, তাই। মাথায় তেল, দুই বিনুনি। সে যে আবার হিরোইন হয়েছে কে জানত। থোবড়া তো পুরো পাল্টে ফেলেছিস রে। তার উপর আবার হাতে সিগারেট! করেছিস কী?”
সোনেলা একটা জবরদস্ত টান দিয়ে বলল, “মারব এক চড়। মিশুকের সঙ্গে তোর রিলেশন আছে এত ক্ষণ বলিসনি তো। বললি, কী একটা কাজে এসেছিস আশপাশের কোনও বাড়িতে।”
“স্টান্ট দিলাম। এক হিরোইনের সঙ্গে প্রেম আছে জানলে আর এক হিরোইন কি পাত্তা দিত?”
“তুই কিন্তু এক আছিস সব্যসাচী। এতটুকু বদলাসনি। জানো মিশুক, জ়েভিয়ার্সে এদের গ্রুপটাকে জাস্ট টলারেট করতে পারতাম না। এত ফাজিল, এত টকেটিভ।”
“আর তুই? একদম লক্ষ্মীদিদিমণি। আর এখন? প্রচুর বকতে হয়, তাই না রে?”
“সে তুই মিশুককে জিজ্ঞেস করলেই বুঝতে পারবি। সারা দিন বকবকানি আর ইমোশনের সাপ্লাই দিয়েই তো কেটে যায়। বাড়ি ফিরে জাস্ট চুপ করে থাকি। ও সব ছাড়। সব্যসাচী তো আমার স্কুলের বন্ধু। মিশুক, তুমি এই ফাজিল ছেলেটার পাল্লায় পড়লে কী করে?”
মিশুক অর্থপূর্ণ হাসে। ওর মন এখন উসখুস করছে সব্যকে একা পাওয়ার জন্য। কথা বললেই কথা বাড়বে। ভাগ্য ভাল সোনেলা নিজেই বলল, “তোরা কথা বল, আমি ফ্লোরে যাই। প্রচুর কান্নাকাটি করতে হবে আজ।”
ওর কথার ধরনে হেসে ফেলে মিশুক আর সব্যসাচী। মিশুক অ্যাপ-ক্যাব ক্যানসেল করে সব্যসাচীর বাইকে চেপে বসল, আর এক ঘণ্টার মধ্যে শ্যামবাজারের একটা গলিতে একটা বাড়ির সামনে বাইক দাঁড় করাল সব্যসাচী। হেলমেট খুলে মিশুক দেখল, একটা পুরনো সেকেলে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তারা। উত্তর কলকাতার গলিগুলোতে ঢুকলে কেমন মন খারাপ হয়ে যায়। কেমন একটা ছায়া-ছায়া, নির্জন। সরু সরু গলি আর জমা জল। তবে একটা জিনিস দেখতে বেশ মজা লাগে। বেশ কয়েকটা বাড়ির সামনের রোয়াকগুলো। মনে হয় শীতের দুপুরে বেশ জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যায় এখানে। তবু মনখারাপটা সঙ্গ ছাড়ে না। আর আগেও, পুজোর উদ্বোধন করতে গোরাবাজার, হাতিবাগান, শ্যামবাজার, বাগবাজার এই সব জায়গায় এসেছে সে। যেন মনে হয় পঞ্চাশ-ষাট বছরের আগের কোনও সিনেমার সেটে ঢুকে পড়েছে। এই হয়ত শোনা যাবে ‘অ্যাকশন’, আর ওই রোয়াকওয়ালা বাড়িটার দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসবেন প্রমথেশ বড়ুয়া নয়তো পাহাড়ী সান্যাল।
কিন্তু এই গলিতে কী কাজ সব্যর? সব্য মাথা থেকে হেলমেট খুলতে খুলতে বলল, “চলে আয়।”
ডোরবেল টিপতেই মিনিটখানেকের মধ্যে একটা মাঝবয়সি ভদ্রলোক দরজা খুলে বলল, “সব্যসাচী বাগচী? আই প্রিজ়িউম।”
“ইয়েস স্যর।”
“ওয়েটিং ফর ইউ। কাম ইন।”
ভদ্রলোকের উচ্চারণ বেশ দুরস্ত। হয়ত উচ্চশিক্ষিত অথবা বিদেশে থাকেন। ভদ্রলোকের পিছু পিছু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে গেল তারা। এর মধ্যে ঘাড় ঘুড়িয়ে চার দিক দেখে নিয়েছে মিশুক। ভেতরে একটা বৃত্তাকার উঠোন ঘিরে সার সার ঘর। তবে কেমন খাঁ খাঁ করছে। কেউ কি নেই নাকি বাড়িতে? এই বাড়িতে সব্যর কী দরকারি কাজ থাকতে পারে?
দোতলার একদম কোণের একটা ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢোকার আগে থেকেই একটা হাল্কা কুঁই কুঁই, কিঁউ কিঁউ আওয়াজ পাচ্ছিল সে। ঘরে ঢুকে একেবারে চমকে গেল সে। ঘরটা প্রায় তিরিশ বাই তিরিশ হবে। ছোটখাটো বাচ্চাদের খেলা মাঠ। তাতে দেওয়াল ঘেঁষে সার সার পুঁচকে পুঁচকে খাট, রেলিং দিয়ে ঘেরা। কাছে এসে যা দেখল, চমকে আর আনন্দে হৃৎপিণ্ড চমকে এল গলার কাছে। প্রতিটি খাটের মধ্যে একটি দু’টি করে সারমেয় শাবক! কেউ শব্দ করছে, কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ আবার তাকাচ্ছে পিটপিট করে।
“পাপ্পি!” একেবারে যেন লাফিয়ে উঠল মিশুক।
“ইয়েস ডিয়ার। ইয়োর বিলেটেড বার্থডে গিফট। চলবে?”
চলবে মানে! একেবারে উদ্দাম দৌড়বে। মিশুকের কত্ত দিনের শখ একটা কুকুর পোষার। অ্যালশেসিয়ান টাইপের বড়সড় নয়। বেশ সাদা, সাদা, তুলোর বলের মতো কুকুরছানা। কী ভাল যে লাগে! মাসখানেক আগে তার বার্থডে চলে গেছে। সব্য তার জন্য একটা ফুলের বুকে এনে বলেছিল, “আর একটা ডিউ স্লিপে থাক, পরে পাবি।”
মিশুক ভাবল এর চেয়ে ভাল বার্থডে গিফট তাকে কেউ দিতে পারত না। ভদ্রলোক সামনে না থাকলে একটা জম্পেশ চুমু সব্যর প্রাপ্য হত। সব্য বলল, “সবগুলো আগে দ্যাখ। কোনটা পছন্দ হয়। ইনফরমেশন চাইলে মিস্টার ভট্টাচারিয়া আছেন, উনি বলে দেবেন।”
মিশুক খুব মন দিয়ে প্রতিটি বাচ্চাকে দেখতে লাগল। মিঃ ভট্টাচারিয়া পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, “দিস ইজ় এরডেল টেরিয়ার, ওটা আকিতা, পাশেরটা আলাস্কান মালামুট, এটা বুলডগ, এটা ব্রিডেড অ্যালশেসিয়ান, ওর বাবা পোলিশ, এই ছোট্ট বদমাশটা আমেরিকান স্ট্যাফোর্ডশায়ার...” একটা কালো কুচকুচে শাবককে দেখিয়ে বললেন, “ইনি অস্ট্রেলিয়ান কেল্পি। খুব ফেরোসাস কিন্তু...”
একটা বাদামি রঙের শাবকের দিকে চোখ আটকে গেল মিশুকের। কেমন অদ্ভুত দেখতে। বাচ্চাটা অপলকে যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আচমকা দেখলে মনে হয় সন্দেহের চোখে দেখছে। ভদ্রলোক আন্দাজ করে বললেন, “ও ও রকমই দেখতে। থিংকার্স লুক। আসলে চোখের উপরের চামড়া এমন ভাবে নেমে এসেছে যে দেখলে মনে এক জন বয়োবৃদ্ধ মানুষ গভীর ভাবে চিন্তা করছে।”
এই সারমেয় শাবকটি লম্বায় বেশি উঁচু নয়। পেট প্রায় ছুঁয়ে আছে খাটের নরম বিছানা। কী কিউট! মিশুক বলল, “এটি কী?” ভদ্রলোক খাটের ভেতর থেকে আলগোছে শাবকটিকে তুলে এনে বললেন, “এ হল বিগল। অরিজিন ইংল্যান্ড। অ্যাকচুয়ালি ব্যাসেট হাউন্ড। নিন ধরুন।”
খুব সাবধানে ওকে কোলে নিল মিশুক। কোলে উঠেই কেমন মায়াভরা চোখে মিশুককে দেখতে লাগল বাচ্চাটা। ভদ্রলোক বলে গেলেন, “বিগল ইজ় আ ব্রিড অফ স্মল হাউন্ড দ্যাট ইজ় সিমিলার ইন অ্যাপিয়ারেন্স টু দ্য মাচ লার্জার ফক্সহাউন্ড। এদের স্মেলিং পাওয়ার মারাত্মক। প্রাথমিক ভাবে শিকার, যাকে বিগলিং বলে, তার জন্য বিখ্যাত। গন্ধ এবং উচ্চতর ট্র্যাকিং প্রবৃত্তির একটি দুর্দান্ত কম্বিনেশন। খুব বুদ্ধিমান কুকুর। আর সবচেয়ে বড় কথা হেরিডিটির কারণে এদের স্বাস্থ্য-সমস্যা হয় না।”
ভদ্রলোক থামলেন না, “এই জাতের কুকুর আড়াই হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে আছে। তবে এই ধরনের বিগলরা গ্রেট ব্রিটেনে আছে ১৮৩০ সালের কাছাকাছি সময় থেকে। অবশ্য অ্যান্সিয়েন্ট গ্রিসে...”
মিশুক বুঝল ভদ্রলোককে না থামালে তিনি বিগল খুঁজতে খুঁজতে খ্রিস্টের যুগে পৌঁছে যাবেন।
মিশুক তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, “ও কী খায়?”
“আপনারা নিলে আমি ফুড-চার্ট দিয়ে দেব।”
মিশুক তাকাল সব্যসাচীর দিকে, সব্য মিশুকের দিকে। মিশুকের চোখের ভাষা পড়ে নিল সব্যসাচী। ভদ্রলোকও পড়ে নিলেন নিজস্ব অভিজ্ঞতায়। বললেন, “অফিসে আসুন।”
সব্যসাচী বলল, “তুই বাইরে গিয়ে দাঁড়া ওকে নিয়ে। আমি ফর্মালিটিগুলো কমপ্লিট করে আসছি।”
সব্যসাচী ফিরে এল মিনিট পনেরো পরে। ততক্ষণ একটা চলমান পুতুলের মতো শাবকটা বার বার চেষ্টা করছে ওর কাঁধ বেয়ে ওঠার। মিশুক দু’বার ওর মাথায় চুমু খেল। এক বার শাবকটা তার ছোট্ট লাল জিভটা বের করে চেটে দিল ওর গাল। ইসস। তবে রে দুষ্টু। ওকে কোলে বাচ্চা নেওয়ার মতো করে ঝুলিয়ে নিল মিশুক। তার দু’হাতের মধ্যে নড়েচড়ে উঠছে বাচ্চাটা। সামান্য চেপে ধরলে দেহের মধ্যে থেকে একটা হাল্কা তাপ অনুভব করছে।
এই যাঃ, ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করা হয়নি, এরা কত বড় হয়? খুব লম্বা হয়ে গেলে ভাল হবে না। বেশ ছোট্টখাট্টোটি থাকবে। ঘরের মধ্যে ঘুরঘুর করবে। মিশুক কাজ থেকে ফিরতেই ছুট্টে এসে পা চেটে দেবে। কোলে উঠতে চাইবে। ওকে নিয়েই তো টাইম কেটে যাবে। আচমকা মনে হল এর জন্য একটা খাট কিনতে হবে তো। আর একটা বিছানা। শীতকাল এলে পুঁচকে লেপ, বালিশ। নিজের মনেই হেসে ফেলল মিশুক।
ক্রমশ