ছবি প্রসেনজিৎ নাথ।
পূর্বানুবৃত্তি: অভ্র তার মায়ের কাছ থেকে সুমি সম্পর্কে নানা কথা জানতে পারে। প্রায় একার জোরেই লড়াই করে ডিভোর্স আদায় করেছে সুমি। সে বাবদ কিছু টাকাও পেয়েছে সে। এখন আবার তার বিয়ের চেষ্টা চলছে। তবে সুমি অতটা আগ্রহী নয়। বিয়ের প্রসঙ্গে আগ্রহী নয় অভ্রও। মা অনেক বুঝিয়েও তার মত করাতে পারে না। জীবনে জটিলতা বাড়াতে চায় না অভ্র। টাকাপয়সার অনিশ্চয়তাই তাকে সঙ্কুচিত করে রাখে। অন্য দিকে ফোনে কিংবা চ্যাটে, কোথাওই চিরশ্রীর উত্তর না পেয়ে হাঁপিয়ে ওঠে মল্লার। যেদিন তাদের ফিরে আসার কথা, সেদিনই আর থাকতে না পেরে তার বাড়ির সামনে পৌঁছয় মল্লার। তার দেখা হয় প্রমিতের সঙ্গে। তার থেকেই মল্লার জানতে পারে, খুব ভাল ঘুরেছে তারা। কষ্ট হয় মল্লারের। টিউশনের বাহানা দিয়ে গভীর রাতে বারের উদ্দেশে রওনা হয় সে। নেশাকেই নিজেকে শান্ত করার একমাত্র উপায় বলে মনে হয় তার।
রাত এগারোটায় বাড়ির ডোরবেল টিপল মল্লার। সুরা তাকে কখনও কাত করতে পারে না। আজ পাঁচ পেগ গলায় ঢাললেও সে স্বাভাবিক আছে। নেশায় আচ্ছন্ন হতে পারলে বেশ হত। কিন্তু তার পা টলছে না, চোখ জড়িয়ে আসছে না। দুর্গাপুজোর পর চারটি ফাংশনে সিন্থেসাইজ়ার বাজিয়ে সে সাত হাজার রোজগার করেছিল। তার মধ্যে আজ রাতেই দেড় হাজার উড়ে গেল। টাকা তার জীবনে উড়ে আসার জন্যই আসে। শুধু কি টাকা? হে ঈশ্বর, দিয়েও এ ভাবে কেড়ে নাও কেন? এই শ্রীহীন অতিসাধারণ ছেলেটার জন্য কি কিছুই রাখোনি? মল্লার বিড়বিড় করে থেমে গেল। স্বাভাবিক থাকলেও গলা বেয়ে অবাধ্য কথারা উঠে আসতে চাইছে।
দরজা খুলে দিয়ে সবিতাকে বেজায় উৎফুল্ল দেখাল। মুখে হাসি উপচে পড়ছে।
“কী ব্যাপার? এত খুশি-খুশি মুখ কেন?”
“তুই জেঠু হয়েছিস।”
“মা... মানে?”
“দীপ বাবা হয়েছে। মেয়ে হয়েছে ওদের। রাত দশটায় দীপ ফোনে জানাল।”
মল্লার বলল, “কিন্তু এক্সপেক্টেড ডেট ডিসেম্বরের ফার্স্ট উইকে ছিল।”
“অনেক ক্ষেত্রে কিছু আগেই হয়ে যায়। দীপটা কী পাজি বল তো! সারা দিনে এক বারের জন্যও টের পেতে দেয়নি, কিচ্ছুটি জানায়নি। ও নাকি সারপ্রাইজ় দেবে বলে চেপে রেখেছিল। ঋতা যে বিকেল চারটেয় ভর্তি হয়েছে, তা-ও চেপে গেছিল।”
মল্লার স্লিপার খুলে বলল, “গ্রেট নিউজ়!”
“তোর বাবা দশটা থেকে ফোন করে যাচ্ছে তোকে। ফোন নাকি বন্ধ! দীপও তোকে বহু বার চেষ্টা করে পায়নি।”
এই সুসংবাদের জন্য আন্তরিক ভাবেই মুখিয়ে ছিল মল্লার। আনন্দের আতিশয্যে কত কিছু করবে ভেবে রেখেছিল। তেমন কিছুই যে হচ্ছে না! কে যেন তার সমস্ত আনন্দ, খুশি, হাসি ব্লটিং পেপার হয়ে শুষে নিয়েছে।
মল্লার জোর করে হাসল, “ঋতা নিশ্চয়ই খুব খুশি। ওরা দু’জনে মেয়েই চেয়েছিল।”
“হ্যাঁ। পরেরটা যেন ছেলে হয়।”
কী অদ্ভুত পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা! বংশে বাতি দেওয়ার জন্য একটা পুত্রসন্তান না হলে মন ভরে না। মায়ের আর দোষ কী! আশপাশে অনেক শিক্ষিত দম্পতিকেই পুত্রকামনায় হত্যে দিতে মানত করতে দেখেছে সে।
মল্লার বলল, “এখন সবাই একটি নিয়েই গলদঘর্ম। দিল্লি দূর অস্ত্।”
বাবা-মায়ের বাঁধভাঙা আনন্দে সে ভাবে শামিল হতে পারল না মল্লার। যথাসম্ভব হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করলেও ভিতরের শূন্যতা ভুলে থাকা যাচ্ছে না। খেয়েদেয়ে দীপকে ফোন করল মল্লার, অভিনন্দন জানাল, কৃত্রিম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল। ভিতরটা তার অসম্ভব নিরুত্তাপ, শীতল ও অসাড় হয়ে যাচ্ছে। তার ডান দিকে প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা, বাম দিকে অপ্রাপ্তির ভয়। তিরিশে নভেম্বর দু’হাজার বাইশ— এই তারিখটা সে বোধহয় কখনও ভুলতে পারবে না।
মল্লার আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। নেশা করলে ঘুম তোফা হয়। আজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘুমের দেশে যেতে চায় সে। ঘুম তবু এল না সহজে। চিরশ্রীর পরিপূর্ণ মুখ, সুন্দর চোখ দুটি বার বার ভেসে উঠছে। তার হাসির লাবণ্য, গালের গোলাপি আভা ঢেউ তুলছে গভীরে। একটি বার তাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করছে। স্বপ্নে অন্তত এক বার সেহয়তো আসবে। সেই প্রত্যাশায় ঘুমে জড়িয়ে এল মল্লারের দু’চোখ।
সুমি বলেছিল যে, দীপাবলির পরে শেয়ার মার্কেট চাঙ্গা হবে। মেয়েটার বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার দাম আছে বলতে হবে। গত চার দিনে কিঞ্চিৎ ঝুঁকি নিয়ে ভাল লাভের মুখ দেখেছে অভ্র। সেই আনন্দে সে সুমিকে কল করল, “তোমার টিপস খুব কাজে দিয়েছে। তোমাকে ট্রিট দিতে চাই।”
“এত অল্পেই ট্রিট দিতে চাইছ?”
“প্রত্যাশা কমতে কমতে যেটুকু জোটে, তাতেই খুশি থাকতে হয়,” অভ্র বলল।
“তাই?”
“হ্যাঁ। উচ্চাশার উচ্চাশয় হতাশার গর্ভাশয়। কোনও এক প্রতিবেদনে পড়েছিলাম। মনে গেঁথে গিয়েছে। ভেবেছিলাম নাইন-টেন, ইলেভেন-টুয়েলভের টিচার নেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি বেরোবে। কোনও সাড়াশব্দ নেই। উপায় না দেখে প্রাইমারি টেট-এর জন্য ফর্ম ফিল-আপ করেছি।”
“মন্দ কী!”
“ফর্ম ফিল-আপ মানেই পেয়ে যাওয়া নয়,” অভ্র বলল, “পরীক্ষাটা হয়তো হবে। রিক্রুটমেন্ট আদৌ হবে কি না, কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে না।”
“তা ঠিক।”
“তুমি অনেক দিন হল বাড়িতে আসোনি।”
সুমি বলল, “কাজের চাপ বেড়েছে। অফটাইমে হাত-পা ছড়িয়ে শুধু শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কোথাও যেতে মন চায় না।”
“তা হলে ট্রিট নেবে না?”
“না, তা নয়...” সুমি হালকা গলায় বলল, “সময় হলেই নেব। ফাটকার সাফল্যে অত খুশি হওয়ার কী আছে? ভাল কিছু হলে খাওয়াবে।”
“একটা কথা বলব?”
“বলো।”
দ্বিধাগ্রস্ত গলায় অভ্র বলল, “তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
সুমি হাসল, “এমন ভাবে বলছ যেন আমি তোমার প্রেমিকা। অত হেজ়িটেট করার কিছুআছে? আজ সন্ধে সাতটায় এসো। সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে থাকব।”
“কালীমন্দিরে? ওখানে কেন?”
সুমি বলল, “মাঝেমধ্যে ওখানে যাই।ভাল লাগে।”
“তোমার জীবনে এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও তুমি ঠাকুর-দেবতায় আস্থা রাখো?”
সুমি বলে, “রাখি।”
“আমার বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। মায়ের গোপাল-গোপাল খেলা দেখি। পুতুলখেলা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।”
সুমি বলল, “সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমি শুধু ওই সময়েই কিছু ক্ষণ বাইরে থাকি। আসবে কি না ভেবে দেখো।”
প্রথমে অনিচ্ছে থাকলেও অভ্র শেষমেশ মন্দিরে গিয়ে পৌঁছল। মার্বেল-বাঁধানো চাতালে সুমি বসে রয়েছে। আরতি শুরু হয়েছে এইমাত্র। সুমি কোনও কথা না বলে ইশারায় পাশে বসতে বলল। কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে অনেক ক্ষণ আরতি চলল।
অভ্রর খারাপ লাগছে না। সন্ধ্যারতির মধ্যে কেমন একটা ঘোর রয়েছে, মন সমস্ত কিছু ভুলে আবেশে থাকে, চার পাশটা বেশ পবিত্র লাগে। ভাল লাগার অনুভূতিতে চুপ করে মোহাবিষ্টের মতো বসে থাকল সে।
আরতি শেষ হলে প্রণাম সেরে সুমি বলল, “এখানে কেন আসি জানতে চেয়েছিলে না? এই আরতি, প্রণাম, ভক্তিভাব ইত্যাদির মধ্যে একাত্ম হতে চেষ্টা করি। নিজের মনে জোর পাই। এগিয়ে যাওয়ার, লড়ে যাওয়ার শক্তি ফিরে পাই। বিশ্বাস রাখলে আমার তো কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। বরং মানসিক শক্তি আর শান্তি সহজেই পেয়ে যাই।”
অভ্র বলল, “বুঝলাম। এ রকম ভাবে কখনও ভেবে দেখিনি।”
সুমি ঘাড় ঘুরিয়ে মৃদু হাসল, “সবাইকে এ রকম ভাবতেই হবে তা তো বলিনি। এ বার বলো, কেন দেখা করতে চেয়েছিলে?”
“এমনিই,” অভ্র সহজ হতে পারল, “বন্ধুহীন জীবন ভাল লাগে না। মনের কথা বলব এমন কেউই নেই। দেখা করতে, কথা বলতে মন চাইছে।”
“কেউ নেই?”
“না।”
“কেউ ছিল না?” সুমি অবাক চোখে তাকাল।
“দু’জন ছিল। এক জন রুমকি। চার বছর প্রেম ছিল। তার পর যা হয়। আমার চেয়ে যোগ্য এবং সফল কেউ তাকে বিয়ে করেছে।”
“আর এক জন?”
“মল্লার। ছেলেবেলা থেকে বন্ধু। আমার মতোই দশা। উচ্চশিক্ষিত বেকার। এক মাসের উপর হল তার সঙ্গে যোগাযোগ নেই।”
সুমির চোখে কৌতুক খেলা করল, “এত দিনের বন্ধুত্বে এখন কথাবার্তা নেই। আমার সঙ্গে মাত্র ক’দিনের পরিচয়। কী ভাবে বন্ধু ভেবে নিলে?”
“জানি না।”
“নারী-পুরুষ সারা জীবন গভীর বন্ধুত্ব রেখে কাটিয়ে দিতে পারে?” সুমির চোখে প্রশ্ন।
“পারে না?”
সুমি মাথা নাড়ে, “খুব কঠিন কাজ। ধরো আমার এক দিন বিয়ে হয়ে যাবে। একটা ভুলভাল বিয়ের ক্ষত নিয়ে তো আর সারা জীবন একা একা কাটাব না। দুঃখ বা শোক করে নিজেকে শুধু শুধু কষ্ট কেন দেব? আমারও শখ-সাধ-আহ্লাদ আছে। হ্যাঁ, মনের মিল হবে কি না তা বুঝে নেব আগেভাগে। অমিলের আভাস পেলে বিয়ের কোনও প্রশ্ন নেই। তার চেয়ে একা বেশ ভাল আছি। তবে দুর্গাপুরের এক ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ এসেছে।”
“জানি। মা বলেছে। শুনলাম বাড়ির লোক তোমাকে ভয়ে বলতে পারেনি।”
“আমার পিসেমশাই বলেছেন। ডিভোর্স এবং মামলার ব্যাপারে একমাত্র উনিই আমার পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছিলেন। তবে ওঁকে বলেছি যে ঘটা করে পাত্রী দেখার বিয়েতে বিশ্বাস নেই। বিয়ে যখন একটা চুক্তি, তখন আগেভাগে বোঝাপড়া করে নেওয়াই ভাল। ছেলেটি এক দিন ফোন করেছিল। তার পর থেকে মাঝেমধ্যে মেসেজে কথা চলছে। বিয়েটা হয়ে গেলে তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে পারব? তুমি পারবে?”
অভ্র থতমত, “আগে থেকে কী করে বলব?”
“তা হলে?”
এই প্রশ্নের উত্তর অভ্রর জানা নেই। নিজের মনের খবর বোধহয় সে নিজেও জানে না। সুমির প্রতিটি কথা, প্রতিটি যুক্তির কাছে সে হেরে যাচ্ছে। এই হেরে যাওয়ায় কোনও লজ্জা নেই তার।
অভ্র ধীর গলায় বলল, “তা হলে মেন্টর হয়ে থাকো। তুমি আমাকে দিশা দেখাবে, পথখুঁজে দেবে।”
“এত কঠিন দায়িত্ব সামলাতে পারব না,” সুমি লঘু চালে বলল, “যার নিজের জীবনেই দিশা নেই, সে অন্যকে পথ দেখাবে কী করে? আমাকে অত উঁচুতে তুলো না, ধপাস করে পড়ে যাব।”
“সত্যিই ফ্ল্যাট কিনবে তুমি?”
সুমি বলল, “ডিসিশন নিতে পারছি না। এই শহরে চিরদিন থাকলে তো স্থায়ী কিছুর কথা ভাবা যেত। কিছুই নিশ্চিত নয়। এ বার মেসে ফিরব। ডিউটি থেকে সোজা এখানে এসেছি। বিশ্রামনিতে হবে।”
অভ্র বলল, “বেশ। চলো, পৌঁছে দিই।”
দু’পাশের ফুটপাতে অজস্র দোকান, আলো ও মানুষের মেলা, তবু অভ্রর নিজেকেনিঃসঙ্গ লাগছিল।
সুমি জিজ্ঞেস করল, “কিছু ভাবলে?”
“কী নিয়ে?”
“কিছু তো একটা করতে হবে তোমাকে। অঢেল টাকা নিয়ে শেয়ার মার্কেটে নামলে ওটাকেই পাখির চোখ করা যেত।”
অভ্র বলল, “সামনে শুধু কুয়াশা দেখি। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।”
সুমি জিজ্ঞেস করে, “এখানকার প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে কাজ পাবে না?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভ্র, বলে, “ভেকেন্সি নেই। অ্যাডভান্সড অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে রেখেছি। অভাগা যে দিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়।”
সুমি বলল, “তোমার প্রত্যেকটা কথার আড়ালে নিরাশা কাজ করে। পজ়িটিভ হতে পারো না?”
অভ্র ধরা গলায় বলল, “খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে পজ়িটিভ থাকা যায় না।”
“আমি খাদের কিনারা থেকেই ফিরে এসে জীবনের দিকে মুখ তুলেছি। খারাপ সময় এক দিন কেটে যাবে। দেখে নিয়ো।’’
“কী জানি!”
“মেসের কাছে এসে পড়েছি। নামিয়ে দাও।”
বাইক থেকে নেমে সুমি হাসিমুখে অভ্রকেবলল, “শুভরাত্রি।”
“সেম টু ইউ,” অভ্র বাইকের মুখ ঘুরিয়ে নিল। শূন্যতার সকরুণ গান বাজছে শরীর জুড়ে। সুমি চলে যাবে এই শহর ছেড়ে। পাশে থাকার এক জনহারিয়ে যাবে।
কারও উপর সে নিজের অজান্তেই একটু বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।
ক্রমশ