ধারাবাবিক উপন্যাস পর্ব ৩৭
Bengali Novel

হাওয়ার আড়ালে

প্রায় মিনিট চল্লিশ কেটে যাওয়ার পর কস্তুরী চিন্তিত হল। এত সময় তো লাগার কথা নয়! খাবারদাবার টেবিলে সাজিয়ে টয়লেটের দরজায় টোকা দেবে কি না ভাবছে, মিশুক বেরিয়ে এল।

Advertisement

অজিতেশ নাগ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:২১
Share:

ছবি: পিয়ালী বালা।

কস্তুরী কফি বসাল। এই ঠান্ডায় এক কাপ কড়া কফি খুব কাজে আসবে। কিন্তু ও কি সকাল থেকে কিছু খেয়েছে? কস্তুরী ফ্রিজ খুলে দেখল, পাউরুটি আছে, ডিম আছে। সাদা তেলে ফ্রেঞ্চ টোস্ট মিশুকের খুব প্রিয়। তড়িঘড়ি গ্যাস জ্বালিয়ে কস্তুরী ডিম ফেটাতে লাগল।

Advertisement

প্রায় মিনিট চল্লিশ কেটে যাওয়ার পর কস্তুরী চিন্তিত হল। এত সময় তো লাগার কথা নয়! খাবারদাবার টেবিলে সাজিয়ে টয়লেটের দরজায় টোকা দেবে কি না ভাবছে, মিশুক বেরিয়ে এল। মেহুলির জামাকাপড় ওর গায়ে ঢিলে হয়েছে। তবুও একটা পাতলা জামায় কি হয়? মেহুলির প্রচুর শীতের জামাকাপড়। তার থেকে একটা দেওয়া যেত, কিন্তু এই মুহূর্তে দেহের ওম সবচেয়ে ভাল। কস্তুরী মিশুককে নিজের কোল ঘেঁষে বসিয়ে নিজের চাদর দিয়েই ঢেকে নিল আর তখনই খেয়াল করল, মিশুকের হাত কী ঠান্ডা। চোখ দুটোও লাল। কপালে হাত দিয়ে বুঝল, নাঃ জ্বর আসেনি। তা হলে সম্ভবত টয়লেটে ঢুকে খুব কান্নাকাটি করেছে ও। কিন্তু কেন? সব জানতে হবে। মিশুক একটা পাখির বাচ্চার মতো এখন কস্তুরীর বুকে লেপ্টে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। কস্তুরী কফির কাপটা তুলে নিজে হাতে ওকে এক ঢোক খাইয়ে দিল। সেই মুহূর্তে মনে হল, এ ভাবেই এক দিন সে মেহুলিকে কোলে নিয়ে ঝিনুকে করে দুধ খাইয়ে দিত।

Advertisement

প্রায় মিনিট পনেরো এই ভাবে কেটে যাওয়ার পর মিশুক মুখ তুলে কস্তুরীর চোখের দিকে তাকাল। কস্তুরী দেখল মিশুকের চোখদুটো বেশ লাল এবং ছলছল করছে। কস্তুরী এত দিনে জেনে গেছে, এ মেয়ের ভাঙতে কতটা সময় লাগে। সে আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবি?”

মিশুক ফের বুকে মুখ গুঁজে, অস্ফুটে বলল, “তুমি আজ অফিস যাবে, তাই না বিবি?”

“ইচ্ছে নেই, কিন্তু এক বার তো যেতেই হবে তিতি। তবে...”

মুখ তুলল মিশুক, “তবে?”

হেসে ফেলল কস্তুরী, “তুই বললে যাব না। কিন্তু তার আগে বল, তুই এত ভিজে গেলি কী করে?
গাড়ি নিসনি?”

“নিয়েছিলাম। কিন্তু ওই মোড়টার কাছাকাছি এসেই জল ঢুকে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। বাদ দাও না। প্লিজ়, আজ আর কোথাও যেয়ো না বিবি।”

“সে না-হয় গেলাম না। কিন্তু ঠিক কী কারণে...”

ফের বাইরের ঘোলাটে আকাশ আলোয় ঝলসে উঠল। সঙ্গে কানফাটা আওয়াজ। মিশুক সামান্য কেঁপে উঠে আরও সাপ্টে ধরল কস্তুরীকে, “দেখছ না কী অবস্থা?”

কস্তুরী বুঝল, অদ্যপি সময় ঘনাইয়াছে। সে মিশুকের ভেজা চুলে একটা চুমু খেয়ে বলল, “কী হয়েছে মা?”

অমনি বৃষ্টি নামল। মুহূর্তে মুহূর্তে তার গতিবেগ আর বারিধারায় কস্তুরীর বুকের সবটা অঞ্চল ভিজে যেন কাদা হয়ে গেল। সামান্য অবাক হলেও কস্তুরী জানে ওকে কাঁদতে দেওয়া উচিত। কোনও কারণে খুব কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। মানুষের হাসি তো সবারই জন্য। চুয়া-নন্দিনীতে চুয়ার চরিত্র সবাইকে হাসাতে হাসাতে লুটোপুটি খাইয়ে দেয়। কিন্তু কান্না! তার জন্য লুকোনোর দরকার হয়, বিশেষ এক জনের কাছে মুখ লুকিয়ে কাঁদার আয়োজন দরকার হয় প্রত্যেকটা মানুষের। কস্তুরীর দুর্ভাগ্য, তার এমন কেউ নেই, যার বুকে মুখ লুকিয়ে সে কাঁদতে পারে, কিন্তু মিশুকের জন্য সে আছে, সে থাকবে। কাঁদুক মেয়েটা, কাঁদুক প্রাণভরে। সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা লাঘব হয়ে যাক, ধুয়ে যাক। নীরবে কাঁদুক, চিৎকার করে কাঁদুক। যেমন ইচ্ছে।

ভাবতে ভাবতেই মিশুক মুখ তুলল আর ঘর ভেঙে চিৎকার করে উঠল। কস্তুরী জানে এরও দরকার আছে। সে মিশুককে ফের নিজের বুকে জড়িয়ে নিল আরও। বাইরের অনর্গল ধারাপাতের শব্দে মিশুকের কান্নার শব্দ মিশে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেতে লাগল ভাঙা কাচের মিহি টুকরোর মতো।

এর পর ঘণ্টাখানেক কেটে গেছে। বৃষ্টি এখন অনেকটা ধরে এসেছে। তবে আকাশের মুখ প্রচণ্ড থমথমে। মনে হচ্ছে ফের জল ঝরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাঘ যে ভাবে শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে সামান্য পিছনে সরে আসে, ঠিক তেমন।

মিশুক সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে আধশোয়া। ওকে বসিয়ে রেখে কস্তুরী দক্ষিণের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টির ছাঁটে বারান্দাটা জলে জলাক্কার। কস্তুরী চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। কিছু দেখার নেই। কিছু দেখছেও না সে। দেখার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে। সামনের ইলেকট্রিক তারে বর্ষণধ্বস্ত দুটো কাক ডানা নেড়ে জল ঝরিয়ে ফের উড়ে গেল নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।

সামান্য আগেই একটা বাজ পড়েছিল, তবে আর বাইরে নয়, ঘরের মধ্যেই। খুব কষ্ট করে একটা একটা করে শব্দ উচ্চারণ করে মিশুক জানিয়েছিল, সে দিন গাড়ি দুর্ঘটনার সময় সব্য একা ছিল না, পাশে একটা মেয়েও ছিল। সদ্য পুলিশ ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট পড়ে এসেছে মিশুক। খবরের কাগজেও নাকি বেরিয়েছিল কাল খবরটা, যদিও ছোট করে।

সব্য সে দিন একটা নাইট ক্লাবে গিয়েছিল। সেখানে সম্ভবত সে আকণ্ঠ মদ্যপান করে। কারণ পোস্টমর্টেমে পেটে অ্যালকোহলের মাত্রা প্রচুর ছিল। নাইট ক্লাব থেকে বেরিয়ে আফিয়া মেনন নামের একটা মেয়ের সঙ্গে একটা থ্রি-স্টার হোটেলে যায়। হোটেল রেজিস্ট্রারে সব্যসাচী বাগচী এবং আফিয়া মেননের নাম পাওয়া গেছে। সেখানে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে তারা ফের বাইরে আসে এবং চায়নাটাউনের দিকে চলে যায়। রাত আন্দাজ সোয়া তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে দুর্ঘটনাটা ঘটে বলে পুলিশের আন্দাজ। মাথায় অতিরিক্ত চোট অর্থাৎ মেজর ইন্টারনাল হেমারেজের কারণে ঘটনাস্থলে সঙ্গে সঙ্গে সব্যসাচী বাগচীর মৃত্যু হয়। আফিয়া মেনন নামক মেয়েটিকে অতি আশঙ্কাজনক হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে সে-ও মারা যায়। খবরে আরও জানা গেছে, দুর্ঘটনার সময় দু’জনের কারও সিটবেল্ট বাঁধা ছিল না। তাই এয়ারব্যাগ খোলেনি সময়মতো। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে, ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী, অতিরিক্ত মদ্যপান এবং লাগামছাড়া কার রাইডিং-এর উল্লেখ রয়েছে রিপোর্টে। পিভিডি রিপোর্টে জানা গেছে দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন সব্যসাচী বাগচীর নামেই।

দৃশ্যত স্তম্ভিত কস্তুরী সামান্য কিছু খড়কুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় বলেছিল, “পুলিশি রিপোর্টে তো কত ভুলভাল বেরোয়, হয় না কি? আর মদ খাওয়াটা তো আজকালকার ফ্যাশন। হয়তো আফিয়া মেনন মেয়েটিকে বাড়ি পৌঁছে অত রাতে বাড়ি পৌঁছে দিতে যাওয়ার সময়... হয়তো গাড়িটা ব্রেক ফেল করেছিল...”

কস্তুরীকে কথা শেষ করতে দেয়নি মিশুক। সাইডব্যাগ খুলে বার করে এনেছিল সব্যর মোবাইলটা। অভ্যস্ত হাতে প্যাটার্ন লক খুলে গ্যালারিতে চলে গিয়েছিল, আর তার পরেই মোবাইলটা তুলে দিয়েছিল কস্তুরীর হাতে। পর পর ছবি। সবগুলোই সব্যর। অবশ্য একা নয়। সঙ্গে একটি কাটা-কাটা চোখমুখের মেয়ে। বেশির ভাগ ছবিতেই দু’জনের শরীরে একটি সুতোও নেই। পর পর বেশ কিছু ছবি স্ক্রোল করে যাওয়ার পর কেন যেন গা গুলিয়ে উঠেছিল কস্তুরীর। মোবাইলটা সোফায় রেখে সে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল ভূতগ্রস্তের মতো।

কখন নিঃশব্দে মিশুক এসে দাঁড়িয়েছে পাশে, খেয়াল করেনি কস্তুরী। আলতো করে কোমরটা জড়িয়ে ধরায় চমক ভাঙল তার। মিশুকের মাথায় একটা হাত রেখে কস্তুরী বলল, “মালবাজার যাবি?”

“মালবাজার!”

গলার আওয়াজে কস্তুরী বুঝল, অনেকটা জল ঝরে যাওয়ায় আকাশ এখন ক্রমশ ফর্সা হয়ে আসছে। সে বলল, “আমার বাপের বাড়ি রে। কত কাল যাইনি। যাবি?”

“হুঁ।”

“কী করে যাবি? তোর যা শিডিউল...”

“সে আমি ম্যানেজ করে নেব।”

“তা হলে আমিও ছুটির অ্যাপ্লাই করে দিই, কী বলিস? কিন্তু যে দু’জন বাচ্চা ছেলেমেয়ে এক তলায় আছে, তাদের ছেড়ে...”

“দাদু, দিদা? সে তুমি চিন্তা কোরো না। আমার কাছে রিলায়েবল লোক আছে। ক’টা দিন তো। ঠিক ম্যানেজ করে দেবে।”

“তাই? তা হলে তো কোনও চিন্তাই নেই।”

“বিবি, মালবাজার যাওয়ার পথে নদী আছে?”

“হুঁ। আছে তো। নদী আছে, ডুয়ার্সের জঙ্গল আছে। তাতে কী?”

“আমার কাছে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট আছে। ফেলে দেব।”

বুঝল কস্তুরী। সেই ভাল। অযথা যন্ত্রণা জমিয়ে লাভ নেই। যা এই জীবনে আর দরকারি নয়, তাকে নদী, জঙ্গলে ছুড়ে ফেলে দেওয়াই ভাল। তাতে জীবন সুস্থ থাকে।

কস্তুরী বলল, “দুপুরে খিচুড়ি খাবি? রাঁধব?”

মিশুক সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল, “নাহ, বৃষ্টিটা ধরে এলে তুমি বরং অফিস যাও। আমিও কাজে যাই। অনেকটা দেরি হয়ে গেল। সাড়ে দশটায় কলটাইম ছিল।”

“এই দুর্যোগে? আকাশের অবস্থা দেখেছিস?”

কস্তুরীর মুখোমুখি দাঁড়াল মিশুক, “তাতে কী বিবি? বৃষ্টি আসবে, ঝড় আসবে, ফের চলেও যাবে। জলের ভয়ে বাড়িতে বসে থাকলে চলবে? বাইরে বেরিয়ে দেখব, তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। আমি কী বিশ্বাস করি জানো বিবি? ফার্স্ট ক্রস দ্য ডোরস্টেপ অ্যান্ড দেন স্টার্ট থিঙ্কিং।”

এই বয়সে এত ম্যাচিয়োরিটি! ভিতরে ভিতরে চমকে গেল কস্তুরী। কত দামি কথা বলল তিতি! ফার্স্ট ক্রস দ্য ডোরস্টেপ অ্যান্ড দেন স্টার্ট থিঙ্কিং! সত্যিই তো। আমাদের যত ভয় সব চৌকাঠের এ পারেই। চৌকাঠ পেরোনোর আগেই আমরা ভয়ে কেঁপে মরি। অথচ এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কতটা বেশি ভেবে ফেলছে। এরা চৌকাঠ ডিঙোতে পিছপা হয় না। আর তাই হুট বলতে মেহুলি সাগরপাড়ি দেয়, প্রচণ্ড ঝড়জল তুচ্ছ করে মিশুক পাটুলি থেকে যোধপুর পার্ক চলে আসে। কস্তুরীর মতো মানুষরাই শুধু নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বাইরে বেরোতে একশো একানব্বই বার ভাবে। ঠিকই বলেছে মিশুক। আসলে এই চৌকাঠটা পেরোতেই যত ভয়। এক বার ডিঙোতে পারলেই...

“উফ! কত ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? আমার ফ্রেঞ্চ টোস্ট তো জমে আইসবার্গ হয়ে গেল।”

হেসে ফেলল কস্তুরী, “সে নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না। চল। বানিয়ে দিচ্ছি ফের।”

বলতে বলতে ফের ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। দু’জনেই ঘরে ঢুকতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফের বারান্দার কিনারে এসে দু’টি মানুষ এক সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিল বাইরে। দুই জোড়া অসমবয়সি হাত ভিজতে লাগল অঝোর ধারায় নেমে আসা জলে।

দু’জনেই ফের হেসে উঠল। ওদের হাসির রেশ জলজ বাতাসে ভর করে ভেসে যাচ্ছিল অনেক দূরে।

শেষ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement