পূর্বানুবৃত্তি: থিয়েটার দেখতে গিয়ে সে বার হরপার্বতী আর শশিকান্ত জানতে পারে যে, অভিনেতা অমরেন্দ্রনাথ অসুস্থ। তবু দর্শকদের মুখ চেয়ে তিনি অভিনয় করেন। অভিনয় করতে করতেই তাঁর কাশির দমকে মুখ দিয়ে রক্ত ওঠে। অভিনয় সে দিনের মতো মুলতুবি হয়ে যায়। প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে শশিকান্ত হরপার্বতীর সঙ্গে বাগবাজারের বিখ্যাত রসগোল্লা খেতে যায়। সেখানে হরপার্বতীর পরিচিত জনৈক কৃষ্ণকাকার সঙ্গে তাদের দেখা হয়। কথায় কথায় জানা যায়, কৃষ্ণকাকা শশিকান্তর বাবাকে চেনেন। অন্যদিকে কনকবালা এবং তার কাকা উমানাথ, দু’জনেরই বিবাহ একে একে সম্পন্ন হয়ে যায়। উমানাথের স্ত্রীর নাম পারুল। নিভাননীর কাছে এক দিন তার সদ্য জানা এক কষ্টদায়ক তথ্য প্রকাশ করে ফেলে সে। তার স্বামী উমানাথের অন্য স্ত্রীলোক আছে।
কাগজের টুকরো দেখে অবাক নিভাননী প্রশ্ন করে, “কী এটা?”
“মেয়েছেলেটি চিঠি লিখেছে ওঁকে। আমি ওঁর পিরানের পকেটে পেয়েছি,” পারুল উত্তর দেয়।
নিভাননী দ্রুত কাগজের ভাঁজ খুলে, চিঠিটা পড়তে শুরু করে। সামান্য দু’-চার কথা। পাপড়িবাই নামে এক মহিলা অপটু হাতে বাংলা লিখেছে। দেখে মনে হচ্ছে, কোনও শিশু বুঝি বাংলা বর্ণমালা লেখা অভ্যেস করছে। চিঠিতে উমানাথের প্রতি অভিমান প্রকাশ করেছে সেই স্ত্রীলোক।
পারুলের চোখের জল মুছিয়ে, নিভাননী বলল, “সব পুরুষমানুষই এই রকম। এই জন্যই তো বলছি, নিজের পুরুষমানুষকে আঁচলে বাঁধতে শেখো।”
পারুল মাথা নাড়ে। কোনও কথা বলে না। খানিক বাদে উঠেও যায় নিভাননীর কাছ থেকে। নিভাননী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
সন্ধেবেলায় রমানাথ ঘরে ঢুকলে, নিভাননী কথাটি তোলেন তার কানে। রমানাথ চমকে যান না। বলেন, “এ কথা আমি আগেই জানি, নিভা। আমি চেষ্টাও কম করিনি উমানাথকে শোধরানোর। ওকে বড়বাজারে নিয়ে গেছিলাম এই জন্যই। ভেবেছিলাম, কাজের মধ্যে থাকলে, হাতে টাকা-পয়সা থাকলে, হয়তো বদলে যাবে উমানাথ। তা তো হলই না, উল্টে বড়বাজারে গিয়ে, খারাপ মেয়েছেলেদের বাড়িতে যেতে শুরু করল। এক বাইজিবাড়িতে যায় শুনেছি, নামটা বোধহয় পাপড়িবাই। আমাকে সব বলেছে ঘনশ্যাম। কিন্তু আমি কী করব? এখন লায়েক হয়েছে। আমার মুখের উপরও কথা বলে।”
নিভাননী অবাক হয়ে যায়। বিস্ময়ে তার মুখে কথা সরে না। অনেক কষ্টে বলে, “তুই এত সব জেনেও ওই মেয়েটির এত বড় সর্বনাশ করলি, রমা!”
রমানাথ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ বার বসে পড়লেন মাটিতে নিভাননীর সামনে। বললেন, “নিভা, তুই বিশ্বাস করবি কি না জানি না, আমি চেয়েছিলাম উমানাথের বিয়েটা যেন না হয়। বড়দাকে সে কথা বলেওছিলাম। কিন্তু বড়দা শোনেননি। বড়দা নাকি মেয়ের মামাকে কথা দিয়ে রেখেছেন। বল তুই, আমি কী করতে পারি?”
নিভাননী আবার বলেন, “তুইও আর আগের মতো নেই রমা। বাড়ির দিকে, সংসারের দিকে একদম নজর নেই তোর। নীলুটা তো দেশোদ্ধারে মেতে আছে, তার তো প্রথম থেকেই সংসারে মন নেই। তোরও যদি না থাকে, তা হলে সংসারটা যায় কোথায়?”
“ভাল লাগে না রে, কিছুই ভাল লাগে না,” রমানাথ বলেন, “শুধু বাগবাজারে মায়ের কাছে গেলে একটু শান্তি পাই।”
“তা বললে হবে কেন রমা? তোর ছেলেটা বড় হচ্ছে...” নিভাননী বলে।
শুনে রমানাথ হাসতে হাসতে বলেন, “শশী বড় হচ্ছে কী রে? বড় হয়ে গেছে।”
নিভাননীও হাসে। বলে, “হ্যাঁ, সে দিনের ছোঁড়া, দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। এখন কলেজে যাচ্ছে।”
রমানাথ এ বার উঠে পড়েন। লম্বা দালান পেরিয়ে তাঁর ঘরে যান। নিভাননী একা বসে থাকে। তার নিজেরও আর ভাল লাগে না। রমা যদি বাগবাজারে মায়ের কাছে গিয়ে শান্তি খুঁজে পায়, সে-ই বা যাবে না কেন? রমাকে বললে, সে কি এক দিন তাকে নিয়ে যাবে না? চোখে দেখতেও ইচ্ছে করে। অত বড় সিদ্ধপুরুষের স্ত্রী বলে কথা! রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে এক বার স্বচক্ষে দেখা হল না। বাবা দেখেছিলেন। দেওয়ান বাড়িতে যখন ঠাকুর এসেছিলেন, বাবা দেখতে গিয়েছিলেন। দিব্যি কথা বলছিলেন ভক্তদের সঙ্গে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকল। সবাই বলল, ভাবসমাধি হয়েছে ঠাকুরের। এই গল্প যে কত বার শুনেছ সে বাবার কাছে!
হঠাৎ নিভাননীর খেয়াল হয়, বাইরের দরজায় কেউ যেন কড়া নাড়ছে। উঠে পড়ে সে। দরজা খুলে দেখে, শশী দাঁড়িয়ে। সঙ্গে একটি ছেলে। ফর্সা, রোগাটে চেহারা।
নিভাননী কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই শশিকান্ত আলাপ করিয়ে দেয় ছেলেটির সঙ্গে। বলে, “আমার বন্ধু। ওর নাম মতিরুল ইসলাম। ও আজ এ বাড়িতে থাকবে।”
নিভাননী ছেলেটির দিকে চেয়ে একটু হাসলেন। তার পর শশিকান্তকে বললেন, “বন্ধুকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসা। আমি খাবার নিয়ে যাচ্ছি।”
শশিকান্ত মতিরুলকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসানোর সঙ্গে সঙ্গেই পিসিমার ডাক, “শশী, এক বার ইদিকে আয় তো।”
রান্নাঘরে শশী আসতেই, নিভাননী চাপা গলায় বললেন, “তোর কী আক্কেল, শশী?”
শশী ভয়ে ভয়ে বলল, “কেন কী করলাম আমি?”
নিভাননী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “বলা নেই কওয়া নেই একটা মুসলমান ছেলেকে ঘরে নিয়ে চলে এলি, আবার জিজ্ঞেস করছিস, কী করলাম!”
শশিকান্ত তর্ক জুড়ে দেয়, বলে, “মুসলমান বলে কি ও মানুষ নয়?”
“দেখ শশী, তর্ক করবি না। আমি মানুষ নয় বলিনি। আমাদের হিন্দু ঘর। মুসলমান ঘরের ছেলে তোর বন্ধু হতে পারে না।”
শশিকান্ত দৃঢ় গলায় বলে, “এ তোমার ভুল ধারণা পিসি। মুসলমানরা আমাদের শত্রু নয়। আমাদের ধর্মের কিছু শয়তান লোক আমাদের এটা বুঝিয়ে এসেছে। ওদের ধর্মেরও কিছু লোক ওদের এত কাল বুঝিয়ে এসেছে যে, হিন্দুরা ওদের শত্রু।”
নিভাননী কোনও উত্তর দেয় না। সামনের দিকে চেয়ে থাকে নিষ্পলক। তার চোখের দিকে তাকিয়ে শশিকান্ত বুঝতে পারে যে, ঠিক তার পিছনেই কেউ এক জন এসে দাঁড়িয়েছে। পিসিমা তার দিকেই চেয়ে আছে। মুহূর্তে, তার মনে হল, বুঝি মতিরুলই তার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে, তাকে খুঁজতে এখানে চলে এসেছে। তার মানে, সব কথা মতিরুল শুনে ফেলেছে। ছি ছি, এমন হবে জানলে সে মতিরুলকে আনতই না এ বাড়িতে, এই সব ভাবতে ভাবতে পিছনে তাকাতেই চমকে গেল শশিকান্ত। বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন অনেক ক্ষণ। গম্ভীর মুখ। শশিকান্তর মুখ দিয়ে কথা সরছে না। অনেক কষ্টে বলার চেষ্টা করল, “বাবা—”
তাকে থামিয়ে রমানাথ বলে উঠলেন, “ছেলেটির নাম কী?”
“মতিরুল। মতিরুল ইসলাম।” শশিকান্ত বলল।
“না, এ বাড়িতে ওর নাম মতিলাল গাঙ্গুলি। এই নামে এক দিন কেন, দশ দিন সে এ বাড়িতে থাকতে পারে। কেউ জিজ্ঞেস করলে, এই নামটি যেন সে বলে, এটা তাকে বলে দিয়ো।”
“মিথ্যে বলবে?”
“জীবনে ভাল কিছু পাওয়ার জন্য যদি সামান্য মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়, তাতে ক্ষতি কী?”
রমানাথ আর দাঁড়ান না। সদর দরজার দিকে এগিয়ে যান। তার পর কী মনে করে, পিছিয়ে আসেন। নিভাননীকে কাছে ডাকেন। নিভাননী কাছে এলে বলেন, “উমানাথ এলে সাবধান। সে যেন ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে যে, শশী তার মুসলমান বন্ধুকে বাড়িতে এনেছে।”
নিভাননী মাথা নাড়েন। কিছু একটা বলেন, সেটা শশিকান্ত শুনতে পায় না। সে তার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ঘরে এসে শশিকান্ত দেখে মতিরুল জানালার কাছে দাঁড়িয়ে। শশিকান্তর পায়ের শব্দ তার কানে যায় না। নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে এক ভাবে। শশিকান্ত পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে, “কী দেখছিস?”
“সূর্যাস্ত,” মতিরুল বলে, “তোর এই ঘরটা কী সুন্দর রে শশী! কত সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যায়।”
“হ্যাঁ, পশ্চিম দিকের ঘর তো! সেই জন্যই...” শশিকান্ত বলে।
“জানিস শশী, জাহিদপুরে আমাদের বাড়িতেও এ রকম একটা পশ্চিমের ঘর আছে। ঘরটা অবশ্য আমার চাচার। সেই ঘর থেকেও এ রকম সূর্য অস্ত যাওয়া দেখতাম,” জানালা থেকে পশ্চিমাকাশের দিকে তাকিয়ে মতিরুল বলে।
“সূর্যাস্ত পরে দেখবি। এখন একটু এ দিকে আয়। তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে,” বলে মতিরুলকে একটা চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করে শশী।
মতিরুল অবাক হয়ে জানালার কাছ থেকে সরে শশিকান্তর দেখানো চেয়ারে বসে পড়ে। তার মুখে চোখে উদ্বেগ। বলে, “কী হয়েছে?”
শশিকান্ত খানিক ক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “এখানে তোর নাম মতিলাল। কেউ জিজ্ঞেস করলে তা-ই বলবি।”
“কেন?” মতিরুল যথেষ্ট অবাক হয়েছে।
“দেখ, সবই তো বুঝিস। এটা হিন্দুদের বাড়ি। এক জন অহিন্দু এখানে থাকলে...”
শশিকান্তকে শেষ করতে না দিয়ে মতিরুল বলে ওঠে, “বেশ থাকব না। তোদের বাড়ির লোকজনের যদি অসুবিধে হয়, আমি থাকব কেন। আর মিথ্যে কথা বলব কেন?”
শশিকান্ত বুঝতে পারে না, কী উত্তর দেবে। তার নিজেরও এক বার জাহিদপুরে মতিরুলের বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। আজ যদি মতিরুল রাগ করে এ বাড়ি থেকে চলে যায়, সে কি আর কোনও দিন ওর বাড়িতে যেতে পারবে? কলেজে মতিরুলের সামনে মুখ দেখাবে কী করে! তবু তাকে চেষ্টা করতে হবে, মতিরুল যেন তাকে ভুল না বোঝে।
মতিরুলের পিঠে হাত রেখে বলে, “তুই একটু বোঝার চেষ্টা কর, মতিরুল। একটু সহযোগিতা কর। তোকে শুধু এক জনকে মিথ্যে কথা বলতে হবে। তাও উনি যদি এ ঘরে আসেন। বাকি বাড়ির সবাই জানে যে, তুই মুসলমান, এমনকি আমার বাবাও।”
অবাক হয়ে তাকায় মতিরুল।
শশিকান্ত বলে চলে, “হ্যাঁ, বাবাই তোর মতিলাল নামটা দিয়েছেন।”
মতিরুল কিছু বলার আগে, মুড়ি আর হালুয়া নিয়ে পিসিমা ঘরে ঢোকেন। দু’জনের সামনে দুটো বাটি রেখে মতিরুলকে বলেন, “অনেক গল্প হয়েছে। এ বার কিছু খেয়ে নাও। মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে, অনেক ক্ষণ কিছু খাওয়া হয়নি।”
মতিরুল কোনও উত্তর দেয় না। হাসে।
পিসিমা বলে, “তা বাবা, তোমার নামটা যেন কী বললে তখন। বয়স হয়েছে তো, ঠিক মনে রাখতে পারি না।”
মতিরুল গম্ভীর ভাবে উত্তর দেয়, “তখন আমি বলিনি, পিসিমা। শশী আমার নাম বলেছিল। ও বলেছিল, আমার নাম মতিরুল। আসলে আমার নাম মতিলাল।”
পিসিমার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বলেন, “বেঁচে থাকো বাবা। তোমার ভাল হোক।”
পিসিমা চলে গেলে, মতিরুলকে জড়িয়ে ধরে শশিকান্ত। বলে, “তোর কাছে আমি চিরঋণী হয়ে থাকব রে।”
মতিরুল কোনও উত্তর দেয় না। তার চোখের কোণে জল চিকচিক করে।
২৭
“আপ বঙ্গাল কা আদমি হ্যায়, কেয়া?”
সন্ন্যাসীর কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে গেল অমরেন্দ্রনাথ। তার বেশভূষা দেখে ও কথাবার্তা শুনে তো কারও মনে হওয়ার কথা নয় যে সে বাঙালি। তবে? তবে, এই সন্ন্যাসী কি সর্বজ্ঞ— সব জানেন, সব বুঝতে পারেন? নিজেকে একটু সামলে, অমরেন্দ্রনাথ হিন্দিতে উত্তর দিলেন, “না, আমি বাংলার লোক নই, তবে বাংলায় অনেক দিন ছিলাম।”
সন্ন্যাসী হাসলেন। বললেন, “বাংলার লোকদের মন খুব নরম হয়, তাদের মধ্যে খুব দয়ামায়া থাকে। তুমি বাংলায় ছিলে বলে, মানুষকে দয়া করতে শিখেছ।”
অমরেন্দ্রনাথ কোনও উত্তর না দিয়ে, চুপ করে রইলেন। প্রায় সপ্তাহ খানেক হল তিনি কানপুরে এসেছেন।
ক্রমশ