ছবি কুনাল বর্মণ।
কানপুরে এসে অবধি হাঁটতে হাঁটতে সন্ন্যাসীদের ডেরা খোঁজা তাঁর অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুঁজতে খুঁজতে একটা আশ্রম পেলেন বটে, কিন্তু জনমানবশূন্য। অবাক হয়ে আশ্রমে ঢুকতে তার চক্ষু চড়কগাছ। দেখেন, একটি ঘরে এক সন্ন্যাসী শুয়ে আছেন।
এক পলক তাকিয়েই অমরেন্দ্রনাথ বুঝে গেলেন যে, সন্ন্যাসীর মায়ের দয়া হয়েছে। মুহূর্তকাল ভাবলেন অমরেন্দ্রনাথ। মায়ের দয়া ছোঁয়াচে রোগ। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে এই মহামারিতে। এখানে থাকলে তাঁর শরীরেও এই রোগের সংক্রমণ ঘটবে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবু এই অবস্থায় সন্ন্যাসীকে ফেলে চলে যেতে তার মন চাইল না।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন সন্ন্যাসীর কাছে। কপালে হাত দিয়ে দেখলেন, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে সন্ন্যাসীর। সঙ্গে সঙ্গে স্থির করে নিলেন তিনি কী করবেন। ঘরের কোণে একটা জালায় জল ছিল। সেই জল ফেলে দিয়ে জল ভরে আনলেন। তার নিজের পরিধেয় বস্ত্র থেকে খানিকটা ছিঁড়ে নিয়ে জলে ভিজিয়ে সন্ন্যাসীর মাথায় জলপট্টি দিতে শুরু করলেন। জালা থেকে জল নিয়ে সেই জল সন্ন্যাসীকে খাওয়ানোর চেষ্টাও করলেন। তার পর নিমপাতার সন্ধানে আশ্রমের চার পাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। খুঁজতে খুঁজতে একটা নিমগাছ পেয়েও গেলেন। পাতা-সহ নিমের ডাল ভেঙে নিয়ে এসে সন্ন্যাসীর সারা দেহে বুলিয়ে দিতে লাগলেন। তিন দিন পর সন্ন্যাসী চোখ চাইলেন। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে অমরেন্দ্রনাথের জোগাড় করা কিছু আহার্য গ্রহণ করলেন। এক সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে হাঁটা-চলাও শুরু করে দিলেন।
অমরেন্দ্রনাথের স্মৃতিপটে এই সাত দিন যেন অনেক দিন। অমরেন্দ্রনাথ সন্ন্যাসীর শেষ কথার উত্তর দিলেন। বললেন, “সেবা মানুষের পরম ধর্ম। আমি এটুকুই করেছি। এর বেশি কিছু নয়।”
সন্ন্যাসী বললেন, “এই ধর্মই বা ক’জন মানুষ পালন করে? তা ছাড়া তুমি নিজের জীবনের কথা না ভেবে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। গভীর মানবিকতা বোধ না থাকলে এমন কাজ কেউ করতে পারে না। তুমি সামান্য মানুষ নও। তুমি জানো না, তুমি কত বড়। তুমি আমার কাছে কী চাও বলো। আমার সাধ্যে কুলোলে, তা আমি তোমাকে দিয়ে যাব।”
অমরেন্দ্রনাথ বললেন, “মহারাজ, আপনার কাছে কিছুই চাই না, শুধু চাই, আপনার সঙ্গে এই আশ্রমে থাকতে।”
সন্ন্যাসী হাসলেন। শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখে। সেই আলোয় ওঁর হাস্যময় মুখ বিষণ্ণ লাগল অমরেন্দ্রনাথের। বললেন, “আমার নিজেরও যে ঠাঁই নেই, বৎস। কাল প্রত্যুষে আমি এখান থেকে চলে যাব। আমি যাব পুবে। তোমার গন্তব্য হবে দক্ষিণে। সরযূ নদীর পাড় বরাবর হেঁটে গেলেই মিলবে তোমার ঠাঁই। সেই স্থানই তোমার পক্ষে নিরাপদ।”
অমরেন্দ্রনাথ বিস্মিত হলেও, মুখে চোখে সেটা প্রকাশ করলেন না।
সন্ন্যাসীও আর কোনও কথা না বলে দাওয়ায় নেমে ধ্যানে বসলেন।
সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠতে কিছুটা দেরি হয়ে গেল অমরেন্দ্রনাথের। উঠে দেখলেন, সন্ন্যাসী বিদায় নিয়েছেন। আগেই জানিয়েছিলেন, তবু মনটা কী রকম বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। নিজেও প্রস্তুত হলেন বিদায় নেওয়ার জন্য। হঠাৎ নজরে এল একটা কমণ্ডলু। ভুল করে ফেলে গেলেন সন্ন্যাসী, নাকি তার জন্য রেখে গেলেন? বিদায়ের পূর্বে দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে কমণ্ডলুটি তুলে নিয়ে সন্ন্যাসী নির্দেশিত পথে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। পথ যেন আর শেষ হয় না। হেঁটেই চলেছেন সরযূর পাড় বরাবর দক্ষিণ দিকে। পথে দু’বার বিশ্রাম নিয়ে আবার হেঁটেছেন।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধের মুখে একটি আশ্রমের সন্ধান পেলেন অমরেন্দ্রনাথ। আশ্রমটি বড়। সন্ধেবেলাতেও প্রচুর লোকজনের ভিড় সেখানে। ক্লান্ত পায়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যান অমরেন্দ্রনাথ। একটি লোক তার পথ আগলে দাঁড়ায়।
বলে, “অন্দর কিঁউ যা রহে হ্যায়?”
একটুও বিব্রত না হয়ে অমরেন্দ্রনাথ বলেন, “মহারাজ আমাকে ডেকেছেন।”
লোকটি সরে যায়। অমরেন্দ্রনাথ এগিয়ে যান সামনের দিকে, যেখানে এক দীর্ঘকায়, সৌম্যদর্শন সন্ন্যাসী আসনে উপবিষ্ট। অমরেন্দ্রনাথকে দেখে সন্ন্যাসী অবাক হলেন না। এমন ভাব করলেন, যেন তিনি জানতেন, এই লোকটি তার কাছে আসবে। মৃদু হাস্যে জিজ্ঞেস করলেন, “কেয়া মাঙতা বেটা?”
অমরেন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “আমি এই আশ্রমে থাকতে চাই মহারাজ। আপনাকে আপনার কাছে থাকতে দিন।”
“এই আশ্রমে যারা থাকে, তারা কাজ করে। তুই কী কাজ করতে পারবি?”
“আমি সব কাজই জানি। যা কাজ দেবেন, আমি তা-ই করব।”
“বেশ, কাল থেকে তুই আশ্রমের চার পাশ পরিষ্কার করবি।”
খুব ভোরবেলায় উঠে কাজে লেগে গেলেন অমরেন্দ্রনাথ। খানিক ক্ষণ কাজ করার পর মহারাজ স্বয়ং এলেন তার কাজ দেখতে। খানিক ক্ষণ তার কাজ দেখার পর বললেন, “রুখ যা বেটা, এ কাম আপ কা নেহি হ্যায়।”
অমরেন্দ্রনাথ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। বললেন, “সব ঠিক হয়ে যাবে, মহারাজ। আসলে, এই প্রথম ঝাঁটা হাতে ধরলাম তো।”
মহারাজ অমরেন্দ্রনাথের কোনও অজুহাত না শুনে চলে গেলেন সেখান থেকে। বিকেলবেলায় তাঁকে বললেন, “তুই আজ থেকে বাসন মাজার কাজটা কর। এটা পারবি তো?”
জীবনে কখনও তাকে বাসন মাজতে হয়নি। তবু মহারাজের প্রশ্নে তিনি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন।
পরের দিন সকালে ভক্তসমাগম শেষ হলে, মহারাজ অমরেন্দ্রনাথকে ভর্ৎসনা করে বললেন, “তুই কিছুই পারবি না। বাসন মাজার মতো সহজ কাজও তুই করতে পারিস না।”
অমরেন্দ্রনাথ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন। কোনও উত্তর দেন না। তিনি জানেন, তার কোনও অজুহাতই মহারাজের কোপ থেকে তাকে বাঁচাতে পারবে না। আশ্রম থেকে বিতাড়ন তার নিশ্চিত।
খানিক ক্ষণ নীরব থেকে মহারাজ বললেন, “পড়াই-লিখাই জানতে হো?”
অমরেন্দ্রনাথ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তেই, মহারাজ বললেন, “কাল থেকে আমার পাশে বসে শাস্ত্র অধ্যয়ন করবি। পাঠ করে আমাকে শোনাবি।”
অবিশ্বাস্য! এমনটা যে মহারাজ বলবেন, ভাবতেই পারেননি অমরেন্দ্রনাথ। তিনি ভাবছিলেন, মহারাজ তাড়িয়ে দেবেন, কিন্তু তিনি আদর করে কাছে ডেকে নিলেন।
মহারাজের এই সিদ্ধান্তে অন্য সাধু-সন্ন্যাসীরা মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তাঁদের রুষ্ট হওয়ার অন্য কারণও ছিল। মহারাজের পদসেবার ভারও যে মহারাজ অমরেন্দ্রনাথের উপর ছেড়েছেন। যে সাধুটির উপর এই ভার ন্যস্ত ছিল, তিনি ক্রুদ্ধ হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। কিন্তু মহারাজের মুখের উপর কথা বলা যায় না বলে, অন্য সাধুদের কাছে উষ্মা প্রকাশ করছিলেন। মহারাজ সব জানতে পারলেন। এক দিন সেই সাধুটিকে ডেকে বললেন, “সন্ন্যাসীদের উষ্মা প্রকাশ মানায় না। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য— এই ছয় রিপু ত্যাগ করতে না পারলে তোর কিসের সন্ন্যাস?”
সাধুটি মাথা নিচু করে তাঁর অপরাধ স্বীকার করে নিলে, ব্যাপারটা মিটে যায়।
আশ্রমে ভক্তসমাগম লেগেই থাকে। সে দিনও অনেক ভক্ত ভিড় করেছিল। ভজন ও নামগানে আশ্রম ছিল মুখরিত। হঠাৎ এক দল পুলিশের আগমনে সেই সুরটা যেন কেটে গেল। অবশ্য আশ্রমে পুলিশের আগমন নতুন কিছু নয়। নতুন কোনও সাধু এলেই ওরা খোঁজ নিতে আসে। এ বার পুলিশের দলটি বেশ ভারী। তাদের কাছে খবর গেছে, আশ্রমে নতুন সাধু এসেছেন। দলটির নেতৃত্বে যে পুলিশ অফিসার, তার সঙ্গে মহারাজের পূর্বালাপ আছে। তিনি মহারাজের ভক্তও বটে। কাছে এসে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন মহারাজকে। বললেন, “আপনাকে আবার বিরক্ত করতে এলাম।”
মহারাজ হাসলেন, বললেন, “কোই নবীন সন্তকে লিয়ে?”
“ঠিক ধরেছেন, মহারাজ,” হাসতে হাসতে বললেন অফিসার, “আমাদের কাছে খবর আছে, এখানে এক জন নতুন সাধু এসেছেন।”
চোখে যেন বিস্ফোরণ ঘটল মহারাজের। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন অফিসারের দিকে। বললেন, “ঝুট বাত মাত বোল। ইধার কোই নবীন সন্ত নেহি আয়া।”
বকুনি খেয়ে অফিসার চমকে গেলেও, সামলে নিলেন। বললেন, ‘‘মহারাজ, আপনার পাশে যে সাধুটি বসে আছেন, তাকে তো আগে দেখিনি।’’
মহারাজ অমরেন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, “উয়ো ভি পুরানা হ্যায়।”
অফিসার অমরেন্দ্রনাথের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তার পর মহারাজের দিকে ফিরলেন। হাতজোড় করে বললেন, “মাফ কর দিজিয়ে মহারাজ, গলতি হো গয়া।”
মহারাজ হাত তুলে “ঠিক হ্যায়,” বলতে অফিসার ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। সঙ্গে তার দলটিও। সর্বশেষ লোকটি চলে গেলে, মহারাজ চোখ বুজলেন। ধ্যানে বসলেন।
সন্ধেবেলায় একান্তে মহারাজকে জিজ্ঞেস করলেন অমরেন্দ্রনাথ, “পুলিশের কাছে আপনি মিথ্যে বললেন কেন?”
মহারাজ হাসলেন। বললেন, “হাম ঝুট নেহি বোলা। তুম প্রাচীন সন্ত হ্যায়। জনম জনম সে তুম সন্ত হ্যায়।” তার পর খানিক ক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “লেকিন তুমহারে লিয়ে ইয়ে স্থান ঠিক নেহি হ্যায়, বেটা তু ভাগ যা।”
“আমিও তা-ই ভাবছি মহারাজ। কাল প্রত্যুষে আমি বিদায় নেব। আপনার স্নেহ আমি কোনও দিনও ভুলব না...” বলতে বলতে অমরেন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর ধরে এল। তিনি কোনও রকমে সংযত করলেন নিজেকে। তাকিয়ে দেখলেন, মহারাজের দুই চোখ বোজা। তিনি ধ্যানস্থ।
পরের দিন সূর্য ওঠার আগেই নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে পড়লেন অমরেন্দ্রনাথ। সামনে অন্ধকার। এই অন্ধকার ফুঁড়েই সূর্য উঠবে আর খানিক ক্ষণ পর। অমরেন্দ্রনাথ আশ্রমের দিকে ফিরলেন এক বার। আর হয়তো কোনও দিন এখানে আসা হবে না। তাই বিদায়ের আগে এক বার দেখে নেওয়া। অনেকটা দূর চলে এসেছেন। এখান থেকে একটা বাঁক নিলেই অন্য রাস্তা। তখন আর এই আশ্রমটিকে দেখতে পাওয়া যাবে না। আশ্রমের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলেন অমরেন্দ্রনাথ। ভুল দেখছেন না তো? তাঁর মনে হল, আশ্রমের প্রধান ফটকে কেউ এক জন দাঁড়িয়ে। এত দূর থেকে ঠাহর করা যায় না, তবুও অমরেন্দ্রনাথের মনে কোনও সন্দেহ থাকে না কে তিনি। দূর থেকেই তাঁকে প্রণাম জানিয়ে অমরেন্দ্রনাথ আবার যাত্রা শুরু করেন।
২৮
রমানাথের শরীর আবার খারাপের দিকে। পুরনো রোগ ফিরে এসেছে। পেটে অসহ্য ব্যথা। তার সঙ্গে ঘুসঘুসে জ্বর। ডাক্তার ওষুধ দিচ্ছে। তবে তাতে কাজ হচ্ছে কম। ডাক্তার বায়ু পরিবর্তনের নিদান দিয়েছে। রমানাথের ইচ্ছে নেই কোথাও যাওয়ার। তিনি আজকাল শুধু মায়ের বাড়িতেই যেতে চান। তার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, মায়ের আশীর্বাদ পেলেই তার শরীর থেকে সব রোগ চলে যাবে। সেই উদ্দেশ্যে জ্বর গায়ে আজ মায়ের বাড়িতে এসেছেন রমানাথ। আজ বাগবাজারে আসার তাঁর আরও একটা কারণ আছে। চন্দ্রমোহন দত্তের গৃহপ্রবেশ আজ। রমানাথ সেখানে উপস্থিত না হলে খুব দুঃখ পাবে চন্দ্রমোহন।
অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্যে চন্দ্রমোহনের এই বাড়ি। শ্রীমায়ের স্নেহের পরশ জড়িয়ে আছে এই বাড়ির সঙ্গে। চন্দ্রমোহন গৃহহারা হলে, শ্রীমা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তিনি চন্দ্রমোহনকে বাড়ি করে দেবেন। আদুল-মৌড়ীর জমিদারকে চিঠি লিখলেন জমির জন্য। কারণ, তিনি জানতেন যে, তাঁদের বাগবাজারে অনেক জমিজমা আছে।
বোসপাড়ায় সাত কাঠা জমি তাঁরা দান করলে, সেখানে শুরু হল চন্দ্রমোহনের বাড়ি। বাড়িটা অবশ্য তিন কাঠা জায়গার উপর। বাকি জায়গাটায় চন্দ্রমোহনের ছেলেমেয়েরা খেলাধুলো করবে, এমনটাই ইচ্ছে মায়ের। মা শরৎ মহারাজকে ডেকে এক দিন বললেন, “দেখ শরৎ, বাড়িওয়ালা চন্দুর খোকাখুকুর খেলা বন্ধ করে দিয়েছিল। বেচারিদের খুব কষ্ট হয়েছিল। তাই আমি চাই, চন্দুর বাড়ির সামনে ওই ফাঁকা জায়গাটাতে ওরা খেলাধুলো করুক। ওখানে ওরা দৌড়োদৌড়ি করলে আমার খুব ভাল লাগবে।”
“তাই হবে মা,” বলে শরৎ মহারাজ চলে গিয়েছিলেন এবং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে চন্দ্রমোহনের বাড়ি করে দিয়েছিলেন।
বাড়ি তৈরির সময় মাঝে মাঝেই রমানাথ এসে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে গেছেন মিস্তিরিদের। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মিস্তিরিদের কাজ দেখেছেন। চন্দ্রমোহনের মতো তিনি নিজেও অপেক্ষা করেছিলেন, কবে বাড়ির কাজ শেষ হবে। সেই কাজ শেষ হয়েছে। আজ গৃহপ্রবেশ।
গৃহপ্রবেশে চন্দ্রমোহনের যত না আনন্দ, তার চেয়ে বেশি আনন্দ শ্রীমায়ের। শরৎ মহারাজকে ডেকে বললেন, “চন্দুর নতুন বাড়িতে যেন ঠিকমতো পুজো হয়, তুমি দেখো। সমস্ত আচার মেনে যেন হোমযজ্ঞ করা হয়।”
“আপনি চিন্তা করবেন না মা, আমি যেমন দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ি তৈরি করে দিয়েছি চন্দ্রমোহনের, তেমনই পুজোও করাব দাঁড়িয়ে থেকে,” বলে চলে যাচ্ছিলেন শরৎ মহারাজ। শ্রীমায়ের ডাকে ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, “ডাকলেন মা?”
শ্রীমা বললেন, “হ্যাঁ, তোমায় পেছু ডাকলাম। তুমি একটু চন্দুকে এবাড়ি পাঠিয়ে দিয়ো তো।”
“আচ্ছা,” বলে শরৎ মহারাজ চলে গেলে শ্রীমা জপ করতে বসেন। শরৎ মহারাজের কাছে যখন শুনলেন মা ডাকছেন, চন্দ্রমোহন তখন পড়িমড়ি করে দৌড়লেন মায়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। এসে দেখেন মা জপে বসেছেন।
চন্দ্রমোহন অপেক্ষা করেন। জপ শেষ হলে, শ্রীমা চোখ খুলে চন্দ্রমোহনকে দেখে বলেন, “চন্দু, তোমাকে আমি পরম মূল্যবান একটি জিনিস দেব বলে ডেকেছি। যত্ন করে রেখো।”
চন্দ্রমোহনের হাতে মা সারদা একটি পট তুলে দিয়ে বলেন, “মূল্যবান বললাম এই কারণে যে, এই পট উনি নিজে পুজো করতেন। এখন আমিও করি। আজ থেকে তোমার বাড়িতে এই পট পূজিত হোক, এই আমার ইচ্ছে।”
অশেষ কৃতজ্ঞতায় মাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিল চন্দ্রমোহন। মাথায় ঠেকাল পট। তার চোখ অশ্রুসিক্ত। এই কৃপার কি সে যোগ্য! ভাবতে ভাবতে সে তার নতুন বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
বাড়িতে পুজোর আয়োজন চলছে। গণেন মহারাজ বসেছেন পুজোয়। মায়ের নির্দেশ, পুজোয়। যেন কোনও ভুলত্রুটি না হয়। গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে চন্দ্রমোহনের বাড়িতে লোকসমাগমও কম হয়নি।
ক্রমশ