Bengali Serial Novel

খরস্রোত

গড়গড়ার নলটা এক পাশে সরিয়ে রেখে অবিনাশ কবিরাজ বলে উঠলেন, “আবার জ্বালাতে এলেন। বেশ ছিল গ্রামটা। আবার অশান্ত হয়ে উঠবে। অল্পবয়সি ছেলেগুলোর মাথা খাবেন।”

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৪ ০৯:০৫
Share:

ছবি কুনাল বর্মণ।

লাবণ্যর বাবা অবিনাশ কবিরাজ গড়গড়ায় তামাক খাচ্ছিলেন। শশিকান্তকে দেখে বললেন, “কী ব্যাপার, শশিকান্ত? বাড়িতে সবাই কুশল তো?”

Advertisement

শশিকান্ত হেসে বলল, “হ্যাঁ জেঠামশাই, বাড়িতে সবাই ভাল। আমি একটা অন্য খবর দিতে এলাম।”

“তাই নাকি? তা কী খবর, চট করে বলে ফেলো দেখি...” তামাক টেনে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন অবিনাশ কবিরাজ। তত ক্ষণে লাবণ্য ও লাবণ্যর মা এসে দাঁড়িয়েছেন শশিকান্তর সামনে। শশিকান্ত অবিনাশজেঠু ও জেঠিমাকে প্রণাম করে তার প্রথম হওয়ার খবরটা দিল। এক ঝলক লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে দেখল, তার মুখে হাসি।

Advertisement

“দাঁড়াও শশীদা, আমি তোমার জন্য মিষ্টি নিয়ে আসি...” বলে লাবণ্যময়ী ভিতরে যাচ্ছিল, শশিকান্ত তাকে নিবৃত্ত করল। বলল, “না রে লাবণ্য, মিষ্টি আমি পরে এসে খাব। আমি আর একটা খবর দিই। আমার জেঠামশাই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।”

গড়গড়ার নলটা এক পাশে সরিয়ে রেখে অবিনাশ কবিরাজ বলে উঠলেন, “আবার জ্বালাতে এলেন। বেশ ছিল গ্রামটা। আবার অশান্ত হয়ে উঠবে। অল্পবয়সি ছেলেগুলোর মাথা খাবেন।”

শশিকান্তর খুব রাগ হল। সাধারণত বড়দের মুখের উপর সে কোনও কথা বলে না। আজ আর না উত্তর দিয়ে পারল না। বলল, “জেঠামশাই, আপনি কি চান, আমাদের উপর অত্যাচার করে, আমাদের সম্পদ লুঠ করে ইংরেজরা বড়লোক হবে, আর আমরা সব মেনে নিয়ে তাদের দাসত্বই করে যাব?”

থমকে গেলেন অবিনাশ কবিরাজ। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন শশিকান্তর দিকে। তার পর মৃদু হেসে বললেন, “দেখো, কী ভাবে তোমার মাথাটা খেয়েছেন ভদ্রলোক। তুমি এখন ঠিক বুঝবে না, কারণ তোমার বয়স অল্প। এক দিন ঠিকই বুঝবে।”

শশিকান্ত নিরুত্তর থাকে। শুধু লাবণ্যর জন্য এ বাড়িতে আসা। না হলে কে আসত এখানে!

অবিনাশ কবিরাজ আবার গড়গড়ায় ফিরে গেছেন। গুড়গুড় আওয়াজ হচ্ছে। শশিকান্ত উঠব-উঠব করছে, এমন সময় অবিনাশ কবিরাজ আবার বলে ওঠেন, “এ ভাবে কি দেশ স্বাধীন হয়! পাঁচটা ইংরেজ মারলেই যেন সব হয়ে যাবে! মাঝখান থেকে কিছু ছেলের ভবিষ্যৎটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তোমার জেঠার উপর আমার রাগ এইখানেই। ওদের মতো নেতারাই এই যুবসম্প্রদায়ের মগজ ধোলাই করছে।”

“আপনি কি স্বাধীনতা চান না?” শশিকান্ত বলে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করে যান অবিনাশ কবিরাজ। তার পর বলেন, “স্বাধীনতা মানেই স্বেচ্ছাচারিতা। যার যা খুশি তা-ই করবে। দেশটা রসাতলে যাবে। ইংরেজ সরকারের আমলে আমরা খারাপটা কোথায় আছি? যদি ইংরেজরা চলে যায়, তা হলে দেখবে এরা নিজেরাই মারপিট, ঝগড়াঝাঁটি করে দেশটাকে শেষ করে দিচ্ছে।”

চুপ করে যান অবিনাশ কবিরাজ। গড়গড়াটা এক পাশে সরিয়ে রেখে বলেন, “নীলু আমার স্কুলের বন্ধু। লেখাপড়ায় যথেষ্ট ভাল ছাত্র ছিল। কী ভাবে নিজেকে শেষ করল দেখো। এখন জেল খাটতে হচ্ছে, কোন দিন শুনব পুলিশের গুলিতে...”

অবিনাশ কবিরাজের কথা শেষ করতে না দিয়ে শশিকান্ত বলে ওঠে, “আমি এখন উঠি, জেঠামশাই। অনেক বেলা হল।”

“এসো। জেঠামশাইয়ের সংস্রব থেকে দূরে রেখো নিজেকে...” অবিনাশ কবিরাজ বলেন।

নীরবে ফেরার পথ ধরে শশিকান্ত।

বাড়িতে ঢুকতেই, দিদি দৌড়ে এল। বলল, “কোথায় ছিলি এত ক্ষণ?”

“কেন কী হয়েছে?” শশিকান্ত উৎকণ্ঠিত মুখে প্রশ্ন করল। কনকবালা বলল, “মামা এসেছে। তোকে খুঁজছিল। যা, গিয়ে দেখা করে আয়।”

শশিকান্ত শুনেছে, জেঠামশাইকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার মূলে মামার ভূমিকা সবচেয়ে বড়। জেঠামশাইয়ের পক্ষে উকিল ছিল মামা। বাবা ভিতরে ভিতরে সব ব্যবস্থা করেছেন। ঘরে ঢুকে মামার পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করতেই উষাপতি বুকে টেনে নিলেন শশিকান্তকে। শশিকান্তর রেজ়াল্টের খবর আগেই পেয়েছেন তিনি। বললেন, “এ বার কী করবে?”

“কলেজে পড়ব,” শশিকান্ত বলল।

“সে তো পড়বে। কোন কলেজে, কিছু ভেবেছ? আমার মনে হয় রিপন কলেজই ভাল হবে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা এখন থেকেই ঠিক করে রাখো,” উষাপতি বলেন।

“শশীর ইচ্ছে, তোমার মতো ব্যারিস্টার হবে,” কনকবালা পাশ থেকে বলে ওঠে।

উষাপতির এত ক্ষণ খেয়াল হয়নি, ঘরে কখন কনকবালা এসে দাঁড়িয়েছে। উষাপতি কনকবালাকে কাছে ডেকে নেয়। এই ভাগনিটিকে দেখলেই উষাপতির রাখোমণির কথা মনে পড়ে যায়। মুখের আদল ঠিক ওর মা-র মতো।

উষাপতি কনকবালার কথায় হাসেন। বলেন, “সে তো হবে। আগে গ্র্যাজুয়েট হোক। তার পর আইন নিয়ে পড়বে।” তার পর কনকবালাকে বলেন, “তা তুমি পড়াশোনা বন্ধ করলে কেন?”

কনকবালা খানিক নিরুত্তর থেকে বলে, “আমি তো নিজে থেকে বন্ধ করিনি। আমার পড়াশোনা করতে ভালই লাগে।”

উষাপতি নীলমণির দিকে তাকান। বলেন, “নীলমণিদা, আপনি দেশোদ্ধার করছেন। আর আপনারই বাড়িতে একটি মেয়ে স্ত্রীশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমন বৈপরীত্য কেন?”

নীলমণি একটু কেশে উত্তর দেন, “এ বাড়ির নিয়মই তা-ই ভাই। আমি এর বাইরে যাই কী করে?”

“তার মানে, আপনারা শুধু নিয়ম খাটাবেন বাইরের লোকের জন্য। স্ত্রীশিক্ষা, বিধবা-বিবাহ, এ সবই ঘরের বাইরের লোকেদের জন্য! ঘরের লোকের জন্য এ সব নৈব নৈব চ... তাই তো?” উষাপতি বলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর যথেষ্ট উত্তেজিত।

নীলমণি কোনও উত্তর দেন না। হাসেন। হাসতে হাসতেই শশিকান্ত ও কনকবালার উদ্দেশে বলেন, “তোমরা এখন এসো। বড়রা কথা বললে, সেখানে বেশি ক্ষণ থাকতে নেই।”

শশিকান্ত ও কনকবালা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে নীলমণি গম্ভীর হলেন। বললেন, “তুমি ভদ্রভাষায় যাকে বললে বৈপরীত্য, আমি তাকে বলি হিপোক্রিসি। আমরা সবাই হিপোক্রিট। বাইরের লোকের কাছে আমরা সংস্কারমুক্ত। কিন্তু, ঘরে আমরা সংস্কারের বাইরে এক পা-ও হাঁটি না। আমার বোন নিভাননীকে দেখেছ তো?”

উষাপতি ঘাড় নাড়লেন। নীলমণি বলতে শুরু করেন, “অকালবিধবা। যখন শ্বশুরবাড়ি থেকে ওকে নিয়ে এলাম, ওর বয়স তখন উনিশ। পারতাম না কি আমি ওর আর একটা বিয়ে দিতে? আমি জানি, আমি যদি উদ্যোগী হতাম, এ বাড়ির কারও কিছু বলার থাকত না। কিন্তু আমি নিজেই সংস্কারের গণ্ডি পেরোতে পারলাম না। অথচ দেখো, রমানাথকে কত বার আমি আর একটি বিয়ে করতে বলেছি। রমা রাজি হয়নি তাই, না হলে পত্নীবিয়োগের পর রমা অনায়াসেই দার পরিগ্রহ করতে পারত। শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে আমরা এখনও ততটা উদার হতে পারিনি। আমাদের হিন্দু সমাজের থেকে ব্রাহ্মরা বরং এগিয়ে এ ব্যাপারে।”

“ব্রাহ্মরা স্ত্রীশিক্ষাতেও অনেক এগিয়ে। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের দেখুন। তারা কত আধুনিক। সরলা, ইন্দিরা কত পড়াশোনা করেছে। এ ছাড়া জগদীশ বসুর বোন, শিবনাথ শাস্ত্রীর মেয়ে... প্রত্যেকেই শিক্ষিতা। যুগ বদলে যাচ্ছে নীলমণিদা। মেয়েরাই পারবে মেয়েদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে। তার জন্য তাদের শিক্ষার আলো দেখাতে হবে!” উষাপতির চোখেমুখে উত্তেজনা ধরা পড়ল।

সেটা লক্ষ করে নীলমণি বললেন, “রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে আমিও পরিচিত। তবে তোমার মতো নয়। জোড়াসাঁকোতে আমিও দু’-এক বার গেছি। তুমি যা বললে, তা আমারও চোখে পড়েছে। ও বাড়ির মেয়েরা অন্য রকম। শিক্ষা না থাকলে, রুচিবোধই তৈরি হয় না। তবে, তুমি যে মেয়ে দু’টির কথা বললে, তারা রবীন্দ্রবাবুর কে হন?”

“ইন্দিরা রবিঠাকুরের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে। আর সরলা রবিঠাকুরের বোনের মেয়ে। সেই অর্থে সরলা ঠিক ঠাকুরবাড়ির মেয়ে নয়। আমি সরলার সঙ্গে পরিচিত। দেখেছি, কী অদ্ভুত পরিশীলিত এক মহিলা। নিজেকে গড়েপিটে তৈরি না করলে, এমন ব্যক্তিত্বে পৌঁছনো যায় না।”

নীলমণি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ‘নীলু আছিস নাকি রে!’ বলে ঘরে এসে উপস্থিত হলেন অবিনাশ কবিরাজ।

“আয় অবিনাশ,” বলে একটা খালি চেয়ারে আগন্তুককে বসতে ইঙ্গিত করলেন নীলমণি। উষাপতির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন।

উষাপতি গল্প-উপন্যাস লেখেন শুনে অবিনাশ মন্তব্য করেন, “আমার আবার ও-সব পড়া হয় না। বাড়িতেও গল্পের বই উপন্যাসের প্রবেশ নিষিদ্ধ। উঠতি বয়সের একটি মেয়ে আছে কি না!”

উষাপতি মৃদু হেসে বলেন, “তা বটে! ঠিক কাজই করেন আপনি।”

“তা মশাইয়ের তো গল্প-উপন্যাস লিখে পেট চলে না। পেশা কী?”

“ওই একটু ওকালতি করি আর কী!”

“উকিল? কিছু মনে করবেন না, ভারী বদ লোক আপনারা!” বলেন অবিনাশ কবিরাজ।

“কেন?” মুখে হাসি ধরে রাখেন উষাপতি।

“দেখুন, চাটুজ্জেদের এজমালি সম্পত্তি আমরা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ভোগ করে আসছি। ওদের এক উত্তরাধিকারী এসে উকিল ধরে আমাকে সেই সম্পত্তি থেকে বেদখল করে ছাড়ল। শুধু বাড়িটাই দয়া করে আমাকে লিখে দিয়েছে।”

“আপনার কোনও উকিল ছিল না?”

“ছিল তো। শুধু টাকা খাওয়ার জন্য।”

“তাই আপনার ধারণা, সব উকিলই বদ!”

“অবশ্যই! তা ছাড়া কী!”

“আর আপনার বন্ধুটিকে যে উকিল জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এল, তাকে আপনি ভাল উকিল বলবেন না?”

অবিনাশ কবিরাজ এক বার নীলমণির দিকে, এক বার উষাপতির দিকে তাকালেন। তার পর বললেন, “না, বলব না। অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে। ও আমার ছোটবেলার বন্ধু হতে পারে, কিন্তু নীলমণিরা যুবসমাজের শত্রু। তাদের মাথা খাচ্ছে। স্বাধীনতা এলে নাকি ভাল হবে! ছাই হবে। আমি বলে দিচ্ছি, এর থেকে চরম দিন আসবে।”

“তাই বোধহয় খবর সংগ্রহের চেষ্টায় ছিলে, আমি কোথায় লুকিয়ে আছি, সেটা জানার। যদি মাথার দামের টাকাটা পাওয়া যায়!” নীলমণি হাসতে হাসতে বলেন।

অবিনাশ আমতা আমতা করে বলেন, “না না, এ তোমার ভুল ধারণা। আমার এ রকম কোনও অভিপ্রায়ই ছিল না।”

নীলমণি গম্ভীর হন। বলেন, “পুলিশের মতো আমাদেরও গুপ্তচর আছে। তাদের কাছ থেকেই আমার জানা। কিন্তু অবিনাশ, আমার মাথার দাম পেলে, তোমার মাথাটি যে যেত ভাই। ভাগ্য ভাল যে তুমি আমার সন্ধান জানতে পারোনি।”

“আমি উঠি। অনেক বেলা হল,” বলে অবিনাশ উঠে দরজার দিকে এগোন। পিছন থেকে নীলমণি মোলায়েম কণ্ঠস্বরে ডাকেন, “অবিনাশ।”

অবিনাশ কবিরাজ থমকে দাঁড়ান।

নীলমণি বলেন, “একটু মিষ্টিমুখ করে যাও। রমার ছেলে শশী পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করেছে।”

“সে হবে’খন,” বলে দ্রুতগতিতে দরজার বাইরে বেরিয়ে আসেন অবিনাশ।

উষাপতি ও নীলমণি দু’জনেই সশব্দে হেসে ওঠেন। সেই হাসির শব্দ অবিনাশ কবিরাজের কানে পৌঁছয়। তার কানদুটো গরম হয়ে যায়। গজগজ করতে করতে দ্রুত বাড়ির পথে পা চালান তিনি।

২০

নদীর বুকে ধীর গতিতে ভেসে চলেছে একটি বজরা। বজরাটি সুসজ্জিত। মৃদুমন্দ লয়ে বাতাস বইছে বলে, বজরার কোনও দুলুনি নেই। মাঝেমধ্যে অবশ্য পাশ দিয়ে কোনও স্টিমার বা জাহাজ চলে গেলে বজরাটি একটু দুলে উঠছে। এই প্রমোদ-ভ্রমণে মাঝিদের কোনও ব্যস্ততা থাকে না। বজরাটিতে দু’জন মাঝি।

ক্রমশ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement