ছবি কুনাল বর্মণ।
পূর্বানুবৃত্তি: কলকাতার প্রতাপ ডাক্তার এসে বনমালীকে দেখলেন, ওষুধপত্রও দিলেন। কিন্তু রোগীর আরোগ্য বিষয়ে খুব বেশি আশা দিতে পারলেন না রমানাথদের। পরদিন ভোরেই প্রয়াত হলেন বৃদ্ধ বনমালী। তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করতে এসেও কলকাতার ডাক্তার ডাকা নিয়ে মৃদু শ্লেষ প্রকাশ করতে ছাড়লেন না অবিনাশ কবিরাজ। বনমালীকে শেষ দেখা দেখতে এসেও লোকজনের মধ্যে একটাই আলোচনা চলতে লাগল— বাঁড়ুজ্জেবাড়ির দুর্গাপুজো এবার শুরু হতে পারবে কি না। শ্মশানে পিতার মৃতদেহ দেখতে এলেন ছদ্মবেশী নীলমণি এবং দুর্ভাগ্যবশত ধরা পড়লেন সাদা পোশাকের পুলিশের হাতে। অন্য দিকে, দক্ষিণ কলকাতায় তিলজলার এক গোপন আস্তানায় আছেন অমরেন্দ্রনাথ। সেখানে ভূপেন্দ্রকুমারকে তিনি জানালেন, জার্মান পরিকল্পনার আগে থেকেই তাঁর মনে হয়েছে, বিপ্লবীদের মধ্যেই আছে পুলিশের গুপ্তচর।
ভূপেন্দ্রকুমারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। বিছানায় বসে ছিলেন। উঠে পায়চারি করতে শুরু করলেন। তার পর হাঁটা বন্ধ করে অমরেন্দ্রনাথের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “কাউকে সন্দেহ হয়?”
“হয়,” অমরেন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন।
“কে?” ভুরুর ভাঁজ আরও গভীর হয় ভূপেন্দ্রর।
“কানাই,” বললেন অমরেন্দ্রনাথ।
“কানাই, মানে কানাই সাহা... অনুশীলনের অতুল ঘোষের কথায় যাকে আমি এখানে এনেছি?”
“হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত নই, তবে আমার মনে হয়। ওর বেশভূষা, কথাবার্তার পরিবর্তন ঘটেছে। দামি সিগারেট খাচ্ছে। সন্দেহ হয়।”
“বুঝলাম। তবু আর একটু দেখি। রামগোপালের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে আপনার থাকার ব্যাপারে। ও ডকের কাছে একটা বাড়ি দেখেছে। যাই, দেখে আসি এক বার। এখানে থাকলে আপনার ধরা পড়া নিশ্চিত। ভাল কথা, আপনার শাগরেদটি কোথায়?”
“কে... মোটাদার কথা বলছিস?”
“না। মন্মথ বিশ্বাস, যে আপনার সঙ্গে ছায়ার মতো সেঁটে আছে।”
অমরেন্দ্রনাথ হাসলেন এ কথায়। বললেন, “মন্মথই সকলের মোটাদা। তুই হয়তো জানিস না। ও আর উমাশঙ্কর কোথায় বেরোল। বলল, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসবে।”
ভূপেন্দ্র চিন্তিত হলেন। বললেন, “এই রকম হুটহাট বেরোনো ঠিক হচ্ছে না। কানাই কোথায়?”
“সে কখন গেছে, আমাকে বলে যায়নি। আমি সকাল থেকেই দেখছি না কানাইকে,” বিরক্তির সঙ্গে বলেন অমরেন্দ্রনাথ।
ভূপেন্দ্র একটা সিগারেট ধরিয়ে কী যেন ভাবেন। তার পর বলেন, “সাবধানে থাকবেন। আমি রামগোপালের বাড়ি যাই। দেখি, কী করতে পারি। এই আস্তানা নিরাপদ নয়, দু’-এক দিনের মধ্যেই পুলিশের নজরে আসবে। আর... উমাশঙ্কর ফিরলে, ওকে সাড়ে ছ’টা নাগাদ ক্যাম্পবেল হাসপাতালের কাছে দাঁড়াতে বলবেন।”
কথা শেষ করে ভূপেন্দ্র বেরিয়ে যায়।
ঘণ্টা খানেক পর উমাশঙ্কর আর মন্মথ প্রবেশ করে ঘরে। দু’জনেই উদ্ভ্রান্ত। অমরেন্দ্রনাথ সত্যি এ বার একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করছিলেন। চুপচাপ একা-একা বসে থাকলে এই কাজটি তিনি করে থাকেন। তিনি দেখেছেন, এতে তার মনের মধ্যে চলা উল্টোপাল্টা চিন্তাগুলো দূর হয়।
এখন দু’জনকে ওই ভাবে দেখে, অমরেন্দ্রনাথের কবিতা মাথায় উঠে গেল। বিছানা থেকে উঠে ওদের বললেন, “কী হয়েছে?”
মন্মথ উত্তর দিল, “ভূপেন্দ্র ধরা পড়ে গেছে এসপ্ল্যানেডের কাছে। সম্ভবত, রামগোপালইধরিয়ে দিয়েছে।”
“কী বলছিস?” অমরেন্দ্রনাথ উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, “ওই রামগোপালই তো আমার ঘরের সন্ধান দেবে বলেছিল। এখন রামগোপাল যদি তিলজলার এই আশ্রয়ের কথা জানে তো হয়ে গেল! পুলিশ এখানে এল বলে।”
উমাশঙ্কর বলল, “মনে হয়, রামগোপাল এই আশ্রয়ের কথা জানে না। তবে ভূপেন্দ্রকে চাপ দিয়ে, পুলিশ জেনে নেবে।”
“তুই ভূপেন্দ্রকে চিনিস না উমা। ও পকেটে পটাশিয়াম সায়ানাইড নিয়ে ঘুরছে। প্রয়োজনে আত্মহত্যা করবে, তবু পুলিশের কাছে কিছু কবুল করবে না।”
“অমরদা, আমার মনে হয়, আমি কিংবা মন্মথ যদি অ্যারেস্ট হই, আমাদের জেল হবে কয়েক মাসের। বড় জোর এক বছর। কিন্তু আপনার জেল হলে আপনাকে ওরা ফাঁসিতে লটকাবে। কারণ, আপনি জার্মান ষড়যন্ত্রের এক জন নেতা। যতীনদা আর চিত্তপ্রিয়দা শহিদ হয়েছেন, নীরেনদা, মনোরঞ্জন আর জ্যোতিষের ফাঁসি হবে। আপনাকে আমরা হারাতে চাই না, অমরদা।”
“সবই তো বুঝলাম, কিন্তু এখন করণীয় কী? রামগোপালের জায়গা খুঁজে দেওয়ার তো আর ভরসা নেই, এখন যাব কোথায়?”
“আপনি চন্দননগরে চলে যান।”
“আমি জানি উমা, চন্দননগরে গেলে আমি অনেকটা নিরাপদ। কারণ ফরাসি উপনিবেশে ব্রিটিশ পুলিশের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ। কিন্তু এতটা রাস্তা পুলিশের চোখ এড়িয়ে যাব কী করে?”
উমাশঙ্কর ও মন্মথ দু’জনেই জোরে হেসে উঠল এ কথা শুনে।।
“হাসছিস যে!” অমরেন্দ্রনাথ বললেন।
“হাসব না? আপনি যে হাসার মতো কথা বলছেন!” মন্মথ বলে, “পুলিশের চোখে ধুলো দিতে আপনার মতো ওস্তাদ আর কেউ আছে নাকি?”
অন্য সময় হলে অমরেন্দ্রনাথ হাসতেন। এখন হাসলেন না। চুপ করে বসে রইলেন খানিক ক্ষণ, যেন ধ্যানে বসেছেন। একটু পরে কী যেন ভেবে একটু সতর্ক হলেন, উমাশঙ্করকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “উমা, জানালাটা বন্ধ করে দে তো।”
উমাশঙ্কর জানালা বন্ধ করতেই, দু’জনকে ডেকে নিলেন কাছে। কানে কানে কিছু বললেন। দু’জনেই উল্লসিত হল। কিন্তু নেতার নির্দেশে কোনও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল না। যে যার কাজে মন দিল।
অনেক রাতে কানাই এল। পা টলছে। দাঁড়াতে পারছে না। অমরেন্দ্রনাথ উমাশঙ্করকে বললেন, “ওকে শুইয়ে দে, উমা, না হলে পড়ে যাবে।”
উমাশঙ্কর কানাই সাহাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই, অমরেন্দ্রনাথ তার নাসিকাগর্জন শুনতে পেলেন। অমরেন্দ্রনাথ ঘুমন্ত কানাইয়ের দিকে চেয়ে একটু হাসলেন। বুঝতে পারলেন কানাইয়ের অধোগতির ধরনটা কেমন।
ভোরবেলা অমরেন্দ্রনাথকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল মন্মথ ও উমাশঙ্কর। একগাল দাড়ি, গায়ে সাদা জোব্বায় পাদরির বেশ দেখে কে বলবে যে, ইনি অনুশীলন, যুগান্তরের সভ্য, উত্তরপাড়া নিবাসী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। অমরেন্দ্রনাথকে সেই কথা বলায়, অমরেন্দ্রনাথ মুখে আঙুল দিয়ে ইশারায় চুপ করতে বললেন মন্মথ ও উমাশঙ্করকে। তার পর ফিসফিস করে বললেন, “কানাই এখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ও ওঠার আগেই আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে। মন্মথ আমার সঙ্গে যাবে ঘোড়ার গাড়িতে। আর্দালির বেশে।”
উমাশঙ্কর বলল, “আমি কী করব অমরদা?”
অমরেন্দ্রনাথ বললেন, “তোমারও গন্তব্য চন্দননগর। তবে আমাদের সঙ্গে নয়। যদিও আমরা এক সঙ্গেই বেরোব।”
উমাশঙ্কর ঘোড়ার গাড়ি ডেকে আনতেই অমরেন্দ্রনাথ গাড়ির ভিতরে গিয়ে বসলেন। মন্মথ গাড়ির মাথায় কোচম্যানের পাশে আর্দালির বেশে। তার আগে, মন্মথকে কানে কানে অমরেন্দ্রনাথ নির্দেশ দিলেন, সে যেন কোনও বিপদ বুঝলে বন্দুক ব্যবহার করে। অমরেন্দ্রনাথের গ্রেফতারি যদি একান্ত আটকানো না-ই যায়, তা হলে অমরেন্দ্রনাথের জন্য একটা গুলি খরচ করতেও যেন মন্মথ দ্বিধা না করে। বিপ্লবীদের জীবন্ত ধরা দিতে নেই।
গাড়ি চলতে শুরু করল মন্থর গতিতে। অমরেন্দ্রনাথ বাইরে তাকালেন।
এখনও মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু হয়নি। দু’-এক জনকে রাস্তায় দেখা যাচ্ছে বটে, তবে এরা সম্ভবত ধীবর শ্রেণির লোক কিংবা মাছ-বিক্রেতা। রাত থাকতেই এরা বেরিয়ে পড়ে। সূর্যের আলো এখনও স্পষ্ট করে ফোটেনি। আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতা জেগে উঠবে।
ক্যাথিড্রাল রোডের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অমরেন্দ্রনাথের নজরে এল সাদা পাথরের তৈরি স্মৃতিসৌধটি। সবুজ গালিচার মতো ঘাসের সমারোহ। মাঝখানে শ্বেতশুভ্র পাথরের ইমারত। ভারী সুন্দর। চোখ জুড়িয়ে যায়। যদিও সৌধটির নির্মাণ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুতে, লর্ড কার্জনের প্রস্তাবে রানির স্মৃতিতে এই সৌধ নির্মাণ। অমরেন্দ্রনাথের ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। কাদের দেশ, কার স্মৃতিসৌধ!
লাটভবন পেরিয়ে গাড়ি অনেক দূর এগিয়েছে। গাড়ির গতি এখন দ্রুত। ঘোড়ার খুরের শব্দ কানে আসছে অমরেন্দ্রনাথের। চিৎপুর রোডের কাছে গাড়ির গতি একটু মন্থর হতে শুরু করল। রাস্তায় এখন অনেক লোক। এ ছাড়া গরুর গাড়ি, ঠেলাগাড়ি ও রিকশার আধিক্য তো আছেই। হাওড়া সংযোগকারী ভাসমান সেতুতে উঠতেই বিপত্তি শুরু হল। ভাটার সময়। কাঠের সেতু মাঝখানে নিচু থাকায়, গাড়ির চাকা গড়িয়ে ভেঙে এক ধারে কাত হয়ে গেল।
কোচম্যান অমরেন্দ্রনাথকে জানালেন যে, গাড়ি আর যাবে না। সুতরাং বাকি পথটা তাকে হেঁটেই যেতে হবে। অমরেন্দ্রনাথের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। হাওড়া স্টেশন এখান থেকে এমন কিছু দূর নয়। হেঁটে তিনি যেতেই পারেন। কিন্তু পথে পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। এখন অনেকেই অফিসের পথে ভাসমান সেতু ধরে হেঁটে চলেছেন। তবু তাঁকে এক বার নামতেই হবে। সেটুকু ঝুঁকি না নিলেই নয়। তা ছাড়া গাড়ি না চললে তিনি ভিতরে বসেই বা কী করবেন? গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেন অমরেন্দ্রনাথ।
তত ক্ষণে এক দীর্ঘদেহী পুলিশ সার্জেন্ট এসে উপস্থিত। সঙ্গে দু’জন কনস্টেবল। ফাদারকে দেখে শ্রদ্ধাবনত হয়ে, সার্জেন্ট কনস্টেবলদের নির্দেশ দিলেন, গাড়িটাকে টেনে রাস্তার এক প্রান্তে নিয়ে যেতে। কারণ তত ক্ষণে পিছনে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। নির্দেশ দিয়েই সার্জেন্ট অমরেন্দ্রনাথের দিকে ফিরলেন। বললেন, “ফাদার, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?”
অমরেন্দ্রনাথ বললেন, “আমি হাওড়া স্টেশন যাচ্ছিলাম। একটুখানি রাস্তা। হেঁটেই যেতে পারতাম। কিন্তু পায়ে সমস্যা থাকায় হাঁটতে অসুবিধে হয়। যদি কোনও ব্যবস্থা করে দেন তো ভাল হয়।”
সার্জেন্ট সঙ্গে সঙ্গে ফাদারের জন্য একটি গাড়ির ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। হাওড়াগামী একটি খালি গাড়ি আসছিল। সার্জেন্ট গাড়িটিকে দাঁড় করিয়ে, ফাদারকে তুলে দিয়ে বললেন, “আপনার যাত্রা শুভ হোক, ফাদার।”
অমরেন্দ্রনাথ সার্জেন্টকে ধন্যবাদ জানালেন। বললেন, “প্রভু জিশু আপনার মঙ্গল করুন।”
গাড়ি হাওড়া স্টেশনের দিকে এগোতে লাগল।
১৮
পিতৃবিয়োগের পর বেশ কয়েক মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া ভাবটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি রমানাথ। তার সঙ্গে শরীরটাও সব দিন ঠিক যাচ্ছে না। কনকের বিয়েটা পিছোতেই হল। পুরোহিত মশাই বললেন, এক বছর না কাটলে বৈবাহিক অনুষ্ঠান করা যায় না। তা ছাড়া কনকের শ্বশুরমশাইও জানিয়েছেন, বাৎসরিক কাজ হয়ে যাওয়ার পরই তাঁরা এ নিয়ে কথা বলবেন।
রমানাথের কষ্ট, দুর্গাপুজোটা বন্ধ করতে হল বলে। সারা গ্রামের লোককে নেমন্তন্ন করা হয়ে গেছিল। পুরোহিতও ঠিক করা হয়ে গেছিল।
ক্রমশ