ছবি: কুনাল বর্মণ।
পূর্বানুবৃত্তি: অফিসপাড়ার একটি বন্দুকের দোকান থেকে অনেক বন্দুক ডাকাতি করেছে বিপ্লবীরা। তার জেরে আশপাশের সমস্ত দোকানঘর, বাড়িতে খানাতল্লাশি আর ধরপাকড় শুরু করেছে পুলিশ। সেই প্রসঙ্গেই আলোচনা করছিলেন রমানাথ আর ঘনশ্যাম। উপস্থিত ছিল উমানাথও। তখন নিবারণ খবর নিয়ে আসে, রমানাথদের গদিতেও খানাতল্লাশি হবে এবং মারোয়াড়ি সম্প্রদায়েরও অনেকে আছে পুলিশের সন্দেহের তালিকায়। একটু পরেই পুলিশ এসে তল্লাশি শুরু করে গদিতে। সেখান থেকে কিছুই পাওয়া যায় না। পুলিশের বলা বিপ্লবীদের নামগুলোর বেশিরভাগ সকলের অপরিচিত হলেও, প্রভুদয়াল নামে একজনকে চিনতে পারেন ঘনশ্যাম। তবে তার সম্বন্ধে বিশেষ কোনও তথ্য তাঁর জানা না থাকায় পুলিশের বিশেষ সাহায্য হয় না। অন্য দিকে উত্তরপাড়ার গঙ্গাতীরে, নির্জন রামঘাটে এক গোপন সমাবেশের আয়োজন করেছে বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথরা। সেখানে ভদ্রজনেরা তেমন আসেন না এবং আশপাশে বিপ্লবীদের চর ছড়ানো আছে বলে জায়গাটি নিরাপদ। নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে একে একে জড়ো হতে থাকেন স্বদেশিরা।
অমরেন্দ্রনাথ তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেলেন জলের কাছে। তার পর আরোহীদের নিয়ে উপরে উঠে এলেন।
রাত হলেও নদীর ও পারে দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির আর তার দু’পাশের শিবমন্দিরগুলো দেখা যাচ্ছে। আবছা আলোয় ডিঙিনৌকোগুলো মনে হচ্ছে ছায়া দিয়ে তৈরি। জলের ছলাৎছল শব্দ ছাড়া আর তেমন কোনও শব্দ নেই এলাকায়।
শ্রীশচন্দ্র ঘোষ ও জ্যোতিষচন্দ্র পালকে অনেক দিন থেকেই চেনেন যতীন্দ্রনাথ। মতিলাল রায়ের সঙ্গে আলাপ বছর তিনেক আগে দামোদরের বন্যার সময়। যতীন্দ্রনাথ, অমরেন্দ্রনাথ ও আরও অনেকে তখন বর্ধমানের ত্রাণকেন্দ্রে কাজ করছেন। মতিলাল এলেন তাঁর এক নিকটাত্মীয়ের খোঁজ নিতে। অরবিন্দের অনুগত হওয়ার সুবাদে, অমরেন্দ্রনাথ চিনতেন মতিলালকে। তিনিই সে দিন আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে মতিলালের। যতীন্দ্রনাথের মনে আছে, কী পরিশ্রমটাই না করেছিলেন তার পর মতিলাল। শেষের দিকে অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন।
মতিলালকে দেখে একটু হাসলেন যতীন্দ্রনাথ। বললেন, “নৌকাযোগে বুঝি যাতায়াত আছে?”
মতিলাল মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, “আমরা গঙ্গাপাড়ের লোক। সাঁতার কাটতেও পারি, আবার নৌকো বাইতেও পারি। চন্দননগর থেকে নৌকো নিয়েই চলে এলাম।”
অমরেন্দ্রনাথ মহাদেব ও নন্দীর সঙ্গে কিছু দরকারি কথা বলছিলেন, এমন সময় খবর এল আরও দু’জন আসছেন। অমরেন্দ্রনাথ এগিয়ে গিয়ে দেখেন, মনোরঞ্জন ও চিত্তপ্রিয় এসেছে। অমরেন্দ্রনাথ তাদের রাস্তা থেকে নিয়ে এসে বলেন, “এ বার আমরা সভা শুরু করব। নরেন্দ্র বাদে প্রায় সকলেই এসে গেছেন।”
“সভার আগে, কিছু খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করলে হত না, অমরদা? প্রত্যেকেরই খুব খিদে পেয়েছে। নয় কি, জ্যোতিষ?” যতীন্দ্রনাথ বলেন।
জ্যোতিষচন্দ্র সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন।
অমরেন্দ্রনাথ মৃদু হেসে বলেন, “কারুর খিদে না পেলেও, তোমার পাবে। তোমার পেটটা সবার থেকে বড় কিনা!”
সকলে হেসে ওঠেন এ কথায়। যতীন্দ্রনাথও হাসেন। সত্যি, খিদে তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না।
অমরেন্দ্রনাথ সকলকে নিয়ে ভাঙা ঘরটিতে প্রবেশ করেন।
মহাদেব ও নন্দী কলাপাতায় সকলকে মাংস ও লুচি পরিবেশন করে। মনোরঞ্জন হঠাৎ বলে ওঠেন, “খেয়ে নেব? নরেনের জন্য আর একটু অপেক্ষা করলে হত না?”
“খাও, খেয়ে নাও। নরেন্দ্র এলে, আমরা দু’জনে এক সঙ্গে খাব,” অমরেন্দ্রনাথ বললেন।
বলতে বলতেই ঘোড়ার খুরের শব্দ পাওয়া গেল। অমরেন্দ্রনাথ বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, ঘোড়ার গাড়ি চেপে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এসে উপস্থিত হয়েছেন।
সভা শুরু হতে প্রায় বারোটা বাজল। নরেন্দ্রনাথ শুরু করলেন। বললেন, “আমাদের এই নৈশসভায় উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যই এক— ইংরেজকে তাড়িয়ে দেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতা আনা। আবেদন নিবেদন আমাদের পথ নয়, এ আমি অনেক বার বলেছি। আজও বলছি। আমি মনে করি, আপনাদেরও তা-ই বিশ্বাস। তা না হলে এখানে আপনারা আসতেন না। তবু আপনাদের কারও যদি চরমপন্থায় আস্থা না থাকে, দয়া করে হাত তুলবেন।”
নরেন্দ্রনাথ অপেক্ষা করলেন, যদি সত্যি তেমন কেউ থাকেন, যাঁর তাঁদের পথে বিশ্বাস নেই। কেউ হাত তুললেন না দেখে নরেন্দ্রনাথ একটু হাসলেন। একটা সিগারেট ধরালেন। প্রস্তুত হলেন মূল বিষয়ে আসার। ঠিক তখনই বন্ধ দরজায় খুট করে আওয়াজ হল। সকলেই সচকিত হয়ে উঠলেন। নরেন্দ্রনাথ তার ডান পকেটে মাউজ়ার পিস্তলটিতে হাত ছোঁয়ালেন। ভাঙা দরজার সামনে এক পাগল উপস্থিত হয়েছে।
অমরেন্দ্রনাথ বললেন, “ওকে একটু শোবার জায়গা দিতে হবে। এই সময়টা ওর ঘুমোনোর সময় এখানে। আমরা তো ওকে রাতের ঘুম থেকে বঞ্চিত করতে পারি না।”
“ওর সামনে আমাদের সভা করতে হবে— এটা কি সম্ভব?” চিত্তপ্রিয় বলে উঠলেন।
“আমার প্রথম থেকেই জায়গাটা পছন্দ হয়নি। অমরদা যে কী করে!” যতীন্দ্রনাথ বললেন।
“অমরদা ভুল করেন না। সত্যিই তো এত রাতে পাগলটাই বা যাবে কোথায়?” নরেন্দ্রনাথ বললেন। তাঁর মুখে একটা হাসির রেখা দেখা দিল। কেউ লক্ষ না করলেও, অমরেন্দ্রনাথের চোখ এড়াল না।
ঘরের এক কোণে গুটিসুটি পাকিয়ে শুয়ে থাকা পাগলটার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন নরেন্দ্রনাথ, “তা হলে দেখা যাচ্ছে, আমরা এখানে সকলেই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে আগ্রহী। এবং সেটা সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে। কিন্তু সহিংস আন্দোলনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন— সাহস, অর্থ ও অস্ত্র। প্রথমটি আপনাদের আছে, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু বাকি দু’টির অভাব আমাকে ভাবাচ্ছে।”
নরেন্দ্রনাথ আবার একটা সিগারেট ধরালেন। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “অস্ত্র ও অর্থ জোগাড় করতে হবে সময় নিয়ে ও পরিকল্পনা করে। আপনারা জানেন, কলকাতার ডালহৌসিতে রডা কোম্পানির পিস্তল ডাকাতিতে আমার সায় ছিল না। আমার বিবেচনায় ওখানে পরিকল্পনার অভাব ছিল। আমি সভা ত্যাগ করেছিলাম এই কারণে।”
“ডাকাতিটা কিন্তু সফল হয়েছিল। আমাদের কয়েক জন তার সুফলও পেয়েছি। চিত্তপ্রিয়, যতীন্দ্রনাথ ও আমার কাছে যে পিস্তল আছে, তা রডা কোম্পানির ওই ডাকাতির সৌজন্যেই পাওয়া। আমার মনে হয়, আপনার পকেটের পিস্তলটিও রডা কোম্পানিরই...” শ্রীশচন্দ্র বলে উঠলেন।
নরেন্দ্রনাথ একটু চুপ করে যান। ভাবেননি, এই সভায় কেউ তাঁকে ওই দিনে তাঁর ভূমিকা তুলে আঘাত করবেন। এমনিতেই এই নিয়ে তিনি বিবেকের দংশন অনুভব করেছেন। যে সাহসিকতার সঙ্গে দিনের বেলায় কলকাতার ওই রকম জনাকীর্ণ রাস্তায় তার সহকর্মী বন্ধুরা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করল, তাতে তাঁর গর্বই হয়েছে ওঁদের জন্য। তবু, তার মনে হয়েছে কাজটা ছিল যথেষ্টই ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক রক্তক্ষয় হতে পারত। তা ছাড়া, কোনও কাজে আগেপরে না ভেবে নেমে পড়াটা মূর্খের মতো কাজ। সাহস ভাল, কিন্তু, দুঃসাহস ভাল নয়।
অমরেন্দ্রনাথ বলেন, “যা অতীত, তা নিয়ে আলোচনা করা ঠিক নয়। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করতে এখানে উপস্থিত হয়েছি।”
“না অমরদা, শ্রীশ ঠিকই বলেছে। ও জানে না, কতখানি মানসিক যন্ত্রণা আমি পেয়েছিলাম, ছাতাওয়ালা গলির ওই সভা থেকে বেরিয়ে আসার পর। আমি ভেবেছিলাম, এত অল্প সময়ের মধ্যে সংক্ষিপ্ত পরিকল্পনায় ওই রকম একটা দুঃসাহসিক কাজ করা ঠিক হবে না। হয়তো আমিই ভুল ছিলাম। ‘ফরচুন ফেভারস দ্য ব্রেভ’— এটা ওরা করে দেখিয়েছে। যাই হোক, কিছু মাউজ়ার পিস্তল আমাদের হাতে এসেছে ঠিকই, কিন্তু তার সংখ্যা মাত্র পঞ্চাশ। পঞ্চাশ-ষাটটি পিস্তল নিয়ে আমরা ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে লড়াই করব— এটা বাস্তবসম্মত নয়। ব্রিটিশরাজের ভিত নড়িয়ে দিতে চাই অনেক অস্ত্র। সেই অস্ত্র আসবে বিদেশ থেকে।”
“বিদেশ থেকে? সেটা কী রকম?” মতিলাল রায় প্রশ্ন করলেন। এমনিতে কম কথার মানুষ তিনি। সভায় এত ক্ষণ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলেন। নরেন্দ্রনাথের শেষ বাক্যটি তাঁকে চমকে দিল। উপস্থিত আরও দু’-এক জন অবাক হলেন নরেন্দ্রনাথের কথায়।
নরেন্দ্রনাথ যতীন্দ্রনাথের দিকে চেয়ে বললেন, “আমি বলব, নাকি তুমি বলবে যতীন?”
যতীন্দ্রনাথ বললেন, “তুমিই বলো।”
নরেন্দ্রনাথ আবার একটি সিগারেট ধরালেন। পর পর সিগারেট খাওয়াটা তাঁর অভ্যেস।
নরেন্দ্রনাথ বলেন, “গত মাসে জিতেন লাহিড়ীর সঙ্গে এ বিষয়ে আমার কথা হয়েছে।”
“জিতেন লাহিড়ী?” প্রশ্ন করলেন মনোরঞ্জন।
“শ্রীরামপুরের ছেলে। গদর পার্টির সঙ্গে যুক্ত। তার মাধ্যমেই আমার কাছে খবর এসেছে যে, জার্মানি ভারত থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ দূর করতে আমাদের অস্ত্রসাহায্য করতে প্রস্তুত। এর আগেও ওদের কাছ থেকে আমি এই ধরনের আশ্বাস পেয়েছি। তখন যুদ্ধ ছিল না। এখন যুদ্ধ চলছে। আর, আমি মনে করি, আমাদের এই যুদ্ধের সুযোগটাই নেওয়া উচিত। আপনারা কী বলেন?”
সকলেই নরেন্দ্রনাথকে সমর্থন করলেন।
নরেন্দ্রনাথ আবার শুরু করলেন, “বিপ্লব পরিচালনার সমস্ত ভার আমি যতীন্দ্রনাথের হাতে দিতে চাই। জার্মান কনসালের সঙ্গে যোগাযোগ ও অর্থ সংগ্রহের ভার আমি নিতে আগ্রহী, কারণ এই কাজটির সঙ্গে আমি পূর্বপরিচিত। বাকি আর আর যে কাজটি থেকে যায়, তা হল বিদেশ থেকে আগত অর্থ বিভিন্ন ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ভাঙানো ও সেই অর্থ বিপ্লবীদের হাতে তুলে দেওয়া। পুলিশের নজর এড়িয়ে কাজটা করা খুব কঠিন। আপনাদের মধ্যে কে এই কাজটির দায়িত্ব নেবেন?”
যতীন্দ্রনাথ দাঁড়ালেন। বললেন, “এই কাজে অমরদার থেকে যোগ্য আর কেউ নেই। তা ছাড়া, তাঁর শ্রমজীবী সমবায় নামে যে প্রতিষ্ঠানটি আছে, সেখানে টাকা পাঠালে পুলিশ বুঝতেও পারবে না।”
উপস্থিত সকলেই যতীন্দ্রনাথকে সমর্থন করলেন। নরেন্দ্রনাথ মাথা নাড়লেন। বললেন, “সে তো হল, কিন্তু অমরদার অন্য কাজটা করবে কে?”
প্রত্যেকেই অবাক হলেন। এ ওর মুখের দিকে তাকালেন। প্রত্যেকের চোখেই প্রশ্ন।
জ্যোতিষ বললেন, “অন্য কাজ মানে?”
নরেন্দ্রনাথ চোখ থেকে চশমাটা খুলে ডান হাতে দোলাতে দোলাতে বললেন, “পলাতক কমরেডদের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ডের ব্যবস্থা করা।”
অমরেন্দ্রনাথ উঠলেন। একটু হেসে বললেন, “এটা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। দুটো কাজই আমি একা সামলাতে পারব। তা ছাড়া, বিপ্লবীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন তো পিসিমা। আমি তো তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত।”
নরেন্দ্রনাথ একটু অবাক হয়ে তাকালেন অমরেন্দ্রনাথের দিকে। বললেন, “পিসিমা?”
“তুমি হয়তো প্রথম শুনছ, কিন্তু এখানে অনেকেই পিসিমাকে চেনেন। বিধবা মানুষ। একা থাকেন। কোনও সংস্কার নেই। তোমার সঙ্গে এক দিন আলাপ করিয়ে দেব,” অমরেন্দ্রনাথ বললেন।
“আমাদের দেশের বিধবা নারী, অথচ সংস্কারমুক্ত! আশ্চর্য তো! কী নাম ওঁর?”
“ওঁর নাম ননীবালা,” বলেন অমরেন্দ্রনাথ।
ক্রমশ