রোশনাই: আতশবাজির জৌলুসে রঙিন বর্ষশেষের রাত।
বাঙালি বড় ভাগ্যবান, বছরে দু’বার নতুন বছরের আনন্দ উদ্যাপন করতে পারে। এক, পয়লা বৈশাখ আর দুই, সাহেবদের দৌলতে ‘নিউ ইয়ার’ উৎসব। যা নিয়ে কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন, “খ্রীষ্টমতে নববর্ষ অতি মনোহর।/ প্রেমানন্দে পরিপূর্ণ যত শ্বেত নর॥” ইংরেজি নববর্ষে খ্রিস্টানরা আনন্দে মাতবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার সঙ্গে বাঙালি নারীরাও (পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে) যদি অংশগ্রহণ করে এবং মদ্যপান করেন, ঈশ্বর গুপ্ত ব্যঙ্গ করে লেখেন, “শাড়ী পরা এলোচুল আমাদের মেম/ বেলাক নেটিভ লেডি সেম, সেম, সেম্...”
অন্য দিকে ‘দ্য নিউ ইয়ার’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “লাইক ফ্রুট, শেক্ন ফ্রি বাই অ্যান ইমপেশেন্ট উইন্ড/ ফ্রম দ্য ভেল অব ইটস মাদার ফ্লাওয়ার,/ দাউ কাম্স্ট, নিউ ইয়ার, হোয়ার্লিং ইন আ ফ্র্যান্টিক ডান্স...” আর পয়লা বৈশাখে তিনিই আবার লিখেছেন, “নিশি অবসানপ্রায়, ওই পুরাতন বর্ষ হয় গত!…/ বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও,/ ক্ষমা করো আজিকার মতো/ পুরাতন বরষের সাথে/ পুরাতন অপরাধ যত।”
ইংরেজি নববর্ষকে বরণ ও আমোদপ্রমোদের মধ্যে একটা হুল্লোড়ের ব্যাপার আছে। তাই কবি ঈশ্বর গুপ্ত সাহেবি নববর্ষের মৌজ-মস্তি নিয়ে ফুট কেটেছেন, “নববর্ষ মহাহৰ্ষ, ইংরাজটোলায়/ দেখে আসি ওরে মন, আয় আয় আয়॥/ সাহেবের ঘরে ঘরে কারিগুরি নানা।/ ধরিয়াছে টেবিলেতে অপরূপ খানা॥/ বেরিবেষ্ট সেরিটেষ্ট মেরিরেষ্ট যাতে।/ আগে ভাগে দেন গিয়া শ্রীমতীর হাতে॥” বাঙালির নির্ভেজাল সাহিত্যচর্চায় বর্ষবরণ থাকবে এবং নানা আয়োজনে তা পালিত হলেও, আজও অনেকেরই অজানা ‘নিউ ইয়ার’ তথা ইংরেজি নববর্ষের ইতিহাস।
চিরকাল কিন্তু ১ জানুয়ারিকে ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন হিসাবে ধরা হত না। আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে প্রাচীন ব্যাবিলনেই নববর্ষ পালনের সূচনা। সেই সময় ১১ দিন ধরে চলত নববর্ষের উৎসব ‘আকিতু’। মার্চ মাসে প্রথম পূর্ণিমা দিয়ে শুরু হত নববর্ষ পালন। রোমের পুরাণ অনুযায়ী, ভগবান জানুসের হাত ধরেই সব কিছুর সূত্রপাত। তাঁর নামের সঙ্গে মিল থাকাতেই জানুয়ারিকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধরার সিদ্ধান্ত হয়। যুদ্ধের দেবতা মার্স-এর নামানুসারে মার্চ মাসটি নামাঙ্কিত হওয়ায়, সেটিকে পিছিয়ে দেন। মূলত রোমান ক্যালেন্ডার অনুযায়ীই দিনক্ষণের হিসাব রাখা হত সেই সময়। কিন্তু সূর্যের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন রোমান ক্যালেন্ডারের সামঞ্জস্য থাকছিল না। তার জন্য ৭১৫ থেকে ৬৭৩ খ্রিস্টপূর্বে রোমান ক্যালেন্ডারে সংশোধন ঘটান রোমের তৎকালীন সম্রাট নুমা পম্পিলাস। মার্চের বদলে জানুয়ারিকে বছরের প্রথম মাস নির্ধারণ করেন তিনি। তবে ১ জানুয়ারির নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে তকমা পাওয়া তারও পরে, রোমে জুলিয়াস সিজ়ারের হাত ধরে। তাবড় গণিতবিদদের নিযুক্ত করে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার তৈরি করেন তিনি, সেটিই রূপান্তরিত হয়ে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার হয়, যা আজকের দিনে সব দেশ মেনে চলে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে প্রাচীন ক্যালেন্ডারে সংশোধন ঘটিয়ে ১ জানুয়ারি দিনটিকে বছরের প্রথম দিন ঠিক করেন সিজ়ার। ৫ খ্রিস্টপূর্বে রোমের পতনের পর খ্রিস্টধর্মাবলম্বী বহু দেশ ক্যালেন্ডারে রদবদল ঘটায়। ২৫ ডিসেম্বর, বড়দিনকেই নতুন বছরের প্রথম দিন হিসাবে মানতে শুরু করে তারা। গর্ভে জিশু রয়েছেন বলে যে দিন জানতে পারেন মেরি, সেই ২৫ মার্চকে ঘোষণা দিবস হিসাবে পালন করা হতে থাকে। কিন্তু ১৫৮২ সালে ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরি, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন করেন, তাতে ১ জানুয়ারিকেই বছরের প্রথম দিন ঘোষণা করা হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের বিশেষ পার্থক্য নেই। তবে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে লিপ ইয়ার, অর্থাৎ চার বছর অন্তর ফেব্রুয়ারি মাসের একটি বাড়তি দিন যোগ করা ছিল না। হিসাব কষে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে তাতে রদবদল ঘটানো হয়। একেবারে শুরুতে যে সমস্ত দেশে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণযোগ্যতা পায়, তার মধ্যে অন্যতম হল ইটালি, ফ্রান্স এবং স্পেন। ১৭৫৭ সাল থেকে ব্রিটেন এবং আমেরিকাও তা মানতে শুরু করে। আবার গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মেনে চললেও, সেপ্টেম্বরে বর্ষবরণ পালন করে ইথিয়োপিয়া। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও নববর্ষ ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালিত হয়। যেমন, অসমে রঙ্গোলি বিহু, বাংলায় পয়লা বৈশাখ, তামিলনাড়ুতে তামিল পুত্থানাড়ু, ওড়িশায় বিষুব সংক্রান্তি, যা মূলত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পড়ে।
নিউ ইয়ারের আগের রাতকে বলা হতো নিউ ইয়ার্স ইভ, বর্তমানে যা ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ হিসাবে প্রচলিত। জিশুখ্রিস্টের জন্মের পর ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা ক্রিসমাস ডে থেকে শুরু করে বছরের শেষ দিনে রাতের অর্ধসময় পর্যন্ত নানা বিকৃত পন্থায় তাদের দেবতাদের উপাসনা করত। সঙ্গে থাকত ভোগবিলাসের সকল আয়োজন। সে সময় ইউরোপের প্রোটেস্টান্ট ধর্মগুরুরা এ সংস্কৃতিকে পেগানীয় ও অ-খ্রিস্টানীয় আখ্যা দিয়ে বর্জন করতে ঘোষণা করেন। ফলশ্রুতিতে ছড়িয়ে পড়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা। কালক্রমে ধীরে ধীরে প্রোটেস্টান্টরাও যোগ দেয় এ উৎসব পালনে। লন্ডনে ৩১ ডিসেম্বর রাত বারোটায় টেমস নদীর আকাশ ছেয়ে যায় আতশবাজির ঝলকে। স্কটল্যান্ডের নিউ ইয়ার্স ইভকে বলা হয় ‘হোগমেনেই’। এ দিন এডিনবরার প্রিন্সেস স্ট্রিটে আয়োজন করা হয় গ্র্যান্ড পার্টির। গ্রিস ও সাইপ্রাসের নতুন বছর উদ্যাপন শুরু হয় নিজস্ব আঙ্গিকে। তারা বছরশুরুর রাতে বাতি নিভিয়ে বেসিল পাই কেটে শুরু করে উৎসব। পাইয়ের ভিতর থাকে একটি মুদ্রা। যার ভাগ্যে এই মুদ্রাটি পড়ে তাকে সারা বছরের জন্য ভাগ্যবান বলে মনে করা হয়।
ফ্রান্সের কান্ট্রিসাইডের অধিবাসীরা নতুন বছরের ভবিষ্যৎ হিসাবে মনে করে সে রাতের আবহাওয়াকে। তাদের মতে আগত বছরের প্রাপ্তি সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয় বায়ু। কানাডা, রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, নেদারল্যান্ডস-সহ অনেক দেশেই থার্টি ফার্স্ট নাইটে মানুষ ছুটে যায় সমুদ্রসৈকতে। আয়োজন করা হয় ‘পোলার বিয়ার প্লাঞ্জেস’। পশ্চিমের এ উৎসবকে স্বাগত জানিয়েছে আমাদের দেশও। পয়লা বৈশাখকে বাংলা নববর্ষ হিসাবে পালনের পাশাপাশি নানা আয়োজনে পালন করা হয় ইংরেজি নববর্ষও।
আন্তর্জাতিকতার কল্যাণেই ১ জানুয়ারি সারা পৃথিবীর মানুষ এক সঙ্গে উৎসবের আনন্দ অনুষ্ঠানে মেতে উঠে। বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য, বিবিধের মাঝে এমন মহান মিলন বছরের আর কোনও দিন খুব একটা দেখা যায় না।
ইংরেজরা প্রতি বছর নববর্ষ বা নিউ ইয়ারে কেক কেটে, মোমবাতি জ্বেলে, আতশবাজির মাধ্যমে পুরনো ভুল সংশোধন করে নতুন শপথ নেয়, যাতে তারা নতুন বছরে খারাপ কাজ পরিহার করে, ভাল কাজ করতে পারে। নতুন বছর তাই নতুন করে শুরু করার এক শুভক্ষণও বটে।