ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৮
Bengali Story

শূন্যের ভিতর ঢেউ

রুমকির গলায় খুশির ছোঁয়া, “মনে রেখেছিস? তুই যে মনে রাখবি তা জানতাম। বিয়ের পর এই প্রথম আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালি।

Advertisement

সুমন মহান্তি

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৪৫
Share:

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।

অভ্র প্রশ্ন করে, “আচ্ছা, প্রায় সব ঘরেই শাশুড়ি-বৌমার রিলেশনটা ভারত-পাকিস্তানের মতো হয় কেন?”

Advertisement

রুমকি বলল, “ছেলেদের মাথায় ওটা ঢুকবে না। তুই সংসারও করিসনি, ঘোরপ্যাঁচ বুঝবি না।”

“সংসার করার প্রশ্নও নেই। যা বলছিলাম, হাব্বাডাব্বা খেলা, লটারির টিকিট কেনা ইত্যাদি বাজে অভ্যেসগুলো ছাড়তে পেরেছি।”

Advertisement

“শুনে ভাল লাগল। তা কোনও কাজকর্ম জোটালি, নাকি টিউশন করেই কেটে যাচ্ছে।”

“দেখি কী করা যায়।”

“কিছুই আর করছিস না?”

“না।”

“কিছু না?”

“ওই শেয়ার কেনাবেচা করছি।”

“তার মানে ফাটকা কারবারে ঝুঁকেছিস?” রুমকির অপ্রসন্ন গলা, “থিতু হওয়ার মতো কিছু করছিস না! কার বুদ্ধিতে শুরু করলি এ সব?”

মিথ্যেই বলল অভ্র, “নিজেই একটা রোজগারের রাস্তা খুঁজে নিলাম।”

“ও! তোকে গালমন্দ করার অধিকার তো আমার নেই। তবু আমার মনে হয় যে, নিজের ট্যালেন্টের প্রতি তুই সুবিচার করিসনি।”

“ট্যালেন্ট! এটা বলা কিন্তু এক রকম অপমান হয়ে যাচ্ছে!”

রুমকি গলা চড়ায়, “কেন বলব না? তুই ইউনিভার্সিটিতে আমাদের ব্যাচে থার্ড। ওষুধের ব্যাগ বয়ে উঁচু কোনও পজ়িশনে গেলি না, ছেড়ে দিলি। ক’বছর হল?”

“ প্রায় পাঁচ বছর।’’

“ এই পাঁচ বছরে তুই কী করেছিস?’’

“ পাঁচ বছর নয়, তিন বছর হবে। আগের দুটো বছর কোভিড মহামারি খেয়ে নিয়েছে আমাদের। তবে স্কুলের পাকাপোক্ত চাকরির জন্য অপেক্ষা করে ঠকেছি। ভুল করেছি। পরীক্ষাটাই আর হল না,’’ অভ্র বলল, “তুই বিয়ের আগে বার বার ইউজিসি নেট দেওয়ার কথা বলতিস। সেটাই কি বলতে চাইছিস? চাকরি চলে যাওয়ার পরে ভেবেছিলাম দেব। কিন্তু নেট উইথ জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপের জন্য বসার বয়স তখন পেরিয়ে গিয়েছে।”

“কম্পিটিটিভ পরীক্ষা?”

“ডব্লুবিসিএস প্রিলিমে দু’বার পাশ করেছিলাম। ফাইনালে কেটে গিয়েছিল। ওটাই বলতে পারিস একমাত্র ব্যর্থতা। স্কুল ইনস্পেক্টরের ফাইনাল প্যানেলে ওয়েটিং লিস্টে ছিলাম। চাকরি হল না, ওয়েটিং-এই রয়ে গেলাম। রুমি, চেষ্টার কসুর করিনি আমি। সর্বত্র দশ-বারোটা পোস্টের জন্য হাড্ডাহাড্ডি কম্পিটিশন। বাইরে থেকে বলে দেওয়া সোজা।”

“এত সব কিছুই জানতাম না,” রুমকি বলল, “তোর টিউশনের বাজার কেমন?”

“এখানেও ক্লিক করতে পারিনি। পাঁচটা বাড়িতে গিয়ে পড়াতাম। একটা থেকে সদ্য ছাঁটাই হয়েছি। এখন রোজগার ন’হাজার। ওটুকুই সম্বল।”

“কিছুই কি করা যায় না?”

অভ্র নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “জানি না। শুধু গলিঘুঁজির অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আলোর রাস্তাটা খুঁজে পাচ্ছি না। তুই যে আমার জন্য ভাবছিস এটা দেখে ভাল লাগছে।”

রুমকি আর্দ্র গলায় বলল, “আমাকে কী ভাবিস তুই? বিবেকবর্জিত পাষাণ না রোবট? তুই এ রকম থাকলে যে আমার সমস্ত সুখের মাঝখানে একটা কাঁটা ফুটে থাকবে! কী করে বোঝাই তোকে? বিয়ে হলেই একটা মেয়ের প্রেম মরে যায় না।’’

হয়তো অভ্ররই অনুভূতিগুলো ক্রমশ অসাড় হয়ে যাচ্ছে। রুমকির স্বীকারোক্তিতে তার মনে ঢেউ উঠল না, দোলা লাগল না। সে বলল, “যে জন্য তোকে কল করেছিলাম। শুভ জন্মদিন, রুমি।”

রুমকির গলায় খুশির ছোঁয়া, “মনে রেখেছিস? তুই যে মনে রাখবি তা জানতাম। বিয়ের পর এই প্রথম আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালি। তুই হাব্বাডাব্বা, লটারি সব ছেড়ে দিয়েছিস এই খবরটাই তোর তরফ থেকে এ বারের জন্মদিনের আসল উপহার। ধন্যবাদ জানিয়ে তোকে ছোট করব না।”

“রুমি, তুই জীবনে সুখী তো?”

রুমকি হাসল, “হঠাৎ এত দিন পরে এই প্রশ্ন?”

“জানতে ইচ্ছে হল। কত কিছুই তো জানতে ইচ্ছে করে! জীবনে কোথায় কী ভুল করলাম, কেন হেরোদের এক জন হয়ে গেলাম জানতে বড্ড কৌতূহল হয়।”

“সুখী বা অসুখী এই নিয়ে না ভাবলেও চলে। আসল কথা হল জীবনকে দেখার চোখ। ও সব অবান্তর কথা বাদ দে। অভ্র, এখনও তোর জেতার সময় রয়েছে,” রুমকি বলল, “কালীপুজোর পরেই আমরা কলকাতায় থিতু হচ্ছি আপাতত। তার মানে হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিন। এর মধ্যে তোর সঙ্গে দেখা করা যাবে?”

“বাড়িতে চলে আয়।”

রুমকি বলল, “ওখানে যেতে পারব না। কেন পারব না তা বোঝাতে চাই না। অন্য কোনও জায়গার কথা বল।’’

অভ্র বলল, “আচ্ছা। একটু ভাবার সময় দে।”

“তোর মন যদি সাড়া দেয় তবেই জানাবি। আমার মন রাখার দায় তোর নিশ্চয়ই নেই।”

অভ্র মৃদুস্বরে বলল, “তাই তো সময় চাইলাম।”

“রাখছি রে।”

“আচ্ছা।”

সকাল থেকেই অভ্রর ভিতরের অস্থিরতাটা তীব্র হচ্ছে। এই ভাবে বেঁচে থাকার কোনও মানে খুঁজে পাচ্ছে না সে। স্কুল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষার কোনও বিজ্ঞপ্তি এখনও দেয়নি। দেবে এমন আশাও নেই মনে হচ্ছে। মাত্র কয়েকটি টিউশন সম্বল করে কিছুই হবে না। শেয়ার-মার্কেটে কেনাবেচা করে সে লাভ করছে ঠিকই, কিন্তু সেখানেও তো হঠাৎ করে ধস নামার আশঙ্কা আছে। সে মাত্র পঞ্চাশ হাজার পুঁজি নিয়ে নেমেছে।

সুঠাম চেহারা ও রূপ। এটুকুই তার সম্বল। কুশলের প্রস্তাবটা এক বার ভেবে দেখলে হয়। প্রথম বার শুনেই সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। তার স্কুলমেট কুশল পড়াশোনায় সাধারণ ছিল, তবে খেলাধুলোয় চৌকস, জিম করা পেটাই চেহারা। কী ভাবে যোগাযোগ হয়েছিল তা খুলে বলেনি কুশল। সে এখন ‘জিগোলো’, পুরুষ যৌনকর্মী হিসেবে তার খুব ‘ডিম্যান্ড’। কলকাতায় একটি পিজি-তে থাকে। রাস্তায় দাঁড়ানোর ব্যাপার নেই, একটি সংস্থায় নাম লেখানো আছে, তারাই লিঙ্ক হিসেবে কাজ করে, পেশাদারি মনোভাব থেকে নিজের কাজটা করে কুশল। বিভিন্ন বয়সের নারীদের চাহিদা মেটায়, বিনিময়ে রোজগার যথেষ্ট। কুশলের হাত ধরে ওই কাজেই নেমে পড়বে সে। সপ্তাহে দু’দিন বাড়িতে থাকবে, বাকি পাঁচ দিন মহানগরে। বছর দশেক ওই কাজ করে টাকা জমিয়ে কোনও ব্যবসায় নামা যাবে।

মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে না পাঠিয়ে ঈশ্বর নামের গোলমেলে লোকটি তাকে হাইফাই পেডিগ্রির কুকুর করে পাঠাতে পারতেন। কোনও মন্ত্রী বা ব্যবসায়ীর স্পেশাল এয়ারকন্ডিশনড রুমে ভালমন্দ খেয়ে-ঘুমিয়ে তোফা কাটানো যেত। এ দেশে শিক্ষিত বেকারের চেয়ে পোষ্য কুকুরের খাতির অবশ্যই বেশি হয়।

নীচে নামতেই সুপ্রীতি বললেন, “তোর সঙ্গে কথা আছে।”

“বলো।”

“চেয়ারে বসে ঠান্ডা মাথায় শোন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা যায় না।”

অভ্র ভুরু কুঁচকে বলল, “গুরুত্বপূর্ণ কথা?”

“হ্যাঁ। বড়দা একটি মেয়ের সন্ধান দিয়েছে।”

“মেয়ে?’’

“মেয়েটি অনার্স পাশ করেছে। বাবা সাধারণ চাষি, জমিজমা অল্প, অবস্থা ভাল নয়। মেয়েটি দেখতে-শুনতে ভালই। বেচারির বিয়ে হচ্ছে না। বুঝতেই পারছিস, দাবিদাওয়ায় আটকে যাচ্ছে।”

“হুঁ। ঝেড়ে কাশো এ বার।”

“আমাদের দাবিদাওয়ার ব্যাপার নেই। গরিব ঘরের মেয়ে, অল্পে খুশি থাকবে, আমাদের জন্য উপযুক্ত। এক বার দেখলে হয় না?’’

অভ্র এক রাশ বিরক্তি নিয়ে তাকাল, “বেলা দশটায় পাত্রীর বিজ্ঞাপন শোনার কোনও ইচ্ছে নেই। তোমার আহ্লাদ দেখে আশ্চর্য হচ্ছি। তোমার মাথাটা কি গেছে? কত রোজগার আমাদের? কুড়িয়ে বাড়িয়ে পঁচিশ হাজার। নিজেদেরই চলে না। ঝামেলা না করলে চলছে না? তোমার বড়দাকে বলো যে পাত্রী
খুঁজে উপকার করতে হবে না। আমার জন্য যেন একটা কাজের সন্ধান দেয়।”

“বড়দা গাঁয়ের রিটায়ার্ড স্কুলমাস্টার। সে আবার কোন কাজের সন্ধান দেবে?’’

“তা হলে পাত্রী নিয়েও মাথা ঘামাতে যেন না যায়,’’ অভ্র বলল, “ফের ওই নিয়ে একটি কথা বললে আমি তাণ্ডবনৃত্য শুরু করে দেব।”

সুপ্রীতি ব্যাজার মুখে বললেন, “বলব না। বড়দা ঘটকালি করে বেড়ায়, খোঁজখবর রাখে, তাই বলছিল। সুমির জন্যও তো বড়দা সম্বন্ধ দেখছে।”

“সুমি?’’

“চোখ গোল করে তাকাচ্ছিস কেন? সুমির বিয়ে হতে পারে না?’’

অভ্র বলল, “কেন হতে পারে না? অবশ্যই হতে পারে। পাড়াগাঁয়ে আগের মতো রক্ষণশীল মনোভাব নেই শুনে খুশি হচ্ছি। হিমেন, তোমার খুড়তুতো দাদার ছেলে, চাষবাস করে, অবস্থা মন্দ নয়, তার কথা মনে পড়ল। কোনও এক ডিভোর্সি মেয়ের সম্বন্ধ এনেছিল ঘটক। তোমার দাদাটি তাকে পারলে সেখানেই জুতো খুলে মারত। তার সোনার ছেলের জন্য কিনা ডিভোর্সি মেয়ে? মনে পড়ে?’’

সুপ্রীতি বললেন, “মনে আছে। দিনকাল বদলেছে। তুই যাস না, তাই জানিস না।”

“সুমি রাজি?’’

সুপ্রীতি বললেন, “ওকে না জানিয়েই সম্বন্ধ দেখা হচ্ছে। ও শুনলে তোর মতোই কাণ্ড ঘটাবে। এ দিকে ওর বাবা-মা বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া। নিজেদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত না করলে শান্তি পাচ্ছে না ওরা।”

“ভুল? কী রকম সেটা?’’

“ও দিকের এক নামকরা ডাক্তারের ছেলে পাত্র ছিল। সম্বন্ধ আসতেই ওরা আহ্লাদে গলে গিয়ে খোঁজখবর না নিয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। ছেলে হোমিয়োপ্যাথ ডাক্তার, চেম্বার করে। বাবার বিশাল অবস্থা। সুমির বাবা-মা যেন হাতে চাঁদ পেল।”

“বিয়েটা হয়ে গেল?’’

“হ্যাঁ। বিয়ের পরেই জানা গেল যে ছেলেটি মাতাল। সন্ধের পর থেকেই ওই সব ছাইভস্ম গিলে টং হয়ে থাকে। এই দোষের জন্যই কোনও ভাল ঘরে তার বিয়ে হচ্ছিল না। সুমিদের অবস্থা তেমন ভাল নয়, তাই পাত্রপক্ষ রাজি জেনে অন্য কিছু ভাবলই না। সেই ছেলে মাতাল হয়ে সুমিকে প্রায়ই মারধর করত। তার ওপর ছেলের চরিত্রের দোষও আছে। পরে সুমি ঘুরে দাঁড়াতেই ঝগড়াঝাঁটি, প্রবল অশান্তি শুরু হল। দু’বছর সহ্য করার পরেই সুমি কোর্টে ডিভোর্সের... কী যেন বলে!’’

অভ্র খেই ধরায়, “ডিভোর্সের মামলা করে।”

ক্রমশ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement