ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ২২
Novel

মায়া প্রপঞ্চময়

আমার অবস্থা বেশি চুন লেগে জিভ পুড়ে যাওয়া মানুষের মতো, কোনও সুস্বাদু জিনিসেরই স্বাদ ঠিক করে পেলাম না দাম্পত্য জীবনে!

Advertisement

কানাইলাল ঘোষ

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২০ ০০:০৫
Share:

এই জায়গা পর্যন্ত এসে অন্নু একটা নিটোল যুক্তি আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে, কেন মানিককে ভুলে যাওয়ার জন্যে ও একা দায়ী হবে, যেখানে মানিক বারবার করে দু’জনকেই পরস্পরের কাছে মৃত ঘোষণা করে বিস্মৃতির ছাড়পত্র দিয়ে গিয়েছে? কিন্তু পরক্ষণেই খেয়াল করে যে, এখানেও ও আবার একটা সুযোগ তৈরি করে নিচ্ছে। মানিক সম্পর্ক রাখার বিরোধী ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা তো অন্নুরই ভাল চেয়ে। কিন্তু সে তো কখনও বলেনি যে, দিনে এক বার করে আমাকে মনে কোরো না। সেই কাজটুকু কি অন্নু এতগুলো বছরে করেছে? ও তো নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল এত কাল! নিজের সংসার, ভবিষ্যৎ, স্বামী, সন্তান, কেরিয়ার— এ সবের মাঝে নিয়ম করে মানিককে তো মনে পড়েনি!

Advertisement

ড্রাইভার বিড়বিড় করে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে, ‘‘এক হি হাদসা নে মেডামজি কো পাগল বনা দিয়া, পাঁচ মিনট পহলে মকান পৌঁছ চুকা হুঁ লেকিন উনকি হোঁশ নেহি আয়া আভি তক। কেয়া সোচ রহি হ্যায় রামজি জানে...’’ এক বার জোরে হর্ন দেয় ও ম্যাডামের হুঁশ ফেরাতে এবং তাতে কাজ হয়। ধড়মড়িয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে অন্নু গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।

Advertisement

ঘরে ঢুকতেই প্রীতের হাজারও প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়, কোথায় গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল। ইচ্ছে না থাকলেও উত্তর দিতে হয় ওকে, অশান্তি এড়ানোর জন্যে। প্রীত নিজেও যথেষ্ট টেনশনে রয়েছে, সেটা স্বীকার করে, ‘‘আজও খবর পেলাম, ইন্টারন্যাশনালি নামী কোম্পানির ব্র্যান্ডেড জুয়েলারিতেও পাইকারি হারে ভেজাল ঢুকেছে, অথচ ওরা এত পাওয়ারফুল যে, কিচ্ছু করার উপায় নেই। ল্যাবে তৈরি ময়সানাইট কিংবা কিউবিক জ়ারকোনিয়ামের মতো নকল জেল্লাদার জেমস্টোন দিয়ে এমন জুয়েলারি তৈরি করছে যে, পয়সাওলা কাস্টমাররা কুড়ি ডলার পার ক্যারাটের নকল হিরেকে পনেরোশো ডলার পার ক্যারাটের বেস্ট কোয়ালিটি আসল হিরে ভেবে কিনে নিয়ে যাচ্ছে! ক’টা লোকই বা জানে যে খুব সাধারণ ভাবে ওয়াটার টেস্ট, ফগ টেস্ট, হিট টেস্ট, নিউজ়পেপার রিড-থ্রু টেস্ট বা ডট টেস্ট দিয়েই ওই ফারাক ধরা যায়? অথচ সমস্ত এথিক্স বজায় রেখেও কম্পিটিশনে মার খেয়ে যাচ্ছে আমার মতো জেনুইন ব্যবসায়ীরা। এ ভাবে হয়তো আর ব্যবসা চালানো যাবে না!’’

ওকে কিছুটা শান্ত করে অন্নু স্নান করতে ঢোকে। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা জলের ধারায় নিজেকে মেলে ধরতে ধরতে বাথরুমের দেওয়ালে লাগানো বড় আয়নায় নিজেকে দেখে। চকিতে সারা শরীরে শিহরন খেলে যায়। সত্যিই তো, এই বিশেষ ভাবনাটা এত দিন কী করে ভুলে ছিল ও! শয়তানটা এক দিন শরৎচন্দ্রের দেবদাস থেকে বলেছিল, ‘‘শোন পার্বতী, অতটা রূপ থাকা ভাল নয়, অহঙ্কার বড় বেড়ে যায়।... শেষ বিদায়ের দিনে শুধু একটুখানি মনে রাখার মতো চিহ্ন রেখে গেলাম। অমন সোনার মুখ আরশিতে মাঝে মাঝে দেখবে তো?’’ তার পর বলেছিল, ‘‘তোমাকেও মনে রাখার মতো কিছু স্মৃতি হয়তো আমি দিয়ে গেলাম যাতে আমাকে ভুলতে গিয়েও একেবারে ভুলতে না পার! পার্বতীর কপালে দেবদাস ছিপের ঘা মেরেছিল মাত্র একবারই।’’

শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে ম্যালেরিয়ার রোগীর মতো থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে ও। হাত-পা যেন অসাড় হয়ে আসে। সব দিক ভেবে-চিন্তে কাজ করে গিয়েছে শয়তানটা, ও নিজে যত দিন সজ্ঞানে বেঁচে আছে, তত দিন পুরোপুরি ভুলে যাওয়ার কোনও অবকাশ রাখেনি। হতে পারে, খুব ঘটা করে ও মানিককে মনে করেনি প্রাত্যহিক রুটিন হিসেবে, কিন্তু যখনই ওর বলে যাওয়া কোনও কথা, ওর করে যাওয়া কোনও কাজ ওর সামনে নতুন করে কেউ রিপিট করেছে, তখনই তো মনের কোণে মানিকের ছায়া আলগোছে ওকে ছুঁয়ে গিয়েছে। ওদের বিচ্ছেদের সময় থেকেই এটা স্বতঃসিদ্ধ, যে যখনই ও নিজেকে আয়নায় দেখবে তখনই মানিকের কথা ওকে মনে করতেই হবে, বিশেষ করে আজকে বিস্মৃতির অতলে চাপা-পড়া সে দিনের ঘটনাটা নতুন করে মনে পড়ার পর। তাড়াতাড়ি মনের জোর সংগ্রহ করে শাওয়ারটা বন্ধ করে অন্নু, প্রীতও না খেয়ে বসে আছে এত বেলা পর্যন্ত।

খেতে-খেতে প্রীত ওকে বোঝায় হিরে পরখ করার জন্যে কোন টেস্ট কী ভাবে করতে হয়। অন্নু দায়সারা হ্যাঁ-হুঁ দিয়ে যেতে থাকে যত ক্ষণ না মিস্টার মেহতার ফোন আসে প্রীতের মোবাইলে। বেশ খানিক ক্ষণ কথা বলে প্রীত ফোন কেটে দিয়ে অন্নুকে জানায়, ‘‘মিস্টার মেহতা তোমার প্রেজ়েন্স অব মাইন্ডের খুব প্রশংসা করলেন, বললেন, ‘আপনার স্ত্রী না থাকলে আজ আমার ছেলে বাঁচত না। এই জন্যেই তো ওঁর হাতে আমার অবোধ ছেলেটাকে তুলে দিয়েছি। আমি সংস্থায় ডোনেশন বাড়িয়ে দেব, শুধু ওঁকে বলবেন যেন আমার ছেলেকে উনি মাতৃস্নেহে দেখভাল করেন!’ আমিও বললাম যে ওঁর রিকোয়েস্ট তোমার কাছে পৌঁছে দেব।’’ সেভেন্টি ফাইভ পার্সেন্টের বিজ়নেস পার্টনারের মুখে নিজের স্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা শুনে খুশিতে প্রীতের মুখ-চোখ উজ্জ্বল। বিজ়নেসের এই লোকসানের সময় বড় তরফকে খুশি রাখা দরকার বইকি!

অন্নু কিছু না বলে ঘরে ঢুকে আসে। প্রীতকে বলা যাবে না যে, শুধুমাত্র নিজের অবোধ ছেলেকে নয়, মিস্টার মেহতা নিজেকেও অন্নুর হাতে তুলে দিতে পারলে পরম সুখী হবেন। আসলে ছেলেটা হওয়ার পর থেকেই মিসেস মেহতার সঙ্গে ওঁর মানসিক ও শারীরিক দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে-বাড়তে এখন পয়েন্ট অব নো রিটার্নে পৌঁছে গিয়েছে। ইশারায় ইঙ্গিতে অন্নুর প্রতি দুর্বলতার বিষয়টা উনি আজকাল বেশ ঘন ঘনই ব্যক্ত করে চলেছেন। প্রীতকেও অল্প-অল্প করে হাই সোসাইটির নানা পরকীয়া আর নানা ধরনের অল্টারনেটিভ রিলেশনের ঘটনা বলে সইয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু এধরনের আভাস এলেই অন্নুর কানে বাজতে থাকে মানিকের বলা কথাগুলো, ‘যদি শেষ পুরুষও না হতে পারি তবে...’

ঘরের দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একেবারে ভেঙে পড়ে ও, বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘‘আর কত শোধ নেবে তুমি? আর কত দিন ধরে এই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে আমায়? আমার প্রেমকে প্রেম থাকতে দিলে না, বিয়েও ঠিক বিয়ের মতো হল না। আমার অবস্থা বেশি চুন লেগে জিভ পুড়ে যাওয়া মানুষের মতো, কোনও সুস্বাদু জিনিসেরই স্বাদ ঠিক করে পেলাম না দাম্পত্য জীবনে! কোথাও না থেকেও সব জায়গায় রয়েই গেল তোমার উপস্থিতি, তুমি বেঁচে থেকেও আমার কাছে মারা গেলে, আবার মরে গিয়েও পাঁচ বছর পরে বেঁচে উঠলে! তুমি নিজেও যেমন ঠিক করে কিছু পেলে না, আমাকেও তেমনি সব পেয়েও কিছু পেতে দিলে না...অপয়া, পনৌতি কোথাকার...’’

অনেক ক্ষণ প্রাণভরে গালিগালাজ করে মনটা একটু শান্ত হতে অন্নু অপালাকে ফোনে ধরে খেজুরে আলাপ চালাল। উদ্দেশ্য, যদি ওর কাছে মানিকের কোনও খবর থাকে তো বেশি ক্ষণ চেপে রাখতে পারবে না। আসলে ও নিজেও জানে না যে ও কী চাইছে এখন। টিভিতে যাকে দেখেছে সে যে মানিকই, এ বিষয়ে ও নিঃসন্দেহ। ওখানে সে যে জীবজন্তুর পাহারাদারির ছোটখাটো একটা কাজ করছে, সেটাও বোঝা গিয়েছে। কিন্তু অপালার সঙ্গে এর মধ্যে মানিকের দেখা বা যোগাযোগ হয়েছে কি না, কিংবা ও কী ভাবে বেঁচে উঠল, এত দিন কোথায় কী করছিল— সেই সব কথাগুলো অপালা না বললে অন্নু জানবে কী করে?

বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে অপালার বদমায়েশি বুদ্ধি বেড়েছে। স্কলার থাকার সময় বোঝা যায়নি, ও এত ধূর্ত! ওকে বরাবর বোকা ভেবে গিয়েছে অন্নু। সেই জন্যে আধ ঘণ্টা ধানাইপানাই করেও অন্নু যখন আসল কথাটা বার করতে পারল না, তখন বাধ্য হয়েই বলে ফেলল, ‘‘হ্যাঁ রে, তুই যে সে বার আমাকে বললি, মানিককে সহদেব খুব খারাপ অবস্থায় দেখেছে শিলিগুড়ির নার্সিং হোমে! কিন্তু আমার তো মনে হল কাল টিভিতে ওকেই দেখলাম কী সব হাবিজাবি বকছে পশুপাখিদের নিয়ে। সত্যিই ও, না কি ওর মতো দেখতে অন্য কেউ...’’

ও পাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসে, ‘‘আর ন্যাকামি করিস না অন্নু, তুই কি আমাকে আগের মতোই ক্যাবলা ভাবিস? তুই ঠিকই বুঝেছিস। হ্যাঁ, ও এখন কালীপুর চিড়িয়াখানায় আছে, বোধ হয় ওখানকার জন্তু-জানোয়ারদের নোংরা সাফ করে। আসলে ওর মতো পোড়াকপালে ছেলেদের শেষ সম্বল তো ও রকম কিছুই হয়, ও নিয়ে তুই ভাবিস না। আমার সঙ্গে ওখানেই দেখা হল তো। ফোন নাম্বারও দিয়েছিল। মাঝে-মাঝে কথাবার্তা হয় টুকটাক। টিভিতে কোনও অনুষ্ঠান থাকলে আমাকে আগে জানিয়ে দেয়। আমি বাবা ওর প্রোগ্রাম মোটেই মিস করি না! এত গুছিয়ে আর সহজ করে বলে যে, আমি পর দিনের রিপিট টেলিকাস্টটাও মন দিয়ে দেখি। তা তুই হলি হীরকসম্রাজ্ঞী, তোর ও সব পাতি লোকেদের খবর নিয়ে তো উৎসাহ থাকার কথা নয়! ছাড় এ সব ফালতু কথা, মানিক গোল্লায় যাক।’’

অন্নুর বুঝতে বাকি রইল না যে, অপালা আগাগোড়া ওকে ঠুকে গেল ও বেকায়দায় পড়েছে জেনে। হতে পারে। সহদেব তো একটা সাদামাটা চাকরি করে, অপালাকেও একটা বাচ্চাদের প্রাইভেট স্কুলে চাকরি নিতে হয়েছে একটু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আনার জন্যে, সব মিলিয়ে একটা জেলাসি কাজ করছে অপালার মনে। একে মানিক ভাল ভাষায় ‘অসূয়া’ বলত। ফোন রাখতে-রাখতেই নিজেরও বুকের মধ্যে একটা অদ্ভুত জ্বালা টের পেল অন্নু, এটাও অসূয়া না কি? মানিকের সঙ্গে রেগুলার ফোনে কথা হয় অপালার, অথচ মানিক এক বারও অপালার কাছে অন্নুর প্রসঙ্গ তোলেনি। এক সময় কত রিস্ক নিয়েছে অন্নু মানিকের সঙ্গে দেখা করতে, ওর সঙ্গ পেতে, আর আজ— মাঝে এতগুলো বছর কেটে যাওয়ার পরও ওর উপর মানিকের আক্রোশ আর বিদ্বেষ গেল না!

হঠাৎই একত্রিশ বছর আগের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল অন্নুর। ওরা বেশ ক’জনে মিলে গাড়ি ভাড়া করে লোকাল টুর-কাম-পিকনিক করতে গিয়েছিল নালন্দায়। পটনা থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টার রাস্তা। রাস্তার পাশে একটা বাগানে গাছ-ভর্তি পাকা আর ডাঁশা পেয়ারা দেখে অন্নুই উৎসাহ দেখিয়ে বেশ কয়েকটা পেয়ারা জোগাড় করল। নালন্দা হেরিটেজ সাইট দেখা শুরু করার সময় ব্যাগ থেকে পেয়ারা বার করে সবাইকে ভাগ করে দিয়ে মানিককেও সাধল একটা বড় ডাঁশা পেয়ারা। মানিকের তো সবেতেই ওর উল্টো দিকে যাওয়া স্বভাব, ঠোঁট উল্টে বলল, ‘‘খাব না, পেয়ারা আমার ভাল লাগে না।’’

ওরও কেমন গোঁ চেপে গেল, দেখিয়ে দেখিয়ে ওই পেয়ারাটাতেই কামড় দিতে-দিতে খণ্ডহরের মধ্যে দিয়ে পথ খুঁজে এগিয়ে গেল। নজর ছিল মানিকের গতিবিধির উপর, একটা গলিপথে ওকে একা পেয়ে এ দিক-ও দিক দেখে মানিককে জাপটে ধরে, চুলের মুঠি পাকড়ে ওর মুখটা টেনে আনল। আধ মিনিট দু’জনেরই বাহ্যজ্ঞান ছিল না। তার পর ঘন শ্বাসের সঙ্গে যখন অন্নু জিজ্ঞেস করল, ‘‘অব বাতাও, অমরুদ তুমকো আচ্ছা লাগতা, ইয়া নহী?’’ উত্তরটাও ও দ্রুত পেয়েছিল নিজের পদ্ধতিতেই। বাকি সময়টা যেন ওরা দু’জনেই হাওয়ায় ভাসছিল। সে দিন মানিক ওকে ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘চার্বাক ও মঞ্জুভাষা’ শুনিয়েছিল আর ওর মনে হয়েছিল পৃথিবীতে ওরা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই, থাকার দরকারও নেই ৷

আজ এতগুলো বছর পরেও সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল সেই অনুভূতির কথা মনে পড়তে। অন্নু টের পেল, মানুষটা যেমন মরতে মরতেও বেঁচে গিয়েছে, তেমনই ওদের সম্পর্ক, ভালবাসা আর অনুভূতি মরেও মরেনি। শোওয়ার ঘরের দরজা আটকে, চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে দিতে দিতে অন্নু ফিসফিস করে বলে চলল, ‘‘ভুলতে পারিনি তোমাকে, ভুলবও না আমৃত্যু। তুমি আমাকে মনে রেখেছ কি না জানি না, জানতেও চাই না। কিন্তু এর চেয়ে বড় সত্যি আর নেই যে, আমার এক আশ্চর্য ভালবাসা রয়ে গিয়েছে তোমার সঙ্গেই— শুধু তোমারই সঙ্গে। আর সব কিছুই এ সংসারে ধোঁকা!’’

১০

কিছুটা আচমকাই ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ায় বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল বেন্দা। কিন্তু এত দিন কাছে-কাছে থেকে ও বুঝতে শুরু করেছে যে, সঙ্গের লোকটা পাগলের মতো আচরণ করলেও পরে তার সুফল বোঝা যায়। বিশেষ করে ও নিজে তো প্রাণেও বেঁচে গিয়েছে এক বার। তাই ধুলো-মাটি ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ও আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল ব্যাপারটা কী হল! তত ক্ষণে উনিও হাত পাঁচেক দূরে নদীর পাড়-ভাঙা আলগা মাটির স্তূপে লাফিয়ে নেমেছেন। বেন্দার পঁয়ত্রিশ বছরের রোগা ছিপছিপে চেহারা, হঠাৎ সাত-আট ফুট উপর থেকে পড়লেও, একদম আলগা মাটিতে পড়ায় ব্যথা-বেদনা লাগেনি।

ও কিছু বলার আগেই উনি বেন্দার হাত ধরে টানতে-টানতে পাড় থেকে কুড়ি-পঁচিশ ফুট নদীগর্ভের দিকে টেনে এনে বললেন, ‘‘কাছে পাড়ের আড়াল পড়ায় দেখতে পাবে না। এ বার এখান থেকে দেখো আমরা যেখানে ছিলাম সেই জায়গাটা।’’

বেন্দা অবাক হয়ে দেখল, একটা বিশাল হাতি ওদের দিকে তাকিয়ে শুঁড় দোলাচ্ছে, যেন বলতে চাইছে, তফাত যাও, তফাত যাও! পাশেই একটা একদম বাচ্চা হাতি— গায়ের তামাটে রোঁয়াই বলে দিচ্ছে, বয়স কয়েক সপ্তাহের বেশি হবে না— পাশে দাঁড়িয়ে ছোট্ট শুঁড়ের আগাটা মুখের মধ্যে পুরে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে।

স্যর বললেন, ‘‘মানুষের শিশু যেমন জীবনে প্রথম হাতি দেখে মুখে আঙুল দিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখে, এই হাতির শিশুটাও তেমনই প্রথম বার মানুষের সামনে এসে মুখে শুঁড় ভরে অবাক বিস্ময়ে আমাদের দেখছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু পিছনের জঙ্গলে আরও হাতি রয়েছে, ছোটখাটো একটা দলও থাকতে পারে। পালের হাতিরা এমনিতে শান্ত, কিন্তু বাচ্চা সঙ্গে আছে বলে ভিতরে একটা উগ্র ভাব আছে, বিশেষ করে মানুষকে ওরা মোটেই বিশ্বাস করে না। আর দশ সেকেন্ড দেরি হলে বড়টা তোমাকে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরত। আসলে হাতিরা এত নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারে যে, একেবারে গায়ের উপর চলে এলে তখন বুঝতে পারা যায়। কিন্তু তখন আর কিছু করার থাকে না। আজ জোর বাঁচা বেঁচে গেলে, বৃন্দাবন!’’

সে কথা আর বেন্দাকে না বললেও চলত। চোখের সামনে পাহাড়ের মতো হাতিটাকে শুঁড় দোলাতে দেখে বাকিটা আন্দাজ করতে কষ্ট হয় না।

ভ্যাবলার মতো ও বলে ফেলে, ‘‘এই লিয়ে দু-দু’বার আপনি হামাকে বাঁচায়ে দিল্যেন, স্যর। কিন্তুন আপনি বুইঝত্যে পারল্যেন কী করে য্যে গণ্যেশবাবাজিরা ইখানট্যায় আছে? হামি ত কুন্যো কিছ্যুই টের পেল্যম নাই!’’

ক্রমশ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement