ছবি কুনাল বর্মণ।
মনে পড়তেই উষাপতি লজ্জা পেয়ে গেলেন এবং তক্ষুনি বাক্সটি আনার উদ্দেশ্যে ঘরে ফিরে যাচ্ছিলেন। জগদিন্দ্রনাথ তাঁকে নিবৃত্ত করলেন। তার পর “নবীন, নবীন” বলে হাঁক পাড়লেন। উষাপতির আগের দেখা সেই ভৃত্যটি উপস্থিত হলে, মহারাজ তাকে উষাপতির বাক্সটি নিয়ে আসার আদেশ দিলেন। চাকরটি চলে গেলে জগদিন্দ্রনাথ বললেন, “ওর নাম নবীনচন্দ্র। আমি নবীন বলে ডাকি। সেই ছেলেবেলা থেকে আমার সেবায় আছে। কাজের লোক হলেও, নবীনকে আমি ভাইয়ের মতোই দেখি। আমার মা, মানে রানি ব্রজসুন্দরীদেবীও সন্তান জ্ঞানে ওকে দেখতেন। আমাদের ভাইবোনেদের যেমন নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন, নবীনকেও দিতেন। ছেলেবেলায় খুব রোগে ভুগতাম। কখনও ম্যালেরিয়া, কখনও বা কলেরা। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নবীন সব সময় আমার পাশে থেকেছে। আজও ছায়ার মতো ও সঙ্গে আছে।”
নবীন বাক্স নিয়ে চলে এসেছে। তার হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে উষাপতি মোটরে উঠে বসলেন। জগদিন্দ্রনাথ আগেই উঠেছিলেন। যাত্রার আগে উষাপতি গাড়ির জানলা দিয়ে প্রাসাদের মতো বাড়িটির দিকে তাকালেন এক বার। নজরে এল, বারান্দায় রানিমা এসে দাঁড়িয়েছেন। হাত তুলে বিদায় জানাতে গিয়েও জানালেন না। গাড়ি তত ক্ষণে চলতে শুরু করেছে, লোহার ফটক পেরিয়ে রাস্তায় উঠে ধীরে ধীরে গতি নিয়েছে।
স্টার থিয়েটারের সামনে এসে যখন গাড়ি থামল, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। উষাপতি প্রথম নামলেন। তার পর জগদিন্দ্রনাথ। স্টার থিয়েটারের সামনে জুড়িগাড়ির যেন মেলা বসে গেছে। অনেক কেষ্টবিষ্টু এসেছেন। কেউ কেউ মহারাজের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছেন। জগদিন্দ্রনাথ পকেট থেকে একটি চিঠি বার করে টিকিট কাউন্টারে দেখালেন। সঙ্গে সঙ্গে একটি ছেলে এসে মহারাজকে থিয়েটার হলের ভিতরে নিয়ে গেল। উষাপতি ছায়ার মতো মহারাজকে অনুসরণ করলেন।
মহারাজ জগদিন্দ্রনাথ ও তাঁর মতো গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জন্য প্রথম সারির কিছু আসন সংরক্ষিত। সেখানে নির্দেশিত দু’টি জায়গায় বসে পড়লেন দু’জনে। স্টার থিয়েটারে নাটক দেখতে আসা এই প্রথম উষাপতির। এর আগে মিনার্ভায় নাটক দেখেছেন। নাটকের নাম ‘সাজাহান’।
সেই নাটকে ঔরঙ্গজেবের ভূমিকায় দানীবাবুর অভিনয় মনে দাগ কেটে গিয়েছিল। কী অভিব্যক্তি! যেন সত্যিকারের মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছেন। সেই রকম ক্রূর, কুটিল ও নিষ্ঠুর! কী আশ্চর্য, আজ যে নাটকটি দেখতে এসেছেন,
তার নামও ‘সাজাহান’।
তবে, ঔরঙ্গজেব এখানে অমর দত্ত। নাটক শুরু হতে আরও পাঁচ মিনিটের মতো বাকি আছে। উষাপতি পকেট থেকে ঘড়ি বার করে সময় দেখলেন। তার পর ঘাড় ঘুরিয়ে এ দিক-ও দিক দেখলেন। দর্শকাসন প্রায় সবই ভর্তি। এখনও লোক আসছে। বলা বাহুল্য, নাটক শুরু হওয়ার পরও কিছু লোক আসবে।
নাটক শুরু হলে বুঁদ হয়ে গেলেন উষাপতি। এই সাজাহান যেন অন্য সাজাহান! ঔরঙ্গজেবের ভূমিকায় অমর দত্ত অনন্য। এই ঔরঙ্গজেব কুটিল নয়, খোদার হাতে ক্রীড়নক মাত্র। কী অভিনয়! কেন এই মানুষটাকে মাথায় নিয়ে নাচবে না দর্শক?
এক সময় নাটক শেষ হল।
জগদিন্দ্রনাথ উষাপতিকে বললেন, “কেমন দেখলেন নাটক?”
“সম্পূর্ণ অন্য রকম। অমরবাবুর ঔরঙ্গজেবকে দেখে রাগ বা ঘৃণা হয় না, যেটা দানীবাবুর ঔরঙ্গজেবকে দেখে হয়েছিল। এই ঔরঙ্গজেবকে দেখে করুণা হয়, চোখে জল আসে। সব কিছুই করছেন, অথচ কোনও কিছুর জন্যই তিনি দায়ী নন। ভাগ্যবিপর্যস্ত এক মানুষ। এক কথায় অসাধারণ।”
“চলুন, একটু অমরবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি...” জগদিন্দ্রনাথ বলেন।
“চলুন,” বলে উষাপতি উঠে পড়েন।
যেতে যেতে জগদিন্দ্রনাথ বলেন, “আপনি দানীবাবুর সাজাহান দেখেছেন, বলেননি তো?”
উষাপতি হাসতে হাসতে বলেন, “ঠিক করেছিলাম, অমরবাবুর অভিনয় দেখার পর বলব।”
“কার অভিনয় বেশি ভাল লাগল?” উষাপতিকে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন জগদিন্দ্রনাথ।
“দু’জনের অভিনয়ই ভাল। তবে অমরবাবুর অভিনয় অন্য রকম। কী যেন আছে, যা দানীবাবুর অভিনয়ে আমি পাইনি!” উষাপতি বলেন।
সাজঘরে মহারাজ জগদিন্দ্রনাথকে দেখে আপ্লুত হয়ে পড়লেন অমর দত্ত। একটা চেয়ার আনিয়ে বসতে বললেন মহারাজকে। জগদিন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে রইলেন। বললেন, “আপনার শরীর কেমন?”
“ভাল নয়। শুধুমাত্র নাটক করব বলে বেঁচে আছি,” মৃদু হাসি হেসে বললেন।
জগদিন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ বদলালেন, ‘‘আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, বিখ্যাত গল্পকার ও ঔপন্যাসিক উষাপতি মুখোপাধ্যায়...” বলে উষাপতিকে দেখালেন। অমর দত্ত অবাক হয়ে তাকালেন উষাপতির দিকে। হাতজোড় করে নমস্কার করলেন। প্রতিনমস্কার জানালেন উষাপতি। বললেন, “চমৎকার অভিনয় আপনার। অনেক দিন মনে থাকবে।”
অমরবাবু হাসলেন। বললেন, “ওইটুকুই তো পারি। আর সবেতেই শূন্য।”
একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, “জুলাই মাসের তিন তারিখে এখানে ‘জয়দেব’-এর অভিনয়। আসুন না ওই দিন।”
“দেখি, কলকাতায় থাকলে আসব, কথা দিচ্ছি,” উষাপতি বললেন।
সময় হয়েছিল। উষাপতি মহারাজের দিকে তাকালেন। জগদিন্দ্রনাথ বললেন, “হ্যাঁ, চলুন এ বার যাওয়া যাক।”
অমর দত্তর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বাইরে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসলেন। প্রায় নির্জন রাস্তায় গাড়ি এগিয়ে চলল অন্ধকারের বুক চিরে।
৮
বেশ কিছু কাল হল উমানাথের ব্যবসায় মন বসেছে। বড়দা ঠিকই বলেছিলেন। পাটের কারবারে আজকাল খুব লাভ। তবে সেই লাভের গুড়টা, উমানাথ মনে করে, মেজদাই খায়। ছিটেফোঁটা তার ভাগ্যে জোটে। তবু সেটাও কম নয়।
পাটের ব্যবসা শুরু করেছিল ইংরেজরা। এখন অনেক মারোয়াড়ি এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। রমানাথ ঘনশ্যামজির পার্টনার। উমানাথকে এদের সহকারী হিসেবে কাজ করতে হচ্ছে। উমানাথের কাজে মন দেখে খুশি হয়েছেন রমানাথ। বড়দার কাছেও খবর পৌঁছেছে। বড়দাও খুশি। ভেবেছেন— যাক, উমাটা নিজেকে শুধরে নিয়েছে।
উমানাথ কিন্তু শোধরায়নি। নিত্য কলকাতায় আসার সুবাদে কলকাতার জল-বাতাসে সে আরও পুষ্ট হয়েছে। কলকাতার আমোদ-ফুর্তির জায়গাগুলো সে জেনে গেছে। টাকা থাকলে সে সেখানে যেতে পারে। যত খুশি মদ্যপানও করতে পারে। কেউ বারণ করার নেই।
উমানাথের এক শাগরেদ জুটেছে সম্প্রতি। অচেনা অজানা বলে কিছু নেই লোকটার। কলকাতার অলিগলি তার নখদর্পণে। তার কাছেই কলকাতার পাঠ নিচ্ছে উমানাথ।
শাগরেদটির নাম নিবারণ দত্ত। রমানাথই একে কাজে বহাল করেছেন। রমানাথের শ্যালক উষাপতির নাকি বিশেষ পরিচিত। নিবারণকে পেয়ে অবশ্য মন্দ হয়নি উমানাথের। কাজের একঘেয়েমি থেকে মুক্তির পথ বাতলে দেওয়ার জন্য নিবারণের থেকে বড় গুরু আর হয় না।
আজ শনিবার। ঘনশ্যামজি একটার পরই বিদেয় হয়েছেন। রমানাথ আজ আসেননি গদিতে। নিবারণ একা পেয়ে গেল উমানাথকে। কাছে এসে বলল, “রূপের হাটে যাবেন নাকি এক বার?”
“কোথায়? কত দূর?” উমানাথের চোখ চকচক করে উঠল।
“কাছেই, কয়েক পা মোটে...” নিবারণ বলল।
“কোনও ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট হবে না তো?”
“কিসের ঝামেলা? টাকা দিয়ে গান শুনবেন, রঙ্গ-রসিকতা করবেন, দু’-চার পেগ মদ খাবেন, আর অন্য লোক ঝামেলা করবে! ছোঃ! নিবারণ দত্ত সেই সব জায়গায় নিয়ে যায় না। রাজি থাকলে উঠুন।”
উমানাথ উঠে পড়ে গদি থেকে। পকেট থেকে ঘড়ি বার করে সময় দেখে। হঠাৎ নজরে পড়ে, গদির দারোয়ান রামশরণ তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বিহারের লোক। বাংলা ভাল বলতে না পারলেও, বোঝে সব। নিবারণের সব কথাই শুনেছে। তাই দাঁত বার করে হাসছে। লোকটা মেজদা রমানাথের পেটোয়া। উমানাথ পকেট থেকে কিছু পয়সা বার করে গুঁজে দেয় রামশরণের হাতে। তার পর নিবারণের সঙ্গে বেরোয়। বাইরে বেরিয়ে উমানাথ দেখল, নিবারণ একটা রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছে। কলকাতায় অল্প কিছু দিন হল যাতায়াত শুরু করেছে উমানাথ। মানুষে টানা এই রিকশাতে শহর ছেয়ে গেলেও, এখনও পর্যন্ত এই যানটিতে চড়ার সৌভাগ্য হয়নি। নিবারণকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করে, “কী বলছে? যাবে না?”
নিবারণ ফিসফিস করে, “যাবে না মানে, ওর বাপ যাবে। তবে শনিবার তো, বাবুদের আমোদ-ফুর্তির দিন, তাই, দু’-চার পয়সা বেশি চাইছে।”
উমানাথ বলে, “সে নিক, তুমি চলো তো বাপু। ও দিকে আবার সময় বয়ে যায়।”
“চলুন,” বলে নিবারণ উমানাথকে রিকশায় উঠে পড়তে বলে।
উমানাথ ভয়ে ভয়ে রিকশায় ওঠে, এই প্রথম তার দু’চাকার মানুষে-টানা যানে ওঠা। রিকশাচালক যখন একটা চাগাড় দিয়ে রিকশাটিকে নীচ থেকে উপরের দিকে তুলে নিল, মনে হল— এই বুঝি পড়ে গেলাম! উমানাথ ভয়ে চোখ বুজে ফেলল। চোখ বুজে থাকা অবস্থায় টের পেল, নিবারণ পাশে উঠে বসেছে। উমানাথ যেন প্রাণ ফিরে পেল।
সেটা লক্ষ করে নিবারণ হেসে বলল, “এই প্রথম চড়ছেন মনে হচ্ছে?”
“হ্যাঁ, ওই আর কী! বেলঘরে তো এমন রিকশা নেই যে চড়ব। কলকাতায় আসছি তো সেদিন থেকে...” উমানাথ হাসতে হাসতে উত্তর দেয়।
রিকশা ঘুঙুরের টুংটাং শব্দে চিৎপুর রোড ধরে এগিয়ে চলে। খানিকটা এসে একটা বাঁক নিয়ে ঢুকে পড়ে একটা গলির মধ্যে। রাস্তার দু’পাশে সাজগোজ করে বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা দাঁড়িয়ে। সে দিকে তাকিয়ে উমানাথ বলে ওঠে, “এ যে বেশ্যাপাড়া দেখছি। নিবারণ, তোমার মতলবটা কী বলো তো!”
ক্রমশ