মৎস্যরাজ: ঔজ্জ্বল্যের জন্যই ইলিশকে জলের রুপোলি শস্য বলা হয়। —ফাইল চিত্র।
বৃষ্টি নামল। বর্ষার কালো মেঘের বৃষ্টি। মেঘলা ঠান্ডায় শরীর ভারী। এ রকম সময়ই স্বামীর সোহাগে পেটে সন্তান আসে ইলিশ-বৌয়ের। পোয়াতি ইলিশ-বৌ ডিম ছাড়তে আসবে মিষ্টি জলের নদীতে। মা গঙ্গা আর মাসি পদ্মার বুকে জল বেড়েছে। সেই জলে ইলিশ-বৌ সন্তানের জন্ম দেবে। বছরে মাত্র দু’বার আসা মিষ্টি জলের নদীতে। সেখানে ডিম ছেড়ে সন্তানদের বড় করে আবার ফিরে আসতে হবে। এই যাওয়া-আসা ইলিশের জীবনে আছে বলেই সে ‘উজানবায়ী মাছ’। ইলিশরা এ ভাবেই ঘুরতে আসে আশ্বিনের প্রথমে কৃষ্ণা নদীতে। কার্তিক মাসে প্রথমে ইলিশ-বর-বৌ আসে গোদাবরী আর ইরাবতী নদীতে। ফাল্গুন-চৈত্রে সিন্ধু নদে। গঙ্গা-পদ্মায় আসে বর্ষায় আর শীতে।
ইলিশ মাছের জন্ম নিয়ে একটি লোককাহিনি পাওয়া যায় গুজরাতের উপকূলে। তখন সবে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। মাটিতে গাছপালা আছে। তবে বেশি মানুষজন নেই। সমুদ্রের পাড়ে থাকত চিকচিকি আর চিকমিলি নামে দুই কিন্নর-কিন্নরী। বহু দিন আগে ওই সমুদ্রের ধারের রাস্তা দিয়ে বরুণ দেবতা যাচ্ছিলেন। তাঁর তখন খুব মন খারাপ, কারণ স্বর্গের রাজা ইন্দ্র বরুণকে খুব বকাবকি করেছিলেন। মন খারাপ করে যেতে যেতে বরুণ দেবতার হঠাৎ চোখে পড়ল কিছু একটা জিনিস চকচক করছে। ভাল করে লক্ষ করতেই চোখ পড়ল চিকমিলির উপর। সূর্যের আলোয় গা একেবারে ঝিলিক দিচ্ছিল চিকমিলির। বরুণ দেবতা চিকমিলিকে দেখে উপস্থিত হন তার কুটিরের সামনে। সরাসরি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। চিকমিলি বরুণ দেবতাকে প্রণাম করে বলে, সে চিকচিকিকে আগে গন্ধর্ব মতে বিয়ে করেছে, সে আর কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। কিন্তু বরুণ দেবতাও ছাড়ার পাত্র নন। চিকমিলিকে ছাড়া তাঁর চলবে না। তা হলে উপায়?
অনেক ভাবনাচিন্তার পর বরুণ চিকচিকি ও চিকমিলিকে নিয়ে গেলেন নারায়ণের কাছে। সব শোনার পর বিষ্ণু চিকচিকি ও চিকমিলিকে বললেন, “তোমরা দু’জনে মাছ হয়ে জন্মগ্রহণ করবে কিছু দিনের মধ্যে। সেই মাছের পিঠের উপর বসে বরুণ দেবতা ঘুরে বেড়াবে জলের মধ্যে।”
ভগবান বিষ্ণুর কথামতো তাই হল। চিকচিকি ও চিকমিলি দু’জনে মাছ হয়ে জন্ম নেওয়ার পর বরুণ তাঁদের নাম রাখেন ‘পালভো’ আর ‘মোদেন’। অর্থাৎ যাকে আমরা ইলিশ বলে চিনি। এবং এই হল তাদের বিবাহের এবং বরুণ দেবতার বাহনপ্রাপ্তির ইতিহাস। উপকথা এ ভাবেই জানিয়েছে, কেমন করে জলের রাজার বাহন হল মাছের রাজা!
মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে তখনকার খাবারদাবারের ধরন-ধারণ সম্পর্কে নানা কথা জানা যায়। বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’ থেকে জানা যাচ্ছে, আমিষ রান্নায় ‘ইলিশের ঝোল’ ছিল খুবই লোভনীয়। বিজয়গুপ্ত লিখছেন, “আনিআ ইলিশ মৎস্য করিল ফালা ফালা/ তাহা দিআ রান্ধে ব্যঞ্জন দক্ষিণ সাগর কলা।”
ইলিশেরও অনেক নাম। সংস্কৃতে তাকে কখনও বলা হচ্ছে ‘গাঙ্গে’, কখনও ‘শফরাধিপ’, কখনও ‘বারিক’। কখনও সে ‘জলতাপী’, ‘জলতাল’, ‘রাজশফর’, ‘ইল্লিশ’। আবার ইলিশের ডাকনামও আছে। মূলত ও-পার বাংলার মানুষেরা ইলিশকে ওই সব নাম দিয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘টুকটুকি’, ‘তুনিয়া’, ‘লিপিয়া’, ‘লালঠোঁটী’, ‘চেলুয়া’, ‘ইল্লি’, ‘তুনি’ ইত্যাদি।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে এক সময় ইলিশ মাছ বাড়িতে প্রথম আনা হলে, ইলিশের এক খাবলা আঁশ তুলে নিয়ে বাড়ির উঠোনে পুঁতে দেওয়া হত। বিশ্বাস ছিল, এর ফলে বাড়িতে ধনসম্পত্তি বাড়বে আর বড় ঘরে বাড়ির ছেলে-মেয়ের বিয়ে হবে। আবার বাংলাদেশের কুষ্টিয়া অঞ্চলে ইলিশের বিয়ে দেওয়ারও রীতি ছিল। বিয়ের পাকাদেখা হয়ে যাওয়ার পর মেয়ের বাড়ি ইলিশের বিয়ে দেওয়া হত। প্রথমে দুটো ইলিশ বাজার থেকে কেনা হত। তার পর জোড়া ইলিশ একটা কুলোয় রেখে ইলিশের মুখে একটু গঙ্গাজল দেওয়া হত কুশি করে। আর মেয়ে ইলিশের কপালে দেওয়া হত সিঁদুরের টিপ। মাছের নাকে পরানো হত নোলক। ছেলে ইলিশের মুখে গুঁজে দেওয়া হত এক খিলি পান। তার পর আইবুড়ো মেয়ের মাথায় ইলিশের কুলো তুলে দেওয়া হত। আর লাল চেলি দিয়ে মাছসমেত কুলো ঢাকা দেওয়া হত। তার পর একটা কলাগাছকে মাঝে রেখে সাত বার প্রদক্ষিণ করা হত। আর গাওয়া হত ইলিশের বিয়ের গান, ‘আমি ইলশা নিয়ে বিয়ে করিতে গিয়াছিলাম ও বিনোদী/ ভরা নদী আমায় দেখে কদম ফুলের মালা দিল ও ননদী/ ভরা নদীর কূলে গো/ টায়রা পরা গলায় গো ও ননদী’। ইলিশের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সেই ইলিশ মাছ কুটে ভোগ দেওয়া হত কুলদেবীকে।
বাড়িতে প্রথম আসা ইলিশকে সিঁদুর মাখিয়ে বিয়ে দেওয়া হত রান্নাঘরের সিঁদুর মাখানো নোড়াটির সঙ্গে। কলকাতার অনেক বনেদি বাড়িতে এই পরম্পরা ছিল। বিয়ের পর সেই মাছ কেটেকুটে পাঠানো হত গুরু বা কুলপুরোহিতের বাড়ি। ভাগ পেত আশপাশের ঠাকুরের থানও।
১৯১৬ সালের কথা, বহরমপুরের কাশিমবাজার রাজবাড়িতে মহারাজা শ্রীশচন্দ্র নন্দীর বৌভাতে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। দু’শো রকমের পদ রান্না হয়েছিল সেই বিয়েতে। সেই পদের মধ্যে ইলিশের পদ ছিল তিন রকম। ৬৩ নম্বর পদটির নাম ছিল ‘আমেলিশ সার্ষপং’ অর্থাৎ কাঁচা ইলিশ সর্ষে দিয়ে। ৬৭টি নম্বর পদটি ছিল ‘ইলিশ পত্রিকা’ অর্থাৎ ইলিশ মাছের পাতুরি। আর ৭৬ নম্বর পদটি ছিল ‘ইলিশাব্রাং’ অর্থাৎ ইলিশের অম্বল। ১৯০৬ সালে কলকাতায় ব্রিটিশদের স্নেহভাজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন কুমার রামেন্দ্রকৃষ্ণ দেব। তাঁর বড় ছেলের বিয়ের আয়োজনে বাংলায় প্রথম প্রচলন হয় মেনু কার্ডের। বাংলা ও ফরাসি ভাষায় ছাপা হয়েছিল পদের তালিকা। সেখানেও ইলিশ স্বমহিমায়।
সাহিত্যিক দেবেশ রায় এক ঘরোয়া আড্ডায় বলেছিলেন, যারা ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান বলে ফুটবলের মাঠে লড়াই করেন, তারা ইলিশ বললে সব লড়াই থামিয়ে একে অন্যের গলা ধরে ইলিশের কাঁটা বেছে খেতে শুরু করেন। আবার ১২০ বছর আগে নাট্যকার রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘কষ্টিপাথর’ নাটকে ইলিশের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন, “কী যে গড়ন, যেন ননীর চাপ থেকে কেটে তুলেছে। দিব্বি দোহারা, একটু পাশ থেকে গোলাপীর আভা মাচ্চে!”
এর পরও বাজারের থলিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন না জলের রুপোলি শস্য ঘরে তুলে আনতে? রবিবারের ইলিশ-দুপুর সবার শুভ হোক।