ফুটবল-সম্রাট: পেলে। ছবি: গেটি ইমেজেস।
ধুলোবালি মাখা একটি জানলা। কোনও রকমে ঠেলেঠুলে ফাঁক করে দেখা যাচ্ছে মর্গের ভিতরটা। কৌতূহল ভরা চোখে বছর সাতেকের খুদে দেখতে পেল সেই মৃতদেহ। মুহূর্তে উৎসাহ বদলে গেল আতঙ্কে।
লোকটা কত ক্ষণ ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল, কে জানে! হাত শক্ত হয়ে গিয়েছে। উঠছে না। মর্গের কর্মী দু’তিন জনকে ডেকে এনে জোর করে তোলার চেষ্টা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে বেরিয়ে এল তাজা রক্ত। লাল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে ঘরের মেঝে।
ওই একটি দৃশ্য!
চিরতরে পাল্টে দিল সেই ছেলেটির জীবন। আর কখনও ফিরিয়ে নিয়ে গেল না বিমান মহড়ার মাঠে। আর কোনও দিন স্বপ্ন দেখাল না পাইলট হওয়ার।
ওই যে মৃতদেহটি পড়ে আছে নিথর হয়ে, তা যে এক জন বিমানচালকের। গ্লাইডার নিয়ে উড়েছিলেন। মাঝ-আকাশে বিকল হয়ে ভেঙে পড়ে জীবনটাই চলে গেল! ওই যে ঘরের মেঝে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া লাল রক্তের বিভীষিকা, দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়াত তাকে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে আর্তনাদ করাত, মুখ ঢেকে বসিয়ে রাখত, অন্ধকার দেখলেই মনে করাত মর্গের জানলার ফাঁক দিয়ে দেখা সেই দৃশ্য।
বছর সাতেকের সেই কিশোর এডসন অ্যারান্তেস ডো নাসিমেন্টো-কে যে পরবর্তী কালে বিশ্ব ‘পেলে’ হিসাবে পেয়েছিল, তার জন্য জানলার ফাঁক দিয়ে দেখা ওই দৃশ্যের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা যায়। যদি সেই উঁকি দেওয়া না ঘটত, তাঁর মনে নিশি-আতঙ্কের সৃষ্টি না হত, হয়তো ফুটবল পায়ে জাদু দেখাতেই নামতেন না। বরং বিমান নিয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতেন। ছোটবেলায় যে ফুটবলার নয়, পাইলট হওয়ার স্বপ্নেই দিবারাত্র কাটত এডসনের!
জীবিকা হিসেবে পাইলটের কাজকেই বেছে নিতে চেয়েছিলেন পেলে। বাবাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন সে কথা। বাবাও উৎসাহ দিয়েছিলেন, তবে দ্রুত এটাও মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি যে, পাইলট হতে গেলে কিন্তু পড়াশোনা করতে হবে। কিশোর পেলে তা শুনে সাময়িক ভাবে স্কুল পালানো বন্ধ করেছিলেন। বিমানচালনা শেখার ক্লাবের মাঠে গিয়ে গ্লাইডারের ডানা মেলে ভেসে বেড়ানো দেখতেন আর ছটফট করতেন, কবে তিনিও মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে খেলে বেড়াবেন!
কে জানত, বাড়ির পাশের রাস্তায় খেলতে খেলতে খবর আসবে, কাছেই একটি গ্লাইডার ভেঙে পড়েছে। অপু-দুর্গার রেলগাড়ি দেখার মতো অচেনার আনন্দ পেতে ছুটেছিলেন পেলে। স্বচক্ষে বিমান তো দেখা যাবে। যেতে যেতে শুনলেন, পাইলট মারা গিয়েছেন। মর্গে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ছুটলেন সেই মৃতদেহ দেখতে। আর তার পর সব কিছু ওলটপালট করে দেওয়া ওই রক্তস্রোত।
এর পরেও খেলে বেড়ালেন তিনি। তবে আকাশে নয়, মাটিতে। মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে উড়লেন। তবে ককপিটে বসে নয়, ফুটবল পায়ে। উড়ান-মহড়ার মাঠে যাওয়া বন্ধ করে ঝুঁকতে থাকলেন ফুটবল-উদ্যানের দিকে। পাইলট হওয়ার যে এমন হতভাগ্য পরিণতিও হতে পারে, তা নিজে চোখে দেখার পরে প্রিয় স্বপ্ন বিসর্জন দিলেন। ক্রমশ স্কুল পালানো বাড়ল, মায়ের শত বকুনিতেও ফোর্থ গ্রেডের পর লেখাপড়া এগোল না। ধাবিত হলেন নতুন চুম্বকের দিকে। গোলাকৃতি চুম্বক নিয়ন্ত্রণ করল তাঁর জীবন।
মিনাস জেরেস রাজ্যের দক্ষিণে অবস্থিত ছোট্ট শহরতলি ট্রেস কোরাসোয়েস। সেখানেই ১৯৪০-এ জন্ম পেলের। তাঁর জন্মের ঠিক আগেই বৈদ্যুতিক আলো এসে পৌঁছয় এলাকায়। টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে মিলিয়ে বাবা নাম রাখলেন এডসন। বিজ্ঞানের ছটায় পৃথিবী আলোকিত করা এডিসন। ফুটবল-জাদুতে বিশ্ব আলোকিত করা এডসন। কিন্তু নামকরণে কেন এই সূক্ষ্ম তফাত?
পেলে সারা জীবন গজগজ করে গিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দুটো ভুল নিয়ে। এক, বার্থ সার্টিফিকেটে তাঁর জন্মের তারিখ ভুল করে ২৩ অক্টোবরের বদলে ২১ অক্টোবর লেখা হয়েছিল। যা নিয়ে বরাবর তাঁর হয়রানি হয়েছে। দুই, তাঁর নাম অবিকল এডিসন রাখতে চাননি বাবা-মা। ইংরেজি ‘আই’ বাদ দিয়ে এডিসনের জায়গায় যে এডসন রাখা হয়েছে, তাতে আমল দেয়নি হাসপাতাল। তারা এডিসন লিখেই ছেড়ে দেয়। পেলে যা নিয়ে পরে বলেছিলেন, “সম্ভবত ব্রাজিলে কেউ নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করে না। তাই এ ধরনের ভুল থেকে যায়।”
তিনি— পেলে, এই ধারণাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে গড়পড়তা ব্রাজিলীয় মনোভাবকে পাল্টে দিয়ে গেলেন চিরতরে। সব সময় নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছেন। ছোটবেলায় গাছে চড়ে আম পেড়ে বিক্রি করার কথা ভাবতে হল পয়সা আয় করার জন্য। তখনও লক্ষ্য ছিল— যেন সব চেয়ে বেশি আম সংগ্রহ করতে পারি। যখন বাবা হাঁটুর চোটে বাড়িতে শুয়ে, বড় ছেলে সংসারে অবদান রাখতে চাইল। জুতো পালিশের বিখ্যাত সেই পেলে-কাহিনির প্রেক্ষাপট। কিন্তু তখনও বাড়ি বাড়ি ঘুরে পালিশের কাজ করার পাশাপাশি রোজ রাতে বাবার জুতোজোড়াও পালিশ করে হাত পাকাতেন পেলে। পাছে অসন্তুষ্ট হয়ে খরিদ্দার হাতছাড়া হয়ে যায়। মঞ্চে সাফল্য আসবে যদি তোমার মহড়ায় সাধনা থাকে— চ্যাম্পিয়ন তৈরির এই মন্ত্রেই বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।
এই অধ্যবসায়, কৃচ্ছ্রসাধন, আগাগোড়া সঙ্গী হয়েছে ফুটবল জীবনে। ১৯৫৮-র সুইডেনে তাঁর প্রথম বিশ্বকাপ। নিজেকে অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি করেছিলেন পেলে। যদিও বিশ্বকাপের ঠিক আগে হাঁটুর চোট প্রায় ছিটকে দিচ্ছিল তাঁকে। স্যান্টোসের জিমে গিয়ে পড়ে থাকতেন ঊরুর পেশি বানাবেন বলে। বেশি করে বাঁ পায়ের ব্যায়াম করতেন, কারণ ডান পায়ের মতো শক্তিশালী ছিল না বাঁ পা। পেলের নিজের বয়ান অনুযায়ী, “বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে আমার ঊরু আয়তনে অনেকটা কোমরের মতো হয়ে গিয়েছিল। নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে আমি নিজেও অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। কত দ্রুত বদলে গিয়েছে।”
মোজার মধ্যে রবারের বল ভরে, দড়ি দিয়ে উপরে ঝুলিয়ে লাফিয়ে হেড প্র্যাক্টিস করতেন। এমনি-এমনি ফুটবলবিশ্ব তাঁর হেড দেখে মোহিত হত না। এমনকি প্রতিপক্ষও বিস্মিত হত তাঁর ‘ঐশ্বরিক’ দক্ষতায়।
১৯৭০-এ মেক্সিকো বিশ্বকাপ ফাইনালে ইটালিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। পেলের হেডিং-দক্ষতা নিয়ে আজ্জুরি ডিফেন্ডার জিয়াসিন্তো ফাচেত্তির বর্ণনা অমর হয়ে রয়েছে। ফাচেত্তির কথায়, “আমরা দু’জনে এক সঙ্গে বলের জন্য লাফালাম। আমি ওর থেকে বেশি লম্বা, লাফাতেও পারতাম বেশি। কিন্তু মাটিতে নেমে আসার পরে বিস্ময়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, পেলে তখনও শূন্যে ভাসমান। যেন চোখের সামনে জাদু দেখছি! যেন মাধ্যাকর্ষণকে হার মানিয়েছে। যত ক্ষণ খুশি ভেসে থাকতে পারে।”
পেলের সময়কার বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতে, তাঁর জীবনের সেরা গোল ব্রাজিলের জার্সিতে নয়, স্যান্টোসের হয়ে। সেই গোলও ছিল হেডে। তিনি যে কী রকম অলৌকিক ফুটবল-দক্ষতার অধিকারী ছিলেন, তার হদিস পাওয়া যায় সেই গোলের বর্ণনা থেকে, “স্যান্টোসের দুই ডিফেন্ডার বল দেওয়া-নেওয়া করে বাড়ালেন পেলের দিকে। তিনি তখন বক্সের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন। পেলে ডান পায়ের আলতো ছোঁয়ায় বলটাকে এক ডিফেন্ডারের মাথার উপর দিয়ে তুলে নিলেন। আরও দু’জন ডিফেন্ডার এগিয়ে এল তাঁকে আটকাতে। পেলে আবার পায়ের আলতো ছোঁয়ায় বলটাকে সামনের দিকে উপরে তুললেন। পোষ্য তার ঠিকানায় পৌঁছে গিয়েছে। এ বার মাস্টার যাবেন। বল শূন্যে ভেসে থাকা অবস্থাতেই শরীরের মোচড়ে বাঁ দিকে ঘোরার ভান করলেন পেলে। দুই ডিফেন্ডার হতচকিত। তাঁদের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে গোলকিপার কিছু বুঝে ওঠার আগেই উড়ন্ত বলে হেড করে জালে জড়িয়ে দিলেন!” ঠিক যে ভাবে স্যান্টোসের জিমে দিনের পর দিন লাফিয়ে উঠে মোজায় ভরা বলে হেড করে অদৃশ্য গোলের মহড়া দিতেন।
পেলে পারতেন শুধুমাত্র নিজের বিরল প্রতিভার হাতে নিজের ভাগ্যকে ছেড়ে রাখতে। তাতেও গোলমেশিন আখ্যা পেতে অসুবিধে হত না। যিনি ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৮১ গোল করেছিলেন, তাঁর রেকর্ড কতটাই বা কমতে পারত? অনেকে পাল্টা কটাক্ষে মনে করিয়েছেন, এই সব গোলের অনেকগুলোই এসেছে ফ্রেন্ডলিতে। তাঁদেরও জবাব দিয়ে রেখেছেন পেলে। দেশের হয়ে ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল। কাতার বিশ্বকাপে নেমার স্পর্শ করার আগে পর্যন্ত ব্রাজিলের কেউ এত কাল ধরে যা ছুঁতে পারেনি।
যুযুধান: ১৯৭৭ সালে কলকাতার ইডেনে খেলছেন পেলে। ‘কসমস’-এর হয়ে। বিপক্ষে মোহনবাগান।
ক্লাবের হয়ে গোলের যাত্রা শুরু হয়েছিল ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬। করিন্থিয়ান্সকে সে দিন ৭-১ হারায় স্যান্টোস। অভিষেকেই চমকে দেন চোদ্দো বছরের বিস্ময়কিশোর। দেশের হয়ে প্রথম গোল ৯ জুলাই, ১৯৫৭। মারাকানায় মারাদোনার দেশের বিরুদ্ধে। তখন বয়স ১৬ বছর ৯ মাস। কিন্তু শুধু গোল আর পরিসংখ্যানের রাজা হয়ে বাঁচতে চাননি তিনি, চেয়েছিলেন ফুটবল-সম্রাট হয়ে উঠতে। বিশ্বব্যাপী মানুষের হৃদয় জয় করতে। তার জন্য পরিশ্রম দরকার ছিল। এই শিক্ষা মূলত মা ডোনা সেলেস্টের থেকে পাওয়া। প্রবল অভাব-অনটনের মধ্যেও মা নজর দিতেন নিখুঁত হওয়ার দিকে। স্যান্টোসে যখন ট্রায়াল দিতে যাচ্ছে ছেলে, ডোনা নিজের জমানো পয়সা খরচ করে জুতো কিনে এনেছিলেন। নতুন জামা, ফুলপ্যান্টের ব্যবস্থা করেছিলেন। স্বামীকে বলেছিলেন, “একটা বড় শহরে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে আমার ছেলে। চাই না, যেমন-তেমন ভাবে যাক।” ছোট্ট পেলে যখন জীবিকার সন্ধানে বাউরুর দ্বারে দ্বারে জুতো পালিশ করে বেড়াতেন, তখনও মায়ের পরামর্শ ছিল— “লোকগুলো কখন বাড়ি থেকে কাজে বেরোয়, সেই সময়টা খেয়াল করো। তার আগে জুতো পালিশ দরকার হবে তাদের।” মায়ের শিক্ষায় পেলে সব সময় দশে দশ হওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছেন। তিনি ছিলেনও যে দশে দশ। নিজেই বলেছিলেন, “সঙ্গীতে যেমন বেঠোফেন, ফুটবলে তেমনই পেলে।” এক বার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এখনকার ফুটবলেও কি সফল হতে পারতেন তিনি? পেলের জবাব, “কী মনে হয় আপনাদের? এখনকার এত উন্নত বাদকের মধ্যে বেঠোফেন সফল হতেন না?”
দিয়েগো মারাদোনার সঙ্গে তাঁর বিস্তর তুলনা হয়। কাতার বিশ্বকাপ জেতার পরে চিরশ্রেষ্ঠদের গ্রহে ঢুকে পড়েছেন লিয়োনেল মেসি। কিন্তু পেলের সিংহাসনে মারাদোনা বা মেসিকে এখনও বসানো যাবে কি না, তা নিয়ে তর্ক চলবে। কার্যত একার কৃতিত্বে ছিয়াশি বিশ্বকাপ জেতেন মারাদোনা। কিন্তু সম্রাট দিয়েগো? কখনও বলা হয়নি। মেসি আধুনিক ফুটবলের জাদুকর। কিন্তু রাজা লিয়ো বা সম্রাট লিয়ো? বলা হয়নি। ওই মুকুট যেন এক জনেরই। চিরকালের জন্য শোভা পাবে তাঁর মাথাতেই। তিন বার বিশ্বকাপ জিতে জুলে রিমে ট্রফি চিরতরে ব্রাজিলের নিজস্ব হয়ে যাওয়ার মতোই।
তা-ও মনে রাখতে হবে, পেলে রঙিন টিভির বরাত পেয়েছিলেন শুধু একটিই বিশ্বকাপে— ১৯৭০-এর মেক্সিকোয়। ’৫৮-র সুইডেন, যেখানে তাঁর উদয় এবং বিশ্বকে চমকে দিল সতেরো বছরের ছেলে, তখনও সাদা-কালো টিভির যুগ চলছে। ম্যাচের সম্পূর্ণ সম্প্রচারও হত না, দেখা যেত শুধু হাইলাইটস। সুইডেনের স্মৃতি সাদা-কালো টিভির মতোই ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। ছ’টি গোল করেছিলেন পেলে, দুরন্ত টেকনিক তখনই নজর কেড়েছিল, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে গোলকিপার গিলমারের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছিলেন। ’৬২-তে ব্রাজিল জেতে, কিন্তু পেলে ছিটকে যান চোট পেয়ে। দারুণ শুরু করেছিলেন যদিও। প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে দু’জনকে কাটিয়ে মারিয়ো জাগালোর জন্য গোলের বল সাজিয়ে দেন। এর পরে চার জনকে কাটিয়ে বাঁ পায়ের দুরন্ত শটে নিজে গোল করেন। পরের ম্যাচ চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে। গ্যারিঞ্চার পাস ধরে ড্রিবল করে এগোতে থাকলেন বক্সের দিকে, তার পরে জোরালো শট পোস্টে লেগে ফিরল। পা সম্প্রসারিত করে ফিরতি বল ধরতে গিয়েই বিপদ ডেকে আনলেন। তখনই কুঁচকিতে হ্যাঁচকা টান অনুভব করেন। তখনও ফুটবলে পরিবর্ত নামানোর নিয়ম চালু হয়নি। পেলেকে তাই বাকি সময়টাও মাঠে থাকতে হয়। খোঁড়াতে খোঁড়াতে খেলে চলেন তিনি। ওই ম্যাচ ফুটবলের জাদুঘরে স্থান করে নিয়েছে চেকদের অসামান্য খেলোয়াড়ি মনোভাবের কারণে। আহত পেলেকে ট্যাকল করতে চাননি তাদের দুই ডিফেন্ডার জান লালা এবং জান পপলুহার। বল পেলের পায়ে পড়লেই তাঁরা ছেড়ে রাখছিলেন, কারণ আহত পা নিয়ে বেশি দূর এগোনোর ক্ষমতাই ছিল না তাঁর। পেলে পরে বলেছিলেন, “আমার ফুটবল-জীবনে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে এমন অভিনব আচরণ আর কখনও পাইনি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে ওদের বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা যখনই মনে করেছি, আবেগে চোখে জল এসে গিয়েছে।”
ইংল্যান্ডে ’৬৬ বিশ্বকাপে এ সব আতিথেয়তার কোনও বালাই ছিল না। বুলগেরিয়ার ডেব্রোমির জেচেভ এবং পর্তুগালের হোয়াও মোরেস। পেলে নিশ্চয়ই শেষ দিন পর্যন্ত এই দু’টি নাম ভোলেননি। এঁরা মন্ত্রগুপ্তির শপথ নেন, পেলেকে ফুটবলের দক্ষতা দিয়ে আটকানো যাবে না, তাই গুন্ডামির ফুটবল প্রয়োগ করবেন। চোরাগোপ্তা লাথি, ধাক্কা, কনুইয়ের গুঁতো চলতে থাকল। রেফারি দেখেও দেখলেন না। শেষ পর্যন্ত গুডিসন পার্কে স্ট্রেচারে করে বেরিয়ে যেতে হল তাঁকে। বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেল ব্রাজিলও। তখনও সাদা-কালো টিভি। তাতেই ঝড় উঠল কোপাকাবানা সমুদ্রসৈকতে। পেলে ঘোষণা করে দিলেন, আর বিশ্বকাপেই খেলবেন না। কিন্তু সেখানেও মারদাঙ্গার ফুটবলকে তাঁদের ব্যর্থতার অজুহাত হিসেবে তুলে ধরেননি কখনও। বরং ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনকে মুখের উপরে বলেছিলেন, কোনও প্রস্তুতি না নিয়ে যাওয়ার জন্যই এই বিপর্যয়। অজুহাতের রাস্তায় হাঁটতে প্রবল অনীহা ছিল তাঁর।
’৭০-এর বিশ্বকাপ ছিল রঙের উৎসব। তাকে আরও রঙিন করে তুলল পেলের ব্রাজিলের মায়াবী ফুটবল। প্রথম রঙিন টিভিতে সম্প্রচারের ডানায় চড়ে হলুদ জার্সির বিশ্বায়ন ঘটিয়ে দিলেন তিনি। ‘ও হোগো বোনিতো’ বা সুন্দর ফুটবলের (দ্য বিউটিফুল গেম) প্রদর্শনীতে ব্রাজিলকে এনে ফেললেন সারা বিশ্বের ড্রয়িংরুমে। পেলে এবং সত্তরের সেই স্বপ্নের ব্রাজিল! কে নেই দলে! টোস্টাও, জায়েরজিনহো, জার্সন, রিভেলিনহো, কার্লোস আলবার্তো। মধ্যমণি সম্রাট পেলে। ফুটবলের ‘বিটল্স’ দল। কেন তাঁকে বলা হয় অন্য গ্রহের ফুটবলার— সেই প্রথম টাটকা ঘ্রাণ নেওয়ার সুযোগ পেল দুনিয়া। দেখল উরুগুয়ের গোলকিপারকে বুদ্ধু বানিয়ে তাঁর ‘ডামি রান’। চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে ৬০ গজের শট। এবং, ফাইনালে ইটালির বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক পাস? কাতার বিশ্বকাপে লিয়োনেল মেসির অসামান্য সব গোলের সহায়তা দেখা গিয়েছে। কিন্তু ’৭০ বিশ্বকাপে কার্লোস আলবার্তোকে তাঁর বাড়ানো পাস থেকে গিয়েছে ফুটবলের জাদুঘরে। বাঁ দিক থেকে জায়েরজিনহোর বাড়ানো বল। ঠিক তিনটি জাদু-স্পর্শ। প্রথম ছোঁয়ায় ডান পায়ে বলটি ধরলেন, তার পর নিলেন বাঁ পায়ে, সেখান থেকে ফের ডান পায়ে। এর পরেই শিকারি চিতা চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল, ডান দিক থেকে দুর্বার গতিতে উঠছেন কার্লোস আলবার্তো। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন পেলে। কিছু ক্ষণ সময় নিলেন। ধনুক থেকে তির বেরোল মোক্ষম সময়ে। সব কিছু কাঁটায় কাঁটায় নিখুঁত। ঠিক যে জায়গায়, যে সময়ে পাসটা বাড়ালে ছুটন্ত অবস্থায় শট নিতে পারেন আলবার্তো, ঠিক সে ভাবেই বাড়ানো। বজ্র আর বিদ্যুৎ যুগপৎ আছড়ে পড়ল ইটালির গোলে। বিশ্বকাপের সর্বকালের সেরা রত্নসম্ভারের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে আলবার্তোর গোল, পেলের পাস।
পেলে অসামান্য প্রতিভাবান ছিলেন, সন্দেহ নেই। তা বলে এমন নয় যে, লাল গালিচা বিছিয়ে লোকে সব সময় অপেক্ষা করেছে। বরং বহু বারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। পেলের বাবা ডনডিনহো, ট্রেস কোরাসোয়েস থেকে বাউরু এসেছিলেন উন্নত ফুটবল চুক্তির সন্ধান পেয়ে। তখন বাবার সঙ্গে নতুন শহরে আসেন পেলেও। সেখানেই জীবন সংগ্রামের মাঝে চলতে থাকে ফুটবলও। এগারো বছর বয়সে বাউরুর নীচের ডিভিশনে খেলার সময়েই নজরে পড়ে যান ভালদেমার ডি ব্রিটোর। তাঁর বাবার বন্ধু এবং ব্রাজিলের প্রাক্তন ফুটবলার ডি ব্রিটো তখন কোচিং করছেন বাউরুতে। তিনি প্রথমে পেলেকে বাউরুর প্রথম ডিভিশনে নিয়ে আসেন, পরের বছরই সিদ্ধান্ত নেন সাও পাওলোর বড় ক্লাবে নিয়ে যাবেন। কিন্তু অবারিত দ্বার খুলে কেউ অপেক্ষা করে ছিল না। একের পর এক ক্লাব বরং প্রত্যাখ্যানই করতে থাকল ডি ব্রিটোর ছাত্রকে। শেষে তিনি ঠিক করলেন, স্যান্টোসে যাবেন। তখন স্যান্টোসের কোচ লুইস আলন্সো পেরেস, যাঁকে সবাই চিনত লুলা নামে। ডি ব্রিটো পেলেকে দেখিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, “এই ছেলেটি এক দিন বিশ্বের সেরা ফুটবলার হবে। আমার কথা মিলিয়ে নিয়ো। এক বার অন্তত একে দেখো।” আকুতি-মিনতিতে রাজি হয়েছিলেন লুলা। প্রথম ট্রায়ালেই তিনি বুঝে যান, ডি ব্রিটো ভুল কিছু বলেননি। এর পরেও রাস্তা মসৃণ ছিল না। ক্লাব কর্তারা বলেছিলেন, এমন ফুটবল-প্রতিভা ব্রাজিলের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে। তাদের সকলকে নিতে হবে না কি? লুলা তাঁদের বুঝিয়ে রাজি করান। বহু ক্লাবের প্রত্যাখ্যান, স্যান্টোসের অন্ধকার ডরমিটরি, সাও পাওলো শহরের বিশালতায় পেলে যেন হারিয়ে যেতে বসেছিলেন। যিনি এক দিন ফুটবল বিশ্বকে শাসন করবেন, বিশ্বাসের প্রবল ঘাটতি তৈরি হয়ে তিনিই তলিয়ে যাচ্ছিলেন ব্যর্থতার অতলে। সম্ভবত ছোটবেলা থেকে দেখে আসা জীবনসংগ্রাম সাহায্য করেছিল উঠে দাঁড়াতে। স্যান্টোসে ঢুকেছিলেন প্রতি মাসে ৭৫ ডলারের নামমাত্র বেতনে। এর পরে সিনিয়র দলে উত্তরণ ঘটায় পেতে থাকলেন প্রতি মাসে ৬০০ ডলার করে। এক দিন স্যান্টোসকে শুধু নিজেদের দেশেই নয়, সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত করে তুললেন তিনি। পেলের স্যান্টোসের খেলা দেখার জন্য ইউরোপে হুড়মুড়িয়ে ভিড় করল জনতা। নাইজিরিয়ায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হল, চিনের সৈন্যরা সীমান্তরক্ষার দায়িত্ব ফেলে রেখে ছুটল। এক বার বিমানবন্দরে চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল পেলে এবং স্যান্টোসকে। ভিড় খালি না করে তাঁদের বার করা যাচ্ছিল না। সেনেগালে ভোর চারটের সময় জনতা দৌড়েছিল তাঁদের বাসের পিছনে। মিলানে একটি স্তম্ভের পিছনে তাঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল, কখন ভিড় সরবে আর তিনি দৌড়ে গাড়িতে উঠে পড়তে পারবেন! আইভরি কোস্ট সফরে পনেরো হাজার মানুষ বিমানবন্দর থেকে শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁকে স্বাগত জানাবেন বলে।
স্যান্টোসে তাঁর ফুটবল দেখে মুগ্ধ ফুটবলভক্ত মার্সিডিজ় উপহার দিয়েছিলেন। অনেক চাপাচাপিতে নিতে রাজি হন পেলে। আর তাঁর আবিষ্কর্তা, কোচ ডি ব্রিটোকে খুশি হয়ে এক হাজার ডলার বোনাস দিয়েছিলেন স্যান্টোসের কর্তারা। কোচ লুলা, যিনি কর্তাদের সঙ্গে লড়াই করে পেলেকে নিতে রাজি হয়েছিলেন, তাঁকে এক বার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সারা জীবনে যত ফুটবলারকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, পেলে-ই কি তাদের মধ্যে সেরা? মুচকি হেসে লুলার জবাব, “বিশ্বে যত কোচ যত ফুটবলারকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তার মধ্যে পেলে-ই সর্বোত্তম।” শুরুতে পেলে কী রকম ছিলেন? ফের অসাধারণ লুলা, “যেমন আর পাঁচটা কিশোর থাকে। কম কথা বলত, লাজুক। বড়দের সোডা এনে দিত। তার পর ওই বড়রাই এক দিন তাকিয়ে থাকত, কখন পেলে গোল করবে আর দলও জিতবে।”
সেই যুগে যে সব শারীরিক কসরতের কথা কেউ ভাবতে পারত না, পেলে তা-ই করতেন। শক্তিশালী ডিফেন্ডারেরা মেরে-ধরে আটকানোর চেষ্টা করবে, তিনি জানতেন। সে কারণে স্যান্টোসের জিমে তিনি কারাটে শিখেছিলেন, যাতে ডিফেন্ডারদের কড়া ট্যাকলে পড়ে গেলেও দ্রুত লাফিয়ে উঠে পড়ার কৌশল রপ্ত করতে পারেন। ভারসাম্য এবং ক্ষিপ্রতা বাড়ানোর জন্য জুডোর তালিম নিয়েছিলেন। প্রতিপক্ষের একের পর এক ফুটবলারকে ড্রিবল করে বেরিয়ে যাওয়ার সময়েও তাঁকে কখনও ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে দেখা যায়নি। জীবনসংগ্রাম থেকে তিনি শিখেছিলেন, কোনও কিছুই সহজে পাওয়া যায় না। পাড়ার রাস্তায় খেলে বেড়াতেন, কিন্তু ফুটবল কেনার মতো পয়সাটুকুও ছিল না। মোজার মধ্যে পরিত্যক্ত কাগজপত্র ভরে বল বানিয়ে খেলতেন। বাবা ডনডিনহোর ফুটবলার হওয়ার নেশা অকালে শেষ করে দেয় তাঁর স্বপ্ন। সেই সময়টা সবচেয়ে অন্ধকারে কেটেছিল পেলে-পরিবারের। দু’বেলা পেট ভরার মতো খাবার জুটত না। মা ডোনা সেলেস্টের পক্ষে তিন সন্তানের নিত্য প্রয়োজনটুকু মেটানোও সম্ভব হচ্ছিল না। খালি পায়েই ঘুরে বেড়াতে হত তাঁদের, জুতো কেনার পয়সা ছিল না। নামমাত্র পোশাকে কোনও রকমে শরীর ঢাকা দিতে পারলেই মনে হত, ঈশ্বর মুখ তুলে চাইলেন। সেখান থেকে বিশ্বের সর্বকালের সেরা হয়ে ওঠা রূপকথা নয়, সত্যি। চরম দারিদ্রের অন্ধকার থেকে ধনীতম ফুটবলারের জ্যোৎস্নায় ঝলমল করার কাহিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে চিরকালীন অনুপ্রেরণা। যাঁর মাথার উপরে চাল ছিল না, এক দিন সাও পাওলোয় গড়ে উঠল তাঁর ১০০ একরের উপরে তিনটি লেক-সহ অট্টালিকা। বাবা-মায়ের জন্য করে দেওয়া আলাদা বাড়ি। নির্জন দ্বীপে ১৫ বেডরুমের ভিলা। লং আইল্যান্ডে বিলাসবহুল বাংলো। এবং, বছরের পর বছর ধরে ঠান্ডা পানীয় থেকে ভিসা কার্ড, দামি ঘড়ি থেকে ভায়াগ্রারও বিজ্ঞাপনে মুখ হয়ে কামানো কোটি কোটি টাকা।
সম্রাট বিদায় নিলেন। রেখে গেলেন তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য। প্রতিভার আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে নয়, সাধনা আর পরিশ্রমের ঘামরক্ত ঝরিয়ে গড়ে তোলা সাম্রাজ্য!