এ বছর স্বর্ণময়ীর প্রয়াণের ১২৫তম বৎসর।
তারিখটা ১৩০৪ বঙ্গাব্দের ১০ ভাদ্র, সময় দ্বিপ্রহর। কাশিমবাজারের মহারানি স্বর্ণময়ী ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে সজ্ঞানে পরলোক গমন করলেন। ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ (সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭) লিখেছে কত দীন দুঃখী ‘মাতৃহীন’ হয়ে “বক্ষে করাঘাত করিতে লাগিল, শোক অশ্রু প্রবাহ ভাগীরথীর সহিত বহিয়া দেশ দেশান্তরে চলিল।” ১৫ মন চন্দন কাঠ, ১ মন ঘি আর ১ মন ধুনোয় সুসজ্জিত চিতা যখন বহ্নিমান, তখন জেলার জজ-ম্যাজিস্ট্রেট, জমিদারবর্গ-সহ তাবড় রাজপুরুষ, সম্ভ্রান্ত লোকজন, বহরমপুর কলেজের ছাত্র-শিক্ষক থেকে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই উপস্থিত। এক জন লিখছেন, “নাহি সে বিদ্যাসাগর অনাথশরণ বঙ্গভূমি কোলে—/ তুমিও মা! যাবে চলি, কাহারে ‘আমার’ বলি, দরিদ্র মুছিবে অশ্রু কাহার আঁচলে?” পরের সংখ্যায় সমস্তিপুর থেকে আর এক মহিলা লিখছেন “কি শুনি দারুণ বার্ত্তা ভারত ব্যাপিয়া।/ জননী মোদের আজ গেছেন চলিয়া॥/ গুণময়ী স্বর্ণময়ী স্নেহের আধার।/ দীনের জননী সদা দয়ার ভাণ্ডার॥”
১০ ভাদ্র ১৩০৪ সংখ্যার ‘অনুসন্ধান’ লিখল, ভারতের একটি মহাপ্রাণ অনন্তধামে যাত্রা করলেন। দয়া, দাক্ষিণ্য, উদারতার এক অপ্রতিম আদর্শ ভাগীরথীর পবিত্র ‘সলিলে স্বীয় স্বর্গীয় তনু মিশাইলেন’। ৫০ বছর ধরে যিনি বাংলার দীন দুঃখী মানুষজনের আশ্রয়স্বরূপা ছিলেন, তাঁদের জন্য যিনি প্রায় ‘কোটী টাকা দান করিয়া গিয়াছেন’, সেই দয়ার অনন্ত পারাবার, দাক্ষিণ্যের অপূর্ব আশ্রয়, ‘শম-দম-তিতিক্ষার মূর্ত্তিমতী স্বর্ণ-প্রতিমা’ স্বর্ণময়ী চলে গেলেন।
এ বছর স্বর্ণময়ীর প্রয়াণের ১২৫তম বৎসর। নিঃশব্দেই চলে যাচ্ছে। স্বর্ণময়ীর পাশাপাশি আঠারো-উনিশ শতকে বাংলাদেশে এমন অনেক মহীয়সী রানি ছিলেন, যাঁদের নিয়ে আস্ত ‘রানিকাহিনি’ লেখা যায়। কিন্তু উনিশ শতকে সে কথা কারও মনে হয়নি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার চর্চায় নিয়োজিত বাঙালির সে সময়ও হয়নি। পাঠকসমক্ষে স্বীকার থাক, তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে এই প্রতিবেদক তাঁর একটি ছবিও কোনও বই বা পত্রপত্রিকায় খুঁজে পায়নি। তিনি পর্দানশীন ছিলেন, এটি এর একটি কারণ। সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র’-বইয়ে তাঁর দাহকার্যের একটি ছবি ছিল, কিন্তু প্রাচীনত্ব এবং অস্পষ্টতার জন্য সেটি কোনও ভাবেই উদ্ধারযোগ্য নয়।
সমকালীন মহীয়সীরা
নাটোরের অধীশ্বরী ভবানী আর জানবাজারের রাসমণি আমাদের খুব চেনা। মহত্ত্ব সে কালে অনেকটাই নির্ধারিত হত ধর্মীয় দান-খয়রাত দিয়ে। কাশীতে ভবানীর কীর্তি আঠারো শতকে লেখা ‘তীর্থমঙ্গল’-এ উল্লেখ করেছিলেন বিজয়রাম সেন—“জত(য) বড় লোক আসি কাশীর ভিতরে। ভবানীর সমকীর্ত্তি কেহ নাহি করে॥” এর বাইরেও ১৮৫২ সালে তাঁর প্রজাহিতৈষণার উল্লেখ করেছিলেন নীলমণি বসাক, ‘নবনারী অর্থাৎ নয় নারীর জীবনচরিত’-এ। রানি রোগ চিকিৎসায় আট জন কবিরাজকে বেতন দিয়ে রেখেছিলেন, যাঁরা বরাহনগর ও তার চার পাশের সাতটি গ্রামের লোকজনের চিকিৎসা করতেন। ওই গ্রামগুলোয় শব সৎকারের ব্যয়ও নাটোরেশ্বরী বহন করতেন।
উনিশ শতকে দান, দক্ষিণা, পুণ্য, সেবা— এ সবের ধারণা কিঞ্চিৎ বদলে গেল। কিছুটা যেন দেশসেবার মতো হয়ে দাঁড়াল। ধর্ম-বহির্ভূত ক্ষেত্রে, মানবকল্যাণে ব্যয়ের সুযোগটাও বাড়ে— স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, গ্রন্থাগার— আরও কত কী। লোকহিতৈষণায় বহু রাজমহিষী এগিয়ে এসেছিলেন, আমরা তাঁদের বিশেষ মনে রাখিনি। বড় ইতিহাসের পাদটীকাতেও তাঁদের পাওয়া ভার। অনেকের তেজ আর দাপটও বিশেষ কম ছিল না। আঠারো শতকে রতিরাম দাসের ‘জাগের গান’-এ পাই “মন্থনার কর্ত্তী জয়দুর্গা চৌধুরাণী। বড় বুদ্ধি বড় তেজ সকলে বাখানি।” নাটোরের মহারাজ বিশ্বনাথের বড় রানি জয়মণি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে পাঠ নিয়েছিলেন কি না জানা যায় না, কিন্তু ‘স্বামীর অনুরোধে শক্তিমন্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক বিষ্ণু মন্ত্র’ গ্রহণ করেননি। ফলে স্বামীর ঘরে আর ঠাঁই হয়নি তাঁর। আজীবন ‘২৬০০ টাকা উৎপাদক দেবোত্তরের উপস্বত্ব’ দিয়েই জীবন চালিয়েছিলেন (রঙ্গপুর বার্ত্তাবহ, ৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৪৮)।
রানিদের দানশীলতাও পৌঁছেছিল কিংবদন্তিতে। ‘সাধারণী’ (১১ জানুয়ারি ১৮৭৪) লিখছে, টাঙ্গাইলের ‘ভূস্বামিনী’ জাহ্নবী চৌধুরানী পুঁটিয়ার রানি শরৎসুন্দরী অপেক্ষা কোনও অংশে ‘ন্যূন নহেন’। জায়গায় জায়গায় তাঁরা বিদ্যালয় আর দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন। শরৎসুন্দরী ছিলেন শীর্ষে। উনিশ শতকের শেষে ‘প্রাতঃস্মরণীয়া মহারানি শরৎসুন্দরীর জীবন চরিত’-এ গিরীশচন্দ্র লাহিড়ী লিখছেন, রানিকে সৎকারের জন্য বারাণসীর মণিকর্ণিকা ঘাটে নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার দু’ধারে ‘দয়াময়ী মাই যাতা হ্যায়, দরিদ্রকা কা গতি হোগা’ বলে নাকি হাজার হাজার ‘নরনারী রোদন করিতে করিতে শবানুগমন’ করেছিলেন।
রানিদের বিদ্যানুরাগও ছিল নজরকাড়া। দিনাজপুরের রানি শ্যামমোহিনী সেখানকার জেলা স্কুলে এক জন শিক্ষকের মাসিক বেতন ১৫ টাকা করে বছরে ১৮০ টাকা দিতেন। আর গরিব ছাত্রদের সাহায্যার্থে ৬০ টাকা (এডুকেশন গেজেট ও সাপ্তাহিক বার্ত্তাবহ, ১৪ এপ্রিল, ১৮৭৬)। ‘অনুসন্ধান’ লিখেছিল মানভূমের রানি কাদম্বরী ‘মৃত স্বামীর স্মরণচিহ্ন সংরক্ষণ মানসে’ মানভূম জেলা স্কুলের গরিব হিন্দু ছাত্রদের ফি বাবদ সরকারকে চার হাজার টাকা দিয়েছিলেন (২১ ভাদ্র, ১৩০৬)।
এই সব পড়লে ‘সাধারণী’-র মতো পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মহিলাগণের দানশীলতা’ শীর্ষক নিবন্ধ আর অতিকথন বলে বোধ হয় না। স্পষ্ট করে লিখছে— “মহিলাগণ যেরূপ দয়াশীলা বঙ্গবাসী পুরুষগণ সেরূপ হইলে অনেক আশা সফল হইত।” বলছে “স্ত্রীলোক জমিদারগণ এক্ষণে প্রায় সকল বিষয়েই পুরুষ জমিদারগণকে অতিক্রম করিতেছেন।” দুর্ভিক্ষকালে অন্নচ্ছত্র খুলে প্রতিদিন শরৎসুন্দরীর আড়াই হাজার লোক খাওয়ানো প্রসঙ্গে লিখেছে, “মহারানি স্বর্ণময়ী, রানি শরৎসুন্দরী প্রভৃতি ব্যতীত কয়জন (পুরুষ জমিদারে) এরূপ অকাতরে ধন ব্যয় করেন?” (১১ জানুয়ারি, ১৬ জুন ও ১৯ জুলাই ১৮৭৪)। ১৬ জুনের ‘সাধারণী’-তে লেখক বলছেন, “মহামান্যা শ্রীমতী মহারানি স্বর্ণময়ীর গুণানুবাদ বড় ২ দ্বাদশখণ্ড গ্রন্থে শেষ হয় না।”
রাজরানি থেকে কাঙালিনি
দ্বিধা থাকার কথা নয় যে, সমকালে স্বর্ণময়ী এক রোল মডেলের স্তরে পৌঁছেছিলেন। রানির মৃত্যুর বাইশ বছর আগে ‘কাশীমবাজার রাজবংশের বিবরণ’-এ রাজকৃষ্ণ রায় লিখেছিলেন, “প্রশস্ত বঙ্গরাজ্যে মহারানি স্বর্ণময়ীর ন্যায় রাশি রাশি অর্থ দান করিতে কোন বিপুল বিত্তশালী ব্যক্তিকেই দেখা যায় না।” কাব্য করে বলছেন, ‘অপব্যয়ী ধনীসম নহ তুমি নির্মম, নহ তুমি কুসঞ্চয়ী কৃপণ সমান/ শস্যময়ী বাঙ্গালায় তব সহ তুলনায় কাহার তুলনা? রাজ্ঞি, তুমি গো প্রধান।”
ন’বছর বয়সে ১৮৩৮ সালে বর্ধমান জেলার ভাটাকুল গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে সারদাসুন্দরী এলেন কাশিমবাজাররাজ কৃষ্ণনাথের ঘরনি হয়ে। রামদাস সেন-তনয় মণিমোহন লিখছেন, কৃষ্ণনাথের পাত্রী খোঁজার জন্য যখন চার দিকে লোক পাঠানো হচ্ছে, তখন প্রত্যেক পাত্রীকে একটি করে মোহর দেওয়া হচ্ছিল, কিন্তু “বালিকাগণের মধ্যে একটি দরিদ্রকন্যা সেই অপরিচিত ব্যক্তিগণের দান গ্রহণ করিতে সঙ্কুচিতা হইলেন।” কর্মচারীদের বারংবার অনুরোধও নাকি স্বর্ণময়ীকে টলাতে পারেনি।
বিহারীলাল সরকার ‘মহারানি স্বর্ণময়ী’-তে লিখছেন ‘ভাটাকুলের ভিখারিণী সারদাসুন্দরী, মুর্শিদাবাদের রাজরানি “স্বর্ণময়ী” হইলেন।’ কিন্তু হায় বিধাতা! “সপ্তদশ বর্ষ বয়ঃক্রমে সধবার সৌভাগ্য-সংকেত স্বর্ণময়ীর সীঁথার সিন্দূর মুছিয়া গিয়াছিল।” কৃষ্ণনাথ আত্মহত্যা করলেন। দুই মেয়ে— লক্ষ্মী আর সরস্বতী। বাপের জীবদ্দশায় প্রথমে লক্ষ্মী চলে গেলেন। আর তার পর সরস্বতীর প্রয়াণ কৈশোরেই।
স্বর্ণময়ী ভাসলেন অকূল পাথারে। স্নানাহার ছেড়ে কেবল ‘সাবিত্রীর ন্যায় সরোদনে কালাতিপাত’ করতে লাগলেন বলে রাজকৃষ্ণ রায় লিখেছেন। দু’খানা উইল বেরোল। যার দ্বারা তাঁকে মাসিক দেড় হাজার টাকা দেওয়ার ব্যবস্থার পাশাপাশি দত্তক গ্রহণে নিষেধ করা হয়। আর এক উইলে অবশ্য উপর্যুপরি ছ’বার দত্তক নেওয়ার কথা ছিল।
উইলের বলে “রাজরানি পথের ভিখারিণী হইলেন। রাজরাজেশ্বরী কাঙালিনী হইলেন।” তবে সহায় হলেন রাজকর্মচারী রাজীবলোচন রায়। আর এক জন শ্রীরামপুরের অ্যাটর্নি হরচন্দ্র লাহিড়ী। এঁদের পরামর্শে রানি মামলা লড়লেন। সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চে উইলের বিচার হল। সিদ্ধান্ত হল, উইল কৃষ্ণনাথ সজ্ঞানে করেননি। স্বর্ণময়ীর জয় হল।
সম্পত্তি দখলের প্রতিদ্বন্দ্বীরা
কিন্তু বিধি বাম। আবার মামলা। এবার করলেন স্বয়ং শাশুড়িমাতা রানি হরসুন্দরী। এই কাশীবাসিনী ২৪ পরগনার আলা সদর আমিন হরচন্দ্র ঘোষের এজলাসে এই মর্মে নালিশ করেন যে, কৃষ্ণনাথ অভক্ষ্য ভক্ষণ ও অপেয় পানাদির জন্য জাতিধর্ম ভ্রষ্ট হয়েছেন। পৈতৃক বিষয়ে তাঁর অধিকার নেই। সুতরাং স্বর্ণময়ীও পতিধনে বঞ্চিত হবেন। ২৭ জুলাই ১৮৪৯ তারিখের ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখছে ‘যোড়াসাঁকো নিবাসী বাদিনী হরসুন্দরী সমুদয় বিভব প্রাপ্তির প্রার্থনায়’ স্বর্ণময়ীর নামে নালিশ ঠুকেছেন। সুপ্রিম কোর্ট রায়ে উল্লেখ করে, কৃষ্ণনাথ সম্পর্কে হরসুন্দরীর অভিযোগের তাৎপর্য হল “বাদিনীর লোভের প্রাবল্য ও স্নেহের শূন্যতা মাত্র।” ওই রানি নাকি কন্যার গৃহশিক্ষক সাত টাকা বেতনের দ্বারকানাথ মণ্ডলের ‘নিমিত্ত’ নিজের ছেলের সঙ্গে শুধু নয়, শাশুড়িমাতা সুসারময়ীর সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেছেন। কন্যা গোবিন্দসুন্দরী ও তাঁর স্বামীর সঙ্গে নিয়ত বিবাদ ও অন্যায় ব্যবহার করেছেন। এবং “অদ্যাবধিও তাঁহারা বাদিনীর [হরসুন্দরী] মুখাবলোকন করেন না।” তবে বিধাতা স্বর্ণময়ীর সহায় হলেন। কিন্তু এ বারে লড়াই শুরু হল চতুর সরকার বাহাদুরের সঙ্গে। তাদের বক্তব্য, আত্মঘাতীর সম্পত্তি সরকারের পাওনা। প্রধান বিচারপতি তুড়ি মেরে নস্যাৎ করলেন সে দাবি। শ্রীমত্যা হরসুন্দরী কাশী থেকে আর ‘কাশিমবাজার বাসিনী’ হননি।
এ বার দেওয়ান রাজীবলোচনের সদুপদেশ, সুপরামর্শ, সৎশিক্ষা, পরিচালনায় স্বর্ণময়ীর নিজের বলবৃদ্ধি করার পালা। ননদিনী গোবিন্দসুন্দরীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাল ছিল না। বংশধর সোমেন নন্দী ‘হিস্ট্রি অব দ্য কাশিমবাজার রাজ’-এ লিখেছেন, রানি প্রথমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই চেয়েছিলেন। নন্দাই নবীনবাবুকে বন্ধু হিসেবে দিশা দেখানোর অনুরোধ করেন, চিঠি দেন, দুর্গাপুজো ও মেয়ে সরস্বতীর কান ফোটানোর অনুষ্ঠানে আসার অনুরোধ করেন। কিন্তু তাঁরা নিমন্ত্রণ রক্ষাই করেননি। কন্যা সর্বসুন্দরীর বিয়ের খরচের জন্য বাবার সম্পত্তি জ্ঞান করেই গোবিন্দসুন্দরী টাকা চাইলেন, রাজীবলোচনের পরামর্শে রানি সে পথে না হেঁটে হাজার টাকা উপহারস্বরূপ পাঠিয়ে দেন।
‘মহারানি’ খেতাবই উপযুক্ত
স্বর্ণময়ীকে নিয়ে কাহিনির তো শেষ নেই। মামলার প্রসঙ্গেই বলি। রানি যখন স্ত্রীধন অবলম্বন করে মামলা মোকদ্দমায় জেরবার, তখন তৎকালীন কলকাতার এক ধনীর কাছে ৫০০ টাকা ধার চাইলেন। এই “বড় লোকের উন্নতি ও গৌরব কৃষ্ণনাথের অর্থসম্ভূত।” কিন্তু তিনি বিনিময়ে গয়না বন্ধক রাখতে বলায় রানি নিজের গলার হার খুলে রাজীবলোচনকে বললেন, “যদি গহনা বন্ধক দিয়া টাকা আনিতে হয়, তবে আর ঐ বড় লোকের কাছে যাওয়ার দরকার নাই, অন্যত্র ব্যবস্থা করিয়া টাকা আন।” এই স্ত্রী-ধন দিয়েই তো মামলা লড়া।
জীবদ্দশাতেই রানি কিংবদন্তি। ‘অবলাবান্ধব’ স্বর্ণময়ীকে উপাধি দান করতে সরকারকে অনুরোধ করায় ‘সম্বাদ ভাস্কর’ (৪ জানুয়ারি ১৮৭০) লিখল, “সহস্র সহস্র সাধারণ কার্য্যে দীনপালিনীর বদান্যতা অবলোকন করিয়া কর্ত্তৃপক্ষীয়গণ এ পর্য্যন্ত যে মৌনাবলম্বন করিয়া আছেন, ইহা অল্প আশ্চর্য্যের বিষয় নহে।” আরও বলছে সাধারণ উপাধি রানির পক্ষে মানানসই হবে না। ‘এডুকেশন গেজেট ও সাপ্তাহিক বার্ত্তাবহ’ (২১ জুলাই ১৮৭১) আবার লিখেছে, ‘মুর্শিদাবাদের কর্ত্তৃপক্ষীয়গণ’ রানিকে ‘স্টার অব ইন্ডিয়া’ উপাধি দেওয়ার জন্য সরকারকে যে অনুরোধ করেছিলেন তাতে নাকি লেফটেন্যান্ট গভর্নর বলেন, তা রানির জন্য যথেষ্ট নয়। এই কথাতেই কমিশনার ‘মহারাণী’ উপাধি দিতে উপরতলায় অনুরোধ করেন। দানশীলতায় আপ্লুত ভারত সরকার ১৮৭১-এ তাঁকে মহারানি উপাধি দিয়েছিল, যা নিয়ে বঙ্গবাসীর গর্বের অবধি ছিল না। ‘সাধারণী’ এক বার লিখেছিল তারা জানত সরকার রানির ‘অসামান্য বদান্যতা গুণে প্রীত’ হয়ে তাঁকে মহারানি উপাধি দিয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ‘ক্যালকাটা গেজেট-এ তিনি সামান্যতঃ রানি বলিয়া অভিহিত’ হচ্ছেন। তাতে আহত হয়ে পত্রিকা লিখেছে, “রানি স্বর্ণময়ী যদি পূর্বে মহারানি উপাধি প্রাপ্তিতে সম্মানিতা হইয়া থাকেন, তবে টেম্পল সাহেব কেন তাঁহার সেই সম্মান হরণ করিলেন?” (৬ ডিসেম্বর, ১৮৭৪)
১৮৮১-র ১০ জুন তারিখের ‘এডুকেশন গেজেট ও সাপ্তাহিক বার্ত্তাবহ’-তে এক জন লিখছেন, “হিমাচল হইতে কুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত এবং করাচি হইতে আসাম সীমান্ত পর্য্যন্ত প্রায় সকল স্থানেই ইঁহার দানশীলতার চিহ্ন আছে। এমনকি, দুর্লঙ্ঘ্য সাগর অতিক্রম করিয়া ইউরোপ খণ্ড পর্য্যন্ত তদন্ত করিলেও ইঁহার দানের পরিচয় পাওয়া যায়।”
সমকালে অনেক জায়গায় ছাপা হয়েছে তাঁর দানের তালিকা, তবে তা সম্পূর্ণ বলে মনে হয় না। ১৮৮০-৮১ সালে ‘কল্পদ্রুম’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত দুর্গাচরণ রায়-এর ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ পাওয়া যায়, ব্রহ্মা যখন বরুণকে ‘রানির কতকগুলি সৎকার্য্যে দানের উল্লেখ’ করতে বলছেন, তখন তিনি এক লম্বা তালিকা পেশ করেন। ভাদ্র, ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের ‘জন্মভূমি’-তে শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে ‘মহারানি স্বর্ণময়ী’ লিখলেন, সেখানে বলা আছে এই ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’ ছাপতেই রানি ১০০ টাকা দিয়েছিলেন। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’-য় কুমারখালির রাধাবল্লভ দে লিখেছেন, তাঁর লেখা ‘ভারত ঈশ্বরী’ বইটি পেয়ে রানি ‘পঞ্চমুদ্রা’ পুরস্কার দিয়েছেন। ‘মণিহারা ফণী— ভারতজননী’-র প্রণেতা পার্বতীচরণ চট্টোপাধ্যায় কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন, রানি তাঁকে মুদ্রণ খরচে অনুদান বাবদ ১৫ টাকা দিয়েছেন বলে।
অগণিত ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র’ দান
শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রানির যে ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র’ দানের উল্লেখ করেছেন, তা বার করা এক বড় গবেষণাই বটে, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফান্ড থেকে লন্ডন ইম্পিরিয়াল জুবিলি ইনস্টিটিউশন, গারোহিল ডিসপেনসারি, আলিগড় কলেজ, ওরিয়েন্টাল সেমিনারি থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ— বলে শেষ করা যায় না। দুর্ভিক্ষকালে রানি তো বাহারবন্দ ও মুর্শিদাবাদ জমিদারির এক বছরের খাজনাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রত্যেক জেলার রিলিফ ফান্ডে তাঁর দান ছিল, যেমন ছিল স্কুল কলেজ হাসপাতালে। ‘সাধারণী’ তো আর এমনি এমনি লেখেনি যে, “এ দুর্ভিক্ষের সময় কোন জমিদার যে স্বর্ণময়ীর ন্যায় অকাতরে ধন ব্যয় করিবেন এমন বিশ্বাস হয় না।” শুধু এ দেশে নয়, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রদত্ত তালিকায় আইরিশ বা আমেরিকান ফেমিন রিলিফ ফান্ডেও রানির দানের উল্লেখ আছে।
‘এডুকেশন গেজেট’-এর মতো পত্রিকায় থাকত রানির এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানের খবর। রঙ্গপুর কাকিনিয়া নিবাসী মদনমোহন অধিকারী কাগজে রানিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন তাঁর ও তাঁর ভাইয়ের ‘বিবাহের সাহায্যার্থ’ ৫০ টাকা দানের জন্য। বহু গ্রন্থকারের, পত্রিকা সম্পাদকের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে এসেছিলেন রানি। লাখুরিয়া কালিগঞ্জের রামরাম মিত্র লিখছেন, তাঁর লেখা ‘বিবেকোদয়’ প্রবন্ধ উপহার পেয়ে উৎসাহদানের জন্য তাঁকে ১৫ টাকা দিয়েছেন স্বর্ণময়ী। ক্যাম্বেল মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্র কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন, বই কিনতে রানি তাঁকে ১০ টাকা দিয়েছেন বলে। ‘প্রতিকার’ লিখেছে, রাজশাহী বিভাগের বালকনাথতলায় আগুন লেগে যে সব গরিব প্রজার বাড়ি পুড়েছে, তাঁদের রানি সাহায্য করেছেন। পাবনার ভারেঙ্গা গ্রামে পুকুর খোঁড়ার জন্য দেন ২৫ টাকা। বাখরগঞ্জে বিপন্ন প্রজাদের সাহায্যে দেন তিন হাজার টাকা, ভাটপাড়া ইঙ্গ-বঙ্গ বিদ্যালয়ের ‘ব্যয়নির্ব্বাহার্থে’ ১০ টাকা, কাটোয়ার কাছে বৈরাগীতলা স্কুলের ‘উপকরণ ক্রয়ার্থ’ এককালীন ২০ টাকা, বর্ধমানের শ্রীধরপুর মধ্য শ্রেণির স্কুলে ১০ টাকা, ময়নাগড় ও ভাতাড়ী স্কুলের ‘আবশ্যক দ্রব্যাদি ক্রয় জন্য’ ১০ টাকা, নদিয়ার দারিয়াপুর মধ্য শ্রেণির বঙ্গ বিদ্যালয়ের আসবাব-সহ মানচিত্র ইত্যাদি কিনতে ১০ টাকা, স্কুলভবন নির্মাণে আরও ১০ টাকা, মালদা নঘরিয়া মধ্যবঙ্গ স্কুল থেকে হুগলির পশপুর বঙ্গ পাঠশালা, যশোর মাগুরার শিবগ্রাম স্কুল বা রামপুর বোয়ালিয়ার কাছে হোজা স্কুল— কাউকে ফেরাননি রানি। জেনারেল অ্যাসেম্বলি স্কুলে ‘উচ্চ শ্রেণীর উৎকৃষ্ট ছাত্রদিগকে’ পুরস্কারের জন্য দেন ৬০০ টাকা। মেডিক্যাল কলেজের একটি ছাত্রীনিবাস নির্মাণের জন্য প্রয়াণের প্রায় এক যুগ আগে দেড় লক্ষ টাকা দান করেছিলেন স্বর্ণময়ী। এ তো কেবল সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র। হিন্দু হস্টেলের নির্মাণ, র্যাভেনশ কলেজ (কটক) বা মেদিনীপুর হাইস্কুল আর বহরমপুরের স্কুল ও কলেজের মতো কতই তো বলা বাকি রয়ে গেল।
রানিমা বিদ্যোৎসাহী ছিলেন বলেই প্রয়াণের তিন দিন পর, বরিশাল জেলা স্কুলগৃহে এক শোকসভায় স্থির হয়েছিল, স্বর্ণময়ীর জীবনী সম্বন্ধে ‘যিনি সর্ব্বোৎকৃষ্ট প্রবন্ধ লিখিবেন, তাঁহাকে পুরস্কার প্রদত্ত হইবে’ (বামাবোধিনী পত্রিকা, সেপ্টেম্বর ১৮৯৭)। বামাবোধিনী-রই ‘প্রাচীনতম গ্রাহিকা’ হিসেবে এককালীন ২০০ টাকা দিয়ে তিনি পত্রিকাটিকে ‘মুমূর্ষু অবস্থা হইতে উদ্ধার করেন’ বলে তারা জানিয়েছিল। আরও লিখেছে, রানির দাতব্য-দফতরে “রেজিষ্টারী করা চিটী স্তূপাকার, প্রতিদিন শতসহস্র পত্রযোগে দেশ বিদেশ নানাস্থানে দাতব্য বিতরিত হইতেছে।”
তেমনই এক ‘চিটী’ ছাপা হয়েছিল ‘পুরশ্রী’ পত্রিকায় (২১ এপ্রিল, ১৯৭৯)। বঙ্গীয় নাট্যশালার পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া ভুবনমোহন নিয়োগীর জন্য অর্থ সাহায্য চেয়ে ‘ধরিত্রী পবিত্রকারিণী করুণাপ্রতিমা মহামহিমান্বিতা শ্রীশ্রীমতী মহারানি স্বর্ণময়ী ভারত-সাম্রাজ্য-সঙ্গিনী চরণ কমলে’ চিঠি লিখেছিলেন স্বয়ং রসরাজ অমৃতলাল বসু। কত মানুষ তাঁর সাহায্য পেয়েছেন— কৃষ্ণদাস পালের জীবনী ছাপতে টাকা পেয়েছেন রামগোপাল সান্যাল। তিনিই লিখেছেন মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন ভবন নির্মাণে রানির থেকে বিনা সুদে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের ঋণ পাওয়ার কথা। মেয়ের বিয়ের সময় অর্থসাহায্য পাওয়ার কথা ‘ইন্ডিয়ন মিরর’ কাগজে অকপটে স্বীকার করেছিলেন চণ্ডীচরণ মজুমদার। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ (১১ নভেম্বর, ১৮৭৬) লিখেছে, এলোকেশী মোহন্ত কাণ্ডের নবীন মুক্তি পেলে কলকাতায় নাকি জনরব উঠেছিল রানি “আণ্ডামান প্রত্যাগত নবীনের বিবাহ দিয়া দিবেন।” এই কাগজে আবার ছিল পিতৃহীন দুই বালকের উপনয়নে রানির ২০ টাকা দানের খবরও (১৭ মার্চ, ১৮৭৭)।
প্রয়াণ ঘিরে রহস্য
রানির মৃত্যু বঙ্গবাসীর কাছে ছিল বজ্রপাতের শামিল। স্কুল, পাঠশালা, কলেজ, অতিথিশালা নির্মাণ, দুর্ভিক্ষে ত্রাণ, চিকিৎসালয়ে সাহায্য— এ সব স্মরণে রেখে ‘বামাবোধিনী’-র ডিসেম্বর, ১৮৯৮ সংখ্যায় ভুবনমোহিনী লিখলেন, “বঙ্গবাসী আজি হল মাতৃহীন।” ‘নব্যভারত’ (আশ্বিন, ১৩০৪) বলছে, ১৩০৪-এ বাংলার প্রধান ঘটনা দুর্ভিক্ষ বা ভূমিকম্প নয়, প্রধান ঘটনা স্বর্ণময়ীর স্বর্গারোহণ। ‘বেঙ্গলি’ লিখল, রানির মৃত্যু ‘জাতীয় বিপর্যয়’ (২৮ অগস্ট, ১৮৯৭)। ৩০ মে ১৮৯৭ তারিখের ‘দ্য ইন্ডিয়ান নেশন’ লিখল, “দিস ডটার অব বেঙ্গল হ্যাড আ মাদার’স ফিলিংস টু দ্য নেশন”— সোনার মূর্তি গড়ে দিলেও তা রানির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য যথেষ্ট হবে না।
শেষটা রহস্যময়। ১ সেপ্টেম্বর ‘মুর্শিদাবাদ হিতৈষী’ লিখছে, রানি ১৬/১৭ দিন অসুস্থ। কেবল দুই গৃহচিকিৎসক শ্রীচরণ কবিরাজ আর মন্মথবাবুই দেখলেন। অ্যালোপ্যাথি ওষুধ তিনি না খেলেও সিভিল সার্জনকে ডাকা উচিত ছিল। পরেশনাথ কবিরাজ বারাণসী থেকে এসে পৌঁছলেন তাঁর মৃত্যুর পরে। শুধু জনগণ নয়, রানির প্রধান কর্মচারীদের কাছেও সব কেন গোপন রাখা হচ্ছিল, তাই নিয়ে পত্রিকার ক্ষোভ। অবস্থা খারাপ হওয়ায় রানিকে যখন ২৪ তারিখ ‘সৈদাবাদ হাউস’ এ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন কাশিমবাজার, খাগড়া, বহরমপুর, সৈদাবাদে গুজব রটেই গেল, ওটা মৃতদেহ। রানি নেই। তখনও পরিবারের দাবি, আগের দিন একাদশী পালন করে রানি একটু বিধবস্ত। এত লুকোচুরির কারণ কী? ‘সঞ্জীবনী’ উদ্ধৃত করে ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ (৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭) লিখছে, মৃত্যুর দিন তিনেক পর কাশী থেকে শাশুড়িমাতা হরসুন্দরীর এক প্রতিনিধি এসে গোপনে মণীন্দ্র নন্দী ও শ্রীনাথ পালের সঙ্গে বৈঠক করেন। তখন কোষাগারে মোটে লাখ দুয়েক টাকা, রানির অসুস্থতা গোপন— সবই ধোঁয়াশা। কিছু তো একটা ছিলই, না হলে আর ‘ইণ্ডিয়ান ডেইলি নিউজ়’ পত্রিকা কেন লিখবে যে, রানির স্বামীর ভাগ্নেরা সব সময় বলে এসেছেন যে, “দে উইল চ্যালেঞ্জ হার পাওয়ার টু লিজ় ফর আ লংগার পিরিয়ড দ্যান হার লাইফ”? পত্রিকা বলছে বাণিজ্যিক লেনদেনগুলো এ বার ধাক্কা না খায়!
সে সব কুকথা এখন থাক। সবটা নিয়েই রানিকে ঘিরে অজস্র গল্পগাথা। তাঁর মৃত্যুর ত্রিশ বছর পরেও ‘প্রবর্ত্তক’-এ (কার্ত্তিক, ১৩৩৪) সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় শুনিয়েছেন দু’-তিনটে গল্প। বহুক্ষণ এক ভিখারিনির কান্না রানির কানে যাওয়ায় দুই ম্যানেজার শ্রীনাথ পাল আর মৃত্যুঞ্জয় ভট্টাচার্যকে তলব করে দাবড়ে দেন। বলেন ভবিষ্যতে ‘উপেক্ষিত দরিদ্রের আর্ত্তনাদ’ যেন আর না শুনতে হয়। আবার রাত জেগে কাজ করার সময় লুচি-পোলাওয়ে অরুচি এক অসুস্থ আমলার জন্য নিজের একমাত্র আহার্য এক বাটি দুধ, তাও তিনি তাঁকে দিয়ে দিলেন। কাশিমবাজারে আজও তো কত জনশ্রুতিই না বহাল! নির্মম এবং মোক্ষম কথাটি তো বিহারীলাল সরকারই লিখেছিলেন— কৃষ্ণনাথের ‘অপমৃত্যুরূপ অমঙ্গলে’ এক মহামঙ্গলের সূচনা হল। “কৃষ্ণনাথ না মরিলে... দীনদয়াময়ী মহারানি স্বর্ণময়ীকে কোথায় পাইতাম?... কোটি কোটি জীবের জীবন রক্ষার জন্যই বিধাতা একটীমাত্র কৃষ্ণনাথের জীবন লইলেন।” সত্যিই তো! স্বর্ণময়ী একটি মডেল তৈরি করে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রয়াণের বছর দেড়েক আগে অছির মাধ্যমে (ব্রজবালা ট্রাস্ট) শ্বশুর কৃষ্ণচন্দ্রের নামে এক কলেজ প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুত হন বীরভূম জেলার হেতমপুরের রানি পদ্মসুন্দরী। অদ্ভুত সমাপতন! স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর মাস দুয়েক আগে উদ্বোধন হল হেতমপুর কৃষ্ণচন্দ্র কলেজ। কোনও মহিলা প্রতিষ্ঠিত বাংলার গ্রামীণ কলেজ, এটিই সম্ভবত প্রথম। কাশিমবাজারেশ্বরী স্বর্ণময়ীর সঙ্গে পদ্মসুন্দরীর পরিচয় ছিল কি না জানা নেই, তবে পরম্পরা তো এ ভাবেই ছড়িয়ে পড়ে।