যা তখনকার হিসেবে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা। দেশ ভেঙে দু’টুকরো করে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের থেকে কাছ প্রাপ্য ছিল স্যর সিরিল জন র‌্যাডক্লিফের। কিন্তু তা না নিয়েই ভারত ছাড়েন তিনি। পুড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশ-ভাগ সংক্রান্ত যাবতীয় খসড়া, ম্যাপ ও কাগজপত্র। ‘র‌্যাডক্লিফ লাইন’ নামের বিভাজন রেখাটিরও এ বার পঁচাত্তর বছর পূর্ণ হল।
Bengali Story

বিভাজনের পারিশ্রমিক তিন হাজার পাউন্ড

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা এসেছিল আমাদের এ দেশে। তার বিনিময়ে ভাগ হয়ে গিয়েছিল অখণ্ড একটা দেশ, ভারত আর পাকিস্তান এই দু’ভাগে।

Advertisement

সত্যরঞ্জন দাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২২ ০৮:২৯
Share:

দায়িত্বপ্রাপ্ত: ব্রিটিশ ব্যারিস্টার স্যর সিরিল জন র‌্যাডক্লিফ।

অমিতাভ ঘোষের আনন্দ পুরস্কার ও সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস ‘দ্য শ্যাডো লাইনস’-এ ঠাকুরমা জানতে চেয়েছিলেন, প্লেনে চড়ে কলকাতা থেকে ঢাকা যাওয়ার সময় ভারত আর পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তটা দেখা যাবে কি না। শুধু মেঘ, বড়জোর কিছু সবুজ খেত ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবে না শুনে অবাক হয়েছিলেন বৃদ্ধা। দু’দেশের মাঝখানে চোখে পড়ার মতো তেমন কোন বিভেদচিহ্নই যদি না থাকে, তা হলে কিসের ভাগাভাগি, কেনই বা এত খুনোখুনি!

Advertisement

ছায়ারেখার করাল ছায়া

একটা অখণ্ড দেশকে দুটো দেশে বিভাজনকারী সে-রেখা দেখা না গেলেও সেটির সৌজন্যে প্রায় দু’কোটি মানুষ ভিটেছাড়া হয়েছিলেন। অন্তত দশ লক্ষ মানুষের প্রাণ চলে গিয়েছিল, অনেকে বিকলাঙ্গ হয়ে বাকি জীবন কাটিয়েছিলেন। ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছিল প্রায় এক লক্ষ নারীকে। জবরদস্তি ধর্মান্তরিত হতে হয়েছিল কত জনকে, সে বলা ভারী মুশকিল। অগ্নি সংযোগ, লুঠপাট তো নেহাতই মামুলি ঘটনা। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আছে শুধু কিছু বিতর্কিত পরিসংখ্যান। দেশভাগ যে কী ভয়ঙ্কর বিপর্যয়, তার সামান্যই বোঝা যায় সে পরিসংখ্যান থেকে। ভিটেমাটি হারানোর দুঃখ কেমন ছিল, সম্মান হারিয়ে বাকি জীবন অসংখ্য হতভাগ্য মহিলার কেমন কেটেছিল, এ সব কথা ইতিহাসে লেখা নেই। ইতিহাস থেকে আমরা এও জানতে পারি না, চিরদিনের জন্য ভিটেমাটি বা আপনজনকে হারিয়ে ফেলার বেদনা কী ভাবে কুরে কুরে খেয়েছে কোনওমতে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোকে। সব হারিয়ে উদ্বাস্তু পরিচয় নিয়ে কোটি কোটি মানুষকে পেরোতে হয়েছিল একটা অদৃশ্য সীমারেখা, যা কেড়ে নিয়েছিল তাদের আত্মিক পরিচয়।

Advertisement

র‌্যাডক্লিফ লাইন-এর সাড়ে সাত দশক

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা এসেছিল আমাদের এ দেশে। তার বিনিময়ে ভাগ হয়ে গিয়েছিল অখণ্ড একটা দেশ, ভারত আর পাকিস্তান এই দু’ভাগে। ভারত থেকে পাকিস্তানকে আলাদা করতে লন্ডন থেকে পাঠানো হয়েছিল আইনজীবী স্যর সিরিল জন র‌্যাডক্লিফকে, অখণ্ড ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্রে একটা বিভাজনরেখা চুড়ান্ত করে ফেলার উদ্দেশ্যে। আমাদের স্বাধীনতার যেমন এ বছর পঁচাত্তর বছর পূর্তি, দেশভাগের জন্য জন্ম নেওয়া সে সীমান্তরেখারও এ বছর পঁচাত্তর বছর পূর্তি। আমাদের স্বাধীনতা এসেছিল ১৫ অগস্ট, আর তার ঠিক দু’দিন পর আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সীমান্তরেখা, কাগজে কলমে যার নাম ছিল র‌্যাডক্লিফ লাইন। স্বাধীনতা লাভের দিন সীমান্ত এলাকার অনেক মানুষ জানতেনই না, তাঁরা ভারতে আছেন, না কি পাকিস্তানে। অশান্তি, দাঙ্গা, রক্তপাত যেন ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটাকে বিঘ্নিত না করে, তাই ১২ অগস্ট চুড়ান্ত হয়ে যাওয়া বিভাজনরেখাটিকে আরও দিনপাঁচেক ফাইলবন্দি করে রাখেন কর্তাব্যক্তিরা।

দড়ি টানাটানি, দর কষাকষি

১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে গৃহীত হয়েছিল মুসলমানদের জন্য পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি। লীগের নেতা জিন্না বললেন, হিন্দু মুসলমান দুই ধর্মের মানুষ একটা জাতি হয়ে উঠতে পারে— এটা একটা স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়। মুসলিম লীগের দাবির সম্পূর্ণ বিপক্ষে ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। তবু ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গান্ধীজি আলোচনায় বসলেন মহম্মদ আলি জিন্নার সঙ্গে। জিন্না দেখলেন তাঁর দাবিমতো পাকিস্তান গঠন মুশকিল। ‘পোকায় খাওয়া’ পাকিস্তানের প্রস্তাবে তিনি রাজি হলেন না। ১৯৪৫ সালের জুন মাসে ওয়াভেল ঘোষণা করে দিলেন, ব্রিটিশরা ভারতের শাসনভার ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক। তবে তিনি জানিয়ে দিলেন তার আগে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের প্রয়োজন। নেহরুর মতো কংগ্রেস নেতা দেশভাগের অনিবার্যতা মেনে নিলেন। তিনি বললেন, ভারতের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন। ওয়াভেল ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে সিমলা কনফারেন্সে এক কর্ম পরিষদ গড়তে চাইলেও জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মুসলিম লীগের মতানৈক্যের কারণে তাঁর পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। দেশভাগ নিয়ে দরকষাকষি শুরু হল। কংগ্রেস পঞ্জাব ও বাংলার অর্ধেক দাবি করলেও জিন্না চাইলেন সামান্য একটু বাদ দিয়ে এই দুই প্রদেশই পাকিস্তানের ভাগে যাক। পাঞ্জাবের তারা সিংহের মতো শিখ নেতারা প্রথম থেকেই পঞ্জাব ভাগ বা পাকিস্তানে যাওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। এক সময় স্বাধীন পঞ্জাবের দাবিও ওঠে, যেমন স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনাও দানা বেঁধেছিল এক দিন। ১৯৪৬-এর প্রথমেই ইংল্যান্ড থেকে এল ক্যাবিনেট মিশন। উত্তর পশ্চিম এবং উত্তর পূর্বের মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলোর দু’টি গোষ্ঠী ও বাকি প্রদেশগুলোর একটি গোষ্ঠী নিয়ে ফেডারেশন গড়ার প্রস্তাব দেয় ক্যাবিনেট মিশন। কংগ্রেস মনে করেছিল, এর ফলে একটি দুর্বল ফেডারেশনের জন্ম হবে। তাই তারা বেঁকে বসেছিল।

বারবার নানা আলোচনা সত্ত্বেও সন্তোষজনক সমাধান না মেলায় অসন্তুষ্ট মুসলিম লীগ ১৯৪৬-এর জুলাই-এর শেষে ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন’-এর ডাক দিয়ে হিংসাত্মক পথে হাঁটবার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৬ অগস্ট থেকে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হয়। কলকাতা থেকে নোয়াখালি, সেখান থেকে বিহারে ছড়িয়ে পড়ে হিংসার দাবানল। পঞ্জাবে বর্বরতা চূড়ান্ত আকার নিল। ক্রমশ বাড়তে লাগল হতাহতের সংখ্যা। ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল অনেককে। মহিলাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সম্ভ্রম রক্ষা করতে রাওয়ালপিন্ডির এক গ্রামে নানা বয়সের তিরানব্বই জন মহিলা একযোগে এক কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। উপমহাদেশ ভাগের আগেই লক্ষ মানুষ দেখেছিল সাম্প্রদায়িক হানাহানির রূপ। সীমান্তরেখা ঘোষণার ঠিক আগে ও তার পর বেশ কয়েক মাস ধরে সে হিংসার স্রোত প্রবল হয়ে আছড়ে পড়েছিল।

১৯৪৭-এর মার্চ মাসে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ভারত ভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। দু’জন সদস্য অবশ্য বিরোধী মত পোষণ করেছিলেন, তাঁরা হলেন খান আব্দুল গফ্ফর খান আর মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। জিন্না মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্র চাইলে কী হবে, অবিভক্ত ভারতের মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষদের একটি বিরাট অংশ কিন্তু তাঁর দাবিতে শরিক হননি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় সীমান্তগান্ধী নিদারুণ হতাশা ও ক্ষোভে কংগ্রেস নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আপনারা আমাদের নেকড়ের মুখে ছুড়ে দিলেন।’ জাতির জনকের হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল পরিস্থিতি। এক রিপোর্টার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি অনশনে বসবেন কি না। উত্তরে বিরক্ত ও হতাশ গান্ধী বলেছিলেন, ‘কংগ্রেস পাগলের কাজ করেছে। তার মানে কি আমাকে মরতে হবে?’

১৯৪৭-এর ১৮ জুলাই ইংল্যান্ড ঠিক করে ফেলল, পরের মাসের পনেরো তারিখ ব্রিটিশরা ভারতের শাসনভার ছেড়ে দেবে আর অখণ্ড ভারতকে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে ভাগ করে দেবে। মুসলিম-প্রধান বালুচিস্তান, সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পুরোপুরি দিয়ে দেওয়া হবে পাকিস্তানকে। পঞ্জাব ও বাংলায় যেহেতু মুসলিমদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না, সিদ্ধান্ত হল এই দুটি প্রদেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে।

ধর তক্তা, মার পেরেক

অবিভক্ত ভারতের দুই প্রদেশ পঞ্জাব আর বাংলা ভাগ করতে যখন র‌্যাডক্লিফ এ দেশে এসে পৌঁছলেন, তাঁর হাতে মোটে পাঁচ সপ্তাহ সময়। সব মিলিয়ে সাড়ে চার লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সে দুই প্রদেশে তখন আট কোটি আশি লক্ষ মানুষ বাস করতেন। জাতীয় কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ— দু’দলের নেতারা কেউ কাউকে এক চুল জমি ছাড়তে রাজি নন, তাঁরা যে যার নিজের দাবিতে অনড়। দু’দলের যুযুধান নেতাদের সামলে কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য ঠিক করতে এইটুকু সময়! স্যর সিরিল একটু আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু কানে তোলেননি কেউ। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভাইসরয় হয়ে ভারতে এসেছেন সবে তিন-চার মাস, তিনি ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছেন যেন! তাড়াহুড়ো করছেন দেশে ফিরবেন, ভাইসরয় তিনি হয়েইছিলেন এই শর্তে যে, ঝটিতি এ দেশের শাসনভার এ দেশের লোকেদের হাতে তুলে দিয়ে টা-টা বাই-বাই করে ইংল্যান্ডের প্লেনে চাপবেন। তার আগে লাউ কুমড়োর মতো দু’ফাঁক করে দিতে হবে দেশটাকে। সেটাই রাজনীতির কারবারিদের দাবি। তাঁরা ধৈর্য ধরেছেন অনেক, আর তর সইছে না। সিরিল ভারতে আগে কোনও দিন আসেননি, এ দেশ সম্পর্কে প্রথমে কোনও ধারণাই ছিল না তাঁর। তবে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে এ কাজের গুরুদায়িত্ব এই জন্যই দিয়েছিল যে, তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভাবে ব্যাপারটা সামলাতে পারবেন। আর খোদ লন্ডনের দুঁদে সাহেব আইনজীবী পরিচয়ের ওজনটা তো ছিলই। সে সময়ের বিখ্যাত ইংরেজ কবি ডব্লিউ বি অডেন তাঁর ‘পার্টিশন’ কবিতায় র‌্যাডক্লিফের ভারত ভাগের সেই কাহিনি অদ্ভুত ব্যঙ্গমেশানো ভঙ্গিতে তুলে ধরেছিলেন।

পঞ্জাব ও বাংলার সীমানা নির্ধারণ করার জন্য গঠিত দু’টি বর্ডার কমিশনের একমাত্র চেয়ারম্যান হয়ে এসেছিলেন র‌্যাডক্লিফ। দুই কমিশনেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ থেকে দু’জন করে সদস্য ছিলেন। সদস্যরা সবাই ছিলেন আইনজীবী, মানচিত্র বা সীমানা নির্ধারণ সম্পর্কে তাঁদের বিন্দুবিসর্গ জ্ঞান ছিল না। কোন উপদেষ্টাও ছিলেন না, যিনি সে ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন, জরিপ বা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্যও ছিল না কমিশনগুলোর কাছে। এ সবের মধ্যে যাওয়ার ইচ্ছেই ছিল না কর্তাব্যক্তিদের, কারণ তাতে অনেক বেশি সময় লাগত। ব্রিটেনে লেবার পার্টির সরকার তখন বিশ্বযুদ্ধের পরে আর্থিক ভাবে বেশ জবুথবু, আর যে ভারত এক সময় তাদের মুকুটের মণি ছিল, সেই ভারত তখন তাদের কাছে মাথাব্যথার কারণ। নানা রাজনৈতিক আন্দোলন, নৌবিদ্রোহের মতো ঘটনা তাদের পায়ের তলার মাটি কাঁপিয়ে দিয়েছে। তার ওপর দেশটার দুটো ধর্মের মধ্যেই সাম্প্রদায়িক লড়াই বেঁধে গেছে। যদিও এক দিন ব্রিটিশদের নিজেদেরও উস্কানি ছিল সে ভাগাভাগি বা হানাহানিতে, তবু তখন এমন অবস্থা যে, পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্তের পুরো বাইরে চলে যাওয়ার আগে কোনও মতে এ সাম্রাজ্য ঘাড় থেকে নামাতে পারলে মুখরক্ষা হয়। কিন্তু সে কাজ মোটেই সহজ ছিল না। পঞ্জাবের মতো অবিভক্ত প্রদেশে হিন্দু, মুসলমান আর শিখ সম্প্রদায়ের বসতি এমন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল যে, কোনও সীমারেখা দিয়েই পরিষ্কার করে তাদের পৃথক করা মুশকিল। পুরনো ম্যাপ, অনেক আগের জনগণনার রিপোর্ট নিয়েই কাজে নামতে হল র‌্যাডক্লিফকে। সরেজমিনে কোনও কোনও এলাকা ঘুরে দেখতে পারলেও হত, কিন্তু সময় অল্প, তার পর এ হতচ্ছাড়া দেশে শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে যা গরম! কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে মোটামুটি ঘরের ভেতর বসেই ঝামেলা সারলেন র‌্যাডক্লিফ। ফল যা হওয়ার তাই হল। নানা ভুলভ্রান্তি বিতর্কের ঝড় তুলল। বাংলার বহু হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে গিয়েছিল। পরে বেশ কিছু ভুল সংশোধন করতে হয়েছিল। তবে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের নির্দেশে পশ্চিমের সীমান্তে পঞ্জাবের ফিরোজপুর আর জিরা এই দুই মুসলিম প্রধান তহশিল ভারতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। না হলে ভারতের সঙ্গে জম্মু কাশ্মীরের যোগসূত্র থাকছিল না। এ ব্যাপারটা অবশ্য সিরিল নাকি তখন বোঝেননি। আসলে কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনার ব্যাপারটাই তিনি জানতেন না। এ কথা তিনি দেশে ফেরার পর জেনেছিলেন। আগের বছর থেকে বার বার দাঙ্গায় মেতেছিল ধর্মের জিগির তুলে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলা মানুষের দল। সীমান্তরেখা ঘোষণার আগে কিছু মানুষ হুঙ্কার ছাড়ল, আরও রক্ত চাই। ১৭ জুলাই ‘পাকিস্তান টাইমস্’ পত্রিকায় হেডলাইন বেরোল, ‘অন্যায্য ভাগাভাগি হলে গৃহযুদ্ধ হবে।’ পঞ্জাবের শীর্ষস্থানীয় মুসলিম নেতারা হুমকি দিলেন, ন্যায্য ভাগের এক একরও যদি কম পায় পাকিস্তান, শেষ দেখে ছাড়বে সেখানকার ছেলেবুড়ো সব্বাই। পঞ্জাবে হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষও মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এককাট্টা হয়েছিল। আর শুরু হয়েছিল জনস্রোত, দেশত্যাগী উদ্বাস্তু মানুষের। আতঙ্কিত র‌্যাডক্লিফ ভারত স্বাধীন হওয়ার পরপরই এ দেশ ছেড়ে চলে যান। পারিশ্রমিক হিসেবে পাওনা ছিল তিন হাজার পাউন্ড বা ভারতীয় মুদ্রায় চল্লিশ হাজার টাকা, এখনকার হিসেবে কয়েক লক্ষ টাকা, সে টাকা নাকি তিনি আর নেননি। ইংরেজ ব্যারিস্টার মনে রাখতে চাননি অস্বস্তিকর সে স্মৃতি। পুড়িয়ে দেন দেশ-ভাগাভাগি সংক্রান্ত যাবতীয় খসড়া, ম্যাপ ও অন্যান্য যে সব কাগজপত্র, যা তাঁর কাছে ছিল।

কুশীলব: মহাত্মা গান্ধী ও মহম্মদ আলি জিন্না।

টোবা টেক সিং

১৯৭১ সালে বিশিষ্ট সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার যখন র‌্যাডক্লিফের সাক্ষাৎকার নিতে যান, তখন তিনি বলেছিলেন, দু’-তিন বছর সময় পেলে তিনি নাকি ভাগাভাগির কাজটা অনেক সুষ্ঠু ভাবে করতে পারতেন। দু’বছর কেন, পাঁচ বছর সময় দিলেও সুচারু দেশ ভাগ সম্ভব হত কি না বলা মুশকিল। একটা মহাদেশের মতোই প্রকাণ্ড এ দেশের সবটা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দু’-তিনটি ধর্ম সম্প্রদায়ের কোটি কোটি মানুষ, তাদের ঘরবাড়ি, জমিজমা, আত্মীয়-স্বজনকে নিখুঁত ভাবে ভাগ করে ফেলতে কোনও সীমান্তরেখাই বোধ হয় যথেষ্ট হত না। যে সব নেতা সে দিন ধর্মের ভিত্তিতে কিংবা ক্ষমতার লোভে দেশভাগের ভয়ঙ্কর খেলায় নেমেছিলেন, তাঁরা যে সুস্থ বুদ্ধির পরিচয় দেননি, এ কথা বললে ভুল হবে না। উর্দু লেখক সাদাত হাসান মান্টো ‘টোবা টেক সিং’ নামে একটি মর্মস্পর্শী ছোটগল্প লিখেছিলেন। দেশভাগের কিছু পরের কাহিনি হিসেবে লেখা সে গল্পে এক বদ্ধ পাগল দাবি করছে সে, মহম্মদ আলি জিন্না। তেমনই আর এক উন্মাদ দাবি করে, সে শিখ নেতা তারা সিংহ। বোধশক্তি হারিয়ে ফেলা লোকগুলোর সে দাবি যেন বাইরের দাপুটে নেতাদের ব্যঙ্গ করে। তবে দেশভাগের খবর পাগলদের স্থির থাকতে দেয় না। অদৃশ্য এক সীমান্তরেখা অখণ্ড ভূখণ্ডে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোর পরিচয় ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চায়। আবছা কোনও এক বোধশক্তিতে তারা মেনে নিতে পারে না সে কঠিন বাস্তব। নিদারুণ বিভ্রান্তির মধ্যে টোবা টেক সিং-এর মতো উন্মাদ বুঝবার চেষ্টা করে তার ফেলে আসা ছোট্ট শহরটা সীমান্তরেখার ঠিক কোন ধারে। ভিটেছাড়া কোটি কোটি মানুষ কি সে পাগলদের চেয়ে ভাল অবস্থায় ছিলেন? তাঁরাও তো একই ভাবে পরিচয়ের সঙ্কটে ভুগছিলেন। তাঁরাও তো পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন তাঁদের হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বা শহর। মান্টোর গল্পের শেষে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন দু’দেশের সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উন্মাদ টোবা টেক সিংকে পাকিস্তান থেকে ভারতে চালান করবার জন্য অন্যান্য হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বী পাগলদের সঙ্গে ওয়াগা সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে যখন এক অফিসারের কাছে সে জানতে পারে, তার শহরটা রয়ে গেছে পাকিস্তানে, সে পেছন ফিরে ছুটে যেতে চায় পাকিস্তানের দিকে। রক্ষীরা তাকে ধরে ফেলে এবং ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য সীমান্তরেখা পার করানোর চেষ্টা করে। ধস্তাধস্তি করে সে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দু’দেশের কাঁটাতারের মাঝখানে এক চিলতে জায়গায়। টোবা টেক সিং নামটা আসলে ছিল সেই পাগলের নিজের শহরটির নাম, যেখান থেকে এক দিন তাকে আনা হয়েছিল। আসল নাম বিষাণ সিং হলেও তার মুখে সব সময় সে শহরের নাম লেগে থাকত বলে সবাই তাকে এই নামেই চিনে গিয়েছিল। সে নাম যেন তার আত্মপরিচয় হয়ে উঠেছে গল্পে। উন্মাদ হলেও নিজের ছোট্ট শহরটির সঙ্গে টোবা টেক সিং-এর কোথাও যেন ছিল এক আত্মার যোগ। সে নিশ্চয়ই বুঝেছিল সীমান্তরেখা পেরিয়ে যাওয়ার অর্থ, অন্য এক দেশে চলে যাওয়া যেখানে তার নিজের শহরের অস্তিত্ব নেই। সে তাই সীমান্তরেখা পেরোতে চায় না। রক্ষীরা জোরাজুরি করলে পরিচয়হীনতার এক ভূমিই সে উন্মাদ বেছে নেয়। সে পনেরো বছর ধরে মানসিক অসুস্থতার জেরে রাতেও দাঁড়িয়ে কাটিয়েছিল। তার পা দুটো ফুলে গিয়েছিল, তবুও কোনও মতে টিকেছিল সে। বোধ হয় আত্মপরিচয়ের নিদারুণসঙ্কটের চূড়ান্ত মুহূর্তে তার শেষ অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখতে পারে না সে। সে দিন রাতের শেষে টোবা টেক সিং সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে সেই নো ম্যানস ল্যান্ডে।

বানরের পিঠে ভাগ?

বানরের পিঠে ভাগের গল্পের কলহে উন্মত্ত মার্জারদের সঙ্গেও বোধহয় খানিক মিল খুঁজে পাওয়া যায় আমাদের দেশের নেতাদের বা তাদের মনোনীত প্রতিনিধিদের, যাঁরা বর্ডার কমিশনের সদস্য ছিলেন। তবে স্যর সিরিল র‌্যাডক্লিফের সঙ্গে বানরের চরিত্রটা ঠিকঠাক খাপ খায় না। ভাগাভাগি থেকে তেমন কিছু লাভের বখরা তিনি নিয়ে যেতে পারেননি। সে দিনের সেই দুই বর্ডার কমিশনের সদস্যরা কিন্তু যে যার দলের স্বার্থে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছিলেন। সবার লক্ষ ছিল নিজেদের জন্য সেরাটা আদায় করে নেওয়া। তর্ক পাল্টা তর্কে বারবারই সৃষ্টি হচ্ছিল অচলাবস্থা। র‌্যাডক্লিফকেই নিতে হচ্ছিল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। শোনা যায়, দেশভাগের সেই গুরুতর পরিস্থিতিতেও এক সদস্যের কাণ্ড দেখে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। পূর্ব বাংলা থেকে মুসলিম লীগ মনোনীত সেই সদস্য নাকি র‌্যাডক্লিফের সঙ্গে গোপনে দেখা করেন। তিনি আসলে দরবার করেন যাতে দার্জিলিংটা পাকিস্তানে থাকে। প্রত্যেক গ্রীষ্মে তাঁরা সপরিবারে দার্জিলিং বেড়াতে যেতেন, জায়গাটা ভারতে চলে গেলে ব্যাপারটা ভাল হবে না বলে তাঁর মনে হয়েছিল, এই ব্যাপারে বড় চিন্তায় ছিলেন তিনি।

মাউন্টব্যাটেনদের ডায়েরি

পঁচাত্তর বছর আগে ঠিক কী ঘটেছিল, তার সব কিছু হয়তো আমরা জানতে পারিনি। গত বছর একটি খবর বেরিয়েছিল, ব্রিটিশ সরকার এক আইনি লড়াইয়ে আট লক্ষ পাউন্ড, মানে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় আট কোটি টাকা খরচ করেছে, শুধু অ্যান্ড্রু লাওনি নামে এক লেখককে আটকাতে। সে লেখক হাতে পেতে চেয়েছিলেন লর্ড ও লেডি মাউন্টব্যাটেনের ডায়েরি ও চিঠিপত্র। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই নাকি নিজেদের মনের কথা রাখঢাক না করে সব কিছু ডায়েরি আর চিঠিপত্রে লিখে ফেলার অভ্যেস ছিল। ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ এই দু’বছরের কোনও না জানা কাহিনি হয়তো ওই সব ডায়েরি বা চিঠিপত্রে লুকিয়ে আছে, যা ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর হতে পারে। তাই তারা চায়নি সে সব সর্বসমক্ষে আসুক। সাড়ে সাত দশক অতিক্রান্ত সেই ঐতিহাসিক পালাবদলের, তবু কিছু অস্বস্তি রয়েই গেল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement