ছবি: বৈশালী সরকার।
সাহানার সৎ-মা ছিল। সৎ-মা তাকে পেঁপেসেদ্ধ, উচ্ছেসেদ্ধ ভাতে মেখে খাওয়ানোর চেষ্টা করত। না খেলে বলত, “তা হলে কিন্তু বিকেলে নুডলস বন্ধ, কোল্ড ড্রিঙ্ক বন্ধ।” সাহানার সৎ-মা দুপুরে তাকে হোমওয়ার্ক করাতে বসত। এবং ঘুমিয়ে পড়ত। সাহানা সেই সুযোগে চুপিসাড়ে বিছানা থেকে নেমে পালাতে চেষ্টা করলে অল্পবয়সি সেই সৎ-মা মেয়েটি ঘুম-জড়ানো কণ্ঠে বলত, “ঠিক আছে, বিকেলে ‘চিচিং ফাঁক’ বন্ধ, ‘হরে কর কম্বা’ বন্ধ, রবিবার স্পাইডারম্যান বন্ধ।” সাহানার সৎ-মা তাকে ভালবাসার চেষ্টা করত, শাসনে রাখার চেষ্টা করত, সাহানাকে ‘মানুষ’ করার যে দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়েছিল, সেই কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করত। মোদ্দা কথা, গল্পে যে সৎ-মাদের কথা সাহানা পড়েছিল, সাহানার সৎ-মা একদম তাদের মতো ছিল না। নিজের মা বেঁচে থাকতে সাহানাকে যে ভাবে ডানার আড়ালে রেখেছিল, সৎ-মাও চেষ্টা করেছিল সে ভাবেই আগলে রাখতে। সে অনেক কিছু জীবনে খুঁজেছে, কিন্তু 'মা'— এই আবেগটা কখনও আর খোঁজেনি। 'মায়ের মতো' কাউকে খোঁজেনি বা কখনও কারও কাছে আশ্রয় চায়নি। মহিলাদের সে মহিলা হিসেবেই দেখেছে। তার আর 'মা'-এর দরকার ছিল না।
প্রায় পঁচিশ বছর পর সাহানার জীবনে সুযোগ এল কারও সৎ-মা হিসেবে নিজের পরীক্ষা নেওয়ার। সাহানা জানত এতে সে পাশ করে যাবে। একটু ভালবাসা, আন্তরিকতা, উদারতা, এই তো লাগে ভাল সৎ-মা হতে, একটা শিশুর মন জয় করতে। আগেকার দিনের মতো পারিবারিক পরিস্থিতি তো নয়। একমুখী পারিবারিক জীবন আর নেই যে, বিপত্নীক পুরুষ অনূঢ়া মেয়ে বিয়ে করে এনে তার হাতে বড় বড় ছেলেমেয়ে ধরিয়ে দিয়ে বলবে, “এখন থেকে তুমিই ওদের মা।” এ এখন আর হয় না।
এখনকার গল্প আলাদা। এখন বৈমাত্রেয় আছে, বৈপিত্রেয়ও আছে, বিমাতার মতো বিপিতাও সত্যি। এখনও বিবাহবিচ্ছেদের পরে বাচ্চার দায়িত্ব সাধারণত মায়ের উপর পড়ে, মা স-সন্তান আবার বিয়ে করে, বাবাও আর একটা বিয়ে করে। সমাজে বিবাহবিচ্ছিন্নরা সংখ্যায় হাজার হাজার। দূর থেকে মনে হতে পারে মানুষ একটা বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে, আবার আর একটা বাড়িতে ঢুকে পড়ছে— এই হল প্রধানত নারী, পুরুষের জীবনে ‘উই মুভড অন’-এর সারবত্তা। শুধু একটি সৎ মায়ের বদলে এখন সৎ-মা, সৎ-বাবা দুটোই বাচ্চাদের জীবনে বাস্তব। এ ব্যাপারে একটা বাচ্চার অভিজ্ঞতা যা খুশি হতে পারে। খুব খারাপ, খুব ভাল বা অবর্ণনীয় কষ্টের। হতে পারে সৎ-মা, সৎ-বাবা দু’জনেই ঈর্ষাকাতর, অনুদার, ডিফিকাল্ট, আনওয়েলকামিং, টক্সিক। আবার এক জন ভাল, এক জন খারাপ হতে পারে। আবার দু’জনেই অ্যাকোমোডেটিং, লাভিং, কেয়ারিং হতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রেই অবশ্য বিষয়টা তেমন সোনায় সোহাগা হয় না। যেমন আগেও সৎ-মা মানে ছিল একটা সংশয়ের ব্যাপার, হয়তো খেতে দেবে না, সারাদিন সংসারের কাজকর্ম করাবে, ভুলচুক হলে মেরে পিঠের ছাল চামড়া তুলে দেবে, সম্পত্তির ভাগ দেবে না ইত্যাদি। তেমনই এখন সৎ-বাবারাও অনেকে এ রকম। ভয়ঙ্কর সব সমস্যা তৈরি করে তারা বাচ্চাদের জীবনে। পাশ্চাত্য সভ্যতায় এই প্রবণতা খুব বেশি। অবশ্য এ রকম ‘টু-ওয়ে ফ্যামিলি’ এখন এ দেশেও দেখা যায়। অর্থাৎ সৎ-মা, সৎ-বাবা আছে, মা ও বাবা উভয়ের পার্টনারদের সঙ্গে বাচ্চাকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে, অনেক সময় তাদের তত্ত্বাবধানে থাকতে হচ্ছে; শুধু তো তা-ই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই সৎ-মা, সৎ-বাবার আবার আগের পক্ষের সন্তান আছে। ফলে একটা বাচ্চার স্টেপ পেরেন্টরা সব দিক ম্যানেজ করতে গিয়ে আতান্তরে পড়ে চরম বিরক্ত, কনফিউজ়ড, অধৈর্য হয়ে দুর্ব্যবহার করে ফেলে। অনেক সময়েই স্টেপ পেরেন্টের আগের পক্ষের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে নিয়ে থাকতে হয় বাচ্চাদের। যেন এক ধরনের সামাজিক পরিবার। কিন্তু আসল কথা হল, এই বহুমুখী পারিবারিক জীবন অনেক বাচ্চাকেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে দেয়। তারা ‘লস্ট’ ফিল করে। অসহায়তা ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ কাজ করে। বাবা, মা আর বাচ্চা নিয়ে যে আগের ইউনিটটা, সেটার জন্য কষ্ট পায়, ছটফট করে। সব থেকেও কিছু না থাকার গোপন কান্না নিয়ে বহু বাচ্চা বড় হয়ে ওঠে।
বিষয়টা জটিল। প্রাচীনপন্থী মানুষের কাছে জীবনযাপনের এই সব সমীকরণ দুর্বোধ্য। কিন্তু এই গল্পগুলো এখন যতটা বিলেত-আমেরিকার বাস্তব, ততটাই আমাদের দেশের মেট্রোসিটিগুলোর শহুরে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত জীবনেরও বাস্তব। হতে পারে পাশের বাড়ির, পাশের ফ্ল্যাটেই আছে এমন ঘটনা।
সাহানার ঘটনাটা এ রকমই। ঘটনাস্থল লন্ডন শহর। সাহানা সঞ্জয়কে বিয়ে করে পাকাপাকি ইংল্যান্ডে শিফট করার আগে অন্তত বছর চারেক ধরে গেছে, এসেছে, থেকেছে, ছ’মাস করে সংসার করেছে, আবার কলকাতায় ফিরেছে নিজের কাজের জগতে। সঞ্জয়ের ছেলে ঋত-র সৎ-মা হয়ে উঠতে তার অসুবিধে হয়নি। ঋত আগে একটা নাদুসনুদুস মিষ্টি বাচ্চাই ছিল, যে মূলত তার মায়ের কাছেই থাকে, মা-ই তার প্রাইম কাস্টোডিয়ান। আর বাবার কাছে সে সপ্তাহান্তে আসে, কিংবা দু’-চার দিনের ছুটিতে। আর একটা বড় স্কুল হলিডে সে পুরোটাই বাবার সঙ্গে কাটায়। সাহানা তাকে আদর করে, একটু বাংলা শেখায়, ভাল ভাল রান্না করে খাওয়ায়, বেড়াতে গেলে হাত ধরে থাকে, গল্পের বই পড়ে শোনায়, হ্যান্ডরাইটিং শেখায়। ঋত একটু একটু করে বড় হয়। সাহানা আর সঞ্জয় দু’জনে মিলে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি ভিসার কাগজপত্র তৈরি করে, সাহানা এ বার রেডি হয় ইংল্যান্ডে পুরোপুরি শিফট করে যাওয়ার জন্য।
এই রকম অবস্থার মধ্যেই সঞ্জয়ের আগের স্ত্রী, মানে ঋতর নিজের মা সোহিনী বিয়ে করে এক জনকে। ধরা যাক তার নাম সৌরভ। এবং সোহিনী প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। বাবা-মার ডিভোর্সের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিল ঋত। একটা ভাঙা পরিবারের সদস্য হয়ে শিশুটি দুটো বাড়ি, দুটো পরিবেশে মানিয়ে নিচ্ছিল। বাবার জীবনে এক জন বহিরাগত মহিলাকে আর মায়ের সংসারে আর এক জন অচেনা মানুষকে মানিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু মার প্রেগন্যান্ট হওয়া, নতুন বাচ্চার আগমন ও সেই নবাগতকে কেন্দ্র করে মার ব্যস্ততা যখন তুঙ্গে— হঠাৎই বিগড়ে যেতে লাগল বছর দশ-এগারোর ছোট্ট ছেলেটা। প্রথমে স্কুলে পারফরম্যান্স খারাপ হতে শুরু হল। চাইল্ড মাইন্ডার স্কুলে রিপোর্ট করল যে ঋতর নানা রকম বিহেভিয়ারাল সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ও দেশে চাইল্ড মাইন্ডারদের বাচ্চার ওয়েলফেয়ার দেখার কিছু লিগাল রাইটস-ও থাকে। বাচ্চার আচার-আচরণে সমস্যা দেখলে, বাচ্চা মারপিট করছে বা গুম হয়ে থাকছে, মানসিক অবসাদে ভুগছে, লেখাপড়া করছে না, সোশ্যালাইজ় করছে না, খেলছে না, খাচ্ছে না, অবাধ্যতা করছে বা আর কোনও রকম অস্বাভাবিকতা তার চরিত্রে ফুটে উঠছে দেখলে চাইল্ড মাইন্ডারের অধিকার আছে সরাসরি স্কুল কর্তৃপক্ষকে সে কথা জানানোর।
ঋত-র চাইল্ড মাইন্ডার ঋত-র বিহেভিয়ারাল সমস্যার কথা স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে সঙ্গে তার নিজস্ব মতামত হিসেবে লিখল যে, “বাচ্চার বাবা, মা কেউই মনে হয় না বাচ্চার ব্যাপারে সিরিয়াস। এবং বাচ্চা তাকে জানিয়েছে যে, বাচ্চার সৎ-বাবা সৌরভ বাচ্চার সঙ্গে প্রায় সময়ই ‘রুড’ বিহেভ করে।” ব্যস! স্কুল কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাকে ইন্টারোগেট করল এবং ঋত যা বলল, তাতে স্কুল কর্তৃপক্ষ বাচ্চার ওয়েলফেয়ারের কথা মাথায় রেখে সোশ্যাল সার্ভিসকে জানাল যে, তারা চায় সোশ্যাল সার্ভিস ইনভলভড হোক। কারণ ঋত বলেছে, সৎ-বাবা সৌরভ ঋতকে মারেও। এ দেশে বাচ্চার গায়ে হাত! ভাবাই যায় না! এ দেশে বাচ্চাকে ভয় দেখানো, ধমকানো কিছুই করা যায় না। সোশ্যাল সার্ভিস নড়েচড়ে বসল।
বাবা, মাকেও ডেকে পাঠাল স্কুল। বাবা পৌঁছতে দেরি করল। তাতে স্কুল অসন্তুষ্ট হল। মা কাজ থেকে ডে অফ নিয়ে অন্য ছোট বাচ্চাটিকে সামলাতে সামলাতে যে ভাবে এসে হাজির হল, তাতে স্কুলের মনে হল এই মা বিয়ে, বাচ্চা, চাকরি সব নিয়ে ছড়িয়ে লাট করছে, মোটেও বাচ্চাদের ভাল করে কেয়ার নিতে পারছে না। সোহিনী বার বার বলল যে, সৌরভ কখনওই ঋতর গায়ে হাত তুলতে পারে না। তা ছাড়া সৌরভ সদ্য ইন্ডিয়া থেকে আসা কোনও ইমিগ্র্যান্ট নয় যে এ দেশের নিয়মকানুন জানে না। ও এক জন সভ্য, ভদ্র ব্রিটিশ নাগরিক। ঋত ছেলেমানুষ। কী বলতে কী বলেছে ঠিক নেই। হয়তো বাবা, মা, সৎ-বাবা সবার উপর অভিমান হয়েছে। হতেও পারে যে সোহিনী ওকে ইদানীং ঠিকমতো সময় দিতে পারেনি, তাই ও একটু ভুল বুঝছে মা-কে। সোহিনী জানাল, সে একটা ছোট্ট ছুটির ব্যবস্থা করে ক’টা দিন শুধু ঋতর সঙ্গে কাটাবে। একটা ডে-ট্রিপ করবে ঋতকে নিয়ে, বা লেক ডিস্ট্রিক্ট ঘুরে আসবে। স্কুল কর্তৃপক্ষ সব শুনল। কিন্তু মনোভাব বদলাল না। একটা কড়া রিপোর্টে সব উল্লেখ করে ঋতর কেসটা সোশ্যাল সার্ভিসকে অফিশিয়ালি রেকমেন্ড করে দিল। স্কুল নোট দিল— বাবা-মা আসলে বাচ্চাটাকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। বাচ্চা অবহেলিত।
এক দিন কোনও খবর না দিয়ে সোহিনীর অক্সফোর্ডের বাড়িতে এসে হাজির সোশ্যাল সার্ভিস। ও দেশে সরকারি কাজের দায়িত্ব সবচেয়ে কঠিন হৃদয়ে পালন করে অ্যাফ্রো-ব্রিটিশরা। তারা যা দেখবে, তা-ই রিপোর্ট দেবে। দু’জন মহিলা, গ্রেস আর জাবাবেরি এসে দেখল সোহিনীর বাড়ি তুমুল অগোছালো; এখানে ওখানে জামাকাপড় পড়ে আছে, বাচ্চাদের খেলনা যেখানে সেখানে গড়াচ্ছে, ছোট বাচ্চাটা তারস্বরে কাঁদছে, ঋতর ঘরের দেওয়ালে মোল্ড, ফ্রিজে ঋতর খাওয়ার মতো স্ন্যাক্স নেই, পানীয় নেই। সৌরভ তার মধ্যে বসে গান শুনছে, বই পড়ছে আর যাকে কেন্দ্র করে এত ঘটনা, সে নিজের বিছানায় গুম হয়ে শুয়ে আছে, ডাকতে গেলে পরিত্রাহি চেঁচিয়ে হাত-পা ছুড়ছে। ভায়োলেন্ট হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চার লিভিং কন্ডিশন, মেন্টাল হেলথ, সেফটি, সিকিয়োরিটি সবেতেই লাল ঢ্যাঁড়া পড়ে গেল। সোশ্যাল সার্ভিস ঋতর নামে রেকর্ড তৈরি করে ফেলল। কোনও ব্রিটিশ বাবা-মা চায় না, এই রেকর্ড তার বাচ্চার নামে কখনও তৈরি হোক।
তিল থেকে তাল হল। কলকাতায় বসে সাহানা পর্যন্ত আতঙ্কিত হল এই ভেবে যে, এ বার না সোশ্যাল সার্ভিস বাচ্চাটাকে বাবা-মার থেকে টেনে নিয়ে ফস্টার কেয়ারে দিয়ে দেয়! সঞ্জয় ফোনে বলল, “সাহানা, সোশ্যাল সার্ভিসের রিপোর্ট এত খারাপ যে, ওরা যে কোনও মুহূর্তে ঋতকে নিয়ে নেবে।” সেই রিপোর্টে সঞ্জয়কেও কমপিটেন্ট বাবা হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। কারণ সঞ্জয় নাকি ইন্টারভিউয়ে কথায় কথায় বলেছিল, “আমি লন্ডনে টানা থাকতে পারি না, ডিপ্রেশন হয়।” যে বাবা নিজেই ডিপ্রেশনে ভোগে, টানা দেশে থাকতে পারে না, তেমন বাবার কাছে গভর্নমেন্ট কোন ভরসায় তাদের বাচ্চা দেবে? হ্যাঁ। এ দেশে বাচ্চা আসলে সরকারের সম্পত্তি। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বাচ্চার আসল অভিভাবক রাষ্ট্র। রাষ্ট্র যেমন ভাল বুঝবে, তেমনই হবে।
“এক বার বাচ্চা নিয়ে নিলে আর আঠারো বছর বয়স অবধি বাচ্চা ফিরে পাওয়ার চান্স নেই। কোথায় থাকবে, কাদের সঙ্গে থাকবে সেটুকুও জানা যাবে কি না সন্দেহ!” বলছিল সঞ্জয়। তার পর বলল, “সাহানা, তুমি এসে আমার ছেলেটাকে বাঁচাও। প্লিজ়! প্লিজ়!”
সাহানা সাগরিকা চক্রবর্তীর কেসটার কথা ভাল করেই জানত। নরওয়ের চাইল্ড ওয়েলফেয়ার ভদ্রমহিলার বাচ্চাদের কেড়ে নিয়েছিল। ইউরোপ, আমেরিকা জুড়ে সোশ্যাল সার্ভিস বাচ্চা নেগলেক্টেড বা অ্যাবিউজ়ড দেখলে বাচ্চাকে নিজেদের হেফাজতে টেনে নেয়। ইংল্যান্ডেও সেই একই নিয়ম।
সাহানা পড়িমরি করে ছুটল লন্ডন। যদি এখনও শেষরক্ষা করা যায়। যদি সাহানা যাওয়ার পর একটা পারিবারিক ছবি প্রেজ়েন্ট করে ঋতকে সোশ্যাল সার্ভিসের হাত থেকে বাঁচানো যায়! লন্ডনে পৌঁছতেই সোশ্যাল সার্ভিস থেকে মরোক্কান ব্রিটিশ মহিলা ফাতিমা এসে দেখা করে গেলেন সাহানার সঙ্গে। সাহানা খুব যত্ন করে অ্যাপায়ন করল তাঁকে। লিভিং রুমে না বসিয়ে একেবারে নিয়ে গিয়ে বসাল কনজ়ারভেটরিতে। যাতে মহিলা দেখতে পান ঋতর বাবার বাড়ি কত অর্গানাইজ়ড, স্টিঙ্কিং কিছু নেই, ড্যাম্প নেই, মোল্ড নেই। সে গোপনে সুগন্ধী ক্যান্ডেল জ্বেলে দিল। তার পর ফাতিমাকে কফি খাওয়াল সুন্দর পোর্সেলিনে। পরিপাটি জয়পুরি হ্যান্ড ব্লক প্রিন্টেড ন্যাপকিন এগিয়ে দিল। পেস্তা, পাইন নাটস, ড্রায়েড ক্র্যানবেরি দিয়ে মাখনের গন্ধে ভরপুর কেক আগেই বেক করতে বসিয়েছিল। সেই গরম কেক ওভেন থেকে বার করে প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “তুমি প্লিজ় একটু খেয়ে দেখো কেমন হয়েছে। আমি ভীষণ রান্না করতে ভালবাসি, বেক করতে ভালবাসি।” কথাটা শুনিয়ে দিল যাতে মনে হয় যে ঋতর সৎ-বাবা যেমনই হোক না কেন, সৎ-মা খুব লাভিং, কেয়ারিং, হোমলি, কাম অ্যান্ড কমপোজ়ড স্টেবল পার্সোনালিটির মহিলা।
ফাতিমা বেশ সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেলেন মনে হল। এবং পরের দিন সোশ্যাল সার্ভিস মেলও করল যে, এখনও অবধি যা হয়েছে খারাপ হয়েছে, কিন্তু একটা চান্স সোশ্যাল সার্ভিস তবু বাচ্চার বাবাকে দিতে চায়। আগামী শুক্রবার সোহিনী-সৌরভ, সাহানা-সঞ্জয়কে সোশ্যাল সার্ভিসের সঙ্গে যৌথ মিটিং-এ বসতে হবে। অক্সফোর্ডের হার্লোর চাইল্ড প্রোটেকশন সেন্টারে যেতে হবে সবাইকে। ঋতকে কী ভাবে মিড টার্মে লন্ডনে মুভ করানো যায় এ সব নিয়ে আলোচনা হবে। সৌরভের বিরুদ্ধে চাইল্ড অ্যাবিউজ়ের কমপ্লেনটা নিয়েও আলোচনা হবে ইত্যাদি।
শুক্রবার সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে। মনমরা আবহাওয়া। সাহানা সঞ্জয়ের সঙ্গে রওনা দিল অক্সফোর্ড। হার্লো সেন্টারের মিটিং রুমে বিভিন্ন পদমর্যাদার সোশ্যাল ওয়ার্কার উপস্থিত। ইসাবেলা নামে একটি ইংরেজ মেয়ে মিটিংটা সঞ্চালনা করছে। সঞ্জয়কে খুব বকল মেয়েটি, সব কাউন্সেলিং ঠিক মতো অ্যাটেন্ড করেনি বলে। সোহিনীর সঙ্গে সাহানার আগে কথা হলেও এ রকম মুখোমুখি আলাপ হয়নি। সোহিনী ভয়ে তটস্থ। কাউন্সেলর বলেছে যে, সোহিনীর সম্পর্কে রিপোর্ট এত খারাপ যে, সোহিনীর ছোট বাচ্চাটার দিকেও সোশ্যাল সার্ভিস নজর দেবে! হঠাৎ কী হল বোঝা গেল না, সাহানারা চার জন ছাড়া বাকি সবাই, “দুঃখিত, আমরা আসছি,” বলে উঠে যেতে সোহিনী বলল, “আমি কয়েক মাস মন দিয়ে কাজ করিনি। আমার চাকরি যাবে। বাচ্চারা চলে যাবে। বর যাবে জেলে। বাহ!” বলে বড় একটা কান্না গিলে নিল সোহিনী। সৌরভ সঞ্জয়কে এড়িয়ে সাহানার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি জানি না এ সব কেন হচ্ছে! আমি কোনও দিন ঋতকে মারতে পারি? আমি এ দেশের চাইল্ড প্রোটেকশন আইন জানি না? আমি এ দেশে লিগাল ডেভলপমেন্ট পড়াই। এ দেশে ছোট থেকে স্কুলে শেখানো হয় বাচ্চার কী কী রাইটস। এখানে বাচ্চারা জানে তাদের সঙ্গে কী কী করা যাবে না, করলে কী হবে। সে দিন আমি ঋতকে জুতোর ফিতে বাঁধতে শেখাচ্ছিলাম। ও জেদ করছিল শিখবে না, ইচ্ছে করে লেসগুলোয় গিঁট পাকিয়ে দিচ্ছিল। এ দিকে ছোট বাচ্চাটা কাঁদছে, ওকে খাওয়াতে হবে। বিরক্ত হয়ে ঋতর জুতোজোড়া তুলে ছুড়ে ফেলে দিই। তাতে ঋত সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, “স্টপ পেস্টারিং মি। আমি তোমার বিরুদ্ধে কমপ্লেন করব। এটা চাইল্ড অ্যাবিউজ়।”
আমি রেগে গিয়ে ওকে বলেছিলাম, “কিসের অ্যাবিউজ়? ডিড আই হিট ইউ?”
ও তখন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “আই ক্যান সে দ্যাট যে, তুমি আমাকে হিট করেছ, কিক করেছ, পাঞ্চ করেছ। আফটার অল তুমি আমার সৎ-বাবা।”
এ বার সঞ্জয় বলে উঠল, “আমি বিশ্বাস করি না ঋত মিথ্যে বলছে। আমার ছেলের গায়ে হাত দিলে আমি বরদাস্ত করব না।”
সোহিনী বলল, “এটা তোমার চাল। তুমি এ সব করিয়েছ। কিন্তু মনে রেখো ঋতকে সোশ্যাল সার্ভিস টেনে নিচ্ছে। ইউ আর গোয়িং টু লুজ় ইয়োর চাইল্ড। তুমি জেলাসি করে আমার বরকে জেলে পাঠিয়ে ভাবছ আমার সংসারটা নষ্ট করে দেবে? সৌরভ নয়, তুমিই ওর স্টেপ ফাদার।”
সঞ্জয় রেগে গিয়ে বলল, “প্লিজ় সোহিনী। ইউ হ্যাভ মুভড অন, আই হ্যাভ মুভড অন। আই ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট ইয়োর লাইফ। এখন তো ছেলের দায়িত্ব আমাকেই নিতে হচ্ছে। কারণ ইউ আর আ ব্যাড মাদার!”
মিটিং-এ মোটামুটি সব ঠিক হয়ে গেল। সোশ্যাল সার্ভিস রাজি। আপাতত একটা টার্ম লন্ডনে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে সাহানা আর সঞ্জয়ের কাছে থাকতে শুরু করবে ঋত। সৌরভের বিরুদ্ধে অভিযোগ এখনও তোলা হবে না, খতিয়ে দেখা হবে। সোহিনীর ছোট বাচ্চাকে মাঝে মাঝে ভিজ়িট করবে সোশ্যাল সার্ভিস।
কিন্তু দিনটা কিংবা ঘটনাটা, এখানেই শেষ হল না। সাহানারা যখন প্রায় লন্ডনে ঢুকছে, এ রকম সময় সোহিনীর ফোন এল যে, ঋত বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। তখন রাত প্রায় ন’টা। সঞ্জয় বলল, “পালিয়ে গেছে? কখন পালাল?”
সোহিনী বলল, “ঘণ্টাখানেক আগে ঝগড়া করে বেরিয়ে গিয়ে বাড়ি লক্ষ করে পাথর ছুড়ছিল। লাগল গিয়ে পাশের বাড়ির কাচে। ওদের কাচ ভেঙেছে। ও ফস্টার কেয়ারে যাবে না, ও এ বার জেলে যাবে। নেবারই পুলিশে খবর দিয়েছে। পুলিশ আসছে বলে ও পালিয়ে গেছে। আজ নিজের মাথা নিজে ঠুকে বলেছে, ‘তুমি আমাকে মেরেছ! তুমি জেলে যাবে। তোমার এই বাচ্চাটাকেও সোশ্যাল সার্ভিস কেড়ে নেবে। ঠিক হবে।’ এখন বুঝতে পারছ সৌরভের এগেনস্টে আনা অ্যালিগেশন সব মিথ্যে?”
সঞ্জয় বলল, “এ সব তুমি এত ক্ষণ পরে আমাকে বলছ?” ফোন কেটে গাড়ি ঘোরাল সঞ্জয়। আবার লন্ডন থেকে অক্সফোর্ডের দিকে। অন্ধকার। ঠান্ডা। সমানে বৃষ্টি পড়ছে। সাহানা বার বার বলতে লাগল, “প্লিজ়, আস্তে চালাও। হয় টিকিট খাবে। নয় অ্যাক্সিডেন্ট করবে। প্লিজ়, এ রকম কোরো না! আই অ্যাম স্কেয়ার্ড!”
“ছেলেটার জীবনটা কি নষ্ট হয়ে গেল সাহানা?” সঞ্জয় কাঁদছে।
“এতে তোমারও ভূমিকা আছে,” ঠান্ডা কঠিন গলায় ধমকে উঠল সাহানা, “তোমার উচিত ছিল ঋতকে শেখানো মা-কে, সৌরভকে রেসপেক্ট করতে। তুমি তার বদলে মিসট্রাস্ট করতে শিখিয়েছ। দিনের শেষে সৌরভ কিন্তু তোমার ছেলেকে রান্না করে খেতে দেয়। সোহিনী ফেরে রাত বারোটায়! কী টাফ লাইফ এখানে সঞ্জয়! একটা এগারো বছরের বাচ্চা তার সৎ-বাবাকে, নিজের মাকে জেলে পাঠাতে চাইছে, হুমকি দিচ্ছে, ব্ল্যাকমেল করছে... কারণ তুমি ওর মাথায় ঢুকিয়েছ যে, সোহিনী যদি ঋতকে ভালবাসত, তা হলে কখনও আর একটা বাচ্চা নিত না। অস্বীকার কোরো না। অনেক বার আমি এ সব বলতে শুনেছি তোমায়। তোমাকে আমি নিজের কানে বলতে শুনেছি, ‘ঋত, সৌরভ তোর স্টেপ ফাদার। হি ইজ় নট গোয়িং টু লাভ ইউ এভার।’ তুমি ম্যানিপুলেটর সঞ্জয়। তুমি ঋত আর আমাকে ক্লোজ় দেখতে চাও। কিন্তু সোহিনী-সৌরভের থেকে ঋতকে সরিয়ে দিতে চাও! শেম অন ইউ।”
সঞ্জয় চুপ করে গেল।
সাহানারা যত ক্ষণে অক্সফোর্ড পৌঁছল, তত ক্ষণে মেট পুলিশ চপার নামিয়ে দিয়েছে ঋতকে খুঁজতে। সোহিনীর বাড়ির পেছনেই একটা ফরেস্ট। সেখানে সার্চলাইট ফেলছে পুলিশের চপার। পুলিশ কুকুরও নেমে গেছে। কয়েক দিন আগেই একটা বাচ্চা ছেলের শরীর পাওয়া গেছে এই জঙ্গলে। এক জন সিরিয়াল কিলারের কাজ। এর মধ্যে ঋত গায়েব। পুলিশ তো ঋতকে নিয়ে চিন্তিত হবেই। এ দিকে সোহিনী সমানে কেঁদে যাচ্ছে। ছোট বাচ্চাটাও কাঁদছে। সৌরভ গেছে পুলিশের সঙ্গে ঋতকে খুঁজতে। বাড়িতে বসে আছে তিন-চার জন পুলিশ। বাইরে পুলিশের গাড়ি। পাড়াটা শান্ত। এখানে কেউ কৌতূহল দেখায় না।
সাহানা ছোট বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। বলল, “ওর খিদে পেয়েছে সোহিনী। ওকে খাওয়াও। ঋতকে ঠিক পাওয়া যাবে। ও কোথাও যায়নি। এখানেই লুকিয়ে আছে। মনে হয় না ওর এর থেকে বেশি সাহস হবে বলে।" বলে সে তীব্র ভর্ৎসনার চোখে সঞ্জয়ের দিকে তাকাল। তার পর বাচ্চাটাকে ভোলাতে চেষ্টা করতে লাগল।
তখন সাহানার মনে পড়ছিল নিজের সৎ-মার কথা। যে তাকে চিরকাল ভালবেসেছে। শাসন করেছে। ছলনা করেনি। তাই সেও করবে না। সে সোহিনী-সৌরভের পাশে দাঁড়াবে। সঞ্জয়কেও বুঝতে হবে। ঋতর স্বার্থে সবাইকে সবার সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে।
তখনই, ওই অত রাতে, চোখে-মুখে গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে ইসাবেলা নামের সোশ্যাল সার্ভিসের মেয়েটি এসে হাজির হল। সঙ্গে আরও এক জন সাদা মহিলা। ভাগ্যিস ছোট বাচ্চাটা এখন বেবি-কটে শান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। সাহানার মনে হল, কী দেশই না তৈরি করেছে সাদারা! বাচ্চা ভাল হোক, দুষ্টু হোক, বাচ্চার জন্য সমস্ত রাষ্ট্র যে কোনও মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে রেডি!
ঋতকে রাত দুটো নাগাদ পাওয়া গেল পাশের পাশের বাড়ির পিছনের বাগান থেকে। সাহানার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। কুকুর, হেলিকপ্টার সব নিয়ে এত বড় পুলিশ টিম এত খোঁজাখুঁজি করল, আর ঋত পাশেই লুকিয়ে বসে সব দেখছিল! সে ভাবল, এক সোশ্যাল সার্ভিসে রক্ষে নেই, তার উপর আবার পুলিশ না বিরাট একটা রিপোর্ট লেখে ঋতর বিরুদ্ধে। কিন্তু তাকে আশ্চর্য করে সার্চ টিম কম্যান্ডার বললেন, “ওয়েল ঋত, তুমি তো জানোই যে আমরা সমস্ত দেশকে রক্ষা করার চেষ্টা করি। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তাদের কাছে সময়মতো পৌঁছতে পারি না যাদের আমাদের খুব দরকার। কারণ আমাদের এত লোক বা রিসোর্স নেই। আজ তোমাকে খুঁজতে আমরা ব্যস্ত ছিলাম বলে আমরা হয়তো এমন এক জনের কাছে পৌঁছতে পারলাম না, যার তখন আমাদের সাহায্যের সত্যিই দরকার ছিল। অথচ তোমার তো প্রয়োজন ছিল না আমাদের, তাই না? নো প্রবলেম। তুমি হয়তো না বুঝে করে ফেলেছ। কিন্তু এটা আমাদের সোসাইটির পক্ষে ঠিক নয়। তুমি একটা কাজ করবে। তুমি আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটা চিঠি লিখবে। তাতে লিখবে যে, তুমি আর কখনও দুষ্টুমি করে পুলিশের বহুমূল্য সময় এবং রিসোর্স নষ্ট করবে না, কেমন?”
সেই রবিবারই সাহানার উদ্যোগে সাহানা, সঞ্জয়, সোহিনী, সৌরভ ঋতকে নিয়ে কোভেন্ট গার্ডেনের একটা ফ্যামিলি পাব-এ দেখা করে এক সঙ্গে লাঞ্চ করল। প্রথম কিছু ক্ষণ অস্বস্তি হচ্ছিল সবারই, কিন্তু ঋতর ভালর জন্য চার জনই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কিছুটা সময় পর দেখা গেল, খেতে খেতে বেশ ভালই গল্প হচ্ছে বড় চার জনের মধ্যে। গল্পের বিষয় কলকাতার মোগলাই পরোটা। সাহানা না দেখার ভান করেও দেখে নিল ঋত জ্বলজ্বলে চোখে সাহানা, সঞ্জয়, সোহিনী, সৌরভ, সবার মুখের দিকে এক বার এক বার করে তাকিয়ে দেখছে। চোখে বিস্ময়, চোখে আনন্দ।