সংগ্রামী: দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। ডান দিকে, তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বাসভবন ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ নামে। বন্ধ হয়ে পড়ে আছে তাঁর নামাঙ্কিত সংগ্রহালয়। (ছবি: লেখক)।
যাচ্ছেন, যান। কিন্তু ওখানে এখন দেখার কিছু নেই,” বলেছিলেন সেই খেপাটেদর্শন মানুষটি।
জানতে চেয়েছিলাম ‘স্টেপ অ্যাসাইড’-এর রাস্তা। সে পথ বাতলে দিয়েছেন এক লহমায়। তার পরে উপযাচক হয়ে এই উপদেশ। কিন্তু কেন?
মানুষটি বলছিলেন, “কবে থেকে বাড়িটা তালা বন্ধ। কোনও দেখভাল নেই।”
তার পরে হাতের উপরে কাগজ রেখে যেন খসখস করে লিখছেন, এই ভাবে দেখিয়ে বললেন, “ঘুরে এসে ডিএম-কে (জেলাশাসক) চিঠি দিন। এই অবস্থা কেন!”
নাম পেমা ভুটিয়া। থাকেন ভুটিয়া বস্তিতে। ম্যালের পাশ দিয়ে যে সি আর রোড নেমে গিয়েছে, ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ যেতে যে রাস্তা ধরে এগোতে হবে, তারই একটি রোয়াকে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। জানতে চাইলাম, “স্টেপ অ্যাসাইড-এ দেখার মতো কিছু আছে?”
পেমা বললেন, “দেশবন্ধু সি আর দাশের নামে মিউজ়িয়ম ছিল। এখন সে সব কী অবস্থায় আছে কে জানে!” পাশে বসা পেমা দাজুর বন্ধুরাও প্রায় একই সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, কেন বাড়িটি খোলার ব্যবস্থা করা হবে না?
পেমাদের পেরিয়ে মিনিট পাঁচেক এগোতেই বাঁ হাতে পড়ল বাড়িটি। গ্রিলের দরজায় বাড়ির নাম লেখা। এবং একটি তালা ঝোলানো। সেই দরজা থেকে বাড়িতে যে পথ উঠে গিয়েছে, পুরোটাতেই শুকনো পাতা পড়ে পুরু গালচের মতো হয়ে রয়েছে। মূল দরজার দু’পাশে দু’টি ফলক। একটিতে হিন্দি, বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা: দেশবন্ধু সংগ্রহালয়। অন্যটিতে ইংরেজিতে লেখা: এখানেই ১৯২৫ সালের ১৬ জুন শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ।
গত সপ্তাহে সেই প্রয়াণের ৯৮ বছর পূর্ণ হল।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে দার্জিলিং-এর যোগ অবশ্য এরও বেশ কয়েক বছর আগে থেকে। ১৯১১ সালে। যখন এই শৈলশহরেই অসুস্থ অবস্থায় শরীর সারাতে এসেছিলেন সিস্টার নিবেদিতা। তাঁকে দেখতে আসেন চিত্তরঞ্জন। নিবেদিতা সে যাত্রা সুস্থ হয়ে ফিরতে পারেননি। দার্জিলিং-এই মারা যান। তবে তিনি থাকতেন অন্য একটি বাড়িতে।
আলিপুর বোমার মামলার দৌলতে ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন তত দিনে রাজনৈতিক ভাবে যথেষ্ট পরিচিত। এর পরে ধীরে ধীরে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেবেন। প্রথম থেকেই চিত্তরঞ্জন ছিলেন মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর ঘনিষ্ঠ। ব্যারিস্টার হিসেবেও সেই সময় চিত্তরঞ্জন দেশের প্রথম সারিতে। দু’হাতে রোজগার যেমন করছেন, তেমনই তাঁর দানধ্যানের কথাও কিংবদন্তি হয়ে উঠছে।
১৯২০ সালে চিত্তরঞ্জনের মনে হল, আর ব্যারিস্টারি নয়, এ বারে পুরোদস্তুর রাজনীতিতে যোগ দেবেন তিনি। স্ত্রী বাসন্তীদেবী ও পুত্র চিররঞ্জনের কাছেও তিনি এই ব্যাপারে মতামত চান। তাঁরা সায় দিয়েছিলেন। আয়ের পাহাড়চুড়ো থেকে এক কথায় তিনি নেমে আসেন মাটিতে। সাধারণ মানুষের পাশে।
প্রথমে চিত্তরঞ্জন যোগ দেন গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে। সেই সূত্রে তাঁর ছ’মাসের জেলও হয়। কিন্তু চৌরিচৌরার ঘটনার পরে গান্ধীজি হঠাৎই আন্দোলন থামিয়ে দেন। এর ফলে চিত্তরঞ্জন ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তবে গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক বরাবরই ছিল।
এর পরে মোতিলাল নেহরুর সঙ্গে জোট বেঁধে স্বরাজ পার্টি গঠন করেন তিনি। যদিও তাঁরা বার বারই বলেছেন, কংগ্রেস তাঁরা ছাড়েননি। বরং সেই সংগঠনের মধ্যে থেকেই পৃথক দল করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে চাইছেন। এই পার্টির কাজে চিত্তরঞ্জন নিয়মিত বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে লাগলেন। আগে ‘ব্যারিস্টার দাশ’ হিসাবে যেতেন ট্রেনের উচ্চতর শ্রেণিতে। এখন ঘুরতে শুরু করলেন সাধারণের সঙ্গে। গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তত দিনে দামি কাপড় ছেড়ে খদ্দর পরতে শুরু করেছেন। যদিও চরকা কাটা তাঁর দ্বারা হয়নি কোনও দিনই। এই একটি কাজে তাঁকে বার বার ব্যর্থ হতে দেখে গান্ধীজি বলেছিলেন, “এই কাজটি আপনার দ্বারা আর হবে না।”
১৯২৩ সালে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের ভোটে অংশ নেন। এই শহরের প্রথম নির্বাচিত মেয়র হন চিত্তরঞ্জন দাশ। একই সঙ্গে জাতীয় স্তরে রাজনীতিও চলতে থাকে। দু’বছর আগেই তিনি ঢাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। দুই বাংলার মধ্যে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও বন্ধ হয়নি।
১৯২৫ সালের মে মাসে অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত হয় বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস অধিবেশন। সেখানে তিনি সভাপতিত্ব করেন। সেই অধিবেশনে অনেকের সঙ্গে গান্ধীজিও যোগ দিয়েছিলেন। ফরিদপুর থেকে কলকাতায় ফিরেই চিত্তরঞ্জন অসুস্থ বোধ করেন। তত দিনে চূড়ান্ত অনিয়ম এবং কাজের পাহাড় প্রমাণ চাপের জন্য তাঁর শরীর অনেকটাই ভেঙেছে। চিকিৎসকের পরামর্শে এর পরে দার্জিলিং পাহাড়ে বিশ্রাম নিতে যান চিত্তরঞ্জন।
সেই দার্জিলিং পাহাড়, যেখানে চোদ্দো বছর আগে গিয়েছিলেন সিস্টার নিবেদিতাও। চিত্তরঞ্জন তখন তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন। ভাগ্যচক্রে এ বারে সেই শহরে এসেই বাসা নিলেন তিনি। বন্ধু স্যর নীপেন্দ্রনাথ সরকারের একটি বাড়ি ছিল ম্যালের পাশের রাস্তায়। বেশ মনোরম জায়গায়। সদ্য কিছু দিন আগে সেটি কিনেছেন সরকার মহাশয়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এই বাড়ি থেকে তুষারধবল পাহাড় দেখা যায়। চিত্তরঞ্জন সেখানেই গিয়ে ওঠেন। সঙ্গে স্ত্রী বাসন্তীদেবী। সেটা ছিল ১৯২৫ সালের ৬ মে।
পাহাড়ের জলহাওয়ায় চিত্তরঞ্জনের শরীর প্রাথমিক ভাবে কিছুটা সেরে ওঠে। মনোরম পরিবেশে পাহাড়ি পথে হাঁটাচলাও শুরু করেন তিনি। কিছু দিনের মধ্যে মনে হতে থাকে, সুস্থ হয়ে সমতলে ফিরে আবার কাজে যোগ দিতে পারবেন তিনি। এর মধ্যে অবশ্য রাজনীতির কাজকর্ম বন্ধ হয়নি। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন অ্যানি বেসান্ত। ১৯১৭ সালে যাঁকে কংগ্রেস সভানেত্রী করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা ছিল চিত্তরঞ্জনের। অ্যানি তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির আনা একটি বিলের ব্যাপারে।
জুনের প্রথম দিকে আসেন গান্ধীজি। তিনি কয়েক দিন থেকে যান এই বাড়িতে। গান্ধীজি এবং চিত্তরঞ্জনের মধ্যে বহু বিষয়ে কথা হয়। পরে গান্ধীজি জানিয়েছিলেন, চিত্তরঞ্জনের প্রাণখোলা হাসিতে কী ভাবে ভরে যেত ‘স্টেপ অ্যাসাইড’-এর ঘরগুলি।
লেখা এবং পড়াও শুরু করেছিলেন চিত্তরঞ্জন। একটা সময়ে মনে হয়, আর কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো কাজে যোগ দিতে পারবেন। কিন্তু বিধি বাম। গান্ধীজি ফিরে যাওয়ার সপ্তাহখানেক পরে ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সেটা ছিল ১৪ জুন। দু’দিন পরে, ১৬ জুন মারা যান চিত্তরঞ্জন।
সেই খবরে দেশের রাজনীতিকদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। চিত্তরঞ্জনের খুব নিকটজন, এক কথায় তাঁর শিষ্য সুভাষচন্দ্র বসু তখন কারারুদ্ধ। সেখানে তিনি শোনেন তাঁর রাজনৈতিক গুরুর মৃত্যুর খবর। পরে তিনি এই মৃত্যুকে বর্ণনা করেন ‘দেশের রাজনৈতিক বিপর্যয়’ বলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন, ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ...’। দেশবন্ধুর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে কলকাতায় এসেছিলেন গান্ধী। শোকবার্তায় তিনি লিখেছিলেন, ‘ওঁর যত কাছে এসেছি, ততই ওঁকে ভালবেসেছি’। চিত্তরঞ্জনের দেহ এসেছিল দার্জিলিং মেলে, যে ট্রেন তখন চলত অধুনা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে।
তার পরে কত মেঘ ঘিরেছে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে, কত রোদ ম্যালকে আকর্ষণীয় করেছে। যে রাস্তার উপরে ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ বাড়িটি, তার নামকরণ হয়েছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নামে। বাড়িটিতে তৈরি হয়েছে তাঁর সংগ্রহালয়। তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে সেই সংগ্রহালয়টি।
সেই দরজাতেই এই মুহূর্তে তালা ঝুলছে।
বাড়িটির পিছনে গেলে দেখা যায়, অনেক উপরে একটি বোর্ড টাঙানো। তাতে লেখা, দেশবন্ধু মাতৃ ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র। পাশে একটি ফ্লেক্স জানান দিচ্ছে, এখানে শিশুদের টিকাকরণ হয়। সেই কেন্দ্রটিও এখন খোলা হয় কি না সন্দেহ।
দার্জিলিং-এর সাধারণ মানুষ কতটা ওয়াকিবহাল তাঁদের এই ইতিহাস সম্পর্কে? পেমা ভুটিয়া বা তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে কিন্তু মনে হল, বাড়িটির ঐতিহ্য এবং গুরুত্ব কতটা, তাঁরা জানেন। তাই বাড়িটি বন্ধ হয়ে থাকায়, প্রশাসনের প্রতি এত ক্ষোভ তাঁদের।
জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা অবশ্য বলছেন, সংস্কারের অভাবে মিউজ়িয়মে খুব কম লোকজনই যান। পর্যটকদের মধ্যে সে ভাবে প্রচারের ব্যবস্থাও নেই। করোনার পরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তাই বেশির ভাগ সময়ই সেটি তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকে। দার্জিলিং-এর জেলাশাসক এস পুন্নমবলম বলেন, “সরকারি ভাবে দেশবন্ধু মিউজ়িয়মটি খোলা রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের কিছু সমস্যা রয়েছে। কেয়ারটেকার রয়েছে বলে জানি। বিষয়টি আমরা দেখে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।”
তত দিন দেশবন্ধুর স্মৃতি তালাবন্ধই থাকুক ‘স্টেপ অ্যাসাইড’-এ। একই সঙ্গে এখানে জমে থাকুক ভাওয়ালের মেজকুমারের স্মৃতির কথাও। দেশবন্ধুর ষোলো বছর আগে, ১৯০৯ সালের ৭ মে এই বাড়িতেই ‘মারা গিয়েছিলেন’ মেজকুমার, যিনি পরে ফিরে আসেন ভাওয়াল সন্ন্যাসী হিসেবে।
১৯০৯ সালে রমেন্দ্রনারায়ণের রহস্যমৃত্যুর ঠিক এক দিন আগে আলিপুর বোমার মামলার রায়ে অরবিন্দ ঘোষকে মুক্ত করেছিলেন চিত্তরঞ্জন, দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে। ১৯২১ সালে ভাওয়ালের মেজকুমারের প্রত্যাবর্তনের ঘটনাও জেনেছিলেন চিত্তরঞ্জন। তখন তিনি পুরোপুরি রাজনীতিতে। তখন কি চিত্তরঞ্জন ভাবতে পেরেছিলেন, দেড় যুগ পেরিয়ে তিনিও এক দিন সেই ‘স্টেপ অ্যাসাইড’-এ গিয়ে উঠবেন, কিন্তু সন্ন্যাসী রাজার মতো ফিরে আসা আর হবে না তাঁর!