Bethune Collegiate School

হারিয়ে গিয়েছে লড়াই শুরুর প্রথম ঠিকানা

৫৬ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিট। ২১টি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে শুরু হয়েছিল ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল। বন্ধু বেথুন সাহেবকে বাড়ির বৈঠকখানা ছেড়ে দিয়েছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। পরে স্কুল উঠে যায় হেদুয়ার কাছে। বিদ্যাসাগর স্কুলটির নতুন নাম দেন বেথুন স্কুল। এ বছর ১৭৫ বছরে পড়ল স্কুলটি।

Advertisement

আর্যভট্ট খান

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২৩ ০৯:৩৮
Share:

ঐতিহাসিক: হেদুয়ার পশ্চিম পাড়ে বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের বর্তমান ভবন। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী 

বাড়ির বৈঠকখানায় পরিপাটি করে রাখা বই, খাতা। ছোট ছোট মেয়েরা পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে পড়ছে। মন দিয়ে লক্ষ করছেন এক সাহেব। কিন্তু এইটুকু মেয়েদের কি সব সময় পড়ায় মন বসে! ঘটনা বুঝে সাহেব করলেন এক কাণ্ড। নিজে ঘোড়া সেজে ছোট ছোট শিশুদের ডাকলেন তাঁর পিঠে বসার জন্য। পড়া ছেড়ে সাহেবের পিঠে বসতে হবে শুনে প্রথমে ইতস্তত করলেও, পরে জড়তা ভেঙে যায় শিশুদের। কিছু ক্ষণ পরেই দেখা গেল ঘোড়া সেজে সাহেব শিশুদের পিঠে নিয়ে ঘোরাচ্ছেন আর বলছেন, “আমি ঘোড়া তুমি মেম।”

Advertisement

শুধুই কি ঘোড়া সাজা! যখনই বেথুন সাহেব তাঁর এই স্কুলে পড়াশোনার খোঁজখবর নিতে আসতেন, সঙ্গে আনতেন নানা রকম খেলনা। বিলি করে দিতেন শিশুদের। আর স্কুলের শিক্ষকদের বলতেন, “শিশুদের মাতৃভাষায় পড়াশোনা শেখান, পণ্ডিত।”

সময়টা ১৯৪৯ সাল। ৭ মে স্কুলের পথ চলা শুরু হয়েছে মাত্র ২১ জন শিশুকে নিয়ে। স্কুলের ঠিকানা ৫৬ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিট। স্কুলের নাম ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল। স্কুল চালু করেছেন তখনকার শিক্ষা সংসদের সভাপতি বেথুন সাহেব। তাঁর একটাই চিন্তা। কী ভাবে স্কুলে ছাত্রীর সংখ্যা বাড়ানো যায়।

Advertisement

৫৬ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটে যাঁর বাড়ির বৈঠকখানায় এই ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল চালু হল, সেই দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় সাহেবের ঘোড়া সাজার কাণ্ড দেখে মজা করে হাসেন আর অবাক হয়ে যান। বাচ্চা মেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য এই আশ্চর্য প্রচেষ্টা আগে কখনও এই দেশে চোখে পড়েছে কি?

মেয়েদের স্কুল তৈরির উদ্যোগে পিছিয়ে ছিলেন না সমাজ সংস্কারক দক্ষিণারঞ্জনও। শুধু নিজের ৫৬ নম্বর বাড়ির বৈঠকখানাই নয়, নিজের লাইব্রেরি এবং লাইব্রেরির পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের বইও তিনি স্কুলকে দান করে দিয়েছিলেন।

বেথুন সাহেব আর দক্ষিণারঞ্জন ১৭৫ বছর আগে আমাদের দেশে নারীশিক্ষার জন্য যে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন, তা অচিরেই নিবে যেত, যদি না তাঁরা পাশে পেতেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রামগোপাল ঘোষদের— বলছিলেন বর্তমানের বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা সংহিতা চক্রবর্তী। বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের ১৭৫ পূর্তি উপলক্ষে সংহিতা স্কুলের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন। তাঁকে বিস্তর গবেষণা করতে হয়েছে। সংহিতা বললেন, “বেথুন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বেথুন সাহেবের নাম তো সবাই জানেন। কিন্তু মদনমোহন তর্কালঙ্কার, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষের নাম আড়ালেই থেকে গেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামও বেথুন স্কুলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রায় প্রথম থেকেই। এঁরা সবাই সে যুগে মেয়েদের স্কুল তৈরির করার জন্য ছিলেন একই পথের পথিক।”

যেমন রামগোপাল ঘোষের কথাই ধরা যাক। ১৮৪৮ সালে বেথুন সাহেব কলকাতায় এসেছিলেন গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের এক জন লিগাল মেম্বার হিসেবে। এর পর তিনি যখন শিক্ষা সংসদের সভাপতি হন, তখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ডিরোজিয়োর ভাবধারা ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ সমাজ সংস্কারক রামগোপাল ঘোষের। রামগোপালও তখন শিক্ষা সংসদের সদস্য। রামগোপালকেই বেথুন সাহেব প্রথম মেয়েদের জন্য কলকাতায় স্কুল প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেন। এই বিষয়ে পরামর্শ করতে রামগোপাল তাঁকে নিয়ে যান তাঁর বন্ধু দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। কারণ তিনি জানতেন, দক্ষিণারঞ্জনও এ ব্যাপারে উৎসাহী।

দক্ষিণারঞ্জনের প্রপৌত্র নরেন্দ্ররঞ্জন বর্তমানে থাকেন প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড এলাকায়। নিজের বাড়িতে বসে নরেন্দ্ররঞ্জন জানান, দক্ষিণারঞ্জন জন্মেছিলেন পাথুরিয়াঘাটায়। তিনি ভাবনাচিন্তায় ছিলেন সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে। তিনি বর্ধমানের বিধবা মহারানি বসন্তকুমারীকে বিয়ে করেন। শুধু বিধবাই নন, বসন্তকুমারী ছিলেন অন্য জাতের এবং ওই বিয়ে হয়েছিল পুলিশ কোর্টে রেজিস্ট্রি করে। কোর্টে গিয়ে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে তখন ভাবাই যেত না। ফলে তখন ওই বিয়ে নিয়ে সমাজে খুব আলোড়ন হয়েছিল। নরেন্দ্ররঞ্জন বলেন, “দক্ষিণারঞ্জন তাঁর বন্ধু রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক বার পাথুরেঘাটার বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং থাকতে দেন। কৃষ্ণমোহন তখন খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছেন। কেন এক জন খ্রিস্টানকে বাড়িতে রাখলেন, এই নিয়ে দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে তাঁর বাবার মনোমালিন্য হয় এবং দক্ষিণারঞ্জনকে তাঁর বাবা ত্যাজ্যপুত্র করেন। তখন থেকে দক্ষিণারঞ্জন এই ৫৬ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করেন।”

নরেন্দ্ররঞ্জন জানান, রামগোপাল ঘোষ বেথুন সাহেবকে দক্ষিণারঞ্জনের কাছে নিয়ে আসেন। বেথুন সাহেবের কাছে মেয়েদের স্কুল খোলার প্রস্তাব শুনে দক্ষিণারঞ্জন এক কথায় রাজি হয়ে যান। যখন প্রশ্ন ওঠে, কোথায় খোলা হবে এই স্কুল, তখন দক্ষিণারঞ্জন বলেন, “কেন, আমাদের বৈঠকখানায় এতখানি জায়গা। এখানেই সাহেব খুলে ফেলুন না মেয়েদের জন্য স্কুল। পরে ছাত্রীসংখ্যা বাড়লে তখন না-হয় অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হবে।” নরেন্দ্ররঞ্জনের কথায়, “একই ভাবধারার কিছু মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন স্ত্রীশিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্যে মেয়েদের স্কুল খোলার জন্য। আজ বেথুন স্কুলের ১৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বেথুন সাহেবের সহযোদ্ধাদের নাম যেন আমরা ভুলে না যাই।”

স্কুল তো স্থাপিত হল। কিন্তু ছোট ছোট মেয়েদের পড়াবেন কারা? মেয়েদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে তখন সমালোচনার ঝড়। বেথুন সাহেব বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে বললেন, “পণ্ডিত, ওদের তুমি বই লিখে পড়াও। মাতৃভাষায় ওরা পড়বে। যে পাঠ্যক্রমে কোনও ধর্ম থাকবে না।”

১৮৪৯ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে মদনমোহন তর্কালঙ্কার লিখলেন শিশুদের জন্য ‘শিশুশিক্ষা’-র প্রথম ভাগ এবং দ্বিতীয় ভাগ। শিশুশিক্ষার প্রথম ভাগে তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল, কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল’। বিনা বেতনে পড়িয়ে আর শিশুশিক্ষার উপর বই লিখেই দায়িত্ব শেষ করেননি মদনমোহন। বেথুন সাহেবের স্কুলে ছাত্রীর সংখ্যা বাড়াতে তাঁর দুই মেয়ে ভুবনমালা-কুন্দমালাকে পড়তে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেখানে, যেখানে তিনি নিজে শিক্ষক।

দক্ষিণারঞ্জনের বাড়িতে স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৪৯ সালে। আর ১৮৫০ সালেই বিদ্যাসাগরকে স্কুলের সম্পাদক করে দেন বেথুন। তবুও আশঙ্কা ছিল, স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে না তো? সেটিই কলকাতার প্রথম মেয়েদের স্কুল নয়। তার আগেও স্কুল চালু হয়েছে। কিন্তু তখন মেয়েদের বাল্যবিবাহ চালু ছিল বলে স্কুলে ছাত্রীসংখ্যা কমে যেত। বেথুন সাহেবের স্কুলে পড়লে মেয়ে খ্রিস্টান হয়ে যাবে, এই আশঙ্কাও ছিল। যদিও বেথুন বরাবরই জোর দিয়েছিলেন মাতৃভাষায় ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার উপর।

রাতদিন শুধু স্কুলের উন্নতি নিয়ে চিন্তা করতেন বেথুন। কিন্তু কখনও চাননি স্কুলের নাম তাঁর নামে হোক, চেয়েছিলেন স্কুলের নাম হোক রানি ভিক্টোরিয়ার নামে। রানির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ নয়, বেথুন একে সরকারি স্কুল করে তুলতে চেয়েছিলেন। তাতে স্কুলের স্থায়িত্ব নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যেত। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল-এর নাম রানি ভিক্টোরিয়ার নামে হলে এই স্কুল আর কোনও দিন বন্ধ হবে না।

নানা দোলাচলের মধ্যেই দক্ষিণারঞ্জনের বাড়ির উঠোন থেকে ১৮৫০ সালের ৬ নভেম্বর হেদুয়ার পশ্চিম পাড়ে এখনকার বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন বেথুন সাহেব। ৬ নভেম্বর ১৮৫০। বেথুন সাহেব ঠিক করে রেখেছিলেন, তাঁর স্বপ্নের স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হবে অশোক গাছের চারা রোপণ করে। সে দিনও তিনি তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে স্কুলের নাম বলেছিলেন ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল।

এত গাছ থাকতে অশোক গাছের চারা কেন? বেথুন স্কুলের শিক্ষিকা সংহিতা জানালেন, স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার আগে এক বার বেথুন সাহেব মদনমোহন তর্কালঙ্কারের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। গিয়ে জানতে পারেন, তাঁদের জন্য বাড়ির যে মহিলারা রান্না করলেন, তাঁদের সে দিন উপবাস। মদনমোহন বেথুনকে বলেন, বাড়ির বৌরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের মঙ্গলকামনায় উপবাসী। এই ব্রত ভঙ্গ হবে অশোক গাছের কুঁড়ি খেয়ে। এই ব্রতের নাম অশোকষষ্ঠী।

সংহিতা বলেন, “এই কথা শুনে বেথুন সাহেব খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল এই অশোক গাছ আসলে ত্যাগের প্রতীক। যে মায়েরা সন্তানের জন্য এতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, তাঁদের জন্য কে চিন্তা করেন! তিনি ঠিক করেন, যখন হেদুয়ার পশ্চিম পাড়ের জমিতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করবেন, তখন সেখানে অশোক গাছের চারা পুঁতেই স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হবে।”

বেথুন সাহেবের স্কুলে মেয়েদের পড়তে যাওয়া নিয়ে তখনকার সমাজে তীব্র আলোড়ন শুরু হয়। কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখে ফেললেন, “আগে মেয়েগুলো ছিল ভাল/ ব্রতকর্ম করতো সবে/ একা বেথুন এসে শেষ করেছে/ আর কি তাকে তেমন পাবে।” এ সব উপেক্ষা করেই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের এক বছরের মধ্যে হেদুয়ার পশ্চিম পাড়ে বেথুন স্কুলের স্থায়ী ভবনে পঠনপাঠন শুরু হয় ১৮৫১ সালের সেপ্টেম্বরে। তা অবশ্য দেখে যেতে পারেননি বেথুন সাহেব। ১৮৫১ সালের ১২ অগস্ট কলকাতাতেই প্রয়াত হন তিনি।

বেথুন চলে গেলেন, কিন্তু বিদ্যাসাগর রয়ে গেলেন বেথুনের স্বপ্ন পূরণ করতে। শোনা গেছে, রোগশয্যায় বেথুন সাহেব বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ করে গিয়েছিলেন, “আমি থাকব না। কিন্তু আমার মেয়েরা, আমার স্কুলটা যেন না মরে, পণ্ডিত তুমি একটু দেখো।” বিদ্যাসাগর কথা দিয়েছিলেন বেথুনকে। বেথুন স্কুল ছেড়ে যাননি বিদ্যাসাগর। আঠারো বছর ধরে বেথুন স্কুলের সম্পাদক ছিলেন বিদ্যাসাগর। ১৮৬২ সালে বিদ্যাসাগর সরকারের কাছে যখন স্কুলের রিপোর্ট পেশ করেন, সেখানে তিনি স্কুলের নাম ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল-এর পরিবর্তে উল্লেখ করেন বেথুন স্কুল নামে। এর পর থেকে বেথুন স্কুল নামেই পরিচিতি পায় স্কুল। কারণ বিদ্যাসাগরের সেই নামটিই বেশি উপযুক্ত মনে হয়েছিল। ১৮৭৯ সালে যখন বেথুন কলেজ স্থাপন হয়, তখন স্কুলের নাম হয় বেথুন কলেজিয়েট স্কুল।

বেথুন সাহেব মৃত্যুর আগে তাঁর প্রায় সব কিছুই দান করে গিয়েছিলেন স্কুলকে। তার মধ্যে ছিল তাঁর ঘোড়ার গাড়িও। সেই গাড়িতে করেই তখন মেয়েদের স্কুলে নিয়ে আসা ও বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া হত। সেই গাড়িকে লক্ষ করে বর্ষিত হত নানা ব্যঙ্গবিদ্রুপ, কোথাও কোথাও স্কুলগাড়িকে লক্ষ করে ছোড়া হত জুতোও। এ সব উপেক্ষা করেই তরতরিয়ে স্কুল চলতে থাকল।

দক্ষিণারঞ্জনের বাড়ির উঠোনে ২১ জন পড়ুয়া নিয়ে শুরু হয়েছিল স্কুল। হেদুয়ার পশ্চিম পাড়ে সেই স্কুল যখন উঠে এল, তখন বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১০০ ছুঁয়ে ফেলেছে। কিন্তু মেয়েদের প্রতি ব্যঙ্গবিদ্রুপ কমল না। কবি ঈশ্বর গুপ্ত আর একটি কবিতায় মেয়েদের নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, “যত ছুঁড়ীগুলো তুড়ী মেরে কেতাব হাতে নিচ্চে যবে,/ এবি শিখে, বিবী সেজে বিলাতী বোল কবেই কবে।/ আর কিছুদিন থাকরে ভাই! পাবেই পাবে দেখতে পাবে,/ আপন হাতে হাঁকিয়ে বগী, গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।” স্কুলগাড়ির প্রতি টিটকিরি বন্ধ করতে বিদ্যাসাগর স্কুলের গাড়িতে বড় বড় করে লিখে ফেললেন— ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ’। কন্যাদের যত্নের সঙ্গে শিক্ষা দান করা উচিত। সংস্কৃত উদ্ধৃতি দেখে জুতো ছোড়া, বিদ্রুপ কিছুটা বন্ধ হল।

কিন্তু এই ঐতিহ্যশালী স্কুল যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেই ৫৬ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের ঠিকানাটাই তো হারিয়ে গিয়েছে— জানালেন স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা শবরী ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “স্কুলের ১৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ওই ঠিকানাটা খোঁজার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায়নি।” সত্যিই কি নেই ৫৬ সুকিয়া স্ট্রিট? ওই এলাকার পুরনো বাসিন্দা সুবল মিত্র জানান, “৫৬ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিট বলে কোনও ঠিকানাই এখন আর নেই। সুকিয়া স্ট্রিট এখন আর আগের মতো বড় নেই। এখন আমহার্স্ট স্ট্রিটের যেখানে সুকিয়া স্ট্রিট মিশেছে তার উপরে তো কৈলাস বোস স্ট্রিট।”

বহু বছর আগে যদি কৈলাস বোস স্ট্রিটই ওই সুকিয়া স্ট্রিটের অংশ হয়ে থাকে, তা হলে সেখানকার ৫৬ নম্বর কৈলাস বোস স্ট্রিট-ই কি সেই ঠিকানা? সেখানে গিয়েও কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। সুকিয়া স্ট্রিটের কাছেই থাকেন স্থানীয় বাসিন্দা শঙ্করলাল সিংহ, বললেন, “সুকিয়া স্ট্রিটে কোথায় বেথুন সাহেবের স্কুল শুরু হয়েছিল তার খবর এখন আর কেউ রাখেন না। আমরা নিজেরাই কলকাতার ঐতিহ্য ভাঙতে মেতে উঠেছি। পুরনো বাড়ি ভেঙে প্রোমোটিং রাজ চলছে।” দক্ষিণারঞ্জনের প্রপৌত্র নরেন্দ্ররঞ্জন জানান, তিনিও অনেক খুঁজেছেন ৫৬ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিট। ঠিকানাটা পাওয়া যায়নি। নরেন্দ্ররঞ্জনের প্রশ্ন, “শহরের এক ঐতিহাসিক জায়গার ঠিকানা কেন থাকল না? এখনও তো পুরনো নথি ঘেঁটে বার করতে পারে পুরসভা। এটুকু উদ্যোগ কি নিতে পারে না প্রশাসন?”

১৭৫ বছর আগে ঘোড়ার গাড়ি করে স্কুলে যেতেও মেয়েরা বিদ্ধ হত ব্যঙ্গবিদ্রুপে। সুকিয়া স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায়, রাস্তা দিয়ে স্কুটি চালিয়ে চলে গেল এক কলেজছাত্রী। ইতিহাস সাক্ষী, আজ জিতে গেছেন বেথুন সাহেব আর তাঁর সহযোদ্ধারা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তাঁদের মশাল বয়ে নিয়ে চলেছে মেয়েরাও। শুধু হারিয়ে গেছে লড়াই শুরুর প্রথম ঠিকানাটা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement