ঐতিহাসিক: লেশান জায়ান্ট বুদ্ধ। (ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস)।
সওয়া সহস্র বৎসরেরও বেশি সময় ধরে তিনি স্থাণু হয়ে আছেন তিনটি নদীর সঙ্গমস্থলের এক গিরিগাত্রে। তাঁর অভিব্যক্তি ক্ষমাসুন্দর। তিনি দেখেছেন এই তিন নদী— মিনজিয়াং, দাদু এবং কুইনজি দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। পাল্টেছে রাজা, সিংহাসন, শাসনতন্ত্র; পাল্টেছে সমাজনীতি ও রাজনীতির অভিমুখ।
বুদ্ধমূর্তিটির নাম ‘লেশান জায়ান্ট বুদ্ধ’। এটি প্রাক-আধুনিক যুগের সম্ভবত প্রাচীনতম এবং বুদ্ধের দীর্ঘতম ও বৃহত্তম প্রস্তর-স্থাপত্য। অবস্থান চিনের সিচুয়ান প্রদেশের লেশান শহরের পূর্ব দিকে। সংলগ্ন পাহাড়টি মাউন্ট লিংগিয়ান। এই পাহাড়ের লাল বেলেপাথর সরাসরি কেটে খোদিত ৭১ মিটার উচ্চতার এই উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তিটি। নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ৭১৩ সালে। ৯০ বছর লেগেছিল কাজটি সম্পূর্ণ হতে।
প্রসঙ্গত, আমরা জানি ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল চিন-সহ বিভিন্ন দেশে। আগ্রাসী ধর্মীয় কর্তৃত্ব বা যাজকতন্ত্রের দখলদারিতে নয়, তা পৃথিবী জয় করেছিল ভালবাসার পবিত্রতায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে নিখিলেশের মুখে বলিয়েছেন, “বুদ্ধই পৃথিবী জয় করেছিলেন, আলেকজান্ডার করেননি।”
চিনে বৌদ্ধধর্মের স্বর্ণালি যুগ ছিল তাং সাম্রাজ্যের সময়কালে (৬১৮-৯০৭ খ্রিস্টাব্দ)। আর এই যুগেই নির্মিত হয়েছিল ‘লেশান জায়ান্ট বুদ্ধ’। অনিন্দ্য শিল্পবোধ আর চমৎকার কারিগরি কুশলতায় তা নির্মিত হয়েছিল হাজার হাজার শ্রমিকের পরিশ্রমে। এই পাহাড়টি বেছে নেওয়ার কারণ প্রথমত, এই স্থানটির নিসর্গশোভা। দ্বিতীয়ত, এটির অবস্থান পবিত্র পাহাড় ‘মাউন্ট ই’ মেই’-এর ঠিক বিপরীতে, যে পর্বতে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে নির্মিত হয়েছিল চিনের প্রথম বুদ্ধমন্দির ‘গুয়াং জিয়াং’, এবং পরবর্তী সময়ে আরও তিরিশটিরও বেশি বুদ্ধমন্দির। তৃতীয়ত, গ্র্যানাইটের চেয়েও নমনীয় এই পাহাড়ের লাল বেলেপাথর স্থাপত্যকর্মের জন্য আদর্শ।
‘লেশান জায়ান্ট বুদ্ধ’ নির্মাণের পিছনে যে মহান মানুষটির উদ্যোগ ছিল, তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হাই টং। সহযোগিতা ছিল স্থানীয় মানুষদের। এই উদ্যোগের পিছনে হাই টং-এর ছিল এক মহান উদ্দেশ্য। মিনজিয়াং, দাদু এবং কুইনজি— তিনটি নদীর স্রোত ছিল বড়ই ভয়ঙ্কর। প্রায়ই ঘটত জাহাজডুবি ও নৌকোডুবির ঘটনা। লেগে থাকত স্থানীয় মানুষদের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি আর প্রাণহানি। হাই টং-এর গভীর বিশ্বাস ছিল, মৈত্রেয় বুদ্ধের প্রশান্ত উপস্থিতি নদীগুলির ভয়ঙ্কর স্রোতকে প্রশমিত করবে।
অবিশ্বাস্য হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়েছিল। তার অন্যতম কারণ মূর্তি খোদাই করার জন্য কেটে নেওয়া পাথরের খণ্ডগুলি নদীতে পড়ে নদীর গভীরতা কমিয়ে নদীর স্রোতের প্রাবল্য কমিয়ে দিতে পেরেছিল। জাহাজ বা নৌকো চলাচলের জন্য তা নিরাপদ হয়ে উঠেছিল। কমে গিয়েছিল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি।
অনুদান সংগ্রহের উপর নির্ভর করে নির্মাণকাজ চলতে থাকে। কিন্ত পরে ভিক্ষু হাই টং-কে প্রভূত বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। অর্থসংগ্রহ পর্যাপ্ত হচ্ছিল না। ক্ষোভে দুঃখে তিনি নিজের চোখ দু’টি উপড়ে ফেলেন। অন্য এক মতে, কিছু অসৎ রাজকর্মচারী সাহায্যের পরিবর্তে সংগৃহীত অর্থের ভাগ দাবি করেছিল। তিনি তাদের বলেছিলেন, তিনি নিজের চোখ উপড়ে দিতে পারেন, কিন্তু এই অর্থের ভাগ দিতে পারবেন না। তিনি সত্যিই তাঁর চোখ উপড়ে ফেললে অসৎ লোকজন ভয় পেয়ে পালিয়ে যান। নির্মাণের কাজ প্রায় অর্ধেক হতে হতেই প্রয়াত হন হাই টং। তখন মূর্তি মাত্র কাঁধ পর্যন্ত নির্মিত।
এর পর এগিয়ে আসেন প্রয়াত হাই টং-এর দুই শিষ্য। তাঁরা গ্রহণ করেন তাঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার দায়ভার। অর্থ সংগ্রহে তাঁদের সহযোগিতা করেন স্থানীয় এক রাজকর্মচারী ঝ্যাং চোউ। কিন্তু মূর্তি হাঁটু পর্যন্ত সম্পূর্ণ হতে না হতেই ঝ্যাং চোউ-কে চলে যেতে হয় রাজদরবারে। তাঁর পক্ষে আর সাহায্য করা সম্ভব হয় না। এ ভাবেই পেরিয়ে যায় সত্তর বছর। অবশেষে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এগিয়ে আসেন সিচুয়ান চিনের সামরিক বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্তা ও রাজনীতিবিদ জিদুশি ওয়েই গাও। তাঁর সহায়তায় অবশেষে হাই টং-এর শিষ্যেরা ৮০৩ সালে সম্পূর্ণ করেন নির্মাণকাজ।
‘লেশান জায়ান্ট বুদ্ধ’-র অনন্যতা যেমন নিখুঁত শিল্পসৌষ্ঠবে, তেমনই তার আকারের বিশালত্বেও। বুদ্ধমূর্তির পায়ের বিস্তার ন’মিটার, যাতে একশো জন মানুষ অনায়াসে বসতে পারেন। তাঁর চব্বিশ মিটার চওড়া কাঁধটি একটি বাস্কেটবল কোর্টের সমান আকারের। এমনকি মূর্তির পায়ের কড়ে আঙুলের নখেও এক জন মানুষ বসতে পারেন অনায়াসে। বুদ্ধমূর্তির দশ মিটার চওড়া মাথায় নির্মিত কোঁকড়ানো চুলের স্থাপত্যে নিপুণ ভাবে তৈরি করা হয়েছিল এক হাজার একুশটি ঝুঁটি বা খোঁপা।
বুদ্ধমূর্তির কানগুলি প্রতিটি প্রায় সাত মিটার লম্বা। তবে এই কানগুলি কিন্তু নির্মিত কাঠ দিয়ে, ওপরে মাটির আবরণ। সেই প্রাচীন সময়ে কাঠের তৈরি এই কানগুলি কী ভাবে পাথরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল, সেই কারিগরি কৌশল বিস্ময়কর। তবে সব থেকে বিস্ময়কর, মূর্তিতে বৃষ্টি ইত্যাদিতে জমে যাওয়া জল নির্গমনের জন্য মূর্তির ভিতরে নিষ্ক্রমণ-নালি বা পথ তৈরির ভাবনা এবং তৈরির কারিগরি কৌশলটি। এগুলি নির্মাণ করা হয়েছিল রীতিমতো বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এবং সামনে থেকে যাতে নজরে না আসে সেই আড়ালটি বজায় রেখে।
মূর্তির মাথায়, চুলে, কাঁধের কাছে, বুকে, হাতে বিভিন্ন স্থানে সংযুক্ত আছে নানা গোপন জল নিষ্কাশন-পথ। মূর্তির মাথায় ও চুলের ভাস্কর্যে আছে আঠারো স্তরের সর্পিল কুণ্ডলী। এই কুণ্ডলীর চতুর্থ, নবম ও অষ্টাদশতম স্তরে আছে পারাপার করার মতো জল নিষ্ক্রমণের পথ। বাঁ দিকে বুকের সামনের নিষ্কাশন-পথ যুক্ত আছে ডান হাতের পিছনের নিষ্কাশন-পথের সঙ্গে। দুই কানের পিছন দিকে আবার জল নির্গমনের জন্য আছে গুহা। রোদবৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য বুদ্ধমূর্তির উপর ও পাশগুলি ঘিরে সোনার জলের প্রলেপ বা গিলটি দেওয়া, একটি বিশাল তেরো তলা কাঠের কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্ত য়ুন সাম্রাজ্যের শেষ দিকে মোঙ্গলদের আক্রমণে এটি বিধ্বস্ত হয়।
এখন খোলা আকাশের নীচে থাকলেও মূর্তির অন্তর্গত বিজ্ঞানসম্মত জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ও হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা মূর্তিটিকে ক্ষয় থেকে বাঁচিয়ে রাখায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। তবে স্বাভাবিক ভাবেই এই মহামূল্যবান সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নজরদারি ও মেরামতির তৎপরতা দেখা গিয়েছে সব যুগেই, সে তাং, মিং, কুইং রাজত্বেই হোক কিংবা বর্তমানের গণপ্রজাতন্ত্রী চিন সরকারের সময়কালে।
‘লেশান জায়ান্ট বুদ্ধ’ নিয়ে স্থানীয় মানুষেরা বলেন, ‘পাহাড়টিই বুদ্ধ আর বুদ্ধই একটি পাহাড়’। এ নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক অলৌকিক বিশ্বাস। ওই অঞ্চলের মানুষেরা মনে করেন, স্থানীয় বিভিন্ন আনন্দ বা দুঃখের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ফুটে ওঠে বুদ্ধমূর্তির মুখে। দুঃখে তাঁর চক্ষু হয় নিমীলিত, আর সুখের ঘটনায় মুখে ফুটে ওঠে আনন্দের অভিব্যক্তি। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আবহাওয়ার পরিবর্তন ও বায়ুদূষণের প্রভাবে এমনটা মনে হতে পারে, আবার কাজ করতে পারে স্থানীয়দের আবেগ ও কল্পনাপ্রসূত বিভ্রম। আবার বুদ্ধমূর্তির মাথার পিছনে কখনও কখনও দেখা যায় জ্যোতির্বলয় বা ‘হেলো’। বিজ্ঞানীদের মত, এটি মেঘের জলকণায় সূর্যালোক প্রতিফলনের ফল।
‘লেশান জায়ান্ট বুদ্ধ’ ১৯৯৬ সালে পেয়েছে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর তকমা। এই অনন্য স্থাপত্যকর্মটি হয়ে উঠেছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটনকেন্দ্র। প্রতি বৎসর পঁচিশ লক্ষেরও বেশি মানুষ আসেন এটি দেখতে।