শান্তিবার্তা: প্যালেস্টাইনের জন্য পথে নেমেছেন ইংল্যান্ডবাসীরা। —ফাইল চিত্র।
লন্ডনের অভিজাত স্যাভয় হোটেলের সামনে দিয়ে আড়াই বছরের ছেলেকে প্যারাম্বুলেটরে বসিয়ে হাঁটছেন ফতিমা। বত্রিশ বছরের যুবতী আদতে গাজ়ার আল নুসিরাতের বাসিন্দা। ২০১৮ সাল থেকে লন্ডনবাসী। মায়ের ওভারকোটের প্রান্ত আঁকড়ে ধরে যুদ্ধবিরোধী মিছিলে হাঁটছে তাঁর ছ’বছরের মেয়ে। তার হাতে প্যালেস্টাইনের পতাকা। বুকের প্ল্যাকার্ডে যুদ্ধ বন্ধের দাবি।
ফতিমার সঙ্গে গত এক সপ্তাহ পরিবারের যোগাযোগ নেই। ফোন বন্ধ। শেষ যখন কথা হয়েছিল, বাবা মাহমুদ জানিয়েছিলেন, মুহুর্মুহু বোমা পড়ছে। আশপাশের সব বাড়ি ধ্বংসস্তূপ। খাবার নেই। বিদ্যুৎ নেই। জল নেই। একের পর এক আত্মীয়-বন্ধুর মৃত্যুসংবাদ। ফতিমার বেড়ে ওঠার শহর গাজ়া এখন নরককুণ্ড।
বৃদ্ধ মাহমুদ ভেবেছিলেন, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ গাজ়ায় যাওয়ার চেষ্টা করবেন। ইজ়রায়েলের সেনাবাহিনী উত্তর গাজ়ার সব বাসিন্দাকে দক্ষিণে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। বাবা-মা নিরাপদ আস্তানায় যেতে পেরেছেন কি না, আদৌ বেঁচে আছেন কি না, ফতিমা কিছুই জানেন না। পরদিন থেকে যোগাযোগ বন্ধ। খবর পেয়েছেন, ইজ়রায়েলের ট্যাঙ্ক ঢুকেছে গাজ়ায়। বোমাবর্ষণের তীব্রতা বেড়েছে। ফতিমা বলছিলেন, “আমার স্বামী আটকে আছেন বেইরুটে। ওর সঙ্গে আমার বড় ছেলে থাকে। বাকি দুই সন্তানকে নিয়ে আমি লন্ডনে। প্রতি শনিবার ওদের নিয়ে হাঁটছি যুদ্ধবিরোধী মিছিলে। বাবার জন্য হাঁটছি। মায়ের জন্য হাঁটছি। বন্ধু আর পরিজনদের জন্য হাঁটছি। ওরা কেউ হামাস নয়। প্রতিদিন যে অসংখ্য শিশু মারা যাচ্ছে, তারা কেউ হামাস নয়।”
ফতিমার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি শনিবার জড়ো হচ্ছেন লন্ডনে। দাবি জানাচ্ছেন অবিলম্বে গাজ়ায় ইজ়রায়েলের সামরিক অভিযান বন্ধ করতে হবে। হামাসের উপর আক্রমণের নামে হাজার হাজার শিশুকে খুন করা যাবে না।
ইজরায়েলে হামাসের হামলা হয়েছিল ৭ অক্টোবর। দ্রুত প্রতি-আক্রমণ শুরু করেছিল নেতানিয়াহুর সরকার। বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ। অভিযোগ উঠেছে, হামাসের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে আদতে গোটা গাজ়াকেই মুছে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। বসতি এলাকা, স্কুল, উদ্বাস্তু শিবির, হাসপাতাল— কোনও কিছুই রক্ষা পাচ্ছে না বোমার হাত থেকে। উত্তর গাজ়ার লক্ষ লক্ষ বাসিন্দাকে বলা হয়েছে দক্ষিণে সরে যেতে। প্রাণভয়ে ছুটতে থাকা সেই জনতার উপরেও বোমা ফেলেছে যুদ্ধবিমান।
গাজার পাশে দাঁড়ানোর আলোচনা শুরু হয়েছিল যুদ্ধ শুরুর ঠিক পরেই। বিলেতের ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি ক্যাম্পেন’ নামে একটি মঞ্চ দীর্ঘ দিন ধরে সক্রিয় ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজ়ার বাসিন্দাদের মানবাধিকার রক্ষায়। তাদের সঙ্গে এলেন ইরাক-আফগানিস্তানের যুদ্ধের বিরোধিতায় অন্যতম প্রধান ‘স্টপ দ্য ওয়র’ কোয়ালিশনের লোকজন। এলেন ব্রিটেনের প্রধান ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা। এলেন লেবার পার্টির প্রাক্তন নেতা জেরেমি করবিন-এর অনুগামীরা। এলেন বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি, সোশ্যালিস্ট পার্টি, সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কারস পার্টির সদস্যরা। আর বিরাট সংখ্যায় এলেন ইহুদিরা। তাঁরা ইজ়রায়েলের যুদ্ধনীতি, গাজ়ার গণহত্যা সমর্থন করেন না। সমর্থন করেন প্যালেস্টাইনের সাধারণ মানুষের স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। এক কথায় বলতে গেলে, খুব দ্রুত ব্রিটেনের বিভিন্ন যুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠীগুলি একটি মঞ্চে হাতে হাত ধরে দাঁড়াল। ঠিক যেমন দাঁড়িয়েছিল বাইশ বছর আগে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরুর দিনগুলিতে।
প্রথম কর্মসূচি হল যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহ পর, ১৪ অক্টোবর। জমায়েতের সময় ছিল বেলা ১২টায়। সাড়ে ১০টা থেকে আসতে শুরু করলেন মানুষ। লন্ডন এবং তার আশপাশের প্যালেস্টাইনিদের পাশাপাশি হাজারে হাজারে এলেন প্রতিবেশী আরব বাসিন্দারা। লম্বা টুপি, কালো কোটের বিনুনি বাঁধা ইহুদিরা এলেন। তাঁদের হাতে ব্যানার, ‘নট ইন আওয়ার নেম’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্টরা লন্ডনে সক্রিয়। তাঁরা এলেন নিজেদের পতাকা নিয়ে। লিভারপুলের তারকা মহম্মদ সালাহ-সহ একাধিক ফুটবলার মুখ খুলেছেন গাজ়ায় চলমান গণহত্যার বিরুদ্ধে। প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে গ্যালারিতে উড়েছে প্যালেস্টাইনের পতাকা, গণহত্যা-বিরোধী পোস্টার।
প্রথম শনিবারে জমায়েত হল দেড় লক্ষ। দ্বিতীয় শনিবারে তিন লক্ষ। ইজ়রায়েলের স্থল অভিযান শুরু হওয়ার পর তৃতীয় শনিবারের পাঁচ লক্ষ যুদ্ধবিরোধী জনতার ঢেউ ভাসিয়ে দিল গোটা মধ্য লন্ডন।
এই বিপুল জনতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তার বহুমাত্রিকতা। এই ভিড় সংগঠিত নয়, স্বতঃস্ফূর্ত। মিছিলে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষের রয়েছে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শ। ট্রাফালগার স্কোয়ারের ঠিক সামনে জাতীয় পতাকা শরীরে জড়িয়ে হাঁটছিলেন তুরস্কের শাসক এর্দোয়ানের সমর্থকরা। তাঁদের ঠিক পাশেই কুর্দিস্তানের সমর্থকরা। বছরের পর বছর কুর্দ গেরিলারা সশস্ত্র লড়াই করছেন এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে। দুই পক্ষই মিলেছেন গণহত্যা বন্ধের দাবির সমর্থনে। ইজ়রায়েলের অভিযোগ, ইরান সমর্থন করছে হামাসকে। অথচ মিছিলে শামিল ইরানের বিলুপ্তপ্রায় তুদে পার্টির প্রবাসী সমর্থকরা। শামিল শিয়াখাল গেরিলাদের উত্তরসূরিরা। এই দুই বামপন্থী শক্তিই ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পর বিপুল নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ। কিন্তু ইরানের শাসকদের মতো তাঁরাও প্যালেস্টাইনের পক্ষে। বিলেতের বিভিন্ন কমিউনিস্ট গোষ্ঠী লাল পতাকা হাতে মিছিলে শামিল। তাঁদের পাশেই কমিউনিস্ট চিনের উইঘুর মুসলিমদের উপর হওয়া অত্যাচার বন্ধের দাবিতে ব্যানার হাতে হাঁটছেন হিজাব মাথায় তরুণী। সাতরঙা নিশানের ছায়ায় নমাজ পড়তে বসলেন এক দল মানুষ। সব পথ এসে মিলেছে যুদ্ধ ও গণহত্যা বন্ধের দাবিতে।
মিছিলে হাঁটছিলেন ছিয়াত্তর বছরের আব্বাস। এক সময় লড়াই করেছেন পিএলও-র হয়ে। হামাসের তীব্র বিরোধী এই বৃদ্ধ বলছিলেন, “ধর্মনিরপেক্ষ আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গত তিরিশ বছরে আপসকামী এবং জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ায় হামাসের এই উত্থান। আটের দশকে ইজ়রায়েলের মদতে হামাস তৈরি। আজ সে স্রষ্টাকে দংশন করছে।”
গোটা মিছিল জুড়ে অসংখ্য ইহুদি। তাঁদের মধ্যেই দেখা হয়ে গেল বিরাশি বছরের এস্থারের সঙ্গে। তাঁর বাবা-মা দুজনেই বন্দি ছিলেন মিউনিখের কাছে ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। পেশায় চিকিৎসক এস্থার জিউস ‘ভয়েস ফর লেবার’-এর সঙ্গে যুক্ত। এস্থার হাতে পোস্টার, তাতে লেখা, ‘নট ইন মাই নেম’। বৃদ্ধা বললেন, “এই নির্বিচার গণহত্যার দায় ইজ়রায়েলের জায়নবাদী শাসকের। দায় দখলদারির রাজনীতির। আমার মতো অসংখ্য ইহুদি মনেপ্রাণে এই গণহত্যাকে ঘৃণা করি।” এস্থারের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ইজ়রায়েলের নাগরিক সারা। তিনিও ইহুদি। সারা বললেন, “হামাসের হামলার তীব্র নিন্দা করি। কিন্তু তাতে আমার দেশের সরকারের গণহত্যা বৈধতা পায় না। সাড়ে সাত দশকের দখলদারি বৈধতা পায় না। ২০১৪ সালের স্মৃতি আমার মনে এখনও দগদগে। ইজ়রায়েলি বোমারু বিমান যখন আমাদের করের টাকায় প্যালেস্টাইনের শিশুদের ঝলসে দিচ্ছিল, তখন পাহাড়ি এলাকা থেকে সরাসরি সেই দৃশ্য উপভোগ করছিলেন আমারই কিছু সহনাগরিক। সেই দিন থেকে আমি প্যালেস্টাইনের মানুষের অধিকারের পক্ষে পথে নামি।”
দু’দশক আগের ব্রিটেন আর আজকের ব্রিটেনের ফারাক অনেক। হিংসা যত ‘সহজলভ্য’ হয়, ততই কমে তার অভিঘাত। স্মার্টফোন-বাহিত হয়ে গণহত্যার ছবি যখন নিয়মিত বাসা বাঁধে মগজে, তখন তার আবেদন কমে যায়। তবু লন্ডন উত্তাল হচ্ছে যুদ্ধের বিরুদ্ধে। লাখ লাখ মানুষের এই মিছিলের কোনও নির্দিষ্ট মতাদর্শ নেই। আছে ফকির-দরবেশের বহুবর্ণ আলখাল্লার মতো এক বোধ, যা মানবতার কথা বলে, হাজার হাজার শিশুর মৃত্যুমিছিল থামিয়ে দিতে চায়।