শিল্পী: সত্য চৌধুরী। ডান দিকে ‘গোপাল ভাঁড়’ ছবিতে সাধক রামপ্রসাদের ভূমিকায় তিনি। (ছবি সৌজন্য: পরমানন্দ চৌধুরী)
আমাদের জীবনযাপনে টিভি এখন পিছনের সারিতে। সে জায়গা নিয়েছে স্মার্টফোন। সিরিয়াল কিংবা সিনেমার জায়গা দখল করেছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আর তার নানা রকম অ্যাপসিরিজের রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা। সেখানে রেডিয়োর জায়গা নেই বললেই চলে। কিন্তু শরতের পিতৃপক্ষের শেষ প্রত্যুষে রেডিয়োই হয়ে ওঠে বাঙালিয়ানার এক অমোঘ দিকচিহ্ন। ব্রাহ্মমুহূর্তের সেই মায়াবী লগ্নে চিরকালীন হয়ে ওঠে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র চিরায়ত ভাষ্য— ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর...’ তখনই তো মনে হয় আকাশে বাতাসে পুজো এল, যে ভাবে অতীতকালেও এসেছে, ভবিষ্যতেও আসবে। যে নান্দীপাঠের বয়স বাড়লেও তা কখনও পুরনো হবে না, সেই গীতি-মন্ত্র-ভাষ্যের আশ্চর্য ইন্দ্রজালে মানসপটে মিলে মিশে যায় শরতের নীল আকাশ, কাশের বন আর মাতৃমুখের তিনটি ডাগর চোখ। বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ উৎসবের সূচনাবিন্দুতে জড়িয়ে আছেন বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের এই সম্মিলিত কালজয়ীসৃষ্টি, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
পুজোর পূর্বাভাস মানেই আকাশবাণীর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আর তার অন্যতম জনপ্রিয় গান ‘জাগো, তুমি জাগো’। গানটি আমরা বর্তমানে শুনি দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। তার আগে শোনা গিয়েছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায়। তবে অনেকেরই হয়তো আজ মনে নেই, এঁদের আগে আসবে সেই মানুষটির নাম, যিনি স্বাধীনতার আগে অবিভক্ত বাংলা এবং স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সারা পৃথিবীর সমূহ বাঙালিকে তাঁর একটি গানে আজও সমান উদ্দীপ্ত করে রেখেছেন। সেই গানটি ‘পৃথিবী আমারে চায়, রেখো না বেঁধে আমায়, খুলে দাও প্রিয়া, খুলে দাও বাহুডোর...’ অসামান্য আবেগে বাঙালির স্মৃতিজয়ী এই গানটির গীতিকার মোহিনী চৌধুরী, সুরকার কমল দাশগুপ্ত, শিল্পী সত্য চৌধুরী।
মহালয়ার পিতৃপক্ষের শেষের এই অনুষ্ঠানে প্রথম দিকে বরাবর সত্য চৌধুরীই গেয়েছেন ‘জাগো, তুমি জাগো’ গানটি। নিজস্ব কণ্ঠের আবেদন আর গায়কির গুণে জনপ্রিয় করেছেন তাকে। তার পরে এসেছেন হেমন্তবাবু এবং পরবর্তী সময়ে হেমন্তবাবুর অনুপস্থিতিতে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় বরাবরের মতো ব্যক্তিত্বের সিলমোহর দিয়েছেন সে গানে।
১৯১৮-এর ১৭ সেপ্টেম্বর, কলকাতার গ্রে স্ট্রিটে জন্ম সত্য চৌধুরীর। তাঁর বাবার নাম যতীন্দ্রমোহন চৌধুরী, তিনি ছিলেন উচ্চ আদালতের আইনজীবী। তাঁদের আদি নিবাস অবিভক্ত বাংলাদেশের রাজশাহী। তখনও সত্যর দু’বছরও পূর্ণ হয়নি, বাবা চলে যান মামার বাড়ির কাছে ল্যান্সডাউন রোডে। সত্য চৌধুরীর পড়াশোনা পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশন এবং তার পর মিত্র ইনস্টিটিউশনে, সেখান থেকে ম্যাট্রিকুলেশন। বিজ্ঞান বিষয়ে আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক। মিত্র ইনস্টিটিউশনের ১৯৩৫-এর ম্যাট্রিক পাশ সত্য চৌধুরীর আদত অনুরাগ ছিল রবীন্দ্রনাথের গানেই। তাঁর পূজ্য ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার হল শুরু’ গানের প্রথম রেকর্ডটি তাঁরই। ওঁর রেকর্ডে গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত আরও আছে। কিন্তু উদাত্ত কণ্ঠ এবং দরাজ গায়ন তাঁকে নিয়ে এল উদ্দীপক, বীররস এবং একই সঙ্গে সংবেদনশীল গানেও। ১৯৪৭-এ ‘মন্দির’ ছবিতে দেবব্রত বিশ্বাস আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুবল দাশগুপ্তর সুরে ‘ম্যায় ভুখা হুঁ’ তার অত্যুজ্বল নমুনা। তারও চোদ্দো বছর আগে ‘কবি জয়দেব’ ছবির একাধিক গানে জনপ্রিয়তার শিখর স্পর্শ করেছেন সত্যবাবু। জয়দেবের রচনা ছাড়াও এ ছবির জন্য গান লিখেছিলেন ‘আজ শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও’ এবং ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ’ খ্যাত হীরেন বসু। সুর করেছিলেন সুবল দাশগুপ্ত। সেকালের গীতিকার সুরকারেরা মিলেই গানের পঞ্চাশ শতাংশ সাফল্য নিশ্চিত করে দিতে জানতেন। তার সঙ্গে যুক্ত হত সত্যবাবুদের মানের গায়কের সঙ্গীত সিদ্ধি ও অননুকরণীয় শৈলী। সেই কারণেই হয়তো বহু দশক পেরিয়েও আজ এ গান আলোচনার বিষয়।
এক সময় আকাশবাণীর অনুরোধের আসর সূচিত হত সত্যবাবুর ‘তোমায় যে গান শোনাবো’ গানের সুর দিয়ে। তার পিছনে আছে ধারাবাহিক উত্তরণের কাহিনি। গানের জন্য কম পরিশ্রম করেননি আশুতোষ কলেজের এই মেধাবী ছাত্রটি। কৃষ্ণচন্দ্র দে আর শচীন দেব বর্মণের কাছে গান শিখেছেন। আন্তঃকলেজ এবং নিখিল বঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলনে জগন্ময় মিত্রর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে জিতে নিয়েছেন প্রথম পুরস্কার। মান্না দের মতো ঠোঁটকাটা শিল্পীকেও বলতে শুনেছি, “গানের কম্পিটিশনে সত্যবাবুকে হারাতে পারিনি।” স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রেকর্ডিংয়ের আগে ওঁর কাছ থেকে এটা সেটা টিপ্স নিয়েছেন বরাবর। কী তার কারণ? গানে নাটকীয়তা বিষয়টি জবরদস্ত বুঝতেন সত্য চৌধুরী। ‘জেগে আছি একা’-র কথাই ধরা যাক। স্বাধীনতা সংগ্রামী জেলে অন্তরিন। কুয়াশায় ঢাকা চাঁদ দেখে মনে পড়ছে তাঁর প্রেয়সীকে। মানবিক প্ৰেমকে তুচ্ছ করে দেশের স্বরাজ-সংকল্পের ব্রতে নিবেদিতপ্রাণ তরুণের স্বপ্ন, শপথ আর মানবিক আখ্যানের স্রোত— এ গানে যা শ্রোতার মনকে ভেজায়, উদ্বুদ্ধও করে। এই নাটকীয়তার কারণেই কৃষ্ণচন্দ্র দের অনুপস্থিতিতে পুজোর গানে সত্য চৌধুরীকে দিয়ে গাওয়ানো হয়েছিল কীর্তন। সে রেকর্ড যথারীতি আদায় করল অজস্র অগণিত শ্রোতার মুগ্ধ শ্রবণের অভিনন্দন।
সত্য চৌধুরী নজরে পড়েছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবেরও। স্বাধীনতার পরে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর পরামর্শে ‘বন্দেমাতরম্’ গাওয়ার জন্য উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-কে দায়িত্ব দেওয়া হল। তিনি ডেকে নিলেন সত্য চৌধুরীকে। উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছাড়াও সেই রেকর্ডিংয়ে বাজিয়েছিলেন তিমিরবরণ, মিহিরকিরণ, কেরামাতুল্লা খাঁ সাহেবের মতো দিকপাল। ‘পৃথিবী আমারে চায়’-এর হিন্দি ভারশন প্রকাশ পেল একই বছরে। ‘দুনিয়া বুলা রহে’ গানের সর্বভারতীয় খ্যাতি সেই সময়ের পত্রপত্রিকা খুঁজলে পাওয়া যাবে। এই প্রত্ননিদর্শনগুলি সযত্নে সংরক্ষণ করছেন গায়কের ভ্রাতুষ্পুত্র পরমানন্দ চৌধুরীর নেতৃত্বে গোটা চৌধুরী পরিবার। পরিবারের সকলের কাছেই আদর্শ সত্যবাবু। বাঙালির ভুলে যাওয়ার কালচারে এই পরিবার অবশ্যই ব্যতিক্রম। যুগধর্ম অনুযায়ী বিস্মৃতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে বংশের এই কৃতী পূর্বপুরুষকে ভুলে যাননি তাঁরা।
ভুলে যাওয়ার আরও অনেক নমুনা আছে। নজরুলের গান নিয়ে দীর্ঘ দিনের অনাচার তথা ‘মেড ইন ক্যালকাটা’ সুরগুলি সত্য চৌধুরীর গানের সামনে পড়লে বেআব্রু হয়ে পড়ে। ধরা পড়ে যায় সুর নিয়ে অ-সুরদের খামখেয়ালি আর যথেচ্ছাচার। শোনা যাক ওঁর রেকর্ডের ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার’ গানখানি। ইউটিউবে সহজেই খুঁজে নেওয়া যায়। তৈরি গলায় অন্তরা, আভোগে যে সুরবিহার শিল্পীর, বোঝাই যায় পরবর্তী সময়ে অযোগ্য গলায় পড়ে ধ্বস্ত হয়েছে পুরোপুরি। বাংলাদেশে নজরুলের গানের সুরশুদ্ধতা নিয়ে যে ধারাবাহিক কাজ চলছে, সেখানে সত্য চৌধুরীর গায়ন অতি বিশুদ্ধ নমুনা হিসেবে স্বীকৃত। ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’ বা ‘তোমার আঁখির মতো’ শুনে শুধু মুগ্ধ নয়, বিস্মিতও হতে হয়। কী আন্তরিক গায়ন আর স্বরের নিখুঁত প্রয়োগশৈলী! অনর্থক কালোয়াতির কোনও জায়গাই নেই, আশ্চর্য মায়া আর দরদ যেন চোখ ভিজিয়ে দেয়। এঁরা সম্পূর্ণ শিখে তবে প্রকাশ্যে এসেছেন। ‘জাগ অনশনবন্দী’ বা ‘সংঘশরণ তীর্থযাত্রা’-য় মর্মভেদী প্রবল স্বরোচ্ছাস শুনলেই বোঝা যায় তা। পরবর্তী সময়ে এই গায়নের বানভাসি ঘটে গেছে।
নজরুল সাহেব ওঁকে দিয়েছিলেন ‘হে গোবিন্দ রাখো চরণে’ সুর করতে। সে গান গেয়ে অনুপ জলোটা বাংলা গানে জনপ্রিয় হলেন। না, তাঁর রেকর্ডের ইনলে তে, কিংবা গানের আগের বচনে— কোথাও লেশমাত্র উল্লেখ নেই সত্য চৌধুরীর। বাঙালিরাই মনে রাখেননি! অনুপ জলোটা তো অনেক দূরের। নিজের সময়ে কিন্তু বরাবর জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। ইচ্ছে ছিল ছবিতে অভিনয় করার, সেই ইচ্ছে পূরণ করতে স্বয়ং বি এন সরকারের সামনে অডিশন দিয়ে সফলও হয়েছিলেন। ছবিতে অভিনয় করেছেন, অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়েও দিয়েছেন। নিজেকে মাপতে জানতেন। জানতেন, গানই তাঁর অস্ত্র। বাংলা ছাড়াও কত যে হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছেন এই বিস্মৃত নায়ক! একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। বাংলায় বেসিক আর ছায়াছবির গান মিলিয়ে দুশোর ওপরে গান। হিন্দি ফিল্ম এবং বেসিক গান অর্ধশতাধিক তো বটেই। গেয়েছেন উর্দুতে, গেয়েছেন নাটকের গান। সেই মানুষটির ১৯৫৫ সালের পরে রেকর্ডে আর গান নেই। অকৃতদার হয়েও ঘোর সংসারী মানুষটি কোন অভিমান মনে পুষে রেখেছিলেন, যার জন্য ওঁর সক্ষম কণ্ঠটি রুদ্ধ থাকল দীর্ঘকাল? হালফিলের গান নিয়ে একেবারেই হতাশ ছিলেন, নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতে পারছিলেন না, এমনও শোনা যায়। মনে পড়ল আর এক প্রাণবন্ত গায়ক গৌরীকেদার ভট্টাচার্যও তাঁর শীর্ষ সময়ে গান ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। শিল্পীর অভিমান ধরা মুশকিল। সঙ্গীত তো অভিমান আর অনুরাগেরই যুগল বহতা স্রোত! সত্যবাবুকে স্বচক্ষে দেখেছি আকাশবাণী ভবনে। ঘোষক ছিলেন, কাজের ফাঁকে রেকর্ডিং স্টুডিয়োয় চলে আসতেন। গায়ক জীবনের অভিজ্ঞতা জানাতেন নবীন গায়ককুলকে। সে শুনতে পাওয়াও এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। এই প্রতিবেদক তার সাক্ষী।