Rabindranath Tagore

শ্রাবণের সেই বাইশ তারিখ

এক নীরব অনুভবের দিন। এই দিন পৃথিবীর কর্মশালা থেকে ছুটি পেয়ে বিদায় নিয়েছিলেন কবি। এই দিনের জন্যই যেন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘সমুখে শান্তিপারাবার—/ ভাসাও তরণী হে কর্ণধার’ গানটি। বারণ করেছিলেন, গানটি তাঁর জীবদ্দশায় গাইতে। বিশ্বাস করতেন, জীবনকে মৃত্যুর জানালা দিয়ে না দেখলে তাকে সত্য রূপে দেখা যায় না।

Advertisement

তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২৪ ০৯:২৭
Share:

—ফাইল চিত্র।

বাইশে শ্রাবণ এক আশ্চর্য দিন। দিনটাকে নিয়ে মহাধন্দে পড়ে আছি সেই ছোটবেলা থেকে। কারণ দিনটা নীরবতার। কিন্তু সে মৌন কি আদৌ শোকবাহী? নাকি শুদ্ধ শান্তিময় পরম আনন্দের, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না আজও। ‘বুঝে উঠতে পারলাম না’ না বলে, বলা ভাল সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না। কেন? না আসতে পারার কী আছে, বঙ্গভাষী বিশ্বের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির মৃত্যুদিন কি আমাদের কাছে কখনও অ-শোকের হতে পারে! পুরোপুরি পারে না হয়তো, কিন্তু এমন কিছু বিশেষ দিন থাকে, যার সান্নিধ্যে বসে জীবনের হিসাব-নিকাশ কেমন যেন গুলিয়ে যায়! গুলিয়ে যায় বলতে, প্রত্যেকটা শব্দের অর্থ তৈরি হওয়ার আড়ালে যে সোজা হিসাবের বাইনারি বা দ্বিধাদ্বন্দ্বগুলো থাকে (যেমন ভাল-মন্দ, সাদা-কালো, বড়-ছোট, আনন্দ-দুঃখ ইত্যাদি) তাদের পরস্পরবিরোধী সম্পর্কগুলো আশ্চর্য ভাবে ভেঙে যেতে থাকে। গলে-খসে পড়তে শুরু করে বিরোধাভাসের সব বহিরাবরণ। আর তখনই শুরু হয় ওই ধন্দের, কারণ আবরণ ভেঙে গেলে তাদের তো আর আলাদা করা যাচ্ছে না, চিনতে পারাযাচ্ছে না বিপরীতার্থক বলে, মিলেমিশে যেতে থাকছে মরণপণ।

Advertisement

হাসির কানায় নয়নের জল

ছোটবেলার সবচেয়ে পুরনো বাইশে শ্রাবণের যে স্মৃতি মনে পড়ে, তাতে আমাদের বাড়ির কোণের একটা ঘর রয়েছে। টেবিলের উপর রাখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা সাদা-কালো ছবি, রজনীগন্ধার মগ্ন বিধুর গন্ধ, খাটের উপর পাতা একটা হারমোনিয়াম, তার উপর ‘গীতবিতান’-এর একটা খণ্ড। একা একা বসে মা গাইছে, ‘আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে কী এনেছিস বল্‌—/ হাসির কানায় কানায় ভরা নয়নের জল...’। ভেজানো দরজাটা ঠেলে ঢুকে নিঃশব্দে খাটের এক কোণে বসি। আমাকে দেখে আরও বেশি দরদ দিয়ে আবারও লাইনটায় চাপ দিয়ে তোলেমা, “হাসির কানায় কানায় ভরা নয়নের জল, ও তুই কী এনেছিস...”

Advertisement

এ আবার কী গান, এর মানে কী! ‘হাসির কানায় কানায়’ তো বুঝলাম, বুঝলাম ‘ভরা নয়নের জল’— কিন্তু এই দুটো জিনিস কী করে পাশাপাশি বসতে পারে! মায়ের গলায় বেদনা যেমন রয়েছে, একই সঙ্গে চোখে-মুখে এক ধরনের তৃপ্তিও। দেখেই কেমন যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, আমি না বুঝলেও মা নিশ্চয়ই গানটা বুঝেই গাইছে, তাই গলা ভারী হয়ে এলেও সারা মুখে চিকচিক করছে অসংখ্য তৃপ্তিকণা। ছোট গান, বেশি কথা নেই, তাই ওই লাইনটা বার বার গেয়ে হয়তো আমাকে ওর ভিতরের গূঢ় কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। ওর তৃপ্তিটাকে সঞ্চারিত করতে চাইছে আমার মধ্যে, কিন্তু আমি কিছুতেই নিতে পারছি না। হাবুডুবু খাচ্ছি, অত জলের মধ্যে পা দাঁড়াচ্ছে না কোথাও, মাথায় ঢুকছে না ‘হাসির কানায় কানায়’ আর ‘ভরা নয়নের জল’কে কেমন করে মেলানো যায়!

শেষ গানটা গেয়ে মা কবির ছবিতে প্রণাম করে উঠে পড়ল। এই গানটা নাকি বহুকাল আগের বেতারশিল্পী, মায়ের বাবা গাইতেন বাইশে শ্রাবণে। ‘ছিন্নশিকল পায়ে নিয়ে ওরে পাখি/ যা উড়ে, যা উড়ে যা রে একাকী’তে মাঝের একটা লাইনে হোঁচট খেলাম আরও এক বার, ‘নির্মল দুঃখ যে সেই তো মুক্তি নির্মল শূন্যের প্রেমে’। এ তো আর এক ধন্দ! ‘দুঃখ’ আবার কী করে ‘মুক্তি’ হতে পারে, কী করে হতে পারে ‘নির্মল’!

বেদনা পরম রমণীয়

সে যা-ই হোক, সে দিন যে কথাগুলো বুঝতে পারিনি, আজ কিছুটা পারি। অন্তত বোঝার চেষ্টা করি, ঘনঘোর শ্রাবণের পূর্ণিমায় এমন কোনও এক দিনে কেমন করে একাকার হয়ে যায় ‘হাসির কানা’ আর ‘নয়নের জল’। কেমন করে নির্মল দুঃখ হয়ে উঠতে পারে সুখের চেয়ে অনেক মহত্তর, আর চেনা বাঁধনের নিশ্চিন্ততা ছিঁড়ে অচেনা অশেষ শূন্যে ছাড়া পাওয়া কী করে হয়ে উঠতে পারে জীবনের সর্বোত্তম আকাঙ্ক্ষা। সেই পথেই বুঝতে চাই শ্রাবণ মাসের বাইশ তারিখের এই দিনটির আশ্চর্য মহিমা। বুঝতে পারি ক্যালেন্ডারের এত দিন থাকতে কেন এই বিশেষ দিনেই এ পৃথিবীর যাবতীয় বিপরীতগুলো মিলেমিশে নিজেদের হারিয়ে ফেলতে চায়! কী ভাবে কিছুতেই আর আলাদা হয়ে থাকতে পারে না হাসি-কান্না, জীবন-মৃত্যু, মিলন-বিচ্ছেদ, জেতা-হারা, সব-পাওয়া আর সব-হারানো।

বিপরীতের এই সমন্বয়-সাধন যদি বাইশে শ্রাবণের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে অসাধ্য-সাধন। আর যে কবির সমস্ত জীবন ও সাহিত্যকর্ম সেই অসাধ্যেরই সাধনা, তার ক্ষেত্রে একে প্রকৃত অর্থেই সিদ্ধিলাভের দিন ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়। বলাই বাহুল্য বড় কঠিন সাধনা। অমিয় চক্রবর্তী তাঁর প্রবাদপ্রতিম ‘সংগতি’ কবিতায় যে ভাবে বলেন, “মেলাবেন তিনি মেলাবেন, ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটার ওই ভাঙ্গা দরজাটা মেলাবেন”, কিন্তু যে ঈশ্বরের হাতে ‘ঝোড়ো হাওয়া’ আর ‘ভাঙ্গা দরজা’-টি মেলানোর ভার ছিল, তাঁর ব্যর্থতা তো সর্বজনবিদিত। অথচ কত সাবলীল দক্ষতাতেই না আমাদের বাংলা কবিতার ঈশ্বর সেখানে চূড়ান্ত সফল! কী অননুকরণীয় কারুভঙ্গিমাতেই না তিনি মেলাতে পেরেছেন ‘নিবিড় বেদনা’ আর ‘পুলক লাগে গায়ে’কে, ‘হৃদয় আমার প্রকাশ হল’ আর ‘বেদন বাঁশি’র বেজে ওঠাকে। উচ্চারণ করতে পেরেছেন ‘তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ, দুখের অশ্রুধার’, দেখতে পেয়েছেন ‘চোখের জলে দুখের শোভা’, বেদনা তাঁর কাছে হয়ে উঠেছে ‘পরম রমণীয়’। দুঃখকে গরল নয়, অমৃত রূপে পান করে লিখতে পেরেছেন, “পুষ্পের দুঃখ নাই, পশুপক্ষীর দুঃখসীমা সংকীর্ণ— মানুষের দুঃখ বিচিত্র, তাহা গভীর, অনেক সময় তাহা অনির্বচনীয়... এই দুঃখই মানুষকে বৃহৎ করে, মানুষকে আপন বৃহত্ত্বসম্বন্ধে জাগ্রত-সচেতন করে তোলে, এবং এই বৃহত্ত্বেই মানুষকে আনন্দের অধিকারী করে তোলে।” (মনুষ্যত্ব)

জীবনগ্রাসকারী মহারাক্ষস

তাই রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে, তাঁর চলে যাওয়ার সেই দিনে নিছক দুঃখের গান নিরর্থক, বরং পরম আনন্দের গান গাওয়া হোক, এমনই নাকি চাইতেন মায়ের গানের মাস্টারমশাই। না, কোনও বিখ্যাত স্বনামধন্য প্রশিক্ষক তিনি ছিলেন না, কলকাতা বা শান্তিনিকেতন থেকে একশো কিলোমিটার দূরের কোনও এক মেদুর মফস্‌সলের অখ্যাত অনামা এক জন অকিঞ্চিৎকর মানুষ হয়তো, কিন্তু তাঁর প্রত্যয়ের কী ভীষণ স্পর্ধা ছিল। ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে বাইশে শ্রাবণের দিন তিনি ‘প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে’ গানটি কোরাসে গাওয়াতেন তাঁর রংচটা একতলা অনভিজাত বাড়ির সিমেন্টের মেঝেয় বিবর্ণ শতরঞ্চির উপর বসিয়ে। ‘দুঃখকে আজ কঠিন বলে/ জড়িয়ে ধরতে বুকের তলে/ উধাও হয়ে হৃদয় ছুটেছে...’ সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাওয়ার সময় চোখের কোণদুটো চিকচিক করে উঠত তাঁর।

দুঃখের সঙ্গে নয় পারা গেল তবু, কিন্তু বীভৎস বিশাল অতল অন্ধকারময় মৃত্যুকে জয় করা কি এতই সহজ ছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে? বিশেষ করে যে মৃত্যু বার বার এসে কবির ব্যক্তিগত জীবনকে ভেঙেচুরে ছিঁড়েখুঁড়ে রিক্ত নিঃস্ব তছনছ করে রেখে গেছে? যা তাঁর কথায়, “মহারাক্ষস মৃত্যু জীবনকে গ্রাস করে চিরদিন বেঁচে রয়েছে।” তাঁর দেখায়, জীবন যেন চার দিকে মৃত্যুরূপী কালো জল গিয়ে ঘেরা দ্বীপ। মুহূর্তে যে কালো জলের প্রবল বন্যায় জীবনরূপ দ্বীপ ডুবে যেতে পারে। সেই প্রকাণ্ড কালীদহ মন্থন করে আলোর কমল তুলে আনা যে কী প্রাণান্তকর কাজ, যিনি জানেন তিনিই জানেন শুধু। তিনিই একমাত্র পারেন ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’ বলে সম্বোধন করতে। সেই সর্বগ্রাসী ভয়ঙ্করের চিবুকে চিকন লাবণ্যের খোঁজ পেতে। “এ চিকন তব লাবণ্য যবে দেখি/ মনে মনে ভাবি, এ কি/ ক্ষণিকের ‘পরে অসীমের বরদান,/ আড়ালে আবার ফিরে নেয় তারে/ দিন হলে অবসান।”

মানবজন্মতরীর মাঝি

মৃত্যু সত্য, জীবনের প্রথম ও শেষ সত্য। আমরা যে দিন মায়ের গর্ভজল থেকে নেমে এসে জন্মাই, সে দিন তো আমরা জন্মাই না, আমাদের মৃত্যু জন্ম নেয় আসলে। সে দিন থেকে নিশ্চিত হয়ে যায় পরিণতি— জন্মে গেছি যখন, তখন আমাদের আর কিছু হোক না হোক, মরণ হবেই। সে অর্থে অবশ্যই মৃত্যু আসলে পুংলিঙ্গে জীবনের জন্মদাতা, স্ত্রীলিঙ্গে জীবনপ্রসবিনী। রবীন্দ্রনাথের দেখায় সে কারণেই ‘মরণ বলে আমি তোমার জীবন তরী বাই’। মৃত্যুই তাই তাঁর চোখে সেই মাঝি, ‘আমার মানবজন্মতরীর মাঝি’। আবার একই সঙ্গে সেই চরম, সেই অনিবার্য, অপরিহার্য, অনন্ত, অবিনাশী মৃত্যুই হল জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিপক্ষ। সেই অরি, চিরবৈরী, অপার ক্ষমতাশালী বিরোধী শক্তিকে সম্মুখযুদ্ধে হারানো মানুষের পক্ষে অসম্ভব, তাই মানুষ তার সঙ্গে সমঝোতায় আসে। সোজা পথে জেতা অসম্ভব, তাই তাকে জয় করার সর্বোৎকৃষ্ট পথ, তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা, সখা হিসেবে, প্রেমাস্পদ হিসাবে। সে ক্ষেত্রে তাই মৃত্যুর রূঢ়তাকে হারিয়ে দেওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায়, তাকে যত দূর সম্ভব কাব্যময় করে তোলা, যত খানি সম্ভব সুন্দর, লিরিক্যাল, প্রিয়বাক্যশোভিত।

তা হলে সে তো ছলনা, কাব্যদেবীর ‘মধুর ছলের খেলা’, ‘ললিত লোভন লীলা’। রবীন্দ্রনাথ সে ছলের আশ্রয় নেননি কখনও, মৃত্যুকে তিনি নিরঙ্কুশ সততা, শ্রদ্ধা, শুদ্ধ অন্তঃকরণ থেকেই ভালবেসেছেন। কিটস যেমন তাঁর ‘ওড টু আ নাইটিঙ্গেল’-এ মৃত্যুকে ডেকেছেন প্রেমিকার মতো নরম নাম ধরে, “অ্যান্ড, ফর মেনি আ টাইম/ আই হ্যাভ বিন হাফ ইন লাভ উইথ ইজ়ফুল ডেথ/ কলড হিম সফ্ট নেমস ইন মেনি মিউজ়ড রাইম,/ টু টেক ইনটু দ্য এয়ার মাই কোয়াইট ব্রিদ”। সেই উত্তরাধিকারের পথে হেঁটেই জীবনানন্দ তাঁর নিবিড়তম উচ্চারণে বলেছেন, “মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি তো, — প্রিয়ার মতন।/ চকিত শিশুর মতো তার কোলে লুকায়েছি মুখ;/ রোগীর জ্বরের মতো পৃথিবীর পথের জীবন;/ অসুস্থ চোখের ’পরে অনিদ্রার মতন অসুখ;/ তাই আমি প্রিয়তম; — প্রিয়া বলে জড়ায়েছি বুক।” (জীবন) কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুকে সম্বোধন, তাঁকে সম্ভাষণের ভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন: “ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা,/ মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা।/ সারা জনম তোমার লাগি/ প্রতিদিন যে আছি জাগি,/ তোমার তরেই বহে বেড়াই/ দুঃখসুখের ব্যথা।/ মরণ, আমার মরণ, তুমি/ কও আমারে কথা।”

ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’-র (‘সং অফারিংস’) শেষের দিকে ছিল এই কবিতার কবিকৃত অনুবাদ। ছিল মৃত্যুকে নিয়ে আরও কিছু কবিতা, যেমন, ‘পেয়েছি ছুটি, বিদায় দেহো, ভাই’, ‘ছিন্ন করে লও হে মোরে’, ‘মরণ যেদিন দিনের শেষে’ ইত্যাদি। কবিতাগুলো মুগ্ধ করেছিল ফরাসি আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম জনক বলে খ্যাত কবি, সাহিত্যিক, নোবেলজয়ী অঁদ্রে জিঁদ-কে, এবং তাঁর কথায় মৃত্যুর প্রশস্তিতে লেখা এই কবিতাগুলি পৃথিবীর সর্বকালের সেরা কিছু কবিতার অন্যতম। ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’-র ফরাসি অনুবাদ করেছিলেন জিঁদ নিজে আর লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত বই ‘লফ্রাঁদ লিরিক’-এর একটি অসামান্য ভূমিকা। সেই ভূমিকার শেষ লাইনটি হল: “দ্য লাস্ট পোয়েমস অব গীতাঞ্জলি আর রিটন ইন প্রেজ় অব ডেথ। আই ডু নট থিঙ্ক, আই নো অব মোর সম্বার অ্যান্ড মোর বিউটিফুল অ্যাকসেন্ট ইন এনি ল্যাঙ্গুয়েজ।’ (অনুবাদ: চিন্ময় গুহ)। জিঁদের ওই অনুবাদ পড়েছিল ফ্রান্স, ফরাসি জানা ইউরোপ-সহ ল্যাটিন বিশ্ব। পড়েছিলেন প্রখ্যাত স্পেনীয় কবি হিমেনেথ (হুয়ান রোমাঁ হিমেনেথ), আর্জেন্টিনার বিদুষী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো প্রমুখ অনেকেই। বিমুগ্ধ সকলেই বলেছিলেন সে সব যেন অতি উচ্চস্তরের স্তবগান।

পরমপ্রিয় দয়িত, শ্যামসমান

প্রকৃতপক্ষেই কবি যেন মৃত্যুর প্রেমে পড়েছিলেন, তার কারণ অবশ্যই এই নয় যে, তিনি নৈরাশ্যবাদী বা জীবনবিমুখ। বরং তিনি জীবনকে প্রবল প্রগাঢ়তায় ভালবাসেন বলেই তার বিপরীত মেরু বা তার দোসর মৃত্যুকে এমন বার বার করে চাওয়া। আর সেই কারণেই মৃত্যুর কল্পরূপ নির্মাণ করে, তাকে সম্যক ভাবে অনুভব করতে চাওয়া, মৃত্যুর নানা অনুকল্পের মধ্যে দিয়ে যাওয়া আসলে জীবনপাত্রকে শেষ বিন্দু পর্যন্ত পান করতেই। যখন কালকের দিনটা আমাকে ছাড়াই শুরু হবে, আর সেটা দেখার জন্যে আমিই থাকব না, এই ধরনের এক তীব্র বিষাদ ও কারুণ্য তৈরি করে তাতে আপাদমস্তক ডুবে থাকতে চাওয়ার মধ্যে যে অস্তিত্ব বিরহ রয়েছে, তার স্বাদ নিতেই। ক্রিস্টিনা রসেটির ‘রিমেম্বার মি হোয়েন আই অ্যাম গন অ্যাওয়ে’ কবিতার আদলে রবীন্দ্রনাথের ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ বা ‘তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে’ তাই মোটেই মৃত্যুর কবিতা নয়, ভীষণ ভাবেই জীবনের কবিতা, জীবন-বিরহের। কবির কথায়, “জীবনকে সত্য বলে জানতে গেলে মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই তার পরিচয় পেতে হয়। যে মানুষ ভয় পেয়ে মৃত্যুকে এড়িয়ে জীবনকে আঁকড়ে রয়েছে, জীবনের ’পরে তার যথেষ্ট শ্রদ্ধা নেই বলে জীবনকে সে পায়নি। যে লোক নিজে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে বন্দি করতে ছুটেছে, যে দেখতে পায়, যাকে সে ধরেছে সে মৃত্যুই নয়, সে জীবন।”

রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বিশ্বশ্রেষ্ঠ যে সব কবি মৃত্যু বিষয়ে সুপ্রচুর কবিতা লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবশ্যই আমেরিকান কবি এমিলি ডিকিনসন। তিনি তাঁর বহুপঠিত ‘বিকজ় আই কুড নট স্টপ ফর ডেথ’ কবিতায় মৃত্যুকে দেখেছেন বরবেশে সজ্জিত দূতরূপে, যিনি তাঁর অমরত্ববাহী গাড়িতে করে নববধূকে (কবি) চিরকালের জন্য পতিগৃহে নিয়ে যেতে এসেছেন, যা আসলে নম্র নীরব সমাধিস্থল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একাধিক কবিতায় একই রকম ভাবে মৃত্যুকে দেখেছেন তাঁর পতি রূপে, আর নারী-সত্তায় প্রবেশ করে নিজেকে দেখেছেন নববধূ হিসেবে। ‘ওগো, আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা’ কবিতায় আমরা মৃত্যুকে ও কবিকে পাচ্ছি বর ও বধূর শুভদৃষ্টির মুহূর্তে: “মিলন হবে তোমার সাথে,/ একটি শুভ দৃষ্টিপাতে,/ জীবনবধূ হবে তোমার নিত্য-অনুগতা।” শুভবিবাহের একই দৃশ্যকল্প আবারও দেখছি অন্য এক কবিতায়: “ওগো মৃত্যু, সেই লগ্নে নির্জন শয়নপ্রান্তে/ এসো বরবেশে।/ আমার পরাণ-বধূ/ ক্লান্ত হস্ত প্রসারিয়া/ বহু ভালবেসে/ ধরিবে তোমার বাহু/ তখন তাহারে তুমি/ মন্ত্র পড়ি নিয়ো/ রক্তিম অধর তার/ নিবিড় চুম্বনদানে/ পাণ্ডু করি দিয়ো।”

ভাসাও তরণী হে কর্ণধার

আয়রনি নয়, নিছক প্যারাডক্সও নয় এ, যে এই মৃত্যু বিচ্ছেদমূলক নয়, আদ্যন্তই মিলনান্তক। কবির ভাষায় “মৃত্যু বড়ো মধুর, মৃত্যু জীবনকে মধুময় করে রেখেছে। জীবন বড় কঠিন, সে সবই চায়, সবই আঁকড়ে ধরে, তার বজ্রমুষ্টি কৃপণের মতো কিছুই ছাড়তে চায় না। মৃত্যুই তার কঠিনতাকে রসময় করেছে, তার আকর্ষণকে আলগা করেছে। মৃত্যুই তার নীরস চোখে জল এনে দেয়, তার পাষাণ স্থিতিকে বিচলিত করে।” শুধু তা-ই নয়, তাঁর সমগ্র লেখনীর ছত্রে ছত্রে রবীন্দ্রনাথ শংসাবাক্যে ভরিয়ে দিয়েছেন মৃত্যুর অমৃতপাত্র, “জগৎ রচনাকে যদি কাব্য হিসেবে দেখা যায় তবে মৃত্যুই তাহার সেই প্রধান রস। মৃত্যুই তাহাকে যথার্থ কবিত্ব অর্পণ করিয়াছে। যদি মৃত্যু না থাকিত, জগতের যেখানকার যাহা চিরকাল সেখানেই যদি অবিকৃত ভাবে দাঁড়াইয়া থাকিত, তবে জগৎটা একটা চিরস্থায়ী সমাধি মন্দিরের মতো অত্যন্ত সংকীর্ণ, অত্যন্ত কঠিন, অত্যন্ত বদ্ধ হইয়া রহিত। মৃত্যুর অভাবে কোথাও দাঁড়ি দিবার জো থাকিত না।”

প্রিয়তম বা পতিরূপের প্রেমানুষঙ্গে নয়, তিনি ভালবেসেছিলেন মৃত্যুর ঋষিপ্রতিম শান্ত মুখচ্ছবি।

তাঁর মন্দ্র গম্ভীর মাধুর্যকে আশ্চর্য মহিমান্বিত মনে হয়েছিল কবির, যার ফল ‘সমুখে শান্তিপারাবার—/ ভাসাও তরণী হে কর্ণধার’ গানটি। শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে ডেকে গানটি শিখিয়ে তিনি বলেছিলেন, “আজ হঠাৎ আমার যা মনে হল মৃত্যুর সেই রূপ এই গানে ধরা থাকল, তাই আমার জীবৎকালে এই গান তোমরা গেয়ো না।” সেই কথা মতোই কবির তিরোধানের পর ২২ শ্রাবণ ১৩৬৮, তারিখে শৈলজারঞ্জন শান্তিনিকেতনের শোকসভায় তিন ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গেয়েছিলেন সেই গান। গানটি পরে ব্যবহার করা হয়েছে ‘ডাকঘর’ নাটকে অমলের চলে যাওয়ার সময়ে। সকলেই বলেন এই গান গাওয়ার পরে আর কোনও গান গাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ তিরোহিত, বাঙালির মনোভূমিতে বৃহত্তম ভূকম্পের মতো সেই মহাপ্রয়াণের তাৎক্ষণিক অভিঘাতে সেই বাইশে শ্রাবণে গানটির পরিবেশনের সময়ে শৈলজারঞ্জন, ওই তিন ছাত্রী-সহ সমবেত সকলের চোখে জল ছিল, কিন্তু দিনে দিনে, কালে কালে আমরা বুঝেছি ‘চোখের জল’ জিনিসটা কবি আদতে যে ভাবে মৃত্যুকে দেখেছেন, তার সঙ্গে কিছুতেই যায় না। তাই আজ আর আমরা কাঁদি না। কারণ এই দিন কান্না-হাসি, শোক-আনন্দ, হতাশা-উল্লাস ইত্যাদি বিভেদের তুচ্ছতাকে বোঝার দিন। এ আমাদের জাতির বুকের গভীরে, অনুভবে পাওয়া এক অপার স্নিগ্ধতা— যাকে শান্তিও বলা যায়, বা চিরকাঙ্ক্ষিত মুক্তি।

জীবন দ্রুতগামী কালখণ্ড

তবে এক জন মহামানবের প্রয়াণ আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মৃত্যু তো আর এক কথা নয়। আমরা জীবনে যত ভয়ের দৃশ্য দেখেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়প্রদ মনে হয় যেন আমাদের বাড়ির দেওয়ালঘড়িটাকে। কারণ ঘড়ির সঙ্গে মানুষের মৃত্যুচেতনার গভীর সম্পর্ক। টিক টিক করে বৃত্তপথে ঘুরতে ঘুরতে ঘড়িটা যেন প্রতি সেকেন্ডে মনে করিয়ে দিয়ে চলেছে, এই যে মুহূর্তটা চলে গেল, সে কিন্তু আর কোনও দিন ফিরে আসবে না। এই রকমই একটা একটা করে মুহূর্ত আমাকে নিয়ে যাচ্ছে আমার এই বেঁচে থাকার চিরশেষের দিকে, যার পরে আমার জীবনে শুরু বলে আর কিছু ঘটবে না। তাই হাইডেগারের মতো অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মনে হয়েছিল সময়চেতনা আর মৃত্যুচেতনা দু’জনে আসলে সহোদরা। হাইডেগার তাঁর ‘বিয়িং অ্যান্ড টাইম’-এ স্পষ্ট বলেছেন, সময়ই হল আমাদের অস্তিত্ব, তাই সময় সসীম আর অবশ্যই আমাদের মৃত্যু আছে বলেই জীবন নিয়ে আমাদের এত চিন্তাভাবনা, এত ভালবাসা, তাকে যত দূর সম্ভব সুন্দর করে পাওয়ার এত প্রাণান্তকর চেষ্টা।

উপনিষদ যা-ই বলুক, বিজ্ঞান যে যুক্তিতেই বলুক সময় অন্তহীন, আমাদের মতো নশ্বর প্রাণীদের সাপেক্ষে তো সময় কোনও ভাবেই অসীম নয়। আমরা সময়ের মধ্যে বেঁচে আছি বলেই আমাদের এত ভয়, আশঙ্কা, উদ্বেগ, অশান্তি। সাহিত্যবিশ্বাসের পরিসরে তিনি যা-ই বলুন না কেন, রবীন্দ্রনাথ নামক রক্তমাংসের মানুষটি তো ব্যক্তিগত জীবনে সেই সব শঙ্কা, উদ্বেগ, অশান্তির বাইরে ছিলেন না। জীবন এক সীমিত কালখণ্ড বলেই তো সমস্ত জীবনভর তাঁর এত শ্রম ও সাধনা, জেগে থাকার প্রতিটি পলাতক ক্ষণকে শব্দ দিয়ে ধরে রাখা, প্রতিটি সৃজনসম্ভব মুহূর্তকে চিরস্থায়ী করে রাখার মরিয়া চেষ্টা। কিটসের সেই বিখ্যাত সনেট, “হোয়েন আই হ্যাভ ফিয়ারস দ্যাট আই মে সিজ় টু বি/ বিফোর মাই পেন হ্যাজ় গ্লিনড মাই টিমিং ব্রেন”-এর মতো তিনিও তো ভয় পান যে, আমার কলম এই উর্বর মগজ-খেতের সমস্ত সোনার ফসল ঘরে তুলতে পারার আগেই যদি আমার মৃত্যু হয়, তবে কী হবে!

ধ্যানমগ্ন জীবনসাধক

ব্যক্তিজীবনের ক্ষয়ক্ষতি, শোকতাপ, প্রিয়জন-বিচ্ছেদের প্রাথমিক আঘাতে তিনি মোটেও অবিচলিত নন। মা, পিতৃদেব, কাদম্বরীদেবী, স্ত্রী, দাদা, দিদি, ভাই, আত্মীয়স্বজন বন্ধুপরিজন, সর্বোপরি সন্তানদের মৃত্যুতে তিনি কী পরিমাণ মুহ্যমান ছিলেন, তাঁর অগণিত লেখাই তার সাক্ষী। তবু ভিতরের একটা জায়গায় তিনি অদ্ভুত ভাবে নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত, নৈর্ব্যক্তিক। সেই নিরাসক্তির প্রসঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীকে তিনি যদিও লিখেছেন “ভেতরে একটা জায়গায় আমি নির্মম,” কিন্তু সেটা বোধহয় নিজের প্রতি অভিমানের কথা। আসলে তো মানুষটি মনের গোপনতম গুহায় ধ্যানমগ্ন এক জীবনসাধক। ‘বেদনার রসে গোপনে গোপনে’ যে সাধনা তাঁর সফল হয়েছে, তার পুরস্কার হিসেবে তিনি পেয়েছেন এক আশ্চর্য বিযুক্ত হৃদয়। সমস্ত জীবনব্যাপী দুঃখের দহনে সেই হৃদয় আর কোনও সাধারণ পাথর মাত্র নেই, তা এক উজ্জ্বল হিরে হয়ে গেছে, যা অন্য সব কিছুকেই কাটতে পারে, কিন্তু তাকে কেউ কাটতে পারে না আর।

গালিবকে তাঁর কবিতায় বলতে শুনেছি ‘দর্দ কা হদ সে গুজ়রনা হ্যায় দবা বন জানা’। দুঃখ যখন সব সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন সে নিজেই ওষুধ হয়ে ওঠে— তা নিছক শব্দের কুহকমায়া নয়, সে যে জীবন্ত এক সত্য, রবীন্দ্রনাথের মতো করে আর কে-ই বা জানতে পারেন। খণ্ডদৃষ্টিতে যা ক্ষত, সমগ্রতায় তাই কী ভাবে মলম হয়ে উঠবে, তাঁর চেয়ে ভাল আর কেই-ই বা বুঝতে পারেন। প্রিয়তম পুত্র শমীকে হারানোর নিদারুণ দুঃখরাতে সে চোখ গিয়ে পড়ল আকাশে, যে হৃদয় বলে উঠতে পারল, “শমী যে রাত্রে চলে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই । মন বল্‌লে কম পড়েনি— সমস্তের মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তার মধ্যে।” তাকে অতিমানবীয় ছাড়া আর কী-ই বা বলা যাবে। এ সবই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল, তাঁর কারণ তিনি জীবনকে দেখতে পেরেছিলেন মৃত্যুর জানলা দিয়ে— “জীবনকে মৃত্যুর জানালার ভিতর দিয়ে না দেখলে তাকে সত্য রূপে দেখা যায় না।” সেই সত্য-রূপকেই তিনি চিত্তলোকের স্বচ্ছ আলোয় দেখেছিলেন, তাই তিনি সেই মৃত্যুঞ্জয়— “অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/ সে পায় তোমার হাতে/ শান্তির অক্ষয় অধিকার।” (জোড়াসাঁকো, ৩০ জুলাই, ১৯৪১, সকাল সাড়ে ন’টা)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement