প্রতিবাদী: ভাসিলি গ্রসম্যান। আন্দ্রেই প্লেতোনভ এবং বরিস পিলনিয়াক
চরম দুঃখের মধ্যেও কী ভাবে আমি সব ভুলে থাকতাম জানো? কল্পনা করতাম, কোনও নারী আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে— বলেছিল ইভান। ভাসিলি গ্রসম্যান-এর ‘এভরিথিং ফ্লোজ়’ উপন্যাসের নায়ক। বহু লেখককেই নানা শ্রম শিবিরে নির্বাসিত করেছিলেন স্তালিন। সেই রকম তিরিশ বছর পর গুলাগ বা সোভিয়েট শ্রমশিবির থেকে মুক্ত হয় ইভান। নতুন রাশিয়া তার কাছে অপরিচিত।
হাসপাতালে জীবনের শেষ দিনগুলিতেও গ্রসম্যান এই উপন্যাস লেখার কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। এখানে একটা কথা মনে রাখার, রুশ সাহিত্য আর সোভিয়েট সাহিত্য এক নয়। রুশ বিপ্লবের সময় থেকে সোভিয়েট সাহিত্য আলাদা শাখা হিসেবে উঠে আসে। দস্তয়েভস্কি, তুর্গেনেভ, টলস্টয়, ইভান বুনিন প্রমুখ রুশ সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু ওঁরা তো ধ্রুপদী ঐতিহ্য!
ধ্রুপদী রুশ আর সোভিয়েট সাহিত্য একই মাতৃগর্ভে জন্মালেও মেজাজে আলাদা। ক’জন আর ম্যাক্সিম গোর্কির মতো ‘মা’ বা নিকোলাই অস্ত্রভস্কির মতো ‘ইস্পাত’ লিখতে পারেন?
ভাসিলি গ্রসম্যান সেই বিপ্লব-উত্তর সময়ে প্রতিবাদের ঝঙ্কার। ১৯৪১ সালে আরও ৩০ হাজার ইহুদির সঙ্গে গ্রসম্যানের মাকেও নাৎসিরা মেরে ফেলে। ১৯৫৯-এ বেরোয় তাঁর উপন্যাস ‘লাইফ অ্যান্ড ফেট’। সোভিয়েট ইউনিয়নে নাৎসি আগ্রাসন এই কাহিনির বিষয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেড আর্মির সংবাদপত্র ‘রেড স্টার’–এর সাংবাদিক হিসেবে তিন–চার বছর যুদ্ধক্ষেত্রে কাটান গ্রসম্যান। তাঁর সেই অভিজ্ঞতাই ফিরে এসেছে উপন্যাসে। সেই সময় রুশ সেনানায়কেরা অনেকেই কাপুরুষের মতো আচরণ করেছেন। গ্রসম্যান তাঁর লেখায় সেটাই তুলে ধরেছিলেন। বিপ্লব ও বিজয়ের বলে বলীয়ান সোভিয়েট জমানার তা সহ্য হয়নি। ১৯৫২ সাল থেকেই তিনি কমিউনিস্টদের রোষে পড়েন। পরের বছর স্তালিনের মৃত্যু না হলে নিশ্চিত ভাবেই গ্রেফতার হতেন। গ্রসম্যান প্রথমে এই বইয়ের নাম দিয়েছিলেন ‘স্তালিনগ্রাদ’। রুশ ঔপন্যাসিক মিখাইল শলোকভ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জানতে চান, ‘‘স্তালিনগ্রাদ নিয়ে লেখার অধিকার আপনাকে কে দিল?’’ রুশ ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায় লিখবেন এক ইহুদি, এটা সহ্য হয়নি শলোকভ-এর। অথচ রুশ লেখকদের মধ্যে গ্রসম্যানই ছিলেন ওই যুদ্ধের আগাগোড়া প্রত্যক্ষদর্শী।
১৯৬১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নে নিষিদ্ধ হয় এই বই। উপন্যাসটি হারিয়ে যেতে পারে, এই চিন্তায় গ্রসম্যান দ্রুত বুড়িয়ে যান। প্রবল হাঁপানি আবার ফিরে আসে। ওই অবস্থায় ক্রুশ্চেভকে চিঠিতে লেখেন, ‘আমি যা সত্য বলে বিশ্বাস করি, তা-ই লিখেছি। যা দেখেছি, অনুভব করেছি এবং যে যন্ত্রণাভোগের মধ্য দিয়ে গিয়েছি, তা-ই লিখেছি।’
বিপ্লবের সময় রাশিয়ার সমস্ত কুকুর দিনরাত চেঁচাত। এখন তারা সব চুপ করে গিয়েছে— লিখেছেন আন্দ্রেই প্লেতোনভ, তাঁর ‘দ্য ফাউন্ডেশন পিট’ উপন্যাসে। এই মন্তব্যে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন স্তালিন-জমানার নৈঃশব্দ্যকে, যখন সমস্ত প্রতিবাদী স্বরকে বন্দুক দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই উপন্যাসে রয়েছে এমন এক দল শ্রমিকের কথা, যারা সোভিয়েট ইউনিয়নে, দেশের প্রলেতারিয়েত জনগোষ্ঠীর জন্য একটি অট্টালিকা তৈরি করতে চায়। তারা ভিত খুঁড়তে-খুঁড়তে তাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়। মূত্যুর সময় দারিদ্র, উপেক্ষা আর দুঃখভোগ ছাড়া আর কিছুই ছিল না প্লেতোনভ-এর। তাঁর বেশির ভাগ রচনা চেপে দেওয়া হয়েছিল।
প্লেতোনভ ছিলেন ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের সমর্থক। ১৯২৯-এ প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস, ‘শেভেনগুর’। এই উপন্যাসে শেভেনগুর নামের শহরে কমিউনিস্টরা নানা পরিকল্পনা করে, কিন্তু একমাত্র একটি হত্যা ছাড়া আর কিছুই সম্ভব হয় না সেখানে। অতঃপর প্লেতোনভ কমিউনিস্টদের রোষে পড়ে যান। ১৯৪০ সালে রুশ কবি আন্না আখমাতোভা-র বইয়ের রিভিউ করেন তিনি। প্লেতোনভ
এবং আখমাতোভা, দু’জনের ছেলেকেই গ্রেপ্তার করে নির্বাসনে পাঠানো হয় ১৯৩৮ সালে। ভয় দেখিয়ে তাঁদের কলমকে থামাতে চেয়েছিলেন স্তালিন।
গ্রসম্যান-এর মতোই ‘রেড স্টার’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন প্লেতোনভ। গ্রসম্যান ওই পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ডেভিড অর্টেনবার্গকে অনুরোধ করেন, যাতে প্লেতোনভ তাঁর সঙ্গে থেকেই কাজ করতে পারেন, কারণ, তিনি আত্মরক্ষায় সক্ষম নন এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠাও তাঁর নেই। এই সময় প্লেতোনভ লিখেছিলেন, ‘আমরা সমস্ত প্রাণী জয় করেছি। কিন্তু ওই সব প্রাণী আমাদের ভিতরে প্রবেশ করেছে। আমাদের আত্মার ভিতরে বসবাস করছে সরীসৃপেরা।’
স্তালিনের আমলকে যে ভাবে দেখেছিলেন, সে ভাবেই লিখেছিলেন প্লেতোনভ। তাঁর একটি চরিত্র বলে, ‘‘খুব চালাকি শিখেছ তোমরা। আমাদের জমি দিয়েছ। অথচ শস্যের শেষ দানাটুকুও কেড়ে নিচ্ছ। চাষিদের জন্য থাকছে শুধু ওই ধু-ধু দিগন্ত। কাদের বোকা বানাচ্ছ তোমরা?’’
১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর নভেলা, ‘দ্য রিটার্ন’। এই রচনায় ছিল যুদ্ধফেরত এক রুশ ক্যাপ্টেনের কথা, যার মধ্যে কোনও বীরত্ব বা আশাবাদ আর অবশিষ্ট নেই। স্তালিন জমানায় এ রকম লেখা ছিল অপরাধ। ‘হ্যাপি মস্কো’ উপন্যাসে এসেছে ১৯৩০-এর মস্কো। স্তালিন এই সময় নিয়ে বলেছিলেন, ‘‘জীবন আগের চেয়ে আরও ভাল হয়েছে, আরও আনন্দের হয়েছে।’’ মিথ্যা প্রচার আর বাস্তবের মধ্যে আসলে কতটা দূরত্ব ছিল, তা-ই দেখিয়েছেন প্লেতোনভ।
বিপ্লবের মধ্য থেকে যৌনাঙ্গের গন্ধ বেরচ্ছে— লিখেছিলেন বরিস পিলনিয়াক তাঁর ‘ইভান অ্যান্ড মারিয়া’ গল্পে। ১৯৩৭ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস, ‘নেকেড ইয়ার’। প্রথম দিকে বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন পিলনিয়াক। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তি স্বাধীনতায়। তাঁর মনে হয়েছিল, বিপ্লবের ফলে সামরিক ও প্রযুক্তির দিক থেকে রাশিয়ার যতই উন্নতি হোক না কেন, রাশিয়া হারিয়ে ফেলছে নিজের অতীত ও শেকড়কে। রেড আর্মির কম্যান্ডার মিখাইল ফ্রাঞ্জকে অপারেশনে বাধ্য করেন স্তালিন এবং ওই অপারেশনের নামেই তাঁকে হত্যা করা হয় বলে অনেকে মনে করেন। ‘দি টেল অব দি আনএক্সটিংগুইশড মুন’ গল্পে পিলনিয়াক এক উঠতি স্বৈরাচারীর ছবি আঁকতে গিয়ে এই ঘটনা দেখিয়েছেন। স্তালিন পিলনিয়াককে ক্ষমা করেননি। ‘মেহগানি’ উপন্যাসটি স্তালিনকে ক্ষুব্ধ করেছিল এবং এই বই-ই পিলনিয়াকের মূত্যুর কারণ হয়। এই বইতে লেনিন এবং ট্রটস্কির অনুগামীদেরই তিনি ‘প্রকৃত কমিউনিস্ট’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। অচিরেই সোভিয়েট-বিরোধী বলে দেগে দেওয়া হয় পিলনিয়াককে।
স্বৈরাচারী শাসন এই সাহিত্যিকদের সম্মান দেয়নি। কিন্তু মানুষের মনে তাঁরা আজও অমর।