Story

কে তুমি নন্দিনী

তখনকার মাদ্রাজে জন্ম। প্রথম স্বামী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিভিল সার্ভেন্ট। এই বিবাহিতার জন্যই ফ্রান্সিস ও হেস্টিংসের ডুয়েল। প্যারিসে গিয়ে নেপোলিয়নের বিশ্বস্ত তালেহঁকে বিয়ে। ক্যাথরিন গ্রান্ড ওয়েরলি-র সিঁড়ি বেয়ে ওঠার রঙিন কাহিনি। আসলে তো বোকা মেয়ে নয়। বোকা বৌও।

Advertisement

সন্দীপ দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২০ ০০:০২
Share:

সে  এক বোকা মেয়ের গল্প। এলিজ়াবেথ ভিজে ল্‌ ব্রাঁ তো তেমনই লিখেছেন। এক বার সেই বোকা মেয়ের বরের বাড়িতে ডিনার করতে আসবেন নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মিশর অভিযানের সঙ্গী ভিঁভা দেনো। বোকা মেয়েকে তার বর বলেছে, আমার ডেস্কে ওঁর লেখা বইটা আছে, একটু উল্টেপাল্টে নিয়ো। তা হলে অন্তত অল্পস্বল্প কথা বলতে পারবে লোকটার সঙ্গে।

Advertisement

কিন্তু দেনো-র লেখা মিশর-বিবরণী ‘ভোয়াজ দঁ লা ব্যাশ এট লা এজিপ্ত’ নয়, বোকা মেয়ে ভুল করে বার করে ফেলল ‘দি অ্যাডভেঞ্চার্স অব রবিনসন ক্রুসো’। ফ্রাইডেকে বড় ভাল লাগল! দেনো আসতেই বোকা মেয়ে বললে, ‘‘মঁসিয়ে, এত ক্ষণ আপনার বেড়ানোর গল্পেই ডুবে ছিলাম। কী যে মজার সব কাণ্ড। বিশেষ করে যখন বেচারা ফ্রাইডের সঙ্গে আপনার দেখা হল...’’

আসলে তো বোকা মেয়ে নয়। বোকা বৌও।

Advertisement

যে-সে লোকের বৌ নয়। শাল মইস দে তালেহঁ-র। যিনি কিনা ফরাসি বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের শেষ রাজা ষোড়শ লুই থেকে বিপ্লবের সময়েও ক্ষমতার অলিন্দে নৃত্য করেছেন। এমনকি নেপোলিয়নেরও খুবই বিশ্বস্ত। সম্রাটের বিদেশনীতির কলকাঠি তাঁর হাতে থাকে। তাঁকে নিয়ে কার্টুন ছড়িয়েছিল বাজারে। তালেহঁ-র শরীর থেকে বেরিয়েছে অনেক মুণ্ডু। কোনও মাথা রাজার জয়ধ্বনি দিচ্ছে। একটি বিপ্লব দীর্ঘজীবী হওয়ার কথা বলছে। কোনওটা বা সম্রাটের সমর্থনে সরব। বোঝাই যাচ্ছে, ভোল বদল নিয়ে বিদ্রুপ করতেই এ হেন ব্যঙ্গচিত্র!

রুটির বদলে কেক খেতে বলা রানি মারি আঁতোয়ানেত-এর ছবি এঁকে বিখ্যাত ‘পোর্ট্রেট আর্টিস্ট’ এলিজ়াবেথ বোকা মেয়ের প্রতিকৃতি আঁকতে বসে বুঝলেন, মেয়ের বিদ্যেবুদ্ধি বিশেষ নেই। সে ছবি তিনি এঁকেছিলেন ফরাসি বিপ্লবেরও আগে। ১৭৮৩-তে। শেষ জীবনে স্মৃতিকথা লেখার সময় মন্তব্য করেন, ‘‘এই মেয়ের বরের বুদ্ধি ছিল ঢের বেশি।’’ তিনিই লিখেছিলেন, রবিনসন ক্রুসোকে নিয়ে গল্পটা।

তা হলে তালেহঁ-র কেন বোকা মেয়ের পাণিগ্রহণ?

বাধ্য হয়ে। বিয়ে তো করতে চাননি। সে কালে বড় মানুষদের যেমন রক্ষিতা থাকে, তেমনই ছিল মেয়েটা। প্রথম যখন লন্ডন থেকে প্যারিসে এল, তার প্রেমিক এক ব্যাঙ্কার। এ মেয়ে বিপদে পড়ল বিপ্লবের সময়। গণহত্যা চলছে এমন এক দিন প্যারিসের রাস্তায় প্রায় মারা পড়ছিল। কোনও রকমে পালাল ইংল্যান্ড।

প্যারিসে রোব্‌সপিয়ার-এর সন্ত্রাস শেষ হতে ফিরে এল নতুন প্রেমিকের হাত ধরে। ইনি আবার জেনোয়াবাসী। নাম স্পিনোলা। বার বার লন্ডন-প্যারিস করতে থাকায় এ বার প্রেমিক-সহ তাকে জেলে ভরা হল। অভিযোগ, ইংল্যান্ডের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি।

অতঃপর আসরে নামলেন তালেহঁ। তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য এক কর্তাকে লিখলেন, ‘‘মেয়েটা ভারতীয়। অসম্ভব সুন্দরী। কিন্তু ভীষণ কুঁড়ে। জীবনে এমন আলসে মেয়ে দেখিনি। পারলে ওকে ছেড়ে দিন।’’

মেয়ে ছাড়া পেল। কিন্তু তালেহঁ ছাড়লেন না। বারাঙ্গনা হলেও তাকে নিজের সম্পত্তি করলেন। মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বাড়িতেই থাকতে শুরু করল বোকা মেয়ে। কিন্তু নেপোলিয়ন বলে দিলেন, ও সব চলবে না। মেয়ের নামে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ! বিয়ে না করে এক সঙ্গে থাকা যাবে না। বিয়ে না করলে তালেহঁ-র সব ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হবে।

তালেহঁ বাধ্য হলেন। নেপোলিয়ন-জোসেফিনকে সাক্ষী রেখে বিয়েটা হয়ে গেল। আর যেখানেই তালেহঁ বোকা মেয়েকে নিয়ে গেলেন, লোকে চোখ ফেরাতে পারল না। নেপোলিয়ন অবশ্য চাননি, তালেহঁ বোকা মেয়েকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করুন। তাতে সরকারের বদনাম। বোকা মেয়ে এমন সব কাণ্ড করেছে, ভদ্র সমাজে শোভা পায় না।

এমনিতে বোকা মেয়ে এক জন ডিভোর্সি। তার প্রাক্তন বর ডিভোর্সের কাগজে সইসাবুদ করতে প্রচুর টাকা-পয়সা নিয়েছিলেন। তার উপর তালেহঁ কিনা এক সময় বিশপ ছিলেন। বিবাহবিচ্ছিন্নাকে বিয়ের অনুমতি পেতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হল। আংটি বদল হল দক্ষিণ প্যারিসের নেলিতে। অনুষ্ঠান সেন নদীর পাশে তুইলেরি প্রাসাদে। সেখানে স্বয়ং নেপোলিয়ন নাকি বলে যান, ‘‘তালেহঁ সুসভ্য নাগরিক। আশা করি এই ভাবমূর্তির জন্য তাঁর শ্রীমতীর চপলতার ইতিহাস লোকে মনে রাখবে না।’’

সেই আর্টিস্ট, এলিজ়াবেথ বলেছেন, কী ভাল যে তাকে দেখতে ছিল! হাবুডুবু অবস্থায় তালেহঁ তো তার রূপের শংসাপত্র দিয়ে খোদ নিরাপত্তা বিভাগের এক বড় অফিসারকে চিঠি লিখে ফেললেন। এলিজ়াবেথের ছবিটি বিপ্লবোত্তর ফ্রান্সে কত হাত ঘুরল!

এঁকেছিলেনও বটে। বোকা মেয়ের কোঁকড়ানো সোনালি চুল পড়েছে বক্ষস্থলে। এক জোড়া নীল-হরিণ চোখ ঊর্ধ্বমুখী। চিবুকে স্বর্গীয় হাসির আভা। যেন ইটালীয় বারোক পেন্টিং। একই অঙ্গবিন্যাস। একটু হেলে উপরে তাকিয়ে। যে স্টাইল ফ্রান্সেও আনেন এলিজ়াবেথ।

বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে কত ফরাসির হাত ঘুরে বর্ণ-বিচ্ছুরিত সেই তৈলচিত্র এক দিন নিউ ইয়র্কের আর্ট ডিলার নোয়েডলার-এর জিম্মায় এল। কুক্ষিগত করার সুযোগ ছাড়লেন না এক মার্কিন দম্পতি। অবশেষে তাঁরাই সে ছবি দান করলেন নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত ‘মেট্রোপলিটন মিউজ়িয়ম অব আর্ট’-এ। ১৯৪০-এ।

এখনও সেখানেই আকাশি রিবন আর রুপোলি গাউনে সেজে বসে সেই বোকা মেয়ে। গানবাজনা ভালবাসত বলে হাতে নোটেশন লেখা এক টুকরো কাগজ। কে বলবে বোকা মেয়ের জন্ম ১৭৬২-তে তামিলনাড়ুর নাগাপট্টিনমে! বাবা ফরাসি পন্ডিচেরির নৌ-অফিসার। পরে আসেন চন্দননগর। সেখানেই বোকা মেয়েকে দেখেন ফরাসি বংশোদ্ভূত জর্জ ফ্রাঙ্কোয়েস গ্রান্ড। সিভিল সার্ভেন্ট! আর চন্দননগরের মেয়র শেভালিয়ে ছিলেন অতিথিবৎসল। ওয়ারেন হেস্টিংসও তাঁর বাড়িতে অতিথি হতেন। আসতেন ফোর্ট উইলিয়ামের কেউকেটারা। গিয়েছিলেন গ্রান্ডও। সেখানেই বোকা মেয়ের সঙ্গে আলাপ ও ভালবাসা। বিয়ের সময় মেয়ের বয়স ষোলো। সেটাই বোকা মেয়ের প্রথম বিয়ে।

কলকাতায় আলিপুরের বাড়িতে নতুন বৌকে তোলেন গ্রান্ড। এবং বিয়ের এক বছর না যেতেই সুন্দরী বউ পরকীয়া করছেন জেনে পাগল হয়ে গেলেন। পারলে স্ত্রীর গোপন প্রেমিককে খুন করেন।

সত্যিই তো আর অমন মারাত্মক কিছু করা যায় না। ভাবলেন, বেটাকে আদালতে হিঁচড়ে এনে আচ্ছা করে শিক্ষা দেবেন। গ্রান্ড ছুটলেন অ্যাটর্নি উইলিয়াম হিকি-র কাছে। ইনি কিন্তু ‘বেঙ্গল গেজেট’-এর সম্পাদক হিকি নন। তবে তাঁরই সমসাময়িক অন্য হিকি। পেশায় আইনজীবী। যাঁর ঠাটবাট আলাদা। বাবুগিরিতে ঝোঁক। লেস-ঝালর পরা জামাকাপড় গায়ে চড়ান। এক জোড়া ফিটন গাড়ির মালিক। টগবগে আরবি ঘোড়া ছাড়া নড়েন না। কলকাতায় সবাই ডাকে ‘জেন্টলম্যান অ্যাটর্নি’ বলে। আদালতে সেরা দু’চার জন অ্যাটর্নি ছাড়া কারও সঙ্গে মেশেন না। সপ্তাহে একটা করে ডিনার পার্টি দেন। রাজকীয় আমোদে খানাপিনা চলে। গ্রান্ড তাঁরই পায়ে পড়লেন। লড়তেই হবে তাঁর হয়ে।

হিকি নারাজ। জঘন্য ঘরোয়া কেলেঙ্কারিতে তিনি জড়াবেন না। পীড়াপীড়ি মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে হিকি পালালেন কলকাতা ছেড়ে। গ্রান্ডও নাছোড়। হিকির ক্লার্ক টলফ্রে-কে তিনি পাকড়াও করলেন। তাঁর সুন্দরী বৌয়ের সঙ্গে যে ফস্টিনস্টি করেছে, তাকে সবক শেখাবেন। গলে গেলেন টলফ্রে। হিকি-র বকলমে মামলা রুজু হল। কলকাতার বাইরে বসে সে খবর পেয়েই ছুটে সোজা আদালতে এসে মামলা নাকচ করলেন ‘জেন্টলম্যান অ্যাটর্নি’। বিমর্ষ গ্রান্ড অন্য উকিল ধরলেন। ‘শয়তানটাকে’ কিছুতেই ছাড়বেন না যে।

‘শয়তানটা’ কে?

তাঁর মাথাতেই প্রথম আসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ‘আইডিয়া’। ফোর্ট উইলিয়ামে বসে যে চার জন বাংলার শাসন সামলান, তাঁদের এক জন। চিরায়ত সাহিত্য গুলে খাওয়া মানুষ। হাউস অব কমন্স-এর জাঁদরেল মেম্বার। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পিরিতের লোক। তাঁর তদবিরেই ফোর্ট উইলিয়ামে দাদাগিরি করেন। গভর্নর জেনারেলের খুঁত ধরা নেশা। দিন-রাত ওয়ারেন হেস্টিংসকে বিপদে ফেলার ফন্দি আঁটেন। ঠিক যেমন ভারতে আসার আগে পরিচয় লুকিয়ে শ্লেষাত্মক চিঠি বিলিয়ে ব্রিটিশ সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়েছিলেন।

তিনি ফ্রান্সিস ফিলিপ। নামের আগে ‘স্যর’ও বসেছে। তাঁকে দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না হেস্টিংস। কে না জানে, এক বার দু’জনের ডুয়েল হল। গুলিবিদ্ধ ও পরাজিত ফ্রান্সিস দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ইংল্যান্ডের জাহাজে উঠলেন। পণ করলেন, দেশে ফিরে বেটাকে কাঁদিয়ে ছাড়বেন।

আসলে তো বড়লাট হতে না পারার ব্যথা! বেচারা হেস্টিংস ইংল্যান্ডে বহু বছরের চেষ্টায় চরিত্র উদ্ধারের ‘ডুয়েল’ও জিতেছিলেন। টাকাকড়ি সব গেল। তাতে ফ্রান্সিস রসিকতা করলেন, ‘‘ভারত থেকে আনা লুঠের টাকাই তো গেছে।’’

যে ঘটনায় গ্রান্ড-এর চোখে তিনি ‘শয়তান’, তা অনেক কাল আগের। তখন হিকিরও তাঁকে পোষাত না। ফ্রান্সিস নিজেকে বিরাট কিছু ভাবেন। অ্যাটর্নিরা চাকর-বাকর। হিকি ইংল্যান্ড থেকে আসার সময় কার একটা তদবিরের চিঠি এনেছিলেন। ফ্রান্সিসকে লেখা। ‘‘লোকটা কলকাতায় ওকালতি করবে, দরকার হলে সাহায্য করবেন।’’ ফ্রান্সিস সেই চিঠি পড়ে হেসে খুন। অ্যাটর্নিদের মতো ফালতু পেশার লোকেদের সাহায্য করার সময় তাঁর নেই!

মজা হচ্ছে, সেই বোকা মেয়ের বরের মতো জেন্টলম্যান অ্যাটর্নির চেম্বারে যেতে হল ফ্রান্সিসকেও। ভাবখানা এ রকম: কী সব হাবিজাবি অবৈধ প্রেমের কেসে নোটিশ এসেছে! হিকিকে বললেন, তাঁর হয়ে লড়তে। কিন্তু ভদ্রলোকের উকিল বলে কথা। ‘না’ বলে দিলেন। এ ব্যাপারে কারও পক্ষ নেবেন না।

‘এ ব্যাপার’ মানে অবৈধ প্রেমের ব্যাপার। জানাজানিটা হল কী ভাবে জানার আগে দেখে নেওয়া যাক সে কোন কালের কথা। জর্জ ফ্রাঙ্কোয়েস গ্রান্ড-এর সঙ্গে বোকা মেয়ের বিয়ে হয় ১৭৭৭-এর ১০ জুলাই। কলকাতায় তখন অন্য আর এক হিকি, জেমস অগস্টাস ছাপাখানা কিনে ব্যবসা শুরুর তোড়জোড় করছেন। ষোড়শী বোকা মেয়ের সঙ্গে বিয়ের সময় বরের বয়স তিরিশের এক বছর কম।

‘শয়তান’ ফ্রান্সিস তখন ৩৭। ১৫ বছর আগে এলিজ়াবেথ ম্যাকরাবির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। চার মেয়ে, এক ছেলের বাপ। হেস্টিংসের সঙ্গে তখন থেকেই অহং-সংঘাত। মোদ্দা কথা, রীতিমতো হোমরাচোমরা।

কেউ ভাবেননি, কোম্পানির এ হেন কেউকেটা এক জন এমন কেলেঙ্কারি আর কাঁচা কাজ করবেন! আসলে তো সব কিছুর মূলে সেই বোকা মেয়ে। কে তাকে এত সুন্দরী হতে বলেছিল? বেচারা মোটাসোটা বর গ্রান্ড তাকে কত ভালবেসেছিলেন! বৌ অমন সুন্দরী বলে তাঁর গর্বের শেষ ছিল না। কিন্তু ওই বয়স থেকেই মেয়ে বড় চপলা। তার রূপে পাগল জাঁদরেল ফ্রান্সিসও। পটিয়েও ফেললেন। গ্রান্ড বাড়িতে না থাকলেই চুপিচুপি দেখা করতে যান।

মহাকেলেঙ্কারির সেই রাতে বোকা বৌয়ের সঙ্গে সোহাগ করে বন্ধুর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে বেরিয়েছিলেন গ্রান্ড। ফ্রান্সিস সব জানতেন। গ্রান্ড বেরোতেই কালো জামা পরে মই বেয়ে পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়লেন শয়নকক্ষে। রূপকথার রাপুনজেল-এর গল্পটা মনে পড়ে যেতে পারে। সেই যে, জানলা থেকে ফেলে দেওয়া রাজকন্যার লম্বা চুল বেয়ে দুর্গে ঢুকেছিল রাজপুত্র! ফ্রান্সিস অবশ্য মই বেয়ে উঠলেন। বাঁশের মই। দু’ভাঁজ করা যায়। সঙ্গে নিলেন ইংরেজ শাগরেদদের। আর মিস্টার গ্রান্ড তখন বন্ধুর বাড়িতে সুন্দরী বৌয়ের কথা ভেবে গর্বের ঢেকুর তুলছেন।

অনেক দিন থেকেই তক্কে তক্কে ছিল গ্রান্ড-এর ব্যক্তিগত কর্মচারীরা। মাঝে মাঝেই তারা ফ্রান্সিসকে মাদামের বেডরুমে ঢুকতে-বেরতে দেখে। মূল ফটক বন্ধ থাকায় সে দিন পাঁচিল টপকে এসেছিলেন ফ্রান্সিস। ১৭৭৮ সালের ১২ ডিসেম্বর। এক জমাদার সে রাতে একেবারে হাতেনাতে ধরে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলল ফ্রান্সিসকে। ছুটল গ্রান্ডকে খবর দিতে। কী কাণ্ড!

তার পরেই তো মোকদ্দমা।

মামলায় ফ্রান্সিসই হেরে গেলেন। অভিযোগ ব্যভিচারের। ভদ্রলোকের বাড়িতে তাঁর বৌয়ের সঙ্গে ফস্টিনস্টির। বাদী-বিবাদীর যুক্তিটুক্তি শুনে জাস্টিস হাইড বললেন, দোষ লঘু নয়। শাস্তিই প্রাপ্য। মানলেন না আর এক জজ রবার্ট চেম্বার্স। প্রেম অপরাধ হবে কোন দুঃখে? বিশেষ করে উভয় পক্ষের সম্মতিতে যখন সব কিছু হয়েছে! কিন্তু চিফ জাস্টিস এলাইজা ইম্পে কড়া মানুষ। তার উপর হেস্টিংসের বন্ধু। তিনি বলে দিলেন, হাইডই ঠিক। শাস্তিই হোক। পঞ্চাশ হাজার সিক্কা জরিমানা।

ফ্রান্সিস বিচারে অখুশি। ইংল্যান্ডে আপিল করবেন। কিন্তু তার জন্য কোর্টের অনুমতি নিতে হবে। আবেদন করব-করব অবস্থায় ফ্রান্সিসের উকিলের হাতে একটা চিরকুট এল। শিকেয় উঠল সব কিছু।

ব্যাপারটা কী?

মামলায় না লড়লেও শুনানির সময় নিয়মিত হাজির থাকতেন অ্যাটর্নি হিকি। নিছক কৌতূহলে। অ্যাটর্নি হিকি জানালেন, ব্যাপার কিছুই না। গ্রান্ডই ঝামেলা চান না। কলকাতায় তাঁকে নিয়ে ছ্যা-ছ্যা হচ্ছে। বৌ সামলাতে না পারার বদনাম। হিকির কথায়, ‘‘যা ঘটেছে তাতে কলঙ্ক আর লজ্জা প্রেমিক ফ্রান্সিসের নয়।’’ গ্রান্ড চাননি ইংল্যান্ডেও হাসাহাসি হোক। ফ্রান্সিসও এই সুযোগে জরিমানার সিক্কা আধাআধি ভাগ করিয়ে ছাড়লেন।

সাপ মরল। লাঠিও ভাঙল না।
বেঁচে থাকল সেই বোকা মেয়ে। ক্যাথরিন গ্রান্ড ওয়েরলি। ‘মাদাম গ্রান্ড’ বললে লোকে এক ডাকে চিনত। ট্যাভার্ন থেকে ফিটন— কলকাতার সর্বত্র তার গল্প ঘুরেছিল। ফ্রান্সিসের দুঃসাহসিক রোমান্স নিয়ে কলকাতার সাহেব-কবিরা লিখেছিলেন প্রহসন-কাব্য!
হেস্টিংসের জঘন্য চক্রান্তে নন্দকুমারের ফাঁসি থেকে কালীপ্রসাদি হাঙ্গামা। পুরনো কলকাতায় ‘স্ক্যান্ডাল’ নিয়ে গল্পগাথা নেই এমন নয়। হাটখোলার বিখ্যাত দত্ত পরিবারের কালীপ্রসাদ মুসলমান রমণীকে ঘরে তুলেছিলেন। পরিণাম হয় মারাত্মক। মায়ের শ্রাদ্ধের বামুন পর্যন্ত জোটাতে পারছিলেন না। তবে বোকা মেয়ের গল্পের সঙ্গে বেশি মিল অন্য এক কন্যের। ফ্রান্সিসের কেচ্ছার প্রায় একশো বছর পরে আঁশবঁটিতে বৌ এলোকেশীর ধড়মুণ্ডু আলাদা করেন কোম্পানির চাকুরে নবীনচন্দ্র। বৌ স্বামীকে ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে থাকার সময় তারকেশ্বরের ‘মহন্ত’ মাধবচন্দ্র গিরির অঙ্কশায়িনী হয়েছে জেনে আর মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেননি নবীন।
এলোকেশীর খুন নিয়ে ‘কলিকাতা’ যে ভাবে নাটক-নভেলে মেতেছিল, বোকা মেয়ে মাদাম গ্রান্ড-এর ক্ষেত্রে ততটা হয়নি। সাহেব-সুবোদের ব্যাপার বলে কথা! ক’জন নেটিভের আর সে সব নিয়ে কাব্যি করার দম ছিল! তার উপর বোকা মেয়ের প্রথম বরটা বড্ড ভালমানুষ। যে রাতে এত কাণ্ড, তার পর দিন সকালেই তিন ঘণ্টা টানা বৌয়ের মুখে সবিস্তার সব জেনে ভেঙে পড়লেও বন্দুক-পিস্তল বার করেননি। গ্রান্ড বুঝলেন, ফ্রান্সিসকে বোকা মেয়ের ভালই লেগেছিল। না হলে কেন জমাদার ‘শয়তান’কে চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে ফেললে, বার বার কাকুতি-মিনতি করে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছে।
ভালমানুষ বরটি পাথরচাপা মন নিয়ে বোকা মেয়েকে ফেরত পাঠান চন্দননগরে। কে জানে আর কখনও বৌয়ের চাঁদবদন দেখেছিলেন কি না! আন্দাজ করা হয়, ফ্রান্সিস তাঁর প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে গোপনে ফরাসডাঙায় বার কয়েক পা রেখেছেন। এমনও শোনা যায়, হেস্টিংসেরও ‘সুনজর’ ছিল বোকা মেয়ের উপর। ফ্রান্সিসের সঙ্গে তাঁর কুখ্যাত ডুয়েলের সেটাও নাকি কারণ।
‘ইহলোক’ না ‘পরলোক’, না জানি কোন লোকে যাত্রা করেছিল বেচারা এলোকেশী। বোকা মেয়ে কিন্তু জাহাজে উঠে দিব্যি পাড়ি দিল বিলেতে। অনেকে বলেন, ফ্রান্সিসই সব ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু রানির পাড়ায় পৌঁছে প্রাণের পক্ষী উড়ে গেল অন্য বৃক্ষে। হয়ে গেল প্যারিসের সব চেয়ে সুন্দরী ‘কোর্টিসান’! তাকে দেখে পরের পর প্রেমে পড়ল মাতব্বরেরা। শেষে কিনা তালেহঁ-র মতো মন্ত্রীমশায়ও নিজেকে সামলাতে পারলেন না।
দু’জনের প্রথম আলাপের গল্পটাও ইউরোপে ছড়িয়েছিল। বোকা মেয়েকে কারা সব ভয় দেখায়, নেপোলিয়ন ইংল্যান্ড গিলে ফেলবে। দখল নেবে বোকা মেয়ের বাড়িঘর। সবাই তাকে বললে, তালেহঁ-র কাছে যাও। মন্ত্রীর তো মেয়ের রূপে অজ্ঞান হওয়া অবস্থা। মিছিমিছিই লিখে দিলেন শংসাপত্র। বললেন, কনসালের লোকেরা পৌঁছলেই এই চিঠিটা দেখাবে। কেউ কিচ্ছু করবে না। বোকা মেয়ে ভাবল, ঠিক লোককেই ধরেছি। দেখতে দেখতে শুরু হল তালেহঁ-র সঙ্গে রোমান্স। বোকা মেয়ে ভেবে বসল, সে রাজরানি হবে!
এমন নয় যে সবাই তাকে বোকা মেয়ে ভেবেছিল। যে কিনা ষোলো বছরে কোম্পানির বড় অফিসারকে পাকড়াও করে বিয়ে করে ফেলে, এক বছর না যেতে হেস্টিংসের সমকক্ষ ফ্রান্সিসের সঙ্গে রোমান্স শুরু করে, ফরাসি ব্যাঙ্কারকে প্রেমিক বানিয়ে ফেলতে সমস্যা হয় না, এবং ক’টা বছর যেতেই নেপোলিয়নের অতি বিশ্বস্ত তালেহঁকে বিয়ে করে ফেলে, সে কেন বোকা হবে?
প্রশ্ন অবান্তর নয়। অনেকে বললে, মোটেই এ বোকা মেয়ের গল্প নয়। বরং উল্টোটাই সত্যি। সমাজের উঁচুতে ওঠার ব্যাপারে তুখড় বুদ্ধি ছিল তার। ফ্রান্সিস বানিয়েছিলেন বাঁশের ফোল্ডিং মই। এই মেয়ের মই ছিল সেই সব হাই প্রোফাইল পুরুষেরা। তা এলিজ়াবেথ ভিজে ল্ ব্রাঁ যা-ই লিখুন, যে গল্পই শোনান না কেন। সে মেয়ে ভাল করেই জানত পুরুষেরা তার সৌন্দর্যে পাগল হয়, বুদ্ধি করে আসল লোককে ধরতে হবে। অবশ্য উল্টোটাও কেউ কেউ বলেন। তার রূপে ভুলে অমন করে প্রেম নিবেদন করলে বোকা মেয়ে আর কী করবে। মেয়ের ভাগ্য ভাল, তার প্রথম বরটা এলোকেশীর স্বামী নবীনচন্দ্রের মতো নিষ্ঠুর ছিলেন না। রাতারাতি তাকে বুড়ো বাপের কাছে পাঠিয়েছিলেন। গুলিটুলি করেননি।
সাহেবসুবোদের ব্যক্তিগত স্ক্যান্ডাল নিয়ে এ দেশের লোক বেশি মাথা ঘামায়নি। তবে ‘ঘোর অন্যায়’ নন্দকুমারের ফাঁসি হওয়ায় অরন্ধন পালিত হয়েছিল বঙ্গদেশে। হিকি লিখেছেন, ‘হিঁদুরা’ রাগে শহর ছেড়েই চলে গেছিল। গ্রাম্য মানুষে কান্নাকাটি করেছিল নবীনচন্দ্রের জন্য। তাদের চোখে তিনি এলোকেশীর খুনি ছিলেন না। উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন। কেচ্ছায় এমনটাই হয়ে এসেছে। যূপকাষ্ঠে তোলার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে মেয়েদের। এলোকেশীর জন্যেও কোনও বাঙালি চোখের জল ফেলেনি। কালীপ্রসাদি হাঙ্গামা নিয়ে হুলস্থুল কাণ্ডের গল্পও ডালপালা মেলেছে। সেখানে চন্দনগরের এক শ্বেতাঙ্গিনির এ দেশে কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে বিলেত পাড়ি দেওয়ার খবরই অনেকে পায়নি। নেপোলিয়ন অবধি পৌঁছে গেলেও না।
সে মেয়ে আদৌ বোকা ছিল কি না, তা নিয়ে ধন্দ থাকতে পারে। সব কিছু অন্য চোখে বিচার করে কেউ কেউ হয়তো বলবে, গ্রান্ড-এর মতো ভালমানুষকে ঠকানো প্রথম বোকামো। দ্বিতীয়, ফ্রান্সিসকে মুঠোয় পেয়েও অন্য কোথাও উড়ে যাওয়াটা বড় ভুল। তালেহঁ-কে জীবনসঙ্গী করেও হয়তো ঠিক করেনি। তিনি তো বিয়ের এক বছর যেতেই টাকাপয়সা দিয়ে তাকে লন্ডনে পাঠিয়ে দিলেন। আসলে নারীসঙ্গই ছিল তালেহঁর নেশা। বোকা মেয়ে তো বিশেষ লেখাপড়া করেনি। তাই বছর ঘুরতেই এ হেন স্ত্রীর সঙ্গে তালেহঁর সম্পর্ক বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল।
বোকা মেয়ে আবার প্যারিসে ফিরেছিল, তত দিনে বেশ মোটাসোটা, হয়তো দেখতেও অত ভাল লাগেনি। ও দিকে, মন্ত্রীমশাই বুদ্ধিমতীদের নিয়ে টইটম্বুর। ভাইঝির সঙ্গে ভিয়েনায় প্রমোদভ্রমণ করছেন। রাজতন্ত্রের আপাদমস্তক ভক্ত বোকা মেয়ে রেগেমেগে বাকি জীবন কাটালে ধম্মকম্ম নিয়ে। গ্রান্ড, ফ্রান্সিস থেকে তালেহঁ— কারও ঔরসে তার ছেলেপুলে হয়েছে বলে শোনা যায়নি। কলকাতার আবছা গ্লানি নিয়ে সে মাটি নিল মোপানাস সমাধিক্ষেত্রে।
১৮৩৪-এ মৃত্যুর বছরে বোকা মেয়ে বাহাত্তুরে বুড়ি। তেরো বছর আগে নির্বাসিত নেপোলিয়ন সেন্ট হেলেনায় মারা গিয়েছেন। তালেহঁ আরও বছর চারেক বাঁচলেন। ষোলো বছর আগেই দ্বিতীয় স্ত্রী এমা ওয়াটকিনসকে নিয়ে সুখে ঘরসংসার করতে করতে ফ্রান্সিস শুয়ে পড়লেন কফিনে। কেরি সাহেবের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হল শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান সমাজ। তখনই তো আঁকা হচ্ছে ইডেন গার্ডেন্সের অঙ্গসজ্জা। জন্মগ্রহণের অপেক্ষায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। সতীদাহ বন্ধের আইন প্রণেতা বেন্টিঙ্ককে নিয়ে ধন্য ধন্য পড়েছে সুশীল সমাজে। এত কাণ্ডে কেউ খবর পায়নি বোকা মেয়ের চলে যাওয়ার। কারও মনের এক কোণে পড়ে থাকেনি হিকির সেই পঙ্‌ক্তি— ‘‘মনের দুঃখে শ্রীমতী গ্রান্ড কলকাতা ছাড়লেন।’’
থাকার মধ্যে সেই ছবি। ফরাসডাঙার ধন্যি মেয়ের আজও দেখা মিলতে পারে নিউ ইয়র্কে। যে কিনা প্রাচীন কলকাতার নিষিদ্ধ কোনও প্রেমের অমোঘ চিহ্ন নিয়ে শূন্যপানে চেয়ে নতুন প্রেমিকের জন্য প্রহর গুনতে গুনতে যেন বলছে, ‘‘আমি ভারত থেকে এসেছি, বড় হয়েছি হুগলিতে, মঁসিয়ে দুপ্লের শহরে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement