ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
সবে পাতে ভেটকি মাছের পাতুরি পড়েছে আর তখনই ঝপ করে আলোটা চলে গেল! চারিদিকে চাপা গুঞ্জন উঠল সঙ্গে-সঙ্গে। স্বাভাবিক। এখনকার দিনে লোডশেডিং হয় না কি! তাও এখানে ক’দিন হল বিদ্যুৎ খুব অনিয়মিত। কী একটা কাজ হচ্ছে লাইনে, ফলে প্রদীপকে বলেছিল জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখতে। এত ক্ষণ দু’টো জেনসেটই চলছিল। কিন্তু এ বার সে দু’টোও গেল। এক সঙ্গে। বৈশাখী যা রেগে যাবে না!
কপিল পকেট থেকে মোবাইল বার করে আলো জ্বালিয়ে সবার উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলল, ‘‘আপনারা একটু বসুন। আলো এসে যাবে এক্ষুনি।’
বৈশাখ মাস। কম্বল চাপা দেওয়া একটা গরম পড়েছে। লোকে ফ্যানের তলাতে বসেও ঝরনার মতো ঘামছে। তাই এখানে কিছু স্ট্যান্ডি এসি-র ব্যবস্থা করেছিল কপিল। কিন্তু সে-সবও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
খাওয়ার জায়গা থেকে দ্রুত বেরিয়ে বড় হলটায় এল কপিল। ওদের আজ বিবাহবার্ষিকী। পঁয়ত্রিশতম। দুই ছেলে আর ছেলের বৌদের উদ্যোগেই অনুষ্ঠান হচ্ছে। বৈশাখীরও আগ্রহ ছিল। সাড়ে তিনশো মতো লোকও বলা হয়েছে। কেটারিং, ঘর ভাড়া, গেট সব সুন্দর ভাবেই হয়েছে, শুধু গোল পাকাল এই আলোটাই। প্রদীপটা যে কী করে না!
হলঘরে বসা মানুষজনের অনেকের হাতেই মোবাইলের আলো জ্বলে উঠেছে। আর সেই আলোয় সব কিছুকেই কেমন যেন ভূতুড়ে লাগছে!
বৈশাখী এর মধ্যেই শাড়িতে খসখস শব্দ তুলে এগিয়ে এল।
এই সেরেছে! সিনেমায় অমিতাভের হাঁটার স্টাইল দেখে যেমন ভিলেনরা বুঝত এ বার মারধোর খাওয়ার সময় এসেছে, তেমনই বৈশাখীর হাঁটার স্টাইল দেখেও কপিল বোঝে, ভার্বাল প্যাঁদানি শুরু হল বলে।
বৈশাখী আসতেই কপিল আগে-ভাগে বলল, ‘‘আমি যাচ্ছি প্রদীপের কাছে। দেখছি ব্যাটা কী করল! তুমি রাগ কোরো না।’’
বৈশাখী রাগের গলায় বলল, ‘‘তখনই বলেছিলাম ওই ব্যাটাকে দিয়ো না ইলেকট্রিকের ভার! নিজে বিয়ে-থা করেনি। ও কী বুঝবে এ-সবের মর্ম! কিন্তু না! তোমার দয়ার শরীর! পুরনো বন্ধু! ওকেই দিই! নাও এ বার ভোগো! আলো চলে গেল তো!’’
কপিল চুল কমে আসা মাথায় হাত বোলাল। বলল, ‘‘এত রাগলে চলে! যন্ত্র তো। গোলমাল করতেই পারে। তুমি এমন কোরো না। আমি দেখছি।’’
‘‘যন্ত্রই বটে এক পিস! আর দেখতেই বা হবে কেন? টাকা দিচ্ছি না না কি! আলো যাবে কেন? কেন যাবে আলো?’’ বৈশাখী গলা তুলল সামান্য।
কপিল হাসল। এই আলোছায়ার মধ্যে আলতো করে ধরল বৈশাখীর হাত। তার পর নরম গলায় বলল, ‘‘মনে নেই না তোমার কিছু? পঁয়ত্রিশ বছর আগের সেই ম্যাচের দিনটা কি খুব দূরের স্মৃতি হয়ে গেল শাখী! সে দিন কী হয়েছিল মনে নেই?’’
পঁয়ত্রিশ বছর আগে, ১৯৮৫
কপিলানন্দ নামটা নিয়ে সারা জীবনই কপিলের একটা মনখারাপ ছিল। স্কুলের ছেলেরা সারা ক্ষণ ওকে কপিল না বলে ‘কোকিল, কোকিল’ বলে আওয়াজ দিত। ব্যাপারটা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিল যে বাড়িতে দাদা-দিদিরাও ‘কোকিল’ বলে ডাকত ওকে!
ঠাকুরদা এই নামটা দিয়েছিল ওকে। ওর এত রাগ হত ঠাকুরদার উপর! নিজে তো নাম দিয়ে উপরে চলে গিয়েছে, এখন ভুগতে হচ্ছে ওকে। কেন, স্টাইলিশ কোনও নাম ছিল না! বাংলায় নামের অভাব না কি! একটু খুঁজলেই তো বেশ সিনেমার নায়কের মতো উত্তম, সৌমিত্র বা শুভেন্দু টাইপের একটা নাম দিতে পারত! তা হলে তো সোনালিকার পাশে একটু মানাত ওকে! তা নয়। কপিলানন্দ দেবনাথ! শুনলেই মনে হয় টেকচাঁদ ঠাকুরের সময়কার মানুষ। এই নামের ছেলেকে কোনও দিন সোনালিকা নামের মেয়ে পছন্দ করে!
তাই তো কপিলের প্রস্তাবে সোনালিকা হেসে বলেছে, ‘‘কোকিলের তো নিজের বাসা থাকে না। তা হলে আমায় নিয়ে রাখবে কোথায়?’’
কপিলদের বড় হার্ডওয়্যার স্টোর্স আছে কলকাতায়। ভাল চলে। পাশাপাশি সদ্য ইলেকট্রনিক্সের একটা দোকানও খুলেছে চাঁদনিতে। সময় পেলে সেখানে বসে কপিল। সোনালিকার বাবার মতো না হলেও, কপিলদের বাড়িও কম বড় নয়। তাই সোনলিকার এ-সব গা-জ্বালানো কথা যে আসলে কাটিয়ে দেবার ফিকির, সেটা খুব ভাল করেই বোঝে ও।
সোনালিকা বাংলা ছবির উঠতি নায়িকা। একটা ছবিতে নায়কের বোন হিসেবে সেকেন্ড হিরোইন ছিল। আর-একটা ছবিও নাকি শুরু হবে। ওর বাবার চালের কল আর তেলের ঘানি আছে। টাকার অভাব নেই। ওর বাবাই নাকি মেয়ের জন্য ছবি প্রোডিউস করছে। ফলে সোনালিকার এখন ব্যাপারই আলাদা। তাই তো কপিলকে অমন করে বলতে পেরেছে।
সেই কলেজের সময় থেকে সোনালিকাকে পছন্দ করে কপিল। কিন্তু মেয়েটা পাত্তাই দেয় না ওকে। এত অহঙ্কার কোন গোডাউনে রাখে
কে জানে!
দু’বছর আগে সরস্বতী পুজোর দিন আর থাকতে না পেরে কপিল বলেই দিয়েছিল নিজের মনের কথা। কিন্তু সবার মনের কথার গুরুত্ব তো পৃথিবী দেয় না। এখানে সোনালিকাও দেয়নি। আর উত্তরে বলেছিল ওই কথা। তার পর থেকে কথাটা সারা ক্ষণ এমন করে মনে ফোটে যে, মনে হয় গলায় কাঁটা, চোখে বালি আর জুতোয় পেরেক নিয়ে ঘুরছে কপিল।
কপিল হাতের ফাঁক দিয়ে পড়ে যায় না কি? ও নিজেও কলকাতার বড় ক্লাবের ক্রিকেটার! এ বছর চারটে সেঞ্চুরি আছে! সবাই বলছে যে-কোনও দিন বাংলা দলে চান্স পেয়ে যাবে ও! তাও এমন! ও নিশ্চিত সব এই নামটার জন্য!
তবে সেই দু’বছর আগের সরস্বতী পুজোর পর আর সোনালিকাকে কিছু বলেনি কপিল। শুধু ওদের দু’জনের কমন ফ্রেন্ড বৈশাখীর কাছ থেকে মাঝে-মাঝে টুকটাক খবর নিয়েছে।
কিন্তু এই নাম নিয়ে নাকানিচোবানির ব্যাপারটা বছরদুয়েক আগে অবধি চলেছিল। তার পর এক ধাক্কায় সব বদলে গিয়েছে।
আর সেটা যিনি বদলে দিয়েছিলেন, তাঁর নামও কপিল। কপিলদেব নিখাঞ্জ। আজ থেকে প্রায় দু’বছর আগে লর্ডসের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে কপিলদেবের ভারত জিতেছিল ক্রিকেটের বিশ্বকাপ। ব্যস, তার পর থেকে আর কেউ এই কপিলকে ‘কোকিল’ বলে খেপায় না। বরং বলে, ‘জয়গাছার কপিলদেব’!
সেই যে ভারতে ক্রিকেটের ঝড় শুরু হল, তা এখনও চলছে। আর চলবে না-ই বা কেন! এই বারও অস্ট্রেলিয়ায় যে বেনসন অ্যান্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অব ক্রিকেট হল, মানে ওই রঙিন জামা কাপড়-পরা দিন-রাতের ক্রিকেট, সেটাতেও তো চ্যাম্পিয়ন হল ভারত।
ব্যস, তার পরই পাড়ায়-পাড়ায় শুরু হয়ে গেল বড়-বড় হ্যালোজেন লাগিয়ে দিন-রাতের ক্রিকেট। তার ঢেউ এসে পড়ল এই জয়গাছাতেও।
আজ জয়গাছায় ভবতারিণী স্মৃতি কাপের ডে অ্যান্ড নাইট ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল। আর সেখানে সোনালিকার বাবার টিম ‘ইলেভেন স্টার্স’-এর প্রধান ভরসা এক সময়ের বড় অবহেলার
সেই ‘কোকিল’!
***
লম্বা-লম্বা ছ’টা শালখুঁটিতে দু’টো করে হ্যালোজেন টাঙানো হয়েছে। তাতেই অরুণাচল সংঘের মাঠ আলোয়-আলোয় প্রায় মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড হয়ে গিয়েছে। ম্যাচ পঁচিশ ওভারের। ক্যাম্বিস বলেই খেলা হচ্ছে। তাতে অবশ্য লোকজনের উৎসাহের খামতি নেই। শান্তিপুরের ‘আমরা সবাই’ ক্লাব প্রথমে ব্যাট করে পঁচিশ ওভারে করেছে একশো উনআশি রান। এ বার কপিলদের করতে হবে একশো আশি।
এই নিয়েই ব্রেকের সময় প্রদীপের সঙ্গে কথা হচ্ছিল কপিলের। প্রদীপ কপিলের বন্ধু। ইলেকট্রিকের দোকান আছে ওদের। নাম ‘কিরণ ইলেকট্রিক’। ওরাই এই আলো দিয়েছে, চোঙা মাইক দিয়েছে। প্রদীপ নিজে হাজারটা জট লাগানো তারের মধ্যে বসে দেখছে সব যাতে ঠিক থাকে।
প্রদীপ বলল, ‘‘কী রে! পারবি তো জিততে? না হলে কিন্তু প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন হয়ে যাবে পুরো!’’
কপিল কিছু বলার আগেই নেলো এসে দাঁড়াল। ছেলেটা সোনালিকাদের বাড়িতে কাজ করে।
নেলো বলল, ‘‘কপিলদা, একটু আসবে? দিদি ডাকছে তোমায়। খুব দরকার!’’
***
সোনালিকা বলল, ‘‘কপিল, আজ জিতবে তো? আমার বন্ধুরা কলকাতা থেকে এসেছে। ওদের সামনে হেরে যেয়ো না কিন্তু।’’
মাঠের এক পাশে শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। তার নীচে ভাঁজ করা কাঠের চেয়ার পাতা। একটা টেবিলে সাদা টেবিলক্লথের উপর ভবতারিণী স্মৃতি কাপ রাখা। খেলার শেষে এখানকার এমএলএ সাহেব এসে প্রাইজ় দেবেন।
এই শামিয়ানার নীচে এক পাশে বসে রয়েছে সোনালিকা, বৈশাখী আর কলকাতা থেকে আসা সোনালিকার বন্ধুরা।
কপিল বলল, ‘‘আমি তো কোকিল, আমি আর কী পারি!’’
সোনালিকা সামান্য অপ্রস্তুত হল। বলল, ‘‘আরে মজা করেছিলাম! প্লিজ় ভুলে যাও। তুমি তো আমাদের কপিলদেব!’’
কপিল হাসল, ‘‘যদি জিতি, তা হলে আমি যা চেয়েছি হবে?’’
‘‘মানে? কী হবে?’’ পাশে বসা বৈশাখী ভুরু কুঁচকে তাকাল।
কপিল বলল, ‘‘আমি ওকে অফার করেছিলাম। ও না বলেছিল। সেটাই বলছি।’’ তার পর সোনালিকাকে বলল, ‘‘আমার সবটাই তুমি জানো। আমি অযোগ্য নই। তাই বলছি। জিতলে তুমি হ্যাঁ বলবে?’’
সোনালিকা মাথা নামিয়ে নিল।
বৈশাখী বলল, ‘‘এ আবার কী কথা? এমন করে হয় না কি? এটা সিনেমা পেয়েছ!’’
কপিল হাসল, ‘‘ও বলুক। তুমি কথা বলছ কেন?’’
সোনালিকার কান লাল হয়ে গিয়েছে।
‘‘হ্যাঁ হলে বলো, আর না হলে...’’ কপিল চলে যাওয়ার জন্য ঘুরল।
সোনালিকা বলল, ‘‘ঠিক আছে। আগে জিতে তো এসো।’’
বৈশাখী বলল, ‘‘সোনালিকা, তুই সিরিয়াস!’’
***
টেনিস বল ক্রিকেটের সমস্যা হল, বলটা দরকারের চেয়ে বেশি লাফায়। তার উপর অরুণাচল মাঠের মাঝখানে যেটাকে পিচ বলে চালানো হয়েছে সেটা বেশ এবড়োখেবড়ো। একশো আশি রান করতে হবে বলে নামলেও এক সময় তো ইলেভেন স্টার্স ষাট রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে বসেছিল পনেরো ওভারে। এক দিকে কপিল ধরে খেললেও অন্য দিকে আউট হওয়ার মিছিল লেগেছিল যেন।
বল এমন লাফাচ্ছে যে ব্যাটের কোণে লেগে ডিপ থার্ডম্যান আর ফাইন লেগে লোপ্পা-লোপ্পা ক্যাচ উঠে যাচ্ছে!
তবে কি হেরে যাবে? এমনটাই ভেবেছিল কপিল। তার পর মনে পড়েছিল কিছু দিন আগের ওই বেনসন অ্যান্ড হেজেস টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালটার কথা। নিউজ়িল্যান্ডের রিচার্ড হ্যাডলির বোলিং-এর বিরুদ্ধে কপিলদেবের নট আউট থেকে করা চুয়ান্ন রানকে। বল লাফাচ্ছিল। সুইং হচ্ছিল। কপিল শুধু স্টান্স বদলে চেস্ট অন করে নিয়েছিলেন কিছুটা। ব্যস!
এখানেও কপিল তা-ই করেছে। আর ফলও পেয়েছে হাতেনাতে। বল তো নয়, যেন পালবাড়ির রথের মেলার বেলুন। উড়ে-উড়ে গিয়েছে আকাশে! আর এই শেষ ওভারের শেষ বলে একটা শুধু ছয় লাগবে এখন।
যে ছেলেটা বল করছে, তাতে এই কাজটা খুব একটা সমস্যার হবে না, জানে কপিল।
ও দূরে শামিয়ানার দিকে তাকাল। সোনালিকা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কপিল ভাবল, ছয়টা মেরে ও সোনালিকাকে দেখাবে ‘কোকিল’ আর কপিলের পার্থক্য! ওকে ‘না’ বলেছিল না!
ছেলেটা বল হাতে দৌড় শুরু করল। চোয়াল শক্ত করে ব্যাটটা ক্রিজ় থেকে সামান্য তুলে দাঁড়াল কপিল।
ডেলিভারির পরে ড্রপ খেল মাটিতে, তার পর বুক সমান উচ্চতায় কোনাকুনি ছিটকে এল ওর দিকে। নিমেষে সামান্য কোমর ঘোরাল কপিল, তার পর নটরাজের ভঙ্গিতে স্কোয়্যার অব দ্য উইকেট পুল করল বলটাকে।
হলুদ বলটা আকাশে উঠে গেল। সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে। নন-স্ট্রাইকার বলাই রান নেওয়ার জন্য দৌড়লেও কপিল দৌড়ল না। তাকিয়ে রইল বলের দিকে।
বলটা ভেসে যাচ্ছে বাউন্ডারি লাইনের দিকে। একটা ছেলে ক্যাচ ধরবে বলে পিছনে-পিছনে দৌড়চ্ছে। বলটা নেমে আসছে এ বার। ছেলেটা বাউন্ডারি লাইনের সামনে হাত দু’টো জড়ো করে বাটির মতো করে রেখেছে।
বলটা নেমে আসছে। ক্যাচ হবে, না কি সোনালিকা ‘হ্যাঁ’ বলবে? চোয়াল শক্ত করে সেই দিকে তাকিয়ে রয়েছে কপিল।
বলটা আরও নামল। সবাই দাঁড়িয়ে উঠল উত্তেজনায়। বাউন্ডারি লাইনের দিকে ফিল্ডারটা এক পা সরল। আরও নামল বল।
ছয় হবে, না ক্যাচ? বোঝা যাচ্ছে না। বলটা নেমে এল একদম। ফিল্ডারটা বাড়াল হাত! সবাই চেঁচিয়ে উঠল কী-হয় কী-হয় উত্তেজনায়! কপিলের বুকের মধ্যে দু’হাজার বাইসন দৌড়ে মাটি ফাটিয়ে দিল যেন।
আর হঠাৎ দপ করে সারা মাঠের ছ’টা বড় হ্যালোজেনের আলো নিভে গেল এক সঙ্গে!
পঁয়ত্রিশ বছর পরে
বাড়ির পথটা আজ খুব লম্বা মনে হল প্রদীপের। দূরে আলোয় ঝলমল করছে নেমন্তন্ন বাড়ি। কানেকশনের যে গোলমালটা হয়েছিল, সেটা মিনিট দশেক লেগেছে ঠিক করতে। তার পর আবার আলোয় ভরে গিয়েছে বাড়ি।
প্রদীপ দু’টো ছেলেকে রেখে এসেছে সব দেখাশোনা করার জন্য। ও নিজে থাকতে পারেনি। ওকে বাড়ি যেতে হবে।
কপিল বার বার বলছিল থেকে যেতে। বলছিল, বৈশাখীর কথায় যেন কিছু মনে না করে। রেগে গেলে বৈশাখীর মাথার ঠিক থাকে না।
এটা কি জানে না কপিল! বৈশাখীকে কি ও আজ থেকে দেখছে! সেই ছোট থেকেই তো বৈশাখী রাগী আর একটু পাগলি! ঠিক ভুল বিচার না করেই, যা খুশি বায়না করে! যা মনে আসে বলে দেয়! সোনালিকাকেও তো ছাড়েনি!
প্রদীপের এখনও মনে আছে সে দিনের কথা। মনে আছে, সেই ম্যাচে কোনও ফয়সালা হয়নি। এমন সময় আলোগুলো নিভে গিয়েছিল যে, বলটা ছয় হয়েছে না ক্যাচ, বোঝা যায়নি একটুও।
আলো ফেরার পরে ‘আমরা সবাই’ দাবি করেছিল তারা ক্যাচ ধরেছে, আর কপিলের টিম বলেছিল ওটা ছয় হয়েছে! এক জন বলেছিল, শেষ বলটা আবার হোক। কিন্তু দু’দলের কেউ মানেনি। কারণ দু’দলই দাবি করেছিল তারা জিতেছে! ফলে মারামারিও হয়েছিল বেশ। এমএলএ সাহেব তত ক্ষণে এসে গিয়েছিলেন মাঠে। তাঁর কথায় পুলিশ এসে ব্যাপারটা সামলায়।
তার পর বিপদে পড়েছিল প্রদীপ। কারণ আলোর দায়িত্বে ছিল ও। সবাই ঘিরে ধরেছিল একেবারে। কী ভাবে নিভল আলো? কেন নিভল! বাজে আলো কেন দিয়েছে! ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রদীপ চড়-চাপড়ও খেয়েছিল ভালই! পুলিশ এসে না বাঁচালে সে দিন হাসপাতালে যেতে হত ওকে।
পরের দিন সোনালিকার কাছে গিয়েছিল কপিল। প্রদীপ যেতে চায়নি। তাও ওকেও নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে।
না, সোনালিকা মোটেও কপিলের ‘অফার’-এ রাজি হয়নি! বরং বলেছিল, ‘‘জিততে তো পারোনি, আবার মুখ তুলে এসেছ ও-সব আজেবাজে অফার নিয়ে!’’
প্রদীপের ভাবলে হাসি পায়, এখন যাকে সবাই প্রোপোজ় করা বলে, সে সময় সবাই তাকে ‘অফার’ করা বলত!
কপিল বলেছিল, ‘‘ওটা ছয় হয়েছে। আলো থাকলে দেখতে পেতে। প্রদীপকে জিজ্ঞেস করো!’’
‘‘অপোনেন্ট তো বলছে ওরা ক্যাচ ধরেছিল! তুমি আউট হয়েছ! আর প্রদীপ! ওর জন্যই তো সব গোলমাল হল! আমার নাক কাটা গেল! তোমাদের লজ্জা নেই!’’ সোনালিকা ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল।
ঠিক তখনই সবাইকে অবাক করে রুখে দাঁড়িয়েছিল সোনালিকার পাশে থাকা বৈশাখী।
কপিলের পক্ষ নিয়ে বৈশাখী বলেছিল, ‘‘ওকে অমন করে বলছিস কেন? কিসের এত দেমাক তোর? করেছিস তো ফালতু একটা ছবি। তোর মা, বাবা আর বাড়ির কাজের লোক ছাড়া কেউ দেখেনি! সেখানে এত বড়-বড় কথা বলিস কেন? কপিল প্লেয়ার। জানিস কত স্ট্রাগল করতে হয়? বাপের চালকল থাকলে সেই পয়সায় নায়িকা হওয়া যায়, কিন্তু প্লেয়ার হওয়া যায় না, বুঝেছিস! ফালতু কথা আর-এক বার বললে না... দেখিস কী করি!’’
সোনালিকা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘‘তোকে তো বলিনি! তোর কী!’’
বৈশাখী রাগে মুখ-চোখ লাল করে বলেছিল, ‘‘আমার কী মানে? আমি কপিলকে ভালবাসি, তাই! ওকে বললে আমার খারাপ লাগে। রাগ হয়। ভালবাসা বুঝিস?’’
প্রদীপ বাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। বড় বাড়িটায় ও আর ভানু নামে কাজের ছেলেটা ছাড়া আর কেউ থাকে না।
ও ধীরে-ধীরে দোতলায় উঠল। ক্লান্ত লাগছে। পঁয়ত্রিশ বছর কোথা দিয়ে যে বেরিয়ে গেল! চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় এই তো সে দিনের ব্যাপার!
সে দিন বৈশাখী অমন কথা বলায় কপিল কী যে অবাক হয়েছিল! তবে ভালও লেগেছিল কপিলের।
দু’দিন পরে বৈশাখীর বাড়ি আর কপিলের বাড়ির লোকদের সেই বৈশাখেই ওদের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে একমত হতে সময় লেগেছিল মোটে দেড় ঘণ্টা!
বৌভাতের দিন সবার আড়ালে কপিল বলেছিল, ‘‘প্রদীপ, কেসটা ভাব! বৈশাখী আমায় ভালবাসে! কেউ জানত না পর্যন্ত!’’
প্রদীপ দোতলার বারান্দায় বসল। সামনে বড় পুকুর। হাওয়া আসছে বেশ। ও হাসল নিজের মনে। ভাবল, জানত! প্রদীপ তো জানত!
আর কাউকে বলেনি বৈশাখী। শুধু প্রদীপকে বলেছিল। সেই ছোট থেকে প্রদীপই তো ওর একমাত্র বন্ধু। বৈশাখী সব বলত প্রদীপকে। ওর যত আবদার, বায়না, বকুনি, সব ছিল প্রদীপের উপর। ‘কিরণ ইলেকট্রিক’-এর এক ফালি দোকানের ছোট্ট টুলে বসে মাথা নিচু করে শুনত প্রদীপ।
বৈশাখী বলত, কপিলকে খুব ভালবাসে ও। বলত, কপিলের প্র্যাকটিসে যাওয়ার পথে বৈশাখী দাঁড়িয়ে থাকে ওকে দেখবে বলে। সরস্বতী পুজোয় বাসন্তী শাড়ি পরে, কপিল ওকে দেখবে বলে। কিন্তু কপিল ওর দিকে তাকায় না বলে মনখারাপ
করত বৈশাখী।
আর ম্যাচের দিন তো একেবারে কাঁদতে-কাঁদতে এসে বসে পড়েছিল প্রদীপের সামনে মাটিতে! বলেছিল, ‘‘তুমি কিছু করো। কপিল আজ ম্যাচ জিতিয়ে দিলেই সোনালিকা ওর সঙ্গে প্রেম করবে! তুমি এটা আটকাও। কপিলকে বলো কিছু, না হলে... না হলে...’’
‘‘কিন্তু, আমি কী করব!’’ প্রদীপ বুঝতে পারেনি।
‘‘আমি জানি না। কিছু তোমায় করতেই হবে। না হলে দেখো আমি কী করি! দেখো, আমি মরে যাব!’’ চোখে জল নিয়েও তেজের গলায় প্রদীপের হাত চেপে ধরেছিল বৈশাখী।
কী করবে প্রদীপ! কী করতে পারে! কপিলকে বলবে? কিন্তু কপিল মানবে কেন? তা হলে? তা হলে কী করবে? কী করে এটা আটকাবে ও? বৈশাখী এমন অবুঝ কেন? দিশেহারা লেগেছিল কপিলের।
শেষ বলটা কপিল মেরেছিল জোরে। বলটা সোজা উঠে গিয়েছিল আকাশে। ছয় হবে না আউট? মাঠের সবাই উঠে দাঁড়িয়েছিল উত্তেজনায়! আর তখনই মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল আইডিয়া।
সবার অলক্ষে, ইলেকট্রিকের সুইচ আর তারের পাশে বসে প্রদীপ ভেবেছিল, এই তো সুযোগ! ভেবেছিল, যদি ম্যাচের কোনও ফলাফল না হয়,
তা হলে? বৈশাখীর ছলছলে চোখদু’টো ভেসে উঠেছিল সামনে।
প্রদীপের হাতের কাছেই ছিল মাঠের আলোগুলোর মেন সুইচের বড় লিভার। বলটা যখন প্রায় বাউন্ডারি লাইনের কাছে নেমে আসছে, ও চোখ বন্ধ করে টেনে দিয়েছিল লিভারটা। তার পর আন্দাজে ছিঁড়ে দিয়েছিল তার। ব্যস, সারা মাঠ অন্ধকার!
কিন্তু কেন? কেন বৈশাখীর কথা শুনেছিল ও? কেন ওর কাছেই সব বায়না করত বৈশাখী? আর ও-ই বা মানত কেন অন্যায় সব আবদার? কেন আজও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পায়, বাসন্তী শাড়ি পরা মেয়েটার সেই হাসি!
প্রদীপ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হাসল নিজের মনে। বৈশাখী হাওয়ায় কাঁচাপাকা চুল এলোমেলো হচ্ছে ওর। দূরে কোথাও আলতো স্বরে বাজছে রবি ঠাকুর। ও জানে, আজীবন জ্বলতে হবে ওকে। ও প্রদীপ যে! ঠাকুমার রাখা নাম, বিফলে যাবে না। ও জানে, এই গল্পে কপিলদেবই নায়ক। এবং ও কেবলই আর এক জন মাত্র। আর কেউ নয়।