ছবি: পিয়ালী বালা
দুম করে যে এমন বিপাকে পড়ে যাবেন, ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি ননীগোপাল আইচ। বছরের শুরু থেকেই জমছিল আশঙ্কার মেঘ। তার পর ফেব্রুয়ারি মাসটাও কেটে গেল। কল্পনাতেও আসেনি যে, মার্চের ২৪ তারিখ থেকে পুরো লকডাউন শুরু হয়ে যাবে টানা তিন সপ্তাহের জন্যে।
দমদমের এই আবাসনে ফ্ল্যাট কিনে ননীগোপাল আছেন তিরিশ বছর। পরিপূর্ণ সংসার। স্ত্রী বাসবী আর দুই ছেলেকে নিয়ে সুখে দুঃখে কোথা দিয়ে যে পেরিয়ে গিয়েছে সময়। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ২০০৬-এ। তার পরের বছরেই ছোট ছেলে ক্যাম্পাস-ইন্টারভিউ দিয়ে সফল হয়ে চলে গেল হায়দরাবাদের এক নামী প্রাইভেট কোম্পানিতে। লোভনীয় প্যাকেজ। আর পিছন ফিরে তাকাতে হল না, তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল শিখরে। বছর তিনেক পরেই বিয়ে... এখন বৌ আর মেয়ে নিয়ে প্যারিসে।
বড় ছেলেও ইঞ্জিনিয়ার। নিজের শহরে তারও চাকরি জোটেনি। বেঙ্গালুরু আর দিল্লিতে পাঁচ-ছ’বছর কাটিয়ে এখন সে মুম্বইয়ের স্থায়ী বাসিন্দা। যমজ ছেলে-মেয়ের বাবা।
বহু দিন ধরেই বড় ছেলের কাছে যাব যাব করছিলেন বাসবী। শেষমেশ মাত্র দশ দিনের জন্য মুম্বইয়ে আদরের নাতি-নাতনিদের সঙ্গে কাটিয়ে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফ্লাইট ধরেছিলেন উনিশ তারিখ। ফেরার টিকিট উনত্রিশের বিকেলে।
কিন্তু এখন কী হবে? ভাবতে গিয়ে চোখে অন্ধকার দেখেন ননীগোপাল। কাজের মেয়ে জপা-র ভরসায় তাঁকে রেখে গিয়েছেন বাসবী। জপা বহু দিনের চেনাজানা আর বিশ্বস্ত। কিন্তু সে মাঝের দুটো পাড়া টপকে প্রায় দু’কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে আবাসনে আসবে কেমন করে! চিন্তায় রাতের খাওয়াটাও প্রায় বরবাদ হয়ে গেল ননীগোপালের। টিভি বন্ধ করে জপাকে ফোন করলেন তিনি। সে-ও নিশ্চয়ই এত ক্ষণে খবরটা জেনে ফেলেছে। প্রথম দু’বার রিং হল না, তৃতীয় বার শোনা গেল পরিষেবা সীমার বাইরে। কী আশ্চর্য! ননীগোপাল বাসবীকে ফোন করলেন। দু’-তিন বার রিং হওয়ার পরই অন্য প্রান্ত থেকে বাসবীর উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “কী গো? কী করছ এখন তুমি? খবর শুনেছ তো?”
খেপে উঠতে গিয়েও অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করে ইস্পাতকঠিন কণ্ঠে বললেন ননীগোপাল, “সব কিছু ঘটল শুধুমাত্র তোমার জেদ আর বায়নাক্কার জন্যেই...”
“মানে? আমার জন্যে দেশ জুড়ে লকডাউন হল? আশ্চর্য! তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?”
ধৈর্য হারালেন ননীগোপাল, “ন্যাকামি কোরো না বাসবী! তুমি ঠিকই বুঝেছ, কী বলতে চাইছি আমি... কত বার বারণ করেছিলাম যেতে? মনে নেই, বলেছিলাম, মাসকয়েক পরেই দুগ্গাপুজোর সময় তো আসবে ওরা সবাই মিলে... তখন দেখতে পাবে নাতি-নাতনিকে...বলিনি? কানেই নিলে না তুমি! তোমার কি উচিত হয়েছে, আমাকে জপার ভরসায় রেখে দিয়ে এ ভাবে পড়িমরি মুম্বইয়ে ছোটা?”
“আগেও তো হয়েছে! না কি এ বারই প্রথম হল? তা ছাড়া, উল্টোটাও তো ঘটেছে... ঘটেনি? তুমি জপার ভরসায় আমাকে রেখে তিন দিনের সাহিত্য-সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লি গিয়েছ! গত বছরেই তো...”
“ঝগড়া থামাবে, না কি ফোনটা কেটে দেব?” আক্রমণের ধরন বদলান ননীগোপাল।
“বলো, কেন ফোন করেছ?” সংযত মোলায়েম কণ্ঠে জানতে চাইলেন বাসবী।
“হওয়ার আর কী বাকি আছে! তুমি ফিরে আসা অবধি আমি টিকে থাকব কি না, সেটাই ভাবছি।”
“মানে?”
“মানে, লকডাউনের মধ্যে অটো-টোটো সব বন্ধ, জপা হয়তো আসতেই পারবে না! তা ছাড়া, আরও একটা খবর ইচ্ছে করেই তোমাকে বলিনি গতকাল, দোতলার নমিতার করোনা পজ়িটিভ হওয়ার পর ওদের ফ্যামিলির বাকি সদস্যদের হোম-কোয়রান্টিনে রেখেছে। শুনছি, শিগগিরই নিয়ে যাবে নিউটাউনের কোয়ারান্টিন সেন্টারে। আর আমাদের আবাসন থেকে কাউকে বাইরে বেরোতে দেবে না, বাইরের কাউকে ঢুকতেও দেবে না!... আমি তো না খেতে পেয়েই...”
“এত অস্থির হয়ো না গো, একটা না একটা ব্যবস্থা তো করবে সরকার...” গলা তবু কেঁপে গেল বাসবীর। তার পর, নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন, “এমন অবস্থা তো তোমার একার নয়, অন্যরাও তো আছে আবাসনে...”
“রাখো এখন... একটা ফোন আসছে। পরে কথা হবে...” কানেকশন কেটে দিলেন ননীগোপাল। হ্যাঁ, ঠিকই ভেবেছেন। জপার মিস্ড কল। রিংব্যাক করতেই জপা অন্য প্রান্ত থেকে বলে ওঠে, “কাকু, আমি অন্য ঘরে ছিলাম বলে শুনতে পাইনি, কেন ফোন করেছিলে বলো।”
“তুই খবর শুনিসনি? কাল থেকে তো লকডাউন, মানে সব কিছু বন্ধ...”
“টোটো-অটো চলবে না, তাই তো? আমি হেঁটেই চলে যাব তোমার ফেলাটে, তুমি একদম কিছু ভেবো না তো কাকু!”
“আচ্ছা, পরশু নমিতার করোনা ধরা পড়ার পর তুই যখন কাল আর আজ সকালে এলি, তখন গার্ড তোকে কিচ্ছু বলল না?”
“বলেছিল তো... তুমি একা আছ শুনে ঢুকতে দিল আমায়।”
“আসলে লকডাউনের খবর শুনে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছি আমি।”
“কোনও চিন্তা কোরো না কাকু, আমি কাল ভোর-ভোর বেরিয়ে তুমি বিছানা ছেড়ে ওঠার আগেই এসে চা করে দেব। আর হ্যাঁ, কাঁচা শাক-সব্জি-মাছ যা আছে, তাতে তোমার দু’দিন চলে যাবে।”
সকালে ননীগোপালের ঘুম ভাঙল ফোনের সুরেলা রিংটোনের শব্দে। ইচ্ছে করেই রাতে শোওয়ার আগে সুইচড অফ করেননি তিনি।
ফোন ধরতেই অন্য প্রান্ত থেকে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে জপা, “কাকু, আমাকে তো বড় রাস্তায় ওঠার মুখেই আটকে দিয়েছে পুলিশ, কাউকেই পাড়ার বাইরে যেতে দিচ্ছে না!”
“তুই মাস্ক পরিসনি ?”
“পরেছি তো... অনেক করে বুঝিয়ে বললাম তোমার কথা, বললাম— বয়েস হয়েছে, আমি না গেলে রান্না হবে না, খেতে পাবে না মানুষটা... তা বলে কি না, বয়স্ক মানুষের কাছে বাইরে থেকে যাওয়াই তো উচিত নয় কারও, গেলে নাকি তার করোনা হওয়ার ভয় থাকে!”
“তা হলে কী হবে রে জপা?”
“শোনো কাকু, যে ভাবেই হোক, আমি চলে আসব। জপারে আটকাতে পারবে না কেউ। এখন না পারি, সুযোগ পেলেই... শোনো, ফিরিজে রান্না করা ডাল, তরকারি, মাছ আছে। ভাতও এ বেলার মতো আছে তোমার। মেশিনে গরম করে নেবে। বেরেকফাস্টে পাউরুটি-কলা খেয়ে নাও। এখন রাখছি কাকু। ভয় পাবে না কিন্তু একদম!”
ভয় পাবে না বললেই কি আর ভয় চলে যায়? বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা আশঙ্কা হানা দিতে শুরু করল ননীগোপালের মনে। আজকের দিনটা না হয় কোনও রকমে চলে যাবে, কিন্তু কাল কী খাবেন? পরশু? তার পরেও কত কত দিন! অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সাহায্য নেবেন? সবাই তো এখন ভয়ে সিঁটিয়ে আছে, নমিতার করোনা-পজিটিভ হওয়ার খবর জানার পর থেকে। বেরোচ্ছেই না ফ্ল্যাটের বাইরে। ওদের মধ্যে যার সঙ্গে ওঠাবসা আছে তাঁর, সেই হরেনবাবুও তো সিনিয়র সিটিজ়েন। স্বামী-স্ত্রী দুজন। ওঁদের একমাত্র মেয়ে বিয়ের পর এখন দক্ষিণ কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে। ফোন করে হরেনবাবুর সঙ্গে কথা বলার ভাবনা মাথায় আসতেই মনে পড়ে গেল জপার আশ্বাসবাণী, ‘তুমি চিন্তা করবে না কাকু একদম’—তার বরাভয়-কণ্ঠস্বর, ‘যে ভাবেই হোক, আমি চলে আসব।’
জপাকে ফোন করতে গিয়েও ননীগোপাল সংযত করেন নিজেকে। না, আজকের দিনটা তো কেটেই যাবে, কাল ভোরে যদি... তা ছাড়া, চিঁড়ে, মুড়ি, দুধ, দই, সঙ্গে তিন-চার রকমের ফল তো বাড়িতে আছেই।
পরের দিন কাকভোরে উঠে ব্যালকনিতে বসে কেটে গেল কয়েক ঘণ্টা, দূরে আবাসনের প্রবেশদ্বারের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যথা হয়ে গেল ননীগোপালের, কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত অবয়বটি দেখা গেল না।
ঘরে ঢুকে জপাকে ফোন করলেন তিনি। সুইচ্ড অফ। শরীর খারাপ লাগছিল অনেক ক্ষণ থেকেই। এ বার অবসাদে শয্যা নিলেন অসময়ে।
এ দিকে সময়মতো নিজের মোবাইলে চার্জ না দেওয়ায়, সেটি যে অকেজো হয়েছে, সে খেয়ালও রইল না ননীগোপালের। এমনটা হতেই পারে, বয়েস তো কম হল না, সত্তর পেরিয়েছে গত আশ্বিনে।
সাড়ে দশটায় উঠে রান্নাঘরে ঢুকে বয়াম খুলে দুটো বিস্কুট খেলেন তিনি। চা করতে পারেন অতি কষ্টে... ইচ্ছে করল না, জল খেয়ে গলা ভেজালেন।
দুপুরে চিঁড়ে ভিজিয়ে দই আর কলা মেখে ফলাহার সেরে যখন বেডরুমের শয্যায় আবার আশ্রয় নিলেন ননীগোপাল, তখন তিনি ভেঙে পড়েছেন পুরোপুরি।
গভীর অবসাদে তলিয়ে যাওয়ার পর কখন যে ছোটবেলার মতো ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি এসে তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে গেল, তা তিনি টেরই পেলেন না। ঘুম ভাঙল নরম হাতের মৃদু ছোঁয়ায়, “কাকু, আমি এসে গিয়েছি, আর চিন্তা নেই তোমার।”
তড়িঘড়ি উঠে বসতে গেলেন ননীগোপাল। তাঁকে দু’হাত দিয়ে ধরে আবার শুইয়ে দিল জপা, “তুমি চুপচাপ শোও দিকিনি, আমি চায়ের জল চাপিয়ে দিয়েছি। আর এখন তো নয়, আমি এসেছি অনেক ক্ষণ আগে, সন্ধে নামার পরেই। আমার কাছে থাকা তোমার ফেলাটের চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখি, অঘোরে ঘুমিয়ে আছ তুমি। তাই না ডেকে রাতের জন্যে ভাত চাপিয়ে তরকারি কুটে...”
“তুই আবাসনে ঢুকলি কী করে?” বিস্ময় কাটেনি ননীগোপালের।
মুচকি হেসে জপা বলল, “আবাসন তো পরের কথা, পুলিশের চোখ এড়িয়ে পাড়া থেকে বেরোলাম ঘুরপথে অনেক গলি-ঘুঁজি পার হয়ে...আর আবাসনের গেটের কাছে না গিয়ে আমি পাঁচিলের যে জায়গায় ইট খসে গিয়ে বড়সড় খোঁদল হয়েছে একটা, সেই খোঁদলের মধ্য দিয়ে অতিকষ্টে শরীর গলিয়ে...”
“বলিস কী! আটকে যেতিস যদি! তা ছাড়া... ছড়ে-টড়ে যায়নি তো?”
“না গো কাকু, না! বলেছিলাম না, জপারে আটকানোর সাধ্যি কারও নেই!” জপার মুখে কার্যসিদ্ধির হাসি।
ননীগোপাল ধীরেসুস্থে উঠে বসে অপার বিস্ময়ে চেয়ে থাকেন জপার মুখের দিকে।
‘‘কী দেখছ তুমি অমন করে, আমার মুখের পানে চেয়ে?”
“তুই তো যে-সে মেয়ে নয়... কিন্তু রোজ রোজ তো আর এ ভাবে আসতে পারবি না!”
“দরকারও নেই পারার।”
“মানে ?”
“আমি তো চট করে বাড়ি ফিরে যাব না!” জপার সাফ জবাব।
“কিন্তু তোর মা আর ছেলে? তাদের কী হবে?”
“আমার স্বামী যে দিন থেকে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, সে দিন থেকেই মা-ই দেখছে ছেলেকে। ও আমার মা-র কাছেই বেশি ভাল থাকে। আর মাকে আমি বেশ ক’দিন চলার মতো চাল-ডাল-তেল-নুন-আলু-আনাজ কিনে দিয়ে এসেছি।”
অজান্তেই ননীগোপাল হাত বাড়িয়ে জপার মাথায় বুলিয়ে দিলেন স্নেহের পরশ। তাঁর মনে হল, জপা নয়, তিনি চেয়ে আছেন তাঁর কোনও এক ফেলে আসা জন্মের আত্মজার মুখের দিকে।