ছবি: তারকনাথ মুখোপাধ্যায়
দিন কয়েক ধরে উত্তপ্ত হল্টনগঞ্জ। নির্জন রাস্তাঘাট, স্তব্ধ জনজীবন। আধা সামরিক বাহিনীর কয়েক জন টহলরত জওয়ান ছাড়া স্থানীয়দের তেমন নজরে আসছে না। যে দু’-চারটে দোকানপাট আছে, সেগুলোরও ঝাঁপ ফেলা। তিন কামরার একমাত্র প্রাথমিক স্কুলটাও খাঁ খাঁ করছে। লেখাপড়ার আগ্রহে না হলেও অন্তত মিড-ডে মিলের আকর্ষণে যে কচিকাঁচাগুলো ভিড় জমাত, তারাও নিজেদের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বেরোয়নি। দীর্ঘ চোদ্দো দিন পর আজ কার্ফু তুলেছে প্রশাসন। কিন্তু গ্রামের পরিবেশ এখনও একই রকম থমথমে।
হল্টনগঞ্জে এমন ঘটনা এই প্রথম। আগে কখনও এমন সর্বনেশে কাণ্ড ঘটেনি। আগেও বহুবার দুর্যোগ এসেছে গ্রামে। সবই প্রায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তখন সকলে মিলে একত্রে মোকাবিলা করেছে। কিন্তু এবারের ঘটনা একেবারেই অনভিপ্রেত। এতদিন ধরে একসঙ্গে থাকা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বেধে গেল প্রবল দাঙ্গা। হঠাৎ পরস্পরের বিরুদ্ধে মারমুখী হয়ে উঠল গ্রামবাসী। ফলস্বরূপ বাড়িঘরে আগুন, লাঠালাঠি, বোমাবাজি, রক্তারক্তি কিছুই বাদ রইল না। এর পর দু’-দুটো লাশ পড়ার পর প্রশাসনের টনক নড়ল। পুলিশে, জওয়ানে ছেয়ে গেল গ্রাম। বিরতি ঘটল হানাহানির। কিন্তু এই বিরতিও কতটা স্থায়ী, বলা মুশকিল। পরস্পরের প্রতি রাগে, ঘৃণায়, বিদ্বেষে ফুঁসছে দুই গোষ্ঠী। আবার কোনও নেপথ্যচারী চাবি ঘুরিয়ে দিলেই হয়তো চালু হয়ে উঠবে দাঙ্গার কল। শান্ত গ্রাম অস্থির হয়ে উঠবে পুনরায়।
নামে গঞ্জ থাকলেও হল্টনগঞ্জ আদতে একটা হদ্দ গ্রাম। এতটাই প্রত্যন্ত যে, কাছাকাছি শহরটায় যেতে-আসতেও আধবেলা লেগে যায়। বিচ্ছিন্ন বলেই হয়তো সরকারি সুযোগ-সুবিধে, বিবিধ ঘোষণা, প্রকল্পের প্রসাদ এখানে বিশেষ পৌঁছয় না। কিংবা হয়তো পৌঁছনোর আগেই পথভ্রষ্ট হয়। কারণ যা-ই হোক, সরকারি ঔদার্য থেকে এই গ্রাম বরাবরই বঞ্চিত। বছরের পর বছর যায়, পঞ্চায়েত থেকে রাজ্যে, রাজ্য থেকে কেন্দ্রে, মসনদে মসনদে সরকার বদলায়, কিন্তু হল্টনগঞ্জ যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই পড়ে থাকে। কখনও খরায় শুকিয়ে মরে, তো কখনও বন্যায় খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। অতিবৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টির সঙ্গে নিত্য লড়াই করে বেঁচে আছে এখানকার মানুষজন। দিনের বেলায় বাঁচার লড়াই, অন্ধকার নামলে ক্লান্তির ঘুম, এই তো এখানকার মানুষের যাপনচিত্র। এই চিত্রে বৈচিত্র নেই, রং, মশলা নেই, বিকোবার মতো মুখরোচক খাবার, তথা খবর নেই। ফলে মিডিয়ার কাছেও হল্টনগঞ্জ তেমন গুরুত্ব পায় না।
কিন্তু এতে যদি ভাবা হয়, এ গ্রামের কোনও দাম নেই, তা হলে ভুল হবে। এখানে আর কিছু না থাক, জনসংখ্যা বড়াই করার মতো। তা-ও আবার ক্রমবর্ধমান। মাথা গুনলে ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে খনিবিশেষ। ফলে বহু দিন অগোচরে থাকলেও এবারে নির্বাচনের শুরুতেই নেতৃবর্গের নজর পড়ল এখানে। তারা মহা সমারোহে আসতে লাগল। সঙ্গে নিয়ে এল ঝুলিভরা শতসহস্র প্রতিশ্রুতি। ভাষণ দিল, স্বপ্ন দেখাল, গ্রামবাসীকে আশার জোয়ারে ভাসাল। সেই কয়েকদিন গ্রামে যেন উৎসব লেগে রইল। সভা, সমিতি, মিছিল, মাইকে তারস্বরে গান, স্টেজে নাচ, পান-খাওয়া, এলাহি ব্যাপার-স্যাপার। কেউ চিকেন বিরিয়ানি খাওয়াল, কেউ গরমেও কম্বল বিতরণ করল, কেউ আবার হরির লুটের বাতাসার মতো কড়কড়ে নোট উড়িয়ে দিল হল্টনগঞ্জের বাতাসে। যে যত লাফাতে পারল, সে তত পকেটে পুরল।
নিত্যকার থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড় জীবনে আলাদা বাতাস লাগায় গ্রামবাসীও মহা উৎসাহে মেতে উঠেছিল। এখানের মানুষজন শহুরে ইন্টেলেকচুয়ালদের মতো চৌখস নয়। এরা ক্যাপিটালিজ়ম, সোশ্যালিজ়ম, গ্লোবাল ইকোনমির মতো কঠিন কঠিন শব্দ জীবনেও শোনেনি। তাদের কাছে গড়িয়া বা বেনিয়াটোলার সঙ্গে সিরিয়া বা ভেনিজুয়েলার খুব বেশি তফাত নেই। অবশ্য এর বেশি জানার দরকারই বা কী? খেয়েপরে টিকে থাকা
আর সামান্য নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি পেলেই তারা বর্তে যায়। চাহিদা বলতে এটুকুই।
কিন্তু নির্বাচন বলে কথা! দেশসেবায় ব্রতী নেতাদের অভাব নেই। অভাব নেই দলেরও। ডান-বাম-রাম-রহিম-জনদরদি সবাই। সবাই প্রতিশ্রুতি ঝরাল, মসনদে বসলে হল্টনগঞ্জের হুলিয়াই বদলে দেবে। হাইওয়ে পর্যন্ত রাস্তা হবে, সবার থাকার জন্যে পাকা ঘর হবে, হাসপাতাল, স্কুল, সিনেমাহল হবে, বেকার ছেলেদের কাজ মিলবে, আরও কত কী। প্রতিশ্রুতিগুলো প্রায় একই হলেও তাদের সবার আলাদা আলাদা দল, আলাদা আলাদা চিহ্ন, বিবিধ পতাকার রং। অশিক্ষিত গেঁয়ো মানুষগুলো বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। কোন মিছিলে যোগ দেবে, কার সভায় ভিড় বাড়াবে, কোন চিহ্নের পতাকা বইবে, ভেবে থই পায় না। ঠিক এমনই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে বেধে গেল এই দাঙ্গা। যদিও ব্যাপারটা একেবারেই আকস্মিক। এর জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিল না। তবুও এড়ানো গেল না। ঘটনা ঘটে গেল, আর সবাই এতে জড়িয়েও পড়ল।
দাঙ্গার উৎস অদ্ভুত। বুড়োশিবতলায় যে দুর্গামন্দিরটা আছে, এটাই গাঁয়ের একমাত্র মন্দির। প্রতি বছর এখানেই গাঁয়ের একমাত্র দুর্গাপুজোটি হয়। পুজোর পরে দেবীমূর্তির বিসর্জন না করে তাঁকে মন্দিরেই রেখে দেওয়া হয়। ভাসান যায় আগের বছরের মূর্তি। শরতের এই পুজোকে কেন্দ্র করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সারা গ্রাম উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে। মন্দিরের সামনে মস্ত মাঠ জুড়ে মেলা বসে। রাত জেগে যাত্রা হয়। কখনও ঐতিহাসিক পালা তো কখনও পৌরাণিক। রহমত আলি পৌরাণিক পালার পার্মানেন্ট শিব, নিমাই ভট্টের ছেলে পিনাকী একটু মেয়েলি চেহেরার বলে, সে নায়িকার রোল করে। গেল বছর সে নুরজাহান সেজেছিল। রহমত আলি, পিনাকী, যোগেশ, কানাই, আবদুল্লা, ঋষি, কাশিম, মেহের আলি— এরাই যাত্রাপালার মূল কুশীলব। আছে আরও অনেকেই। কিন্তু মূলত এদের উদ্যোগেই পালাগুলো নামে। আর সেই পালা দেখার জন্যে মুখিয়ে থাকে পুরো গ্রাম। পুজোর মাস দুই-তিন আগে থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি। অনেক রাত পর্যন্ত চলে রিহার্সাল। ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যে সারা দিনের কৃচ্ছ্রসাধনের পরও তখন তাদের একটুও ক্লান্তি আসে না। বরং নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় আরও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এ বছরের দুর্গাপুজো আসতে এখনও মাস কয়েক দেরি।
একদিন সকালে দেখা গেল, মন্দিরের মূর্তিটি ভাঙা আর বেলা বাড়ার পর দেখা গেল, মসজিদের সামনে পড়ে আছে ওই ধর্মে নিষিদ্ধ এক প্রাণীর মৃতদেহ। দুই সম্প্রদায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে পাশাপাশি থাকা মানুষজন এত দ্রুত পরস্পরের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারল না। কিন্তু দেখা গেল, এলাকার মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঙ্গার কল গতি তুলে ফেলল। শুরু হয়ে গেল হানাহানি, শক্তির মেরুকরণ। অদৃশ্য রাজনৈতিক ইন্ধনে পুরো গ্রাম ধর্মের নামে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। ভাগ হল ভোটব্যাঙ্ক।
নিরীহ ভাল মানুষ, আজীবন সবার সাহায্যে, বিপদে আপদে ছুটে যাওয়া বৃদ্ধ হারাধন বাগদি এবং কালু শেখের বছর এগারোর নিষ্পাপ বাচ্চা ছেলেটা শিকার হল দাঙ্গার। অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। দু’পক্ষই প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে। অবশেষে প্রশাসনের তৎপরতায় হানাহানির খেলা বন্ধ হয়েছে। তবুও রাগে, ক্ষোভে, শোকে, তাপে, স্বাভাবিক অবস্থায় এখনও ফিরতে পারেনি হল্টনগঞ্জ।
আজ সবে কার্ফু উঠেছে। দিনান্তে পান্তা ফুরনো লোকগুলো কিছুটা হলেও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। ঘরে ঘরে ভাঁড়ার শূন্য। কয়েক দিন অনেক ঘরে একবেলা খাবারও ঠিকমতো জোটেনি। চাষাবাদ ছাড়াও এখানকার অনেকেরই গ্রাসাচ্ছাদন হয় গ্রামের জিনিস শহরের হাটে বিক্রি করে। কেউ ঝুড়ি বোঝাই করে বাগানের ফসল, কলাটা-মুলোটা নিয়ে যায়, তো কেউ গরুর দুধ, কেউ শীতলপাটি, কেউ বাঁশের তৈরি সরঞ্জাম, তো কেউ নিয়ে যায় ফুলঝাড়ুর মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসও। বিবিধ পণ্য নিয়ে ছেলে, বুড়ো, জোয়ান, মর্দ সাতসকালেই রওনা হয় কাছাকাছি হাটের উদ্দেশ্যে।
কিন্তু খুব কাছের হাটও এখান থেকে অনেকটাই দূর। উপরন্তু রাস্তার অবস্থাও ভাল নয়। খেতের উপর দিয়ে আলপথ আর চড়াই-উতরাই বেয়ে সরু মাটির পথই ভরসা। বর্ষায় পায়ে-চলা পথটুকুও জায়গায় জায়গায় জলে ডুবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সেই সময়টা জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। যা-ই হোক, বর্ষা এখনও নামেনি। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি। মাথার উপর গনগনে রোদ নিয়েই যে যার মতো রওনা হয়েছিল কাছাকাছি হাটগুলোর উদ্দেশ্যে।
তালতলার হাট যখন ভাঙল, সুয্যিদেব পশ্চিমে হেলে পড়েছেন। তবু তাপের প্রকোপ কমেনি। বিকিকিনি সেরে ফেরার সময় প্রায় এক সঙ্গেই রওনা হয়েছিল দিনু মহন্ত আর সিরাজুল। ফেরার পথে দিনুর বাঁকের ঝুড়ি দুটোই খালি। কোঁচড় ভরা টাকা। যা শাকসবজি সে নিয়ে গিয়েছিল, সবই বিকিয়ে এসেছে। হালকা চালে হেঁটে আসছিল সে। তার কিছুটা আগে সাইকেলে দু’খানা পেটফোলা বস্তা চাপিয়ে চলছিল সিরাজুল। অন্য সময় হলে, দু’জনে হয়তো এক সঙ্গেই গল্প করতে করতে যেত। কিন্তু দাঙ্গার পরে দুই ধর্মের মানুষদের সম্পর্কে চিড় ধরেছে বিস্তর। তাই এমন তফাতে চলা।
সাইকেল থাকলেও এ রাস্তা সাইকেলে বসে চালানোর মতো নয়। শুধু মাল বইতেই সাইকেল নিয়েছে সিরাজুল। সিরাজুল শিল্পী মানুষ। পাটের দড়ি দিয়ে অপূর্ব সব পাপোশ, ব্যাগ, আসন, মাদুর আরও কত কী বানায়। এ সব জিনিস শহুরে শৌখিন লোকেরা ব্যবহার করে। ফলে লাভ ভালই হয়। কিন্তু আজকে ওর বোঝা
দেখে মনে হচ্ছে, বিক্রিবাটা মোটেই তেমন হয়নি। দু’টো বস্তাই এখনও মালপত্রে ঠাসা।
বাড়ি ফেরার তাড়ায় দ্রুত পা ফেলে এগোচ্ছিল দিনু। হঠাৎ মনে হল, সিরাজুলের মালবোঝাই সাইকেলটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে টলে উঠল। পরমুহূর্তেই ওর চোখের সামনেই সাইকেলসমেত রাস্তার পাশে লুটিয়ে পড়ল সিরাজুল। দিনু হতবাক। এর পরেও নিস্পৃহ থাকা কঠিন। দিনু ছুটে গেল সেখানে। মাটিতে বেকায়দায় পড়ে আছে সিরাজুল। ওর উপর বস্তাসমেত সাইকেল। দিনু সাইকেলটা টেনে তুলতেই, সিরাজুল কোনও রকমে উঠে দাঁড়াল। লুঙ্গির খুঁট দিয়ে কপালের ঘাম মুছে অপ্রস্তুত স্বরে বলে, “বেসামাল হয়ে গেসলাম...”
সিরাজুলের মলিন মুখটা দেখে দিনুর খারাপ লাগল। ছেলেটার কি শরীর ঠিক নেই? কোমরে বাঁধা ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে সিরাজুলের দিকে বাড়িয়ে দিল সে। সিরাজুল জলটা না নিয়ে ম্লান হেসে বলল, “রোজা চলছে রে দিনুদাদা।”
ওহো, ওদের যে রমজান মাস চলছে, সে তো দিনুর খেয়ালই ছিল না। তা হলে বেচারা উপোস করে আছে! বোঝাই যাচ্ছে সারা দিন হাটে বসেও ব্যবসা কিছুই হয়নি ওর। কোনও কোনও দিন এমন মন্দা যায় বটে। যা পণ্য নিয়ে গিয়েছিল, সবই প্রায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দিনশেষে গভীর ক্লান্তি ও খিদে তেষ্টা নিয়ে সাইকেলটা কোনও রকমে টেনে চলছিল সে। সেই দুর্বলতা হেতুই হয়তো পড়ে গিয়েছিল। মনটা আরও একটু খারাপ হয়ে গেল দিনুর।
দু’জনেই আবার চলা শুরু করলেও সিরাজুল খুব ধীরে এগোচ্ছিল। টলমল করছিল ওর বোঝা বোঝাই সাইকেল। কিছু দূর এগিয়ে ছায়াঘেরা পিপুল গাছটার নীচে এসে দাঁড়িয়ে গেল সে। তার পর দিনুকে বলল, “তুই এগো দিনুদাদা। আমি একটু বিরাম নিয়ে তার পর যাই। অনেক দিন পরে বেরোলাম তো, শরীরে আর দিচ্ছে না।”
দিনু দেখল, সাইকেলটা সত্যি আর বইতে পারছে না সিরাজুল। খুব মায়া হল ওর। সিরাজুল ওর চেয়ে বয়সে খানিক ছোট। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে এক সঙ্গে বড় হয়েছে। মাঠেঘাটে খেলেছে। সিরাজুলের বিয়েতে কতই না আনন্দ করেছিল সবাই। গেল বর্ষায় যখন দিনুর ছেলেটার ঘোর জ্বর হল, শহরের হাসপাতালে ভর্তি করতে হল তাকে, তখন পাড়ার আশুতোষ আর সিরাজুলই তো ওর সঙ্গে ছায়ার মতো থেকে সাহায্য করেছে। সেই সিরাজুলকে এখন একা ফেলে যেতে মন চাইছিল না দিনুর। বলল, “এখনই তো আজানের সুর শোনা যাবে রে সিরাজুল। তোকেও তো ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। এক কাজ কর, আমার ঝুড়ি দুটো তোর বস্তার উপরে বেঁধে দে। আমি তোর সাইকেল টেনে নিয়ে যাচ্ছি। তুই ঝাড়া হাত-পায় আমার পিছে পিছে চল।”
অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায় সিরাজুল, “তুই পারবি, দিনুদাদা?”
“পারব না কেন? দুপুরে তো পেট ভরে চিঁড়ে-বাতাসা খেয়েছি। তা ছাড়া আর কতটাই বা পথ? ঠিক টেনে নিয়ে যাব।” আশ্বস্ত করে দিনু।
কৃতজ্ঞতায় আকণ্ঠ ভরে উঠেছে সিরাজুল, “তোর উপকার ভুলব না
রে দিনুদাদা। শরীরে আর সত্যি দিচ্ছিল না।”
“দাদা বলে ডাকিস, আবার উপকারের কথা বলছিস? তোর আমার সম্পর্ক কি আজকের? এটুকু তোর জন্যে করতে পারি না?”
হাসে সিরাজুল। কথা বাড়ায় না।
সাইকেল নিয়ে রওনা হয়েছে দিনু। পিছন পিছন হেঁটে আসছে সিরাজুল। হাঁটতে হাঁটতে সুখ-দুঃখের গল্প জুড়েছে। আধঘণ্টার পথ নিমেষেই ফুরিয়ে এল। গ্রামে পৌঁছে গেল ওরা। বুড়োশিবতলা থেকে দু’জনের পথ আলাদা হয়ে গেছে। এখানেই সিরাজুলকে সাইকেল ফিরিয়ে দিয়ে নিজের ঝুড়িদুটো নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল দিনু। সিরাজুল পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, “বাড়ির সকলকে নিয়ে ইদে আসিস দিনুদাদা। দাওয়াত রইল।”
দিনু হাত নেড়ে জবাব দিল, “নিশ্চয়ই যাব। বিরিয়ানি আর সেমুই খাওয়াবি তো?”
দিনের আলো ফুরিয়ে একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসছে চরাচরে। কিন্তু এই অন্ধকারকে উপেক্ষা করেই একটা আশার আলো স্বপ্ন-জ্যোৎস্নার মতো ক্রমশ ছেয়ে যাচ্ছে গ্রামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। আর, এই আলোআঁধারির মাঝেই সাইকেল নিয়ে সিরাজুল এবং ঝুড়ি হাতে দিনু একে অপরের দৃষ্টিসীমা থেকে ক্রমশ অস্পষ্ট হতে হতে মিলিয়ে গেল হল্টনগঞ্জের পরিবেশে।