ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক
সে দিন থলে হাতে বাজারে গিয়ে এক অদ্ভুত ধন্দে পড়লেন মিহিরবাবু। মাছের বাজারে তখন থিকথিকে ভিড়। ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে পরখ করছিলেন কী কেনা যায়, পাবদা না চিংড়ি। ঠিক তখনই দোকানদার পিন্টু জিজ্ঞেস করল, ‘‘কাল এলেন না যে! ভাল পার্শে এসেছিল। ফ্রেশ একেবারে।’’ জনস্রোতের তরঙ্গ থেকে নিজেকে কোনও ভাবে বাঁচিয়ে মিহিরবাবু ভুরু কুঁচকে জবাব দেন, ‘‘অ্যাঁ? বলিস কী? কাল তো তোর এখান থেকেই মাছের ডিম নিয়ে গেলাম! কই, পার্শে দেখিনি তো!’’
‘‘এই দেখুন স্যর, আপনারও তা হলে ডেট গুলোচ্ছে। আমার বাবারও গোলায় খুব। আড়াইশো মতো ডিম তো কিনলেন গত পরশু!’’
আর কথা বাড়ালেন না মিহিরবাবু, ‘‘ও হ্যাঁ, তাই তো...’’ ইত্যাদি বলে কৃত্রিম দেঁতো হাসি হেসে ভাবনার ঘুরপাক মাথায় নিয়ে সোজা বাড়ির পথ ধরলেন। এক প্যাকেট কর্নফ্লেক্স, দুশো মিষ্টি দই কেনার কথা ভুলে গেলেন, ভজুয়ার চায়ের দোকানের সামনে শুয়ে থাকা কুকুরের লেজ মাড়িয়ে কামড় খেতে খেতে বাঁচলেন, ফাঁকা গলির রাস্তার মাঝে চটের ফিতেকে সাপ ভেবে মৃদু আর্তনাদ করে ছিটকে দূরে সরে গিয়ে ইতিউতি চেয়ে খানিক হাঁপালেন আর সব শেষে যখন বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দরজার গ্রিলে বুড়ো আঙুলে জোর খোঁচা লাগল, তখন বাজারের ব্যাগ ধাঁই করে নীচে ফেলে আঙুল চেপে দাঁড়িয়ে ‘‘ধুর শালা!’’ বলেই ফেললেন।
সুরমা, মিহিরবাবুর স্ত্রী, তখন সদ্য স্নান সেরে বেরিয়ে ঠাকুরঘরে পুজোর আয়োজন করছেন। ব্যস্ত গলায় জানালেন, ‘‘মাছটা আলাদা করে রেখো আর বাকি জিনিসগুলো ঠিক জায়গায় গুছিয়ে দাও।’’
কথাগুলো অনর্থক বলা। মিহিরবাবু রোজই এই কাজ পরিপাটি করে সেরে রাখেন। তবুও তিনি শোনেন। প্রতিবাদ করেন না।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে মিহিরবাবু দেখলেন, ছেলে বিল্টু রোজকার মতো ঘুমোচ্ছে। এতটুকু হাঁকডাক করলেন না। চুপ করে ব্যালকনিতে চেয়ার পেতে বসলেন। রোদ-ঝলমলে দিন।
ঝিরঝির করে হাওয়া বইছে। ব্যালকনির গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছের পাতা গলে সকালের নরম রোদ চুঁইয়ে পড়ছে। অন্য দিন হলে এইটুকু দৃশ্য দেখেই মিহিরবাবুর মুখে হাসি ফুটে উঠত। গেয়ে উঠতেন কোনও রবীন্দ্রসঙ্গীত। কিন্তু আজ তিনি ভীষণই আনমনা। বাজার সেরে আসার পথে মাথা খুঁড়েও বের করতে পারেননি, গত কাল সারা দিন ধরে তিনি ঠিক কী কী কাজ করেছেন। যত বারই মনে করার চেষ্টা করছেন, ঠিক তত বার গত পরশুর কথাগুলো মাথায় ঘাই মারছে।
আচ্ছা, এ রকমও হয় বুঝি? গোটা এক দিনের কথা কেউ বেমালুম ভুলে যেতে পারে! যেন ‘গত কাল’ বলে তাঁর জীবনে কিছুই ছিল না! পরশু সন্ধেয় অফিস থেকে বেরিয়ে অটো ধরার পর যেন আজ সকালে জেগে উঠলেন। অথচ বাজারে যাওয়ার আগে পর্যন্ত কিছু বুঝতেও পারেননি। বাড়ির কেউ কিছুই বলেনি। শরীরেও কোনও রকম অস্বস্তি নেই। মানে, গায়ে-হাতে-পায়ে ব্যথা-ট্যথা বা সে রকম কিছুই নেই! অবাক কাণ্ড বটে! সুরমাকে জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু সে তিলকে এমন ভাবে তাল করে ফেলবে যে, ডাক্তার-নার্সিংহোম ছুটতে হবে।
‘‘তুমি আজকেও ভুলে গেলে! কর্নফ্লেক্সটা আনার কথা পইপই করে মনে করালাম যে!’’ সুরমার অভিযোগে আজ মিহিরবাবু কর্ণপাত করলেন না। ‘‘হুম...’’ বলে পাশের ঘরে চলে গেলেন। গম্ভীর মুখে সুরমা রান্নাঘরে ঢুকলেন।
রবিবার। হাতে কাজও নেই। অন্য দিন হলে মিহিরবাবু পাশের পাড়ার অবিনাশের বাড়ি যেতেন আড্ডা দিতে। আজ একেবারে ইচ্ছে করছে না। আনমনা হয়ে এ ঘর-ও ঘর পায়চারি করছেন কেবল।
‘‘কী হয়েছে বলো তো! তখন থেকে ডেকে যাচ্ছি! সাড়া দিচ্ছ না কেন?’’ কোমরে আঁচল গুঁজে চোখ বড় বড় করে সুরমার জিজ্ঞাসা।
ঘাবড়ে গেলেন মিহিরবাবু। এমনিতেই তিনি তাঁর স্ত্রীকে একটু সমঝে চলেন। আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন, ‘‘কই কি... কিছু না তো! ওই শেভিং ক্রিমটা খুঁজছি, কিন্তু পাচ্ছি না। তাই।’’
‘‘শেভিং ক্রিমটা তোমায় দেখছে। বাঁ দিকে টেবিলের উপরে দেখো।’’
‘‘যাহ! এক্কেবারে খেয়াল করিনি! দেখেছ কাণ্ড!’’ একটা তেতো হাসি হেসে বাঁ হাত দিয়ে ঝপ করে ক্রিমের টিউব তুলে নিয়ে মিহিরবাবু পাশের ঘরে হনহন করে ঢুকে গেলেন।
‘‘কী জানি বাপু কী হয়েছে! শরীর-টরির খারাপ লাগছে কি না সেও তো বলে না। যা থাকে কপালে তা-ই হবে। আমি তো আর...’’ সুরমার গজগজানি ডালে ফোড়ন দেওয়ার আওয়াজে মিলিয়ে গেল।
দাড়ি কাটার ইচ্ছে তেমন ছিল না। তবু আজ কাটতেই হবে। না হলে আর-এক দফা নাটক শুরু হবে, অগত্যা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একমনে গালে ব্রাশ ঘষছিলেন মিহিরবাবু। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল। রোজ রাতেই তিনি এক-দু’পাতা ডায়েরি লিখে থাকেন। বিশেষ কিছু না। দৈনন্দিন টুকিটাকি। ভাবামাত্র ঝটপট দাড়ি কেটে তাড়াহুড়ো করে বইয়ের তাক থেকে বাদামি রঙের ডায়েরি নামালেন। কিন্তু পাতা উল্টে শেষ দিনের তারিখ দেখে গভীর হতাশ হলেন তিনি। শেষ দু’দিনের লেখা মিসিং। মানে দু’দিন ডায়েরি লেখেননি। বিরক্তি আর বিস্বাদে সারা শরীর-মন ভরে উঠল।
এমন ঘটনা আগে কোনও দিন ঘটেনি। তা হলে বয়স বাড়ছে বলে কি আস্তে আস্তে সব স্মৃতি মুছে যাবে? গত কালের ঘটনাও ভুলে যাবেন? কই গত পরশু, তার আগের দিন... সে সব তো দিব্যি মনে আছে। শুধু কালকের কোনও কিছুই মনে পড়ছে না! কাল ছিল শনিবার। মানে অফিস ছুটি। ঘুম থেকে উঠে বাজারে যাননি। সেটা আজ বাজারে পিন্টুর কথা শুনে বুঝতে পেরেছেন। তার পর? কোথায় যেন পড়েছিলেন ‘সিলেক্টিভ ডিমেনশিয়া’-র কথা। এও কি সে রকম কিছু না কি?
ডায়েরির খোলা পাতার দিকে অপলকে চেয়ে চেয়ে এ সব চিন্তা করছিলেন মিহিরবাবু। হঠাৎ তাঁর মনে হল ১৬ মার্চে লেখা ডায়েরির কথাগুলো তিনি হুবহু এর আগে কোথাও লিখেছেন নিশ্চয়ই। হুবহু মানে এক্কেবারে ফোটোকপি যাকে বলে! প্রবল উত্তেজনায় মিহিরবাবু ঝপাঝপ পাতা ওল্টাতে থাকলেন। এলোমেলো শব্দ, ছোট-ছোট বাক্যের স্রোত পড়তে পড়তে মিহিরবাবু এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ডুবে গেলেন। শুধু ১৬ মার্চ নয়, প্রতিদিনকার রোজনামচাই যেন একে অন্যের রেপ্লিকা। সেই এক ছন্দ কিংবা ছন্দহীনতা। ভাষা, ভঙ্গি, শব্দের ওঠাপড়া— সব এক। ঘুম-খাওয়া-অফিস-বাজার— থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়! দিন, মাস, বছর— রোজ এ ভাবেই কেটে যাচ্ছে। কোনও পরিবর্তন নেই, নেই কোনও নতুনত্ব। কিংবা যদি এসেও থাকে, তবুও এতটুকু উপলব্ধি করেছেন কি? আচ্ছা, এর মধ্যে একটা গোটা দিন, ২৪ ঘণ্টা যদি মুছেও যায়, তা হলে কি খুব কিছু আসবে-যাবে?
সত্যি, এর আগে ব্যাপারটা তলিয়ে ভাবা হয়নি তো! এমনিতে মিহিরবাবু চেষ্টা করেন জটিল ভাবনা এড়িয়ে চলতে। তাতে অশান্তি বাড়ে বই কমে না। আজ তাঁর ইচ্ছে করছিল অযথা চিন্তা দূরে সরিয়ে রেখে সংসারের টুকিটাকি কাজে মন দিতে। আবার একটা নিষিদ্ধ নেশার মতো এই জটিল চিন্তার প্যাঁচ বোনার আগ্রহও ছিল সমান। সেই টানেই ফের দোতলার ব্যালকনিতে এসে বসলেন তিনি। রান্নাঘর থেকে খুন্তি নাড়ার শব্দ আর মশলার উগ্র সুবাস ভেসে আসছে। বিল্টু কখন উঠে বেরিয়ে গিয়েছে, টেরও পাননি। ধীরেসুস্থে ইজ়িচেয়ারে গা এলিয়ে মিহিরবাবু চোখ বন্ধ করলেন।
একটা গোটা দিনে তিনি কী কী কাজ করেন— প্রথমে মনে মনে তার একটা নির্ভুল ফর্দ তৈরি করলেন। ভাবতে বসে ভিতরটা ঘুলিয়ে উঠল। মিহিরবাবু অনুভব করলেন, বহু বছর ধরে তিনি কিছু নির্দিষ্ট কাজের অনুকরণ করে চলেছেন মাত্র! জীবনে কোনও পাপ নেই, পুণ্য নেই, ক্ষয় নেই, অর্জন নেই। নিজের ভিতরে কোনও ভাঙন নেই। সেই একই গড়ন রয়ে গিয়েছে কত দিন হল! অথচ চারপাশ কত বদলে গিয়েছে, যাচ্ছে। দুনিয়া থেমে নেই, সময় থেমে নেই। কিন্তু সুরক্ষিত গর্তে বেঁচে সুখলাভের বাসনা তাঁকে টেনেও তোলেনি, নীচেও নামায়নি। সত্যি, তিনি জীবনে কত দিন কোনও ছোটখাটো পাপ করেননি!
মিহিরবাবু ভিতরে ভিতরে অনুভব করেন, তিনি বরাবরই স্বভাবভীরু, খানিক দুর্বলচিত্ত। তবে এ সবের মূলে হচ্ছে ওই— নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে চাওয়া। ধরা যাক, অফিসে টেবিল চাপড়ে রাজনৈতিক তরজা চলছে। যে-যার মতো করে নিজেদের পছন্দের রাজনৈতিক দলের স্বপক্ষে কথা বলছে। মিহিরবাবু কিন্তু সেখানে নিশ্চুপ। এমন নয় যে, তাঁর নিজস্ব কোনও রাজনৈতিক বক্তব্য নেই। সেই বিতর্কে তিনিও যোগ দিতে পারেন। কিন্তু অযথা কুযুক্তি, কটু কথা শুনে মানসিক সুস্থিতি নষ্ট হবে— এ কথা ভেবে মুখ বুজে থাকেন। তাই যখন অফিসের নিতাই মালাকার— ‘‘কী মিহিরদা, চুপ যে? টুকটুকে লাল সুয্যি যে চিরতরে অস্ত যেতে বসেছে। এট্টু মোটিভেশনাল টক-ফক ছাড়ুন। ললিত, শুভাশিসদের মতো ইয়ং কমরেডদের উদ্বুদ্ধ করুন!’’— বলে খোঁচা মারে, তখন তিনি এতটুকু উত্তেজিত না হয়ে নম্র ভঙ্গিতে একটা কি দু’টো বাক্যে নিজের মতামত দেন। এইটুকুই।
ইজ়িচেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে মিহিরবাবু স্মৃতি হাতড়ে দেখলেন, এক সময় তাঁর নিজের একটা জগৎ ছিল। তিনি নিজে ছেলেবেলায়, এমনকি কলেজ জীবনেও ছবি মন্দ আঁকতেন না। এ দিক-ও দিক ছবির প্রদর্শনীর খবর পেলে ছুটে যেতেন। বই পড়াটাও একটা নেশার মতো ছিল। কবিতা লিখতেন। খুব ভাল না হলেও, লিখতেন। বন্ধুদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বই পড়ার চল ছিল। বিয়ের পরে সুরমাকে নিয়ে কলেজ স্ট্রিটে বই কিনতে গিয়েছেন। আগ্রহের বিষয় নিয়ে সেমিনার হচ্ছে শুনলে অফিস থেকে আগে বেরিয়ে সেখানে গিয়েছেন। ট্রামে চড়ে ফেরার পথে সুরমার সঙ্গে তর্ক বা আলোচনা জুড়েছেন। জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না তেমন, কিন্তু নুনে-ভাতে চলে যেত দিব্যি।
তখন দিনের একটা মানে ছিল। কোনও দিনই তাঁকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়নি। আজ একটা গোটা দিনের হিসেব ভুলে গিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু বহু বছর ধরে একটার পর একটা দিন, কত শতসহস্র মুহূর্ত তিনি তৈরি করতে ভুলে গিয়েছেন কিংবা তৈরি হলেও তাদের দিকে ফিরেও তাকাননি— এর হিসেব তো কোথাও লেখা নেই!
মন্থর পায়ে, ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন মিহিরবাবু। খোঁপা-বাঁধা চুলে সুরমা গুনগুন করে গাইছেন, ‘কঠিন মাটি মনকে আজি দেয় না বাধা।/ সে কোন্ সুরে সাধা...’’ এক বার গলাখাঁকারি দিয়ে চুপ করলেন মিহিরবাবু।
‘‘কী হল? ওর’ম করে দাঁড়িয়ে কেন?’’ বাটনা-বাটা থামিয়ে সপ্রশ্ন চাহনি সুরমার।
‘‘বিশ্ব বলে মনের কথা, কাজ পড়ে আজ থাকে থাক না...’’ প্রাণ খুলে হাসিমুখে এক কলি গেয়ে উঠলেন মিহিরবাবু।
‘‘কী ব্যাপার খুলে বলো দেখি! হয়েছেটা কী?’’ সুরমা যেন ইচ্ছে করে হাসি চেপে রইলেন।
অনেক কিছু বলতে পারতেন মিহিরবাবু। গভীর অবসাদে সুরমাকে জড়িয়েও ধরতে পারতেন। কিন্তু তখন তাঁর মন বলছিল— থাকুক, একটু দূরত্ব থাকুক!
‘‘অ্যাকাডেমিতে নান্দীকারের নতুন নাটক এসেছে। বহু দিন হল-এ বসে নাটক, ফিল্ম কিছু দেখিনি। আজ রবিবার। চলো না, বিকেলে নাটক দেখে ময়দানে এক চক্কর হেঁটে আসি!’’
হাসি আর লুকোতে পারলেন না সুরমা। মুখে হাত দিয়ে এক ঝলক হেসে বলে উঠলেন, ‘‘তা, এই প্রোপোজ়ালটা দিতেই সকাল থেকে ভয় পাচ্ছিলে বুঝি!’’
‘‘ধরে নাও তাই!’’ তিন পা এগিয়ে সুরমাকে গভীর আবেশে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন মিহিরবাবু। না, আজকের দিনটা চুরি যাবে না। এর পর কোনও দিন চুরি যাবে না আর। কোনও দিন নয়।
মিহিরবাবুর বাহুবন্ধন আরও দৃঢ় হল। ব্যালকনিতে জাফরি-কাটা রোদের নকশা দুলে উঠল।