মায়া প্রপঞ্চময়

কিছুটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই অন্নু রিমোটের রেকর্ড বাটনে চাপ দেয়। কথাগুলো কানে যাচ্ছে কিন্তু মাথায় ঢুকছে না।

Advertisement

কানাইলাল ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০০
Share:

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

পূর্বানুবৃত্তি: সুরাটের নামকরা হিরের কারবারি মনপ্রীত সিংহের স্ত্রী অন্নু মধ্য-পঞ্চাশেও নজরকাড়া সুন্দরী। কর্পোরেট পার্টিতে মক্ষিরানি হয়ে সকলের অনুরাগ ও ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনি উপভোগ করতে সে অভ্যস্ত। তবু হালকা নেশার ঘোরে আজও তার মনে পড়ে তীব্র ভর্ৎসনাপূর্ণ দু’টি চোখ। ত্রিশতম বিবাহবার্ষিকীর পরদিন টিভি খুলেই বিহ্বল হয়ে গেল অন্নু। ত্রিশ বছর আগের সেই কোঁকড়ানো চুল, লম্বাটে মুখ, শ্যামলা, বছর তেইশ-চব্বিশের সেই ছেলেটির সঙ্গে টিভির পর্দার চওড়া কপাল, ভারী চেহারার প্রৌঢ়টিকে মেলানো শক্ত। তবু অন্নুর মন বলছে এই-ই সে। তার কণ্ঠস্বর আজও তার বুকে কাঁপন ধরায়।

Advertisement

কিছুটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই অন্নু রিমোটের রেকর্ড বাটনে চাপ দেয়। কথাগুলো কানে যাচ্ছে কিন্তু মাথায় ঢুকছে না। যথেষ্ট দামি এই বিদেশি টিভিটায় সহজেই প্রোগ্রাম রেকর্ডিং-এর সুবিধে আছে বলেই প্রীত এই মডেলটা সিলেক্ট করেছে। এখনও অন্নুর কান-মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করছে, তাই সব কথার মানে ওর কাছে স্পষ্ট হচ্ছে না। রেকর্ড করা থাকলে পরে ধীরে-সুস্থে শোনা যাবে।

মনের ভিতরে ভেসে আসছে একই কণ্ঠস্বরে ত্রিশ বছর আগে বলা কথাগুলো, ‘‘জানো তো, পাখিদের সব ডিম থেকে বাচ্চা জন্মায় না। কিছু-কিছু ডিমের খোলা বেশি শক্ত হয়, বাচ্চা পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পর সে তার নরম ঠোঁট দিয়ে ভিতর থেকে ঠোক্কর দিয়ে খোলা ফাটিয়ে যেমন বেরিয়ে আসতে চায়, তেমনি তা দিতে থাকা মা-ও বাইরে থেকে তাকে সাহায্য করে। সেই দরকারি সাহায্যটুকু না পেলে বাচ্চাটির দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু নিশ্চিত। আমাদের এই অদ্ভুত সম্পর্কও পরিণতি পেতে চেয়েছে, কিন্তু তুমি লোকলজ্জা আর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভেবে মনের সেই জোর আনতে পারোনি। হয়তো চেষ্টাও করোনি। আমিও জোর পাইনি কারণ, নৈতিকতা আর মূল্যবোধের প্রশ্নে আমার বিবেক সায় দেয়নি। জানি আমাদের জীবন এর পর অপূর্ণই থেকে যাবে, তুমি স্বীকার করো বা না করো।’’

Advertisement

ওর নিজের দুর্বলকণ্ঠে বলা কথাগুলোও মনে পড়ে, ‘‘আমরা তো ভাল বন্ধু হিসেবেও আমাদের সম্পর্ক ধরে রাখতে পারি? এক সঙ্গে থাকার ভাললাগাটুকু তো তুমিও অস্বীকার করতে পারো না!’’ উত্তর এসেছিল, ‘‘আমরা দু’জনেই যদি ছেলে কিংবা মেয়ে হতাম, তা হলে হয়তো আজীবন বন্ধুত্ব রাখায় অসুবিধে ছিল না। কিন্তু তুমি ভাল করেই জানো, আমাদের সম্পর্কটা ঠিক ‘রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম’ হিসেবে নেই। কাছাকাছি আসতে, ঘনিষ্ঠ হতে আমাদের দু’জনেরই অসম্ভব ভাল লাগে। এই ভাল লাগাটাই আমার চোখে ভালবাসা হিসেবে সম্পূর্ণতা পেত, যদি তুমি সব পিছুটান কাটিয়ে উঠতে পারতে। তুমি শ্যাম আর কুল, দুটোই রাখতে চেয়েছ। আমি কিন্তু তা চাইনি। আমি ভুল খবর জেনেছিলাম যে, তোমার আগের সম্পর্কে ব্রেক-আপ হয়ে গিয়েছে। আমার সঙ্গে তোমার ব্যবহারেও সে কথাই মনে হয়েছিল। যাক, এখন আর এ সব... ’’

একটা বিষয় অন্নুর কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। ওর এত হিতৈষী, প্রিয় বান্ধবী অপালা তা হলে এত জোর দিয়ে, এতটা নিশ্চয়তার সঙ্গে ওকে কনভিন্স করিয়েছিল কী করে! আর কেনই বা? অন্নু ভাল ভাবেই জানে, অপালা বুদ্ধিবৃত্তির চেয়ে আবেগ আর হুজুগে বেশি চলে। কলেজে পরিচিত হওয়ার পর থেকে ওরা পরস্পরের লোকাল আর লিগ্যাল গার্জেনের ভূমিকা নিয়েছে।

অন্নুর চরম পাগলামির দিনগুলোতেও অপালা পুরো বিষয়টা বুঝে উঠতে পারেনি, তা সত্ত্বেও স্রেফ মেয়েলি সহজাত প্রবৃত্তি থেকে অনুমান করে ওকে পইপই করে বুঝিয়েছে, ‘‘ভেবে দ্যাখ, অনামি, বোকা বা পাগল, ওই ছেলেটাকে যা-ই বলিস, আমি তোকে বলছি, এই ধরনের ছেলেরা মিচকে শয়তান। তুই ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস, এর জন্যে এক দিন তুই পস্তাবি! তোর এমন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, প্রীতের মতো এমন স্মার্ট, হ্যান্ডসাম আর পয়সাওয়ালা ছেলের সঙ্গে তোর এত দিনের সম্পর্ক নষ্ট করে দেবে ওই ভ্যাগাবন্ডটা! আমার কথা শোন, এক দিন কোনও একটা ইস্যুতে ওকে পাবলিকলি একটা চড় কষিয়ে দে, যেমন আগেও তুই কয়েক জনকে করেছিস...’’

নিজের এত দিনের ইমেজের বাইরে গিয়ে অন্নু অপালাকে বলে উঠতে পারেনি যে, চড় মারা তো দূরের কথা, ওই হাড়হাভাতে, ঝলঝলে-মার্কা ছেলেটাই বরং ওর সামগ্রিক অস্তিত্ব সমূলে নাড়িয়ে দিয়েছে। ঘাটে-ঘাটে নৌকো বেয়ে বেড়ানো মাঝির মতো ভবঘুরে ওর মনটা এত দিনে এমন এক জনকে খুঁজে পেয়েছে যাকে পিতা-বন্ধু-স্বামী-সন্তান সব রকম ভাবে ও কল্পনা করতে পেরেছে। সে সামনে এসে দাঁড়ালেই ফণা-তোলা সাপের মতো উদ্ধত, ছটফটে, বিশ্বসংসারকে ছোবল মারতে উদ্যত ওর মনটা অকারণেই যেন নত হয়ে যেত।

ছেলেটা বলেছিল, ‘‘এর নাম মেন্টাল রেজ়োন্যান্স, বাংলায় বলতে পারো মানসিক অনুরণন। ফিজ়িক্স প্র্যাকটিক্যালের টিউনিং ফর্ক নিয়ে পরীক্ষার মতো। হয়তো আমাদের মেন্টাল টিউনিং এক রকম, কয়েক হাজারে এ রকম একটা রিলেশন তৈরি হয়।’’ কে জানে কেন, ওরও ভাল লাগত ছেলেটার কথায় প্রভাবিত হতে। অন্য কেউ অনেক চেষ্টা করেও ওকে যা বোঝাতে পারত না, ছেলেটার অল্প কথাতেই সে রকম কিছুতে সায় দিতে ওর দ্বিধা হত না।

নিজের কাছেও ও ধরা পড়ে গিয়েছিল যে, প্রীতের সঙ্গে ওর দীর্ঘ প্রেমের সম্পর্কে কোথায় যেন চিড় ধরেছে আর সেই ফাটল দিয়ে এই বাচাল, দুর্বিনীত ছেলেটা— যাকে ওরা মেয়েমহলে ‘শুকদেব’ বলে ডাকে ওর মহিলাসংস্রব এড়িয়ে চলার জন্যে— ওর মনের অনেকখানি অধিকার করে বসেছে৷

এক দুপুরবেলায় দেখা করার দিন হঠাৎ ভাল লাগায় তার মুখে দেখা গিয়েছিল রক্তোচ্ছ্বাস। ছেলেটা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘তোমার মুখ এত লাল কেন ? শরীর খারাপ?’’ মনের ভাব চাপা দেওয়ার জন্য মুখঝামটা দিয়ে উঠেছিল ও, ‘‘এত চড়া রোদ, ফর্সা মুখ লাল হবে না তো কি তোমার মতো বেগুনি হবে?’’ উত্তর পেয়েছিল, ‘‘বুঝলাম, এই রোদে তিন কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে আমি এলাম আর তুমি ছায়ায় বসে ছিলে। তাতেই বড্ড রোদ লেগে গিয়েছে, তাই না?’’ ওকে আরও রাঙিয়ে দিল কথাগুলো। বুঝতে পারল, শয়তানটার কাছে ওর মনের দুর্বলতা গোপন রইল না।

ও নিজে বিশ্বাস করার আর অন্যদের বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছে যে, ছেলেটাই ওর পিছু-পিছু ঘোরে, কিন্তু সত্যি ঘটনাটা হল, ওর নিজের মনই ওই রকম একটা আপাতরুক্ষ, অহংসর্বস্ব অথচ অসহায় মানুষের পাশে-পাশে ঘুরে বেড়িয়েছে। শুধু একটা রহস্য ভেদ করার জন্যে, কিসের জোরে ওই ধরনের একটা সাদামাটা, হতদরিদ্র ছেলে ওর মতো এক জন সর্বজনকাম্য, সুন্দরী, ব্যক্তিত্বময়ীকে অবহেলা আর অস্বীকার করতে পারে? এত কিসের অহঙ্কার ওই রকম একটা অ্যাভারেজ কমন ম্যানের?

জানতে গিয়ে ওকেও যেমন অনেক দাম দিতে হয়েছে, অন্যপক্ষের ক্ষয়ক্ষতিও কিছু কম হয়নি। সেইজন্যই বোধ হয় ওর জীবন থেকে সরে যাওয়ার আগে ছেলেটা বলেছিল, ‘‘পরস্পরকে ভুলতে পারব আমরা, এমনটা মনে হয় না। আমি ভুলতে পারব না কারণ অনেক সাবধানতা নিয়েও আমি কেমন অদ্ভুত ভাবে হেরে গেলাম, আর তুমি ভুলতে পারবে না কারণ তুমি যা-যা চেয়েছিলে সব পাওয়ার পরও কোথায় যেন এমন কিছু হারিয়ে ফেললে, যা সারা জীবনেও আর পাবে না। ঠিকই আছে, ভালবাসায় না হলেও ঘৃণায় হয়তো আমরা একে অপরকে স্মরণ করেই যাব, আজ থেকে একে অপরের কাছে মৃত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও!’’

সত্যিই মৃতের তালিকায় নাম তো উঠেই গিয়েছিল ছেলেটার। আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে। দিনটা ওর মনে আছে বিশেষ কারণে। একত্রিশে মার্চ, পরের দিনই ওদের বিয়ের রজত জয়ন্তী উদ্‌যাপন। হঠাৎ করেই ফোনটা বেজে উঠেছিল, তখন অন্নু লোকজন নিয়ে ওদের পটনার বাড়িতে ঘর সাজাতে ব্যস্ত। ড্রয়িং রুমের কোণে ফোনটা ঝনঝনিয়ে উঠতে বিরক্ত হয়েই এগিয়ে গিয়ে ধরেছিল ফোনটা। ল্যান্ডলাইনে ফোন শুনেই মনে হয়েছিল অপালা হতে পারে।

অপালা পারতপক্ষে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না বাড়িতে থাকলে। যাকে করে তারও ল্যান্ডফোনেই আগে চেষ্টা করে। রাস্তায় বেরলে বাধ্য হয়ে মোবাইল ব্যবহার করে, তবে কান থেকে এক হাত দূরত্বে ফোন রাখে বলে কারও কথা ও ভাল করে শুনতে পায় না, আর ওর কথাও অন্যপক্ষ বুঝতে পারে না। ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে শুধু। অপালার মতে, মোবাইলের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ এক বার কানের মধ্যে দিয়ে মাথায় ঢুকলেই বড়-বড় ব্রেন টিউমার গজিয়ে যাবে। এ রকম অনেক বাতিক আছে ওর।

‘‘হ্যালো’’ বলতেই অপালার কাংস্য-কণ্ঠ বেজে ওঠে, ‘‘শোন অনামি, তোর জন্যে দারুণ খবর! আগে বল, কী খাওয়াবি। জানিস তো, সদ্য শুগার ধরা পড়েছে আমার, মিষ্টি একদম বারণ। তবে যা-ই বলিস, একটা স্পেশাল ট্রিট...’’

কিছুটা বিরক্ত, কিছুটা কৌতুহলী অন্নু ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছিল, ‘‘ভণিতা না করে সরাসরি বলতে পারিস না? অনেক কাজ পড়ে আছে। এক দিন বাদে ম্যারেজ অ্যানিভার্সারির সিলভার জুবিলি। বাই দ্য ওয়ে, তুই কি আসতে পারবি অত দূর থেকে?’’ অপালা বলেছিল, ‘‘নোপ, যেতে পারছি না রে! তবে তোর গিফ্‌টটা এখনই দিয়ে দিচ্ছি, যাতে তুই প্রীতের সঙ্গে খোলা মনে সেলিব্রেট করতে পারিস তোদের ‘মেমোরেবল ডে’-টাকে। শোন তবে, এত দিনে তোর জীবনের শনি নিপাত হয়েছে... মারা গিয়েছে বদমাশটা!’’

অজানা আশঙ্কায় শিরশির করে ওঠে অনামিকার শরীর, ‘‘কে রে, কার কথা বলছিস তুই? আমার শনি আবার কে?’’ খোঁচা দেয় অপালা, ‘‘আহা, নেকু আমার! আমার কাছে যতই লুকোবার চেষ্টা করিস, মানিকচাঁদকে তুই একেবারে ভুলে গিয়েছিস, এটা আমায় বিশ্বাস করতে বলিস? আর কেউ না জানলেও আমি জানি, অনেক দূর এগিয়েছিলি তোরা! যাতে প্রীত একেবারে উল্লু না বনে যায় সে জন্যে তোকে অত পাহারা দিতাম! জানিস তো, শরীর নিয়ে আমারই যত ছুঁতমার্গ! যাকগে, মানিকের কথা যদি একেবারে ভুলে গিয়ে থাকিস তো ভালই, ঝুটমুট খুঁচিয়ে ঘা করার...’’ তত ক্ষণে পাশের সোফায় এলিয়ে পড়েছে অনামিকা, এক সঙ্গে দু’-দু’টো শব্দভেদী বাণ ছেড়েছে অপালা। এক তো ওর সেই সময়ের পাগলামির প্রধান সাক্ষী সরাসরি মুখ খুলেছে। তার চেয়েও বড় কথা, মানিকের মৃত্যু-সংবাদ শুনিয়েছে। মানিক যতই ওকে অপমান করুক, মানিকের মৃত্যু ও কখনওই কামনা করেনি। তবু ওর পুরনো দুর্বলতা নিয়ে অপালা ঠাট্টা করছে হয়তো, এই ক্ষীণ আশা নিয়ে ও প্রশ্ন করে, ‘‘কেন, কী হয়েছে মানিকের? কোথা থেকে কী যে আজেবাজে খবর পাস তুই...’’

ঘনিষ্ঠতম এই বান্ধবীর কাছেও এই একটি বিষয়ে অনেক কিছুই লুকিয়েছে সে। ও যেমন মানিকের সঙ্গে ওর অদ্ভুত অথচ গোপনীয় সম্পর্কের কথা এক সময় লুকিয়েছে, আবার তেমনই এটাও বলে উঠতে পারেনি যে, গত পঁচিশ বছর ধরেই ও আর মানিক পরস্পরের স্মৃতিপটে ঝাপসা, বিবর্ণ, হলদেটে দু’টো ছবি, যার উপরে আজ মাকড়সার জাল আর ধুলো!

দোষ ওর তরফের নয়, অনেক ঝুঁকি আর অসুবিধে থাকা সত্ত্বেও অন্নু ওদের সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল অন্য রকমের সামাজিকতার মোড়কে ঢাকা দিয়ে। কিন্তু একগুঁয়ে শয়তানটা রাজি হয়নি। উল্টে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা শুনিয়েছিল, ‘‘আমারে কোরো না দান তোমার নিজের যাহা নয়। / ধার করা বিত্তে মোর লোভ নাই!/ ...সে ঋণ করিতে শোধ দ্রৌপদীর সবগুলি শাড়ি খুলিয়া ফেলিতে হবে... / ...রহিবে না আর / রহস্যের অতীন্দ্রিয় ইন্দ্রজাল॥’’ তার পরই হাসতে-হাসতে বলেছিল, ‘‘ভয় পেয়ো না, চিন্তাও কোরো না, গরিব হলেও আমি মাথা উঁচু করে চলতে ভালবাসি। তোমার কাছে হাত পাততে আসব না, কিছু পাওয়ার আশায় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলেরও সাহায্য নেব না। আর বাবা-মাকে ভালবাসার টান আমার এতই বেশি যে আত্মহত্যার চিন্তাও মন থেকে তাড়িয়েছি।’’

এক জন শিক্ষিতা, স্বাবলম্বী মেয়ে কী করে বিয়ের পরই অন্যের সম্পত্তি হয়ে যেতে পারে অথবা বিয়ের মতো একটা সামাজিক অনুষ্ঠান কেনই বা স্বামীর হাতে স্ত্রীর ব্যক্তিগত মতামত, সম্পর্ক, ভাল লাগা সব কিছু নিঃশর্তে তুলে দেবে, পুরুষরা কেন এই ধ্যানধারণার বাইরে— এই সব প্রশ্ন অনামিকা তুলেছিল। উত্তর পেয়েছিল, ‘‘বিশ্বাস ভঙ্গ করা না-করা তো নারী-পুরুষ উভয়েরই দায়িত্ব। আর এই প্রশ্নটা আমাকে নয়, মাত্র কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে গিয়ে উদ্দালক ঋষির ছেলে বালক শ্বেতকেতুকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পেতে পারতে।’’

ওর আগ্রহ মেটানোর জন্যে মানিক শুনিয়েছিল বৈদিক যুগের সামাজিক বিবর্তন আর গার্হস্থ্যচেতনার কাহিনি, ‘‘জানো তো, বহুযুগ আগে ভারতে আর্যসভ্যতার সময়েও তোমার ভাবনা অনুযায়ী পারমিসিভ সোসাইটির নিয়ম-কানুন চলত। শুধু পুরুষরা নয়, নারীও তার ইচ্ছেমতো সাময়িক সঙ্গী চয়ন ও পোষণ করতে পারত। এক দিন বালক শ্বেতকেতু যখন তার বাবার কোলে বসে আছে, হঠাৎ দেখল অন্য এক আশ্রমিক ওর মায়ের হাত ধরে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। কোলের শিশুকে ছেড়ে মা অন্য এক জনের সঙ্গে চলে যাচ্ছে, দৃশ্যটা বালকের মনে গভীর দাগ কেটে যায়। শ্বেতকেতুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আর্যদের মধ্যে একগামী বৈবাহিক সম্পর্ক, বিশেষ করে নারীর ক্ষেত্রে, স্থায়ী ভাবে চালু হয় যাতে পুরুষের একপত্নী না হলেও নারীর একপতি কনসেপ্ট সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, অবশ্য দ্রৌপদী বাদে।’’

কয়েক মুহূর্তের চিন্তার জাল ছিন্ন হয়েছিল ফোনের ও-প্রান্ত থেকে আসা খনখনে আওয়াজে, ‘‘ঋভুকে তো জানিস, যেচে লোকের উপকার করে বেড়ানো স্বভাব। মাঝে ওকে ওর কোম্পানির কাজে শিলিগুড়ি যেতে হয়েছিল। সেখানে ওর এক কোলিগ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেই রোগীকে নিয়ে ও সুরলোক নার্সিংহোমে গিয়েছিল। ও-ই দেখেছে ওখানে অ্যাম্বুলেন্স থেকে মানিকের ডেডবডি নামাতে। মুখটা দেখে খটকা লাগতে সঙ্গের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, মানিকই। নর্থবেঙ্গলের জঙ্গলে কাজ করার সময় রোগ ধরা পড়ে, জলপাইগুড়ির নার্সিংহোমে সপ্তাদুয়েক চিকিৎসা চলছিল। অবস্থা খারাপ হওয়ায় ওখান থেকে শিলিগুড়িতে রেফার করেছিল, রাস্তাতেই... হ্যাঁ রে, অনামি, শুনতে পাচ্ছিস তো আমার কথা? হ্যালো... শুনছিস তুই, মানিক মারা গিয়েছে...’’

ক্রমশ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement