ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।
চিরশ্রীর কপালে-ঠোঁটে-চিবুকে-কাঁধে অবিশ্রান্ত চুমু দিচ্ছিল মল্লার। আধবোজা চোখে আরও উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরল চিরশ্রী। মল্লার এখন এক অস্থির ঘাসফড়িং, চিরশ্রীর ঠোঁট বেয়ে গ্রীবা, গ্রীবা পেরিয়ে ধবল জ্যোৎস্নার মাঠে মুখ রাখল সে। তার পর বক্র আলপথ পেরিয়ে ফুলের দুটি স্তবকে পৌঁছল সে, বৃন্তে ঠোঁট রাখতেই কেঁপে উঠল চিরশ্রী। প্রস্ফুটিত চাঁপার স্বাদ ও গন্ধে পাগল হয়ে গেল মল্লার। একে একে সে চিরশ্রীকে উন্মোচিত করল। লাল আভা ফুটে উঠল চিরশ্রীর গালে, আকাঙ্ক্ষার রঙে মেরুন হল তার ঠোঁট, আষ্টেপৃষ্ঠে সে মল্লারকে জড়িয়ে ধরল। যেন এক স্বপ্নের মধ্যে মল্লার দেখল চিরশ্রীর চোখদুটি সমুদ্রসম্ভবা, ইচ্ছায় রক্তিম দু’টি ঠোঁট। তার খুব কাছেই এখন এক আবেগরঙিন মুখ, দুধজ্যোৎস্না মাখানো নিটোল বুক, দুপুরের ছায়াপথের মতো বাহু। চিরশ্রীর কালো চোখদু’টি বুজে এল, ঠোঁট গেল খুলে, বুকের কাছে ঢেউ উঠল।
জীবন, তুমি এই অনুভূতি থেকে কোন অপরাধে আমাকে বঞ্চিত করে রেখেছিলে এত দিন? দাও, দু’হাত উজাড় করে দাও। মল্লার বলতে চাইল। চিরশ্রীর শরীর যেন এখন সিন্থেসাইজ়ারের রিড, যে ভাবে বাজানো হবে, সে ভাবেই বাজবে।
একের পর এক পাপড়ি খুলে নিজেকে মেলে ধরল চিরশ্রী, মল্লার উচ্ছ্বাসে ও আবেগে পাগল হয়ে যাচ্ছিল। গলে গলে যাচ্ছিল সে, চিরশ্রীর শরীরের মধ্যে দিয়ে সে যেতে চাইল এক অন্য জগতে। সেই জগতে দুঃখ নেই, ক্ষোভ নেই, আছে অমলিন আনন্দ, শুধুই আনন্দে ভেসে যাওয়া।
একে অপরের স্পর্শ মাখছিল, শুষে নিচ্ছিল প্রাণরস, আরও ঘন আলিঙ্গনে দু’টি শরীর এক হয়ে মিশে গেল। মল্লার যেন অবগাহন করছিল
ক্রমশ, অনাস্বাদিত রোমাঞ্চে পরিপূর্ণ হতে চাইল তার শরীর।
ঝড় থামতেই চিরশ্রী তার নগ্ন শরীর চাদরে ঢেকে হাসল, “কেমন লাগল?”
“স্বর্গসুখ।”
“প্রথম বার?”
“হ্যাঁ, কত বার বলব তোমাকে? তুমি আমার কৌমার্য হরণ করলে।”
চিরশ্রী মল্লারের গাল টিপে বলল, “তা হলে আমিই তোমার জীবনে প্রথম নারী।”
“হ্যাঁ।”
“তোমাকে আবার সর্বস্ব দিলাম।”
মল্লার ঘোরলাগা গলায় বলল, “কেন যে আমাকেই দিলে! কেউ আমার দিকে এক মিনিটের জন্যও ভালবাসার চোখে তাকায়নি।”
“আমি তো তাকিয়েছি।”
“কী পেলে তুমি আমার মধ্যে?”
চিরশ্রী মৃদুস্বরে বলল, “সমস্ত কিছু ব্যাখ্যা করা যায় ন। আমি তো অসুখী ছিলাম না। হ্যাঁ, ও আমাকে সময় দিত না, বড় একা লাগত। কিন্তু ও কখনও অনাদর করেনি, খারাপ ব্যবহারও করেনি। তুমি আসতেই সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল। ঝড় হয়ে এসে সাজানো বাগান তছনছ করে দিলে। কেন এমন করলে তুমি?”
চিরশ্রীর গলা কান্নায় বুজে এল।
মল্লার তার এলোমেলো চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে বলল, “তুমিই তো বললে যে সব কিছুর ব্যাখ্যা হয় না।”
“কিন্তু আমি তো ওকে ঠকাচ্ছি। এক-এক সময় মনে হয় যে, আমি দু’জনকেই ঠকাচ্ছি। এ রকম তো আমি ছিলাম না। স্কুলে-কলেজে কত মুগ্ধদৃষ্টি দেখেছি, প্রস্তাব পেয়েছি, গুরুত্ব দিইনি। প্রেম আমার কাছে গুরুত্ব পায়নি কখনও। বাবার আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না, তোমার দাদা একটি বিয়েবাড়িতে আমাকে দেখে প্রস্তাব দিতেই এক কথায় রাজি হয়ে গেল। সেই আমি এ রকম হয়ে গেলাম!”
মল্লার উঠে বসে ধারালো গলায় বলল, “তোমার কি গিল্ট-ফিলিং হচ্ছে?”
“না না!”
“হ্যাঁ, হচ্ছে। আমার কারণেই হচ্ছে। তুমিই এগিয়ে এসেছিলে, ডাক তোমার তরফ থেকেই এসেছিল,” মল্লার উঁচু গলায় বলল।
চিরশ্রী মল্লারের ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল, “প্লিজ়, আস্তে বলো। তোমাকে কি আমার শরীর সঁপে দিইনি? এমন বলছ কেন? আমি এক জনের স্ত্রী, বিবাহিত, দ্বিধাদ্বন্দ্ব তো থাকবেই। আমার জায়গায় থাকলে তুমিও এমনটাই ভাবতে। ঝগড়া করে এই মধুর মুহূর্তটা নষ্ট করে দিয়ো না।”
“আমিও তা-ই বলতে চাইছি।”
“তোমার আর বয়স কত? যদিও আমার চেয়ে তুমি তিন বছরের বড়। এত দিন যা পাওনি তা দিতে চেয়েছি তোমাকে। তুমি চেষ্টা করলে অনেক বড় হতে পারবে।”
“তুমি পাশে থাকলে সব পারব।”
“সারা জীবন তোমার পাশে কী ভাবে থাকব? তুমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে, বিয়ে-থা করবে। শুধু আমাকে নিয়ে কি দিন চলবে তোমার? হয়তো আর বেশি দিন এত কাছে থাকতেও পারব না।”
মল্লার অবাক হল, “কেন এমন বলছ?”
“এমনিই।”
“প্রমিতদা কিছু টের পেয়েছে?”
“না। তা হলে আজ এত সাহসী হতে পারতাম না। তোমাকে একটি বার নিজের মতো করে পেতে চেয়েছিলাম। পেলাম। কিন্তু কেন যে ওই গানের লাইনটা মনে পড়ে যাচ্ছে!”
“কোন গান?”
“পেয়ে হারানোর ভয় যে এবার।”
“গানের প্রথম লাইন ‘সুখেও কেঁদে ওঠে মন’। তাই তো?”
“হ্যাঁ।”
মল্লার দীর্ঘশ্বাস চেপে চিরশ্রীকে জড়িয়ে ধরল, “এ রকম বোলো না। একটা খুব প্রাইভেট কথা জিজ্ঞেস করব?”
চিরশ্রী হাসল, “প্রাইভেট বলে থাকল
কিছু আর?”
“তোমাদের এখনও কোনও ইস্যু হয়নি কেন?”
চিরশ্রীকে ঈষৎ দুঃখী দেখাল, “বাইরের সবাই ভাবে যে, আমার বা ওর হয়তো প্রবলেম আছে। ও যথেষ্ট সচ্ছলতা না এলে বাচ্চা নিতে রাজি নয়। নিজের জীবন খুব অভাবে কেটেছে। তাই ও বাচ্চাকে সমস্ত কিছু দিতে চায়। জানি না, কবে ও নিজেকে সেটলড ভাববে!”
এটুকু বলেই চিরশ্রী চুপ করে গেল। প্রমিতের বদলি হয়ে যেতে পারে। এরিয়া ম্যানেজারের প্রোমোশন পেয়ে চুঁচুড়া চলে যাবে। সে সরাসরি কিছু বলতে পারছে না। বার বার বোঝাচ্ছে, সারা ক্ষণ মনে মনে চাইছে যে এই ট্রান্সফারটা প্রমিত যেন না নেয়। সহধর্মিণী হিসেবে হাজ়ব্যান্ডের প্রোমোশন তার চাওয়া উচিত। এরিয়া ম্যানেজার হলে প্রমিত হয়তো তার সন্তানের পিতা হতে চাইবে। সে এ বার মা হতে পারবে। তার মাতৃসত্তা বোধহয় অপেক্ষায় ক্লান্ত হতে হতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে এখন আর সহধর্মিণী নেই, দ্বিচারিণী হয়ে গেছে। এই দোলাচল থেকে কী ভাবে সে মুক্তি পাবে জানে না। দূরে চলে গেলে মল্লারকে ভোলা সহজ হবে, মন উচাটন হবে না, দ্বন্দ্বে দীর্ণ হতে হবে না তাকে। কিন্তু নিষিদ্ধ টানের নেশা এমনই যে, হাজার যুক্তিতেও তাকে দমানো যায় না।
মল্লার জিজ্ঞেস করল, “চুপ হয়ে গেলে যে!”
চিরশ্রী বলল, “এমনিই।”
আসলে চিরশ্রী ভাবছিল যে, কী ভাবে সে সম্ভাব্য ট্রান্সফারের কথাটা বলবে! মল্লার হয় খুব রেগে যাবে, না হলে ভেঙে পড়বে। সত্যিটা বলে দিয়ে মল্লারের পুজোটা সে মাটি করে দিতে চাইছে না। বড় নরম ছেলে, আঘাতটা সহ্য করতে পারবে না। মল্লার মাত্র কিছু দিন তার জীবনে অন্য ভাবে এসেছে, এর মধ্যেই সে চলে যাবে ভাবতেই মন হু-হু করে উঠছে। সে নিরুপায়, কিছুই তার হাতে নেই। সময়ের হাতে ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিয়ে অসহায় ভাবে বসে আছে সে। সময়ই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু এবং বন্ধু।
“কাল তোমরা কখন বেরোচ্ছ?”
“ন’টা নাগাদ। দুপুর দেড়টায় ট্রেন। রাজধানী এক্সপ্রেস।”
“তা হলে তেরো দিন দেখা হবে না।”
চিরশ্রী ম্লান হেসে বলল, “এমনও তো হতে পারে যে, আর কখনও দেখা হল না।”
মল্লার মাথা ঝাঁকাল, “আজেবাজে কথা বোলো না। তোমাদের ট্যুর ভাল কাটুক। ভালয় ভালয় ফিরে এসো। আমি অপেক্ষায় থাকব। জীবনে এই প্রথম কারও জন্য মধুর অপেক্ষায় থাকব।”
চিরশ্রী বলল, “তোমার পুজো ভাল কাটুক।”
“প্রতিদিন ফোন করবে। ফোন করা সমস্যা হলে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ আছে। ভুলে যেয়ো না।”
“আচ্ছা। তুমি কিন্তু নিজে থেকে কোনও যোগাযোগ করবে না। মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলা মুশকিল আছে। তেমন মুহূর্ত না-ও
পেতে পারি।”
মল্লার হাসল, “তোমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এমন কিছু করব না।”
“জানি।”
দীর্ঘ এক আলিঙ্গন করল মল্লার। চিরশ্রীর গালে, ঠোঁটে চুমু খেল। ফিসফিস করে বলল, “এই প্রথম প্রমিতদাকে খুব হিংসে হচ্ছে। কী হল? চোখে
জল কেন?”
চিরশ্রী দ্রুত চোখ মুছে নিয়ে বলল, “ও তুমি বুঝবে না। এসো, ভাল থেকো এই তেরোটা দিন।”
মল্লারের চলে যাওয়া দেখল চিরশ্রী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা বন্ধ করল। জীবন পদ্মপাতায় জল, এই আছে, এই নেই। জীবনে কিছুই তো চিরকাল থাকে না। তার যেটুকু ক্ষমতা সেটুকু দিয়ে সে ভালবাসায় বঞ্চিত এক পুরুষকে ভরিয়ে দিতে চেয়েছে। ভেসে যাওয়ার আগে সে ভেবেও দেখেনি যে, এই সম্পর্কের আড়ালে বিচ্ছেদের সুর আছে। অনিবার্য সেই বিচ্ছেদ এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে তা সে ভাবতেও পারেনি। এই দুপুরবেলাতেও কোথাও যেন টুংটাং বিষাদ-পিয়ানো বেজে চলেছে। বুকটা হঠাৎই কেমন ফাঁকা লাগছে। কাউকে আঘাত দিতে চায়নি সে, কাউকে কখনও দুঃখ দেওয়ার কথা ভাবতেই পারেনি। তবু চেতন-অচেতনের মাঝে আচ্ছন্ন অবস্থায় সে ভুল করে ফেলেছে। এক পরিণতিহীন নিষিদ্ধ সম্পর্কে নিজেকে জুড়ে ফেলার আগে গভীর ভাবে ভাবার দরকার ছিল। এতটা দুঃসাহসী হওয়া তার ঠিক হয়নি। মল্লার হয়তো এক দিন আঙুল তুলে ঘৃণাভরে তাকে দোষী সাব্যস্ত করবে। মল্লার বা প্রমিত, কারও ভালবাসার মর্যাদা সে কি রাখতে পারবে?
চিরশ্রীর চোখ ঝাপসা হয়ে এল। বড় বিষণ্ণ হয়ে পড়ল অবেলার আলো।
ষষ্ঠীর রাতে মল্লারের বার বার মনে হতে লাগল, চিরশ্রী এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে দিল্লি চলে যাচ্ছে। সে আর ফিরে আসবে না। চিরশ্রীকে ছাড়া যে সে বাঁচবে না। বিড়বিড় করে সে বলল, “আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে যাচ্ছ চিরশ্রী? নেমে পড়ো কোনও স্টেশনে, ফিরে এসো। চিরশ্রী, তোমাকে ছাড়া একটি দিনও যে বাঁচতে ইচ্ছে করে না। তোমাকে তো আমি বুকের মধ্যে ধরে রেখেছি, তোমাকে হারাতে
চাই না।”
এক ব্যাখ্যাহীন রোমাঞ্চে আচ্ছন্ন হল মল্লার, ঘুম এসে দাঁড়াল পাশে, মল্লারের ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসি। বোজা চোখের অন্ধকার আলো করে চিরশ্রী এসে দাঁড়াল সামনে, গোলাপি হাউসকোট পরে, দু’চোখে ভালবাসার আশ্রয় নিয়ে। প্রাণভরে দেখতে লাগল মল্লার, মোমবাতির মতো গলে গেল, মিশে গেল চিরশ্রীর শরীরে।
সুমির পরামর্শ মেনে কয়েকটি শেয়ারে টাকা খাটিয়ে দ্রুত বেচে দিয়ে লাভের মুখ দেখেছে অভ্র। ব্যাপারটা শুরুতে হেঁয়ালি মনে হলেও হাল-হকিকত অনেকটাই ধরতে পেরেছে সে। মাত্র দশ দিন শেয়ার বাজারে কেনারাম-বেচারাম হিসেবে নেমে কামাই খারাপ হচ্ছে না। কী যেন এক নেশা আছে এই ফাটকা খেলায়, প্রতি মুহূর্তে জয়-পরাজয়ের উত্তেজনা অনুভব হচ্ছে, দিনের শেষে সামান্য লাভ হলেও মেজাজ ফুরফুরে থাকছে। টাকার জন্য জীবন না হলেও ভাল থাকার জন্য টাকা লাগে। যে দিন থেকে এই ট্রেডিং-এ নেমেছে, হাব্বাডাব্বা খেলার জন্য সামান্য ছটফটানিও তার মধ্যে নেই।
আজ চোদ্দোই নভেম্বর। এই তারিখটা সে কখনও ভোলে না। রুমকিকে একটি বার ফোন করতে মন চাইছে। সে ডায়াল করে।
“হ্যালো।”
“সমস্যা আছে?”
“বুঝলাম না।”
“ধারেকাছে কেউ আছে? আমার ফোন ধরা বা কথা বলায় সমস্যা হতেই পারে তোর?”
“নীল নেই। থাকলেও অসুবিধে হত না।”
“কেন?”
“আগেই বলেছি তোকে। ও সন্দেহবাতিক নয়। তবে আমার শাশুড়ি আড়চোখে দেখছে। দেখুকগে, কেয়ার করি না। কালীপুজোর পরেই কলকাতায় চলে যাচ্ছি। আবার আমার জীবন স্বাভাবিক ছন্দে শুরু হবে।”
ক্রমশ