ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ২৩

পরিক্রমণ

এত দিন চুমকির সঙ্গে অভিরূপের বিবাহিক জীবন। চুমকি তো সারা দিন ক্লাব পার্টি বন্ধুবান্ধব নিয়ে মেতে থাকে। কই কখনও, কোনও দিনও তো এমন খারাপ লাগেনি। খারাপ লাগা তো দূর, কিছু মনেই হয়নি।

Advertisement

রাজশ্রী বসু অধিকারী

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৯ ০০:৪২
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র

পূর্বানুবৃত্তি: ডাক্তার অরুণের সঙ্গে দেখা করতে আসে ডাক্তার অভিরূপ। অরুণ খুশি হয় অভিরূপকে দেখে। অভিরূপ তার বিপদের কথা বলে বন্ধুকে। মানসম্মান বাঁচাতে সে যে দ্বারস্থ হয়েছে, অরুণকে তাও জানায়। অরুণ তাকে চিন্তা করতে বারণ করে। এতে মনোবল পায় অভিরূপ। কিন্তু কথায় কথায় সে বুঝতে পারে, তিয়াষার কাছ থেকে সব কিছু আগাম জেনে নিয়েছে অরুণ। যা সেও জানে না। অরুণ-তিয়াষার মধ্যে যোগাযোগের কথা তিয়াষা অভিরূপের কাছে গোপন করেছে। অভিরূপের অভিমানী মন প্রকট হয়।

Advertisement

এত দিন চুমকির সঙ্গে অভিরূপের বিবাহিক জীবন। চুমকি তো সারা দিন ক্লাব পার্টি বন্ধুবান্ধব নিয়ে মেতে থাকে। কই কখনও, কোনও দিনও তো এমন খারাপ লাগেনি। খারাপ লাগা তো দূর, কিছু মনেই হয়নি। বরং চুমকি যত দূরে থাকে ততই স্বস্তি বোধ করেছে ও। তা হলে ওর মধ্যে কোথা থেকে এল এই পজেসিভনেস? তিয়াষা কে ওর? মাত্র কিছু দিনের তো আলাপ। শুধুমাত্র সমব্যথীর বাড়ানো হাতের ছোঁয়া নিয়ে কিছুটা সময় পার করা। এরই মধ্যে কোথা থেকে এল এত অধিকারবোধ? অভিরূপ সারা জীবন পেশার প্রয়োজনে কত মহিলার সংস্পর্শে এসেছে, কত ডাক্তার... নার্স... পেশেন্ট। কই কারও প্রতি এমন অনুভূতি তো হয়নি। তিয়াষা তবে কি মায়া দিয়ে পাল্টে দিল এত দিনের চেনা সত্তাটাকে? নিজের উপর অসম্ভব রাগ হতে থাকে। একটা অচেনা ছটফটানির ঘোরে অভিরূপ এলোমেলো স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে চলে কোনও এক ঠিকানাহীন গন্তব্যের দিকে। অনেক ক্ষণ পরে নিজেকে আবিষ্কার করে সে তিয়াষাদের অফিস লাইফ ডেলি-র বিশাল বিল্ডিংয়ের উল্টো ফুটে।

Advertisement

১৪

দু’হাতে টেনে টেনে কাবার্ড থেকে জামাকাপড় নামাচ্ছিল তিয়াষা। খাটের উপর হাঁ করে ফেলে রাখা ঢাউস সুটকেসে দলামোচা পাকিয়ে চেপে চেপে ঢোকাচ্ছিল টপ কুর্তি জিনস স্কার্ট স্কার্ফের পাহাড়। খাটের পাশের রিডিং টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে আছে অজস্র ফাইল ল্যাপটপ চার্জার সিডি ডায়েরি আর নোটবুক। এর মধ্যে থেকে খাবলে খাবলে কিছু কিছু তুলে মাঝারি একখানা ব্যাগে ঢুকিয়ে আর চেন লাগাতে পারে না। এলোমেলো ভাবে রাখার জন্য ওটাকে আর বন্ধ করা যাচ্ছে না। ব্যাগ সুটকেস সব যেমনকে তেমন রেখে দিয়ে অস্থির হাতে ড্রয়ার থেকে টেনে টেনে বার করে গাদা গাদা প্রসাধন। গুঁজে দেয় দেওয়ালে ঝুলতে থাকা হ্যান্ডব্যাগে।

পিয়াস ঘরের দরজার পাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল চুপ করে। এ বার এসে খাটের এক কোণে বসে।

“এ রকম কোরো না তুমি। প্লিজ় এ ভাবে চলে যেও না। আমি... আমি স্যরি...ভেরি স্যরি। বলছি তো... আর কখনও হবে না। কোনও দিন হবে না। প্লিজ়... প্লিজ়... প্লিজ়... তুমি যেয়ো না...’’ ভাঙা ভাঙা গলায় বলে যায় সে। সেই থেকে অন্তত আধ ঘণ্টা ধরে এই একই কথা বলে চলেছে পিয়াস। তিয়াষাকে দেখে মনে হয় না ওর কানে একটাও কথা ঢুকছে। যেন এই ঘরে ও একা। যেন ওই সামনে বসে থাকা ভগ্নপ্রায় চেহারার ছেলেটার কোনও অস্তিত্ব নেই ওর কাছে। ওর রক্তলাল চোখ, উস্কো চুলে ভরা মাথা আর ব্যাকুল কান্নাজমাট কথাগুলোর কোনও মূল্যই নেই ওই পাথরপ্রতিমা হয়ে যাওয়া মেয়েটার কাছে। পিয়াস আর বোধহয় সহ্য করতে পারে না। উঠে এসে তিয়াষার কাঁধ জড়িয়ে হাত ধরার চেষ্টা করে, “আমি আর কত বার ক্ষমা চাইলে হবে বলো? প্লিজ় এ ভাবে চলে যেয়ো না, বাঁচব না আমি তোমাকে ছাড়া। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আর হবে না...’’

কথা শেষ হয় না। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে তিয়াষা, “একদম টাচ করবি না আমাকে। আই হেট ইউ।’’

এত ক্ষণের নরম লুটিয়ে থাকা ক্রন্দনোন্মুখ ছেলেটার মধ্যে থেকে মুহূর্তে জেগে ওঠে আগ্নেয়গিরির দহন। তিয়াষার আধহাতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে শক্ত হয়ে ওঠা চোয়ালে কেটে কেটে উচ্চারণ করে কয়েকটা শব্দ।

“তোমার ভালবাসা কে পাবে? ওই ডাক্তার মুখার্জি? কী দিতে পারবে সে তোমাকে? ডিভোর্স দেবে তো বৌকে? এমন হবে না তো যে দরকার মিটে গেলে সে তোমায় ছুড়ে ফেলে দিল?’’

তিয়াষা হাতের জিনিসপত্রগুলো মেঝেয় ফেলে পিয়াসের মুখোমুখি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায়।

“লুক, এটা তোর লুক আউট নয়, রাইট? ডোন্ট ক্রস ইয়োর লিমিট...’’

পিয়াস আচমকা জড়িয়ে ধরে তিয়াষাকে। টেনে নিয়ে আসে খাটের দিকে। লোহার মতো কব্জি দিয়ে চেপে ধরে দুই কাঁধ। নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে চায়। সেই উন্মত্ত তীব্র দৃষ্টি ক্রমশ ভরে আসে জলে। টপটপ করে ঝরে পড়ে হার মানা মুক্তোদল। তিয়াষা প্রবল ধাক্কায় পিয়াসকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মুহূর্ত দুই ওর দিকে তাকিয়ে হালছাড়া ভঙ্গিতে বসে পড়ে খাটের কিনারায়। পিয়াস মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে তিয়াষার কোমর জড়িয়ে। ছোট একটা স্কুলের ছেলের মতো কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। কিছু শব্দ শুধু বিকৃত আওয়াজে বেরিয়ে আসে ওর গলা দিয়ে। দেওয়ালে ঝোলানো দিঘার সমুদ্রতীরের ঝিনুকের মালাটা বুঝি কাঁপতে থাকে ওর নিঃশ্বাসের হাওয়ায় হাওয়ায়। সে দিকে আনমনা তাকিয়ে থাকে তিয়াষা। একটু আগের সেই প্রচণ্ড রাগটা আর মনের ভিতর খুঁজে পাচ্ছে না ও। এমন নয় যে পিয়াসের সমস্ত আচরণ ক্ষমা করে দিয়েছে বা মেনে নিয়েছে সে। কিন্তু প্রবল একমুখী ভালবাসার একটা ভয়ংকর শক্তি আছে বোধহয়, যা সম্পূর্ণ ভিন্নপথগামী জলস্রোতকেও চৌম্বক টানে নিয়ে আসে ঊষর মরুপ্রান্তরে। মন পাল্টে গিয়ে কেমন মায়া হতে থাকে তিয়াষার। আলগোছে পিয়াসের অগোছালো চুলের গোছায় হাত বুলিয়ে দেয়।

“এ রকম ছেলেমানুষি কেন করছিস বল তো? এত বড় ছেলে কখনও কাঁদে বুঝি? ওঠ...ওঠ এ বারে... পায়ে লাগছে আমার...ওঠ বলছি।’’

“না... আগে বলো আমাকে ছেড়ে যাবে না তুমি। কোনও দিন যাবে না। আমার সঙ্গে থাকবে। আমার হয়ে থাকবে। না বলা অবধি আমি তোমাকে ছাড়ব না। আগে বলো...’’

“সেটা বলা কি সম্ভব পিয়াস?’’ ছেলেভোলানো হাসি হাসে তিয়াষা। ওর কোমর এখনও এক ভাবে জড়িয়েই রেখেছে ছেলেটা। আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল। আলতো হাতে ওকে ঠেলে তোলার চেষ্টা করে, কিন্তু একটুও কাজ হয় না। শুধু কোলের ভিতর থেকে চোখ দুটো তুলে তাকায় পিয়াস।

“বলা সম্ভব নয়, না? কেন সম্ভব নয় বলো তো? এটাই তো সবচেয়ে সহজ সুন্দর একটা কথা হতে পারত আমাদের মধ্যে, অথচ তুমি তা হতে দিচ্ছ না। কেন? কেন বলো তিয়াষা?’’

“আহ! দিদি বল...’’ অস্ফুটে বলে তিয়াষা। কিন্তু সে বলার মধ্যে জোর নেই তেমন। ওর মন জানে ওকে সারা জীবনে কখনও দিদি বানাতে পারবে না পিয়াস।

“দিদি মাই ফুট। প্রতি বার ভাইফোঁটার দিন আমি পালিয়ে বেড়িয়েছি, তুমি কোনও দিন বোঝনি। আমি যে এক চান্সে বিসিএস পাশ করতে পেরেছি তা কার জন্য জানো? কোথা থেকে সেই মোটিভেশন পেয়েছি আমি? বুঝতে পারো কি?’’

“পারি বইকি।’’ দুর্বল প্রতিরোধ তিয়াষার। ‘‘আঙ্কল, আন্টির তোকে নিয়ে অনেক আশা। সেটাও জানি। তুইও জানিস। তাই পেরেছিস।’’

“না... একদম না!’’ লাফিয়ে উঠেছে পিয়াস, ‘‘তুমি... তুমি... তুমি... শুধু তোমার কাছে থাকব বলে, তোমার যোগ্য হব বলে, দিনরাত পরিশ্রম করেছি আমি। রাতের পরে রাত জেগেছি। তুমি তো জানো সব। বলো, জানো না?’’

ক্লান্ত লাগে তিয়াষার। কান্তি এক কথা পুনরাবৃত্তির। এই কথাগুলোর কোনও সমাধান নেই। আর এই কথা ভেবে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে তিয়াষা। পিয়াস পাগলের মতো আঁকড়ে ধরতে চাইছে ওকে। আগুপিছু কিছু ভাবার মতো অবস্থায় নেই ছেলেটা। কিন্তু ভাল কি জোর করে বাসা যায়? যায় না যে, এই বোধটাও আর কাজ করছে না পিয়াসের। জনস্রোতে মিশে থাকে কত অজস্র মুখ, প্রতিদিন কত শত মানুষকে দেখতে হয়, কথা বলতে হয়। কিন্তু হঠাৎ করে কোনও এক জন বুঝি চোখের পাতায় ছুঁয়ে দেয় ফিনিক্স পাখির পালক, যার দিকে এক বার মাত্র তাকালেই মনে হয় এখনই ঢাকা চাপা দিয়ে রেখে দেওয়া মনটা ভেঙে ছিটকে ছড়িয়ে পড়বে চারধারে। আমার একান্ত আমিটাকে প্রখর সূর্যালোকের তলায় নিয়ে এসে, যার গলার আওয়াজ এক বার শোনার জন্য তৃষিত হয়ে ওঠে কান মন শরীর, মনে হয় এই কণ্ঠটুকু বুক ভরে নেব বলেই যেন এখনও পথ চলা, মুহূর্তে তুচ্ছ করতে ইচ্ছে করে এ যাবৎ জেনে আসা মেনে আসা জীবনের যত ট্রাফিক আইন, ঘুমোনোর আগে যে মানুষের মেঘডাকা আওয়াজের একটামাত্র আশ্বাস বুকের ভিতর শতবার রিওয়াইন্ড হতেই থাকে, হতেই থাকে, সেই সব অসম্ভব সুন্দর পাগল করা অনূভূতি কখনও কোনও দিন পিয়াসের দিকে তাকিয়ে পাবে না তিয়াষা। এই ভালবাসা শুধু দুকূল ভাসিয়ে কখনও কোনও এক দিন হঠাৎ আসে, তার পর হয়তো বা হঠাৎ চলেও যায়। কিন্তু বানভাসি হওয়ার মুহূর্তে নদী আর কবেই বা মনে রেখেছে খরা কবলিত প্রখর দিনরাত্রির কথা! তিয়াষা কী করে বোঝাবে যে পিয়াসকে দেখে, ছুঁয়ে কিছুতেই সুরে বেজে ওঠে না ওর মন প্রাণ শরীর। হ্যাঁ ওকে ছোট ভাইয়ের মতো, খুব বেশি হলে বন্ধুর মতো হাত ধরে হেঁটে যাওয়া যায় কিছু পথ। কিন্তু ওর বুকে মুখ রেখে পৃথিবী ভুলে থাকা যায় না। অথচ মায়া হয় ওকে দেখে। ভারী মায়া হচ্ছে এই অবুঝ ছেলেটার উপর। সন্ধ্যাবেলায় পিয়াস যে অসভ্যতাটা করেছিল তার জন্য যে দারুণ রাগ হয়েছিল তিয়াষার। কিন্তু সেই রাগের পারদ এখন নেমে গিয়েছে। প্রতি বারই তো তা-ই হয়। তিয়াষার আর জিনিসপত্র প্যাক করা হল না। সে আবার ব্যাগ খুলে এক-এক করে বার করতে শুরু করল জামা, প্রসাধনী।

বেশ কিছু ক্ষণ চুপ করে থাকে তিয়াষা। তার পর দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে কথা বলে।

“দেখ পিয়াস, একটা কথা খোলাখুলি হয়ে যাওয়া দরকার। এটা তোর বাড়ি, এখানে তোর কথাই ফাইনাল।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement