অতীত: ওল্ড কোর্ট হাউস। এরই এক অংশে ছিল মেয়র’স কোর্ট।
বৃদ্ধ চামার রুইদাস আর তার যুবতী স্ত্রীর মধ্যে নিত্য খিটিমিটি। এক দিন চূড়ান্ত অশান্তি হওয়ায় পদী বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। স্বামী নিজের ভুল বুঝতে পেরে বৌকে খুঁজতে থাকে, ঘুরতে ঘুরতে এক দিন চন্দননগরের ফরাসি সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর অতিথিশালায় হাজির দুটো ভাতের আশায়। পদী তখন পরিচয় গোপন করে ইন্দ্রনারায়ণের অতিথিশালায় কাজ নিয়েছে। ব্রাহ্মণ-সহ নানা জাতের লোক তাঁর ছোঁয়া খেয়ে যাচ্ছে। রুইদাস তার বৌকে অতিথিশালায় আবিষ্কার করতেই পদীর আসল পরিচয় জানাজানি হয়ে গেল। সমাজে ঝড় উঠল।
চন্দননগরের হালদারবাবুরা ছিলেন বনেদি বড়লোক ও সমাজপতি। ইন্দ্রনারায়ণের ক্রমবর্ধমান আর্থিক উন্নতি ও সামাজিক প্রতিপত্তিতে তাঁরা ছিলেন ঈর্ষান্বিত। পদী চামারনির ঘটনায় তাঁরা অযাচিত সুযোগ পেয়ে গেলেন ইন্দ্রনারায়ণকে অপদস্থ ও বিব্রত করার। পুরো সমাজকে ইন্দ্রনারায়ণের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিলেন তাঁরা। এ দিকে ইন্দ্রনারায়ণের মনের ইচ্ছে ছিল হালদারবাবুদের সরিয়ে গোষ্ঠীপতি হওয়া। সেই ইচ্ছের গুড়ে বালি পড়ল, সঙ্গে সামাজিক বহিষ্কার। পাপক্ষালনের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করলেন চৌধুরীবাবু। তবু হালদাররা তাঁকে সমাজে নিলেন না।
কহানি মে টুইস্ট। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের খাজনা বাকি নবাবের ঘরে। জারি হল তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা। টাকার জন্য কৃষ্ণচন্দ্র হাত পাতলেন ফরাসডাঙার দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণের কাছে। বিপদের সময় টাকা দিয়ে মান রক্ষার প্রতিদানে ইন্দ্রনারায়ণের এই সামাজিক পীড়া দূর করতে এগিয়ে এলেন কৃষ্ণচন্দ্র। বুদ্ধি দিলেন, চন্দননগরের সমাজের এই অবরোধ ভাঙতে পারে একমাত্র সামাজিক বিধান। আর নবদ্বীপের স্মার্ত পণ্ডিতদের গোষ্ঠীপতি হিসাবে সেই বিধান দিতে পারেন একমাত্র মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। কী বিধান? ইন্দ্রনারায়ণের চার কন্যাকে কুলীনদের শ্রেষ্ঠ চারটি ‘মেলের’ চার ঘরে পাত্রস্থ করতে হবে। চার কুলীন ঘরে কুটুম্বিতা হলে সামাজিক বহিষ্কার এমনিই উঠে যাবে। কথা মতোই কাজ হলো, সামাজিক অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে এলেন ইন্দ্রনারায়ণ। কাজ হয়ে যাওয়ার পর নবদ্বীপ-অধিপতি দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণের কাছে ‘তৈলবট’ চাইলেন। তৈলবট, অর্থাৎ স্মার্ত পণ্ডিতরা সামাজিকতা সংক্রান্ত বিধান দেওয়ার জন্য যে অর্থ নিতেন। কৃষ্ণচন্দ্রকে দেওয়া সেই তৈলবটও ছিল অভিনব। প্রতিভাবান কবির অভাবে কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর নবরত্নসভা সাজাতে পারছিলেন না। ইন্দ্রনারায়ণের আশ্রয়ে থাকা এক নবীন প্রতিভার মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্র খুঁজে পেলেন সেই রত্ন। তৈলবট হিসাবে চেয়ে নিলেন কবিকে। নিয়ে গেলেন নিজের রাজধানী। এই কবিই পরে লিখলেন ‘অন্নদামঙ্গল’, উপাধি পেলেন রায়গুণাকর। কবি ভারতচন্দ্রের আসন পাকা হল সাহিত্যের ইতিহাসে।
জাতিমালা কাছারি আজ নেই, কিন্তু রয়ে গিয়েছে ‘ওল্ড মেয়র’স কোর্ট’ ঠিকানার রাস্তা
কলকাতা তথা বাংলার সামাজিক ইতিহাসচর্চায় যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় এক উল্লেখযোগ্য নাম। তাঁর ‘স্মৃতিতে সেকাল’ ছাড়াও সাময়িকপত্রের বহু লেখা পুরনো সমাজের ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে। যোগেন্দ্রকুমার ১৮৮৮ সালে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘তৈলবট’ নামে একটি লেখা প্রকাশ করেন। শুরুর আখ্যানটি পাওয়া যায় সেখানেই।
এই যে স্মৃতিশাস্ত্রের পণ্ডিত ও নবদ্বীপের শাসনব্যবস্থার কথা বলা হল, এক সময় হিন্দু বাঙালির সামাজিক জীবনের সুতো বাঁধা থাকত এঁদের হাতে। স্মার্ত রঘুনন্দনের নাম এ ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখ্য। তাঁর প্রণয়ন করা অষ্টবিংশতিতত্ত্বের ব্যবস্থা অনুসারে পাঁচশো বছর ধরে হিন্দু বাঙালির সামাজিক ও ধর্মীয় আচার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যে সময়ের কথা বলছি, তার আগেই বাংলার সীমান্তে ইসলামের আবির্ভাব। এই সময়েই হিন্দুদের বিভিন্ন নিয়ম তৈরি করার একটা তাগিদ শুরু হয়। রঘুনন্দনের কাছাকাছি সময়ে কুলুকভট্ট নামে এক বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ কাশীতে মনুসংহিতার টীকা রচনা করেন। রঘুনন্দন ও কুলুকভট্ট আজও স্মার্ত বাঙালির অন্যতম পুরোধা। বাঙালির দুর্গাপুজো, তিথিতত্ত্ব সবই রঘুনন্দন অনুসারে।
যেহেতু দেশের রাজারা মুসলমান, স্থানীয় সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে খুব ওয়াকিবহাল নন, এই সব বিবাদে মুসলমান সর্দারদের সিদ্ধান্ত দেওয়া থেকে অব্যাহতির জন্য আলাদা ‘জাতিমালা কাছারি’ স্থাপন করা হয়। কুলগ্রন্থে লেখা আছে, দত্তখাস নামে এক মন্ত্রী এই জাতিমালা কাছারির বিচারক ছিলেন। তাঁর বিচারসভাতেই রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের ৫৭তম সমীকরণ হয়েছিল।
বাংলার বর্ণভেদের ইতিহাস জটিল। জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে নানা কারণে। মূল চতুর্বর্ণ কাঠামোর বাইরেও বাঙালি হিন্দুর অসংখ্য জাতি ছিল, ছিলেন আরও অনেক সংকর জাতি। সকলকেই কাঠামোর মধ্যে বাঁধার চেষ্টা ছিল শাস্ত্রকারদের। কখনও কোনও নির্দিষ্ট পেশার এক দল মানুষ নিজেদের আগের বর্ণ থেকে আলাদা পরিচয়ে পরিচিত হয়েছেন। যেমন বৈদ্যরা। নীহাররঞ্জন রায় দেখিয়েছেন, চিকিৎসক হিসাবে আগে তাঁদের আলাদা পরিচয় ছিল না। ধীরে ধীরে তাঁরা আলাদা বর্ণ হিসাবে পরিচিত হন। কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক কারণে একই বর্ণের দুটি আলাদা গোষ্ঠীর মধ্যে এক দল নিচু ও অন্য দল উঁচু হিসাবে সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। এ ছাড়াও স্থানীয় স্তরে অভিজাত জমিদার শ্রেণি ও নব্য ব্যবসায়ী ধনিক শ্রেণির মধ্যে ক্ষমতার টানাপড়েনও প্রভাবিত করেছে বর্ণভেদের ইতিহাসকে (যেমন প্রথম গল্পে)। এই সব আর্থ-সামাজিক কারণগুলিকে ব্যাখ্যার প্রয়োজনে স্মৃতিকারদের হাতে ছিল মূলত বৃহদ্ধর্ম পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ও বিভিন্ন কুলগ্রন্থ। এই সব গ্রন্থে আদিশূর নামে এক আধা-কাল্পনিক রাজার গল্প পাওয়া যায় যিনি পাঁচ ব্রাহ্মণ ও কায়স্থকে কান্যকুব্জ থেকে বঙ্গদেশে নিয়ে আসেন, যারা বাংলার ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের পূর্বপুরুষ। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, এই তত্ত্ব ঐতিহাসিক ভাবে খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। শিলালিপি, তাম্রশাসন ইত্যাদি প্রমাণের সাহায্যে তিনি দেখিয়েছেন, সুদূর সিলেটেও ব্রাহ্মণদের রীতিমতো বসবাস ছিল সেই গুপ্ত যুগ থেকেই। তাঁর গবেষণায় এই তথ্যও উঠে এসেছে, আরও প্রাচীন যুগ থেকেই বাংলার আদি বাসিন্দা বিভিন্ন জনসমষ্টির মধ্যে মেলামেশা ও সামাজিক আদানপ্রদানের মধ্যে নানান বিধিনিষেধ ছিল। এমনকি যে কৌলীন্য প্রথার প্রসঙ্গে বল্লাল সেনের কথা বলা হয়, সেই প্রথাও সেন বংশের আমলে গড়ে উঠেছিল কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে নীহাররঞ্জনের গবেষণায়। কুলীন বংশের কৌলীন্যের ঐতিহাসিক ভিত্তিটিকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
নবদ্বীপের সংস্কৃতি কলকাতার সংস্কৃতিকে বহুলাংশে প্রভাবিত পড়েছে। খাওয়াদাওয়া, গানবাজনা নিয়ে অনেক উদাহরণ আছে। তাই সেই ধারায় জাতবিচার-কেন্দ্রিক বিবাদও অচিরেই কলকাতায় জাঁকিয়ে বসল। জাতপাত নিয়ে বিবাদ নিরসনের জন্য কাছারি বা আদালত স্থাপনের দৃষ্টান্ত দেখা গেল ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে। এই ব্যবস্থার প্রসাদে আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন শাসকদের কাছের লোকেরা। মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবকে বিচারপতি করে ১৭৭৬ সালে জাতিমালা কাছারি স্থাপিত হয় মহারাজার প্রাসাদের পিছনেই। হেস্টিংসের প্রশাসনে নবকৃষ্ণ যে ক’টি দফতরের দায়িত্বে ছিলেন, তার মধ্যে পুরোদস্তুর আদালত ছিল ২৪ পরগনার মাল আদালত বা রাজস্ব কোর্ট, ২৪ পরগনার তহসিল দপ্তর বা কালেক্টরের কাছারি আর এই জাতিমালা কাছারি।
কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জাত নিয়ে বিবাদ উপস্থিত হলে তার মীমাংসা হত জাতিমালা কাছারিতেই। মেয়র’স কোর্ট-এ যেমন এক জন প্রেসিডেন্ট (মেয়র) ও ন’জন অল্ডারম্যান থাকত, তেমন এই জাতিমালা কাছারিতে থাকতেন এক জন বিচারক ও কয়েক জন সাহায্যকারী বা ‘অ্যাসেসর’। ব্রাহ্মণদের উপরে প্রায় সব জাতের লোকেদেরই রাগ থাকায় রাজা নবকৃষ্ণ দেব প্রায় সারা জীবন এই আদালতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মাঝে কাশিমবাজারের কৃষ্ণকান্ত নন্দীও বারদুয়েক কাছারির বিচারক হয়েছিলেন। সেই সময় তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে ও নবদ্বীপের পণ্ডিতদের হাত করে তাঁর স্বজাতি তেল ব্যবসায়ীদের উচ্চতর সামাজিক স্থান পাইয়ে দেন, এমনও বলা হয়।
নবকৃষ্ণের প্রাসাদের পিছন দিকের রাস্তাটির নাম কম্বুলিটোলা লেন। সেই রাস্তার উপরেই ছিল এই কাছারি। তার একটি অংশ আজও ‘ওল্ড মেয়র্স কোর্ট’ নামে পরিচিত। বাগবাজার টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আজ যে রাস্তায়, সেই রাস্তাটা কলকাতার এক প্রাচীন প্রথা এবং তা থেকে সৃষ্ট বাঙালি সমাজের নানা অবক্ষয়ের ইতিহাসের সাক্ষী। ইতিহাস চর্চা মানে শুধু অতীতের গৌরবগাথার রোমন্থন নয়, তার ভুলগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পাঠও। এই শিক্ষা গ্রহণে অগৌরবের কিছু নেই।