অন্যরকমের দুর্গা পুজো
আট কলস জলে স্নান, সঙ্গে আটটি রাগের আলাপ। প্রতিটি রাগের আলাদা বাদ্যও নির্ধারিত। এমনটাই ছিল দুর্গোৎসবের প্রাচীন বিধান। বর্তমানে এ প্রথা লুপ্ত। বিকল্প শুধুই ঘণ্টাধ্বনি।
সপ্তশতী ‘চণ্ডী’-তে শুধু শরতে দুর্গাপুজোর উল্লেখ থাকলেও ‘দেবীভাগবত’-এ শরৎ ও বসন্ত দুই ঋতুতেই দেবীর পুজোর বিধি আছে। এতে স্বয়ং দেবী বলেছেন— ‘এই দুই ঋতু যেন যমদংষ্ট্রা। এ সময়ে নানা অসুখে মানুষের মৃত্যু হয়। তাই চৈত্র ও আশ্বিন মাসে মানুষ মহামারির হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রীতির সঙ্গে আমার ব্রত পালন করবে।’ চণ্ডী-র দ্বাদশ অধ্যায়ে মেধাঋষি স্পষ্ট বলেছেন, মহামারিরূপেও দেবী প্রকটিত হন।
দেব-দেবীর পুজোর জন্যও স্মৃতিকার পণ্ডিতরা সযত্নে পূজাবিধি তৈরি করে গেছেন। গৌড়বঙ্গের দুর্গাপুজো-বিষয়ক স্মৃতি-নিবন্ধকারদের মধ্যে জিকন ও বালক সম্ভবত প্রাচীনতম। বাংলায় সেন-রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর, খ্রিস্টীয় দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত স্মৃতি-নিবন্ধকারদের রমরমা। বোঝা যায়, সেন বংশের দ্বিতীয় পুরুষ হেমন্ত সেনের আগে থেকেই বাংলায় শরৎকালীন এবং বসন্তকালীন দুর্গাপুজোর প্রচলন ছিল। কারণ, পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকের স্মৃতি নিবন্ধকার আচার্য শূলপাণি তাঁর ‘দুর্গোৎসব-বিবেক’-এ জিকন ও বালকের স্মৃতিবচন উল্লেখ করেছেন। ষোড়শ শতকে নবদ্বীপের নৈয়ায়িক ভট্ট রঘুনন্দনের স্মৃতিনিবন্ধের প্রসার হলে শূলপাণির নিবন্ধ পঠন-পাঠনের চল বন্ধ হয়ে যায়। বেলুড় মঠে দুর্গোৎসব করার আগে বিলেত-ফেরত বিবেকানন্দও ভট্ট রঘুনন্দনের ‘অষ্টাবিংশতি তত্ত্ব’-এ ‘দুর্গোৎসব বিধি’ পড়েছিলেন। স্বামীজির শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী এ কথা ‘স্বামি-শিষ্য সংবাদ’-এ লিখেছেন। সময়টা ছিল ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের মে-জুন মাস। স্বামীজি শরৎচন্দ্রকে বলেছিলেন, “ওরে, একখানা রঘুনন্দনের ‘অষ্টাবিংশতি তত্ত্ব’ শিগগির আমার জন্য নিয়ে আসবি।... এবার মঠে দুর্গোৎসব করাবার ইচ্ছে হচ্ছে। যদি খরচায় সঙ্কুলান হয় তো মহামায়ার পুজো করব। তাই দুর্গোৎসব-বিধি পড়বার ইচ্ছে হয়েছে। তুই আগামী রবিবার যখন আসবি, তখন ঐ পুঁথিখানি সংগ্রহ করে নিয়ে আসবি।”
শূলপাণি তাঁর ‘দুর্গোৎসব-বিবেক’-এ বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে, অষ্টমী ও নবমীর পুণ্যতিথিতে গীতবাদ্য-সহ মহামায়া দুর্গার মহাস্নান ক্রিয়া করতে হয়— কুর্য্যাৎ তত্র মহাস্নানং গীতবাদ্য পুরঃসরম্। দুর্গাপুজোয় স্নান বিশেষ অনুষঙ্গ। গীতবাদ্য-সহ দেবীকে স্নান করানোর বিধি আছে বলেই দুর্গাপুজোকে মহাপূজা বলা হয়। রঘুনন্দন তাঁর অষ্টাবিংশতি তত্ত্বের ‘দুর্গোৎসব’ স্মৃতিনিবন্ধে জানিয়েছেন যে, স্নান, পুজো, বলিদান ও হোম— এই চার প্রকার ক্রিয়া থাকায় শারদীয়া মহাপূজা শুভকরী।
দেখা যায়, রাজা-মহারাজার স্নানপর্বে গীতবাদ্য বা মঙ্গলবাদ্যের প্রচলন বেশ প্রাচীন। রামায়ণে আছে, অযোধ্যায় রামচন্দ্রের অভিষেক অনুষ্ঠানে জাতিরাগ পরিবেশিত হচ্ছিল। সঙ্গতে ছিল বীণা ও মৃদঙ্গ। সঙ্গীতময় পরিবেশে কলসবারি ঢেলে রামচন্দ্রের অভিষেক সম্পন্ন হয়েছিল। এ তো গেল ত্রেতাযুগের কথা। খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে রচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ স্নানপর্বে বাদ্যভাণ্ডের উল্লেখ আছে। মহাপ্রভু দাক্ষিণাত্যে গোদাবরীর ঘাটে স্নান করে কৃষ্ণনাম করছেন। এমন সময় রামানন্দ রায় স্নান করতে এলেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন—“হেনকালে দোলায় চঢ়ি রামানন্দ রায়/ স্নান করিবারে আইলা বাজনা বাজায়।”
সে কালে দুর্গাপুজো ছিল রাজা-জমিদারদের পুজো। তাই দেবীর স্নানপর্বে শুধু বাজনা নয়, রীতিমতো নির্দিষ্ট রাগ-আলাপের সঙ্গে নির্দিষ্ট বাদ্যের নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন বিধিকার স্মার্ত পণ্ডিতরা। পঞ্চগব্য-পঞ্চামৃত দিয়ে প্রথমে দেবীর উদ্দেশে স্নানমন্ত্র উচ্চারণ। এর পর বেশ্যাদ্বার-মৃত্তিকা থেকে রাজদ্বার-মৃত্তিকা পর্যন্ত নানা রকমের মাটি দেবী দুর্গার উদ্দেশে মন্ত্রপাঠ-সহ বিলেপন রূপে প্রদান। মৃত্তিকা-স্নানের পর নির্দিষ্ট আটটি রাগ আলাপ ও নির্দিষ্ট আট রকমের বাদ্য সহ শুরু হয় দেবীর অষ্টকলস স্নানপর্ব। এই অষ্টকলস স্নানে রাগ-বাদ্যের মতো আট রকমের জলও নির্দিষ্ট। সঙ্গে আটটি মন্ত্র। এখন প্রশ্ন, স্মৃতিকাররা এই আট সংখ্যাটি কেন বাছলেন? উত্তর খুঁজলেই পাওয়া যায়। অষ্টম ঘট বা কলসের স্নানমন্ত্রে আছে—‘অষ্ট মঙ্গল সংযুক্তে দুর্গে দেবি নমোঽস্তুতে।’ মধ্যযুগে রচিত মঙ্গলকাব্যেও অষ্টমঙ্গলা প্রসঙ্গ আছে।
পরিতাপের কথা, দুর্গাপুজোয় অষ্টকলস স্নানে রাগ আলাপ-সহ বাদ্য প্রথা আজ অবলুপ্ত। দুর্গাপুজো পদ্ধতির পুঁথির পাতায় রাগবাদ্যের অস্তিত্বটুকু টিকে আছে। মন্ত্রগুলি শুধুমাত্র ঘণ্টাধ্বনি-সহ উচ্চারিত হয়। এর পিছনেও মনে হয় রঘুনন্দনের এক স্মৃতিবচন কাজ করেছে। ‘দুর্গোৎসব’ স্মৃতিনিবন্ধে ইনি মৎস্যপুরাণের বচন অনুসারে লিখেছেন যে, সম্ভব না হলে সর্ববাদ্যময়ী ঘণ্টাটুকু বাজালেও চলবে। যদিও সঙ্গীতসাধকরা রাগকে প্রাণহীন ভাবতে চাননি। অবয়ব কল্পনা করে প্রতিটি রাগের এক বা একাধিক ধ্যানমন্ত্র রচনা করেছেন। পণ্ডিত সোমনাথ তাঁর ‘রাগবিবোধ’ গ্রন্থে রাগকে নাদময় ও দেবময় ভেবেছেন। বলেছেন— ‘সুস্বরবর্ণবিশেষং’। স্বরবর্ণ হল শক্তি আর সুস্বরবর্ণ হল রাগের মধ্যে দেবত্ব বা চেতনার প্রকাশিত রূপ। চণ্ডীর চতুর্থ অধ্যায়ে তাই দেবতারা চণ্ডীর স্তবে বলেছেন, ‘হে দেবি, সমস্ত রম্য গীত পদে আপনারই প্রকাশ।’
দুর্গাপুজোয় আটটি রাগের ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যায়। মহাস্নানে নির্দিষ্ট সেই রাগবাদ্যের ক্রম তালিকা— মালব রাগে বিজয়বাদ্য, ললিত রাগে দেববাদ্য, বিভাস রাগে দুন্দুভিবাদ্য, ভৈরব রাগে ভীমবাদ্য, কেদার রাগে ইন্দ্রাভিষেক বাদ্য, বরাটী রাগে শঙ্খবাদ্য, বসন্ত রাগে পঞ্চশব্দ বাদ্য এবং শেষে ধানেশ্রী রাগে ভৈরববাদ্য। আজ পূজামণ্ডপে যেমন রাগবাদ্যের প্রচলন নেই, তেমনই দুর্গাপুজোর জন্য নির্দিষ্ট রাগগুলির কয়েকটি রাগসঙ্গীতের আসর থেকেও বিদায় নিয়েছে। লুপ্তপ্রায় সেই রাগগুলি হল মালব, বরাটী ও ধানেশ্রী। মালব রাগটি ভারতের প্রাচীন মালব জাতির অবদান। রাগ বরাটী সম্ভবত মহাভারতের বিরাট দেশজাত। বিভিন্ন সঙ্গীতশাস্ত্রে রাগটি বরারি, বৈরাটিকা ইত্যাদি নামেও পাওয়া যায়। শ্রী মানে লক্ষ্মী। রাগবিদ্যার চর্চাকারীরা জানেন সন্ধিকাল প্রকাশক রাগ শ্রী কল্যাণকর। ধানেশ্রী রাগ কি শ্রীবৃদ্ধিকারী ধান এবং শ্রীময়ী লক্ষ্মীর সমন্বয় বার্তা দেয়? তাই কি দেবী দুর্গার স্নানপর্বে শেষতম কলসে ধানেশ্রী রাগ গাওয়ার বিধান দিয়েছেন স্মৃতিকাররা? দুর্গাপুজোয় নবপত্রিকা বা কলাবৌ দেবীরূপে স্বীকৃত। নবপত্রিকার ন’রকমের পত্র বা পাতার মধ্যে একটি হল শেকড়-সহ ধানগাছ। দশমীর দিন বিসর্জন পর্বে নবপত্রিকারূপিণী দুর্গার বিসর্জন দেওয়া হয়। কিন্তু ধানগাছটি বিসর্জিত করা হয় না, ঘরে ফিরিয়ে আনাই প্রথা। তাই ধানেশ্রী রাগে যেন ধান্যরূপা ভগবতীকে চিন্তা করা হয়েছে। লক্ষণীয়, ধানেশ্রী রাগালাপের সঙ্গে ভৈরববাদ্য সংযুক্ত হয়েছে। ভৈরব শিবরূপের প্রকাশ। অন্যদিকে দুর্গাও লক্ষ্মীস্বরূপা। তাই দুর্গাপুজোর স্নানপর্বে ধানেশ্রী রাগে ভৈরববাদ্য যেন শিবশক্তির মিলনকে সূচিত করে।
দেশভেদে রাগের রূপভেদের ভিন্নতা এক কালে স্বীকৃত হত। বিভাস, ললিত, বসন্ত ইত্যাদি রাগে প্রাচীন বঙ্গের সঙ্গে পশ্চিমদেশে প্রচলিত রাগরূপে পার্থক্য ছিল। কিন্তু, আজ আর জানার উপায় নেই, দুর্গাপূজার মহাস্নান পর্বে নির্দিষ্ট রাগগুলির রাগরূপ কোন পথে চলত।